রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩১+৩২

0
268

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৩১
#নবনী_নীলা

মায়ের কোলে কিছুক্ষন মাথা রেখে নিজেকে শান্ত করলো স্নিগ্ধা। এই সবকিছু কি তার মাকে জানানো যায়? সে বুঝে উঠতে পারছে না। মাকে কাছে পেয়ে মনটাকে সে শান্ত করতে পেরেছে।

মনের মধ্যে তার একটা প্রশ্ন ছিল কিন্তু কখনই সেটা তার মাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। আজ সেই প্রশ্ন করার দিন এসেছে। স্নিগ্ধা মাথা তুললো নিজের মায়ের কোল থেকে। তারপর মায়ের দিকে তাকাতেই আয়েশা খাতুন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই স্নিগ্ধা বললো,” আচ্ছা মা! একটা প্রস্ন করি?”

আয়েশা খাতুন হাসলেন।তারপর হা সূচক মাথা নাড়তেই স্নিগ্ধা বলল,” তুমি কি আনোয়ার সাহেবকে আগে থেকে চিনো?”

হটাৎ এমন প্রশ্নে আয়েশা খাতুন অবাক হয়ে তাকালেন।কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললেন,” হটাৎ এই প্রশ্ন কেনো?”

” কেনো? প্রশ্নটা কি করা যায় না? তুমি ওনাকে আগে থেকে চিনো তাই না?”, স্নিগ্ধার কথায় আয়েশা খাতুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,” হুম্, চিনি। উনার বাবা আমাকে ওনার ছেলের বউ করতে চেয়েছিল কিন্তু আমি রাজি হই নি। আমার পছন্দ হয় নি আবরার আনোয়ারকে। লোকটাকে অত্যন্ত অহংকারী মনে হয় আমার।”

মায়ের মুখে এই কথা শুনে স্নিগ্ধার এখন ফাহাদের প্রতিটা কথা সত্যি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে প্রশ্ন জাগলো সে দেরী না করে বললো,” তাহলে তুমি আমাকে এই বাড়িতে বিয়ে দিয়েছো কেনো?”

” আবরার আনোয়ার লোকটা যেমনই হোক।ওনার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আদিলের মধ্যে সেসব গুন আছে আর লোকলজ্জা তো ছিলো বটেই। কিন্তু হটাৎ এমন প্রশ্ন কেনো? আদিলকে তোর পছন্দ না?”, চিন্তিত মুখে তাকালেন আয়েশা খাতুন।

স্নিগ্ধা শেষ প্রশ্নটা চুপ করে রইলো কিছু বললো না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,” এইসব বাদ দেও। স্পৃহা কেমন আছে?”

” ভালোই আছে। কিন্তু দিন দিন মেয়েটা আরো খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। কি যে করবো বুঝতে পারি না।” বলেই চিন্তিত হয়ে ভাবলেন তারপর বললেন,” ও ভালো কথা। এই জিম ছেলেটা কেমন বলতো?”

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,” জিম কেমন মানে? হটাৎ জিম কেমন এইটা জানতে চাচ্ছো কেনো?”

আয়েশা খাতুন ভঙ্গিমা না করে বললেন,” স্পৃহার ফোনে দেখলাম বার বার খালি একটা নাম্বার থেকে কল করছিলো।”

স্নিগ্ধা হা করে বললো,” স্পৃহাকে যে জিম কল করছিলো তুমি কি করে জানলে?”

” ওর ফোনটা আমার কাছেই ছিলো। দুইদিন কমপক্ষে তিরিশটা কল দিয়েছে। এই নাম্বারটা আবার কয়েকদিন আগে স্পৃহা আমাকে দিয়েছিল যে নাম্বারটা নাকি ওকে ডিস্টার্ব করছিলো।”, আয়েশা খাতুনের কোথায় স্নিগ্ধা অবাক হয়ে বললো,” জিম স্পৃহাকে ডিস্টার্ব করছিলো?”

” হ্যা, সে তো আমাকে এই নাম্বার দিয়ে বলেছে তাকে এই ছেলে ডিস্টার্ব করে। ভাবছি আজ যখন এসেছি সরাসরি জিজ্ঞেস করবো।” স্নিগ্ধা মাকে থামাতে বললো,” না না একদম না। তুমি কিছু করো না আমি কথা বলবো।”

আয়েশা খাতুন জিমকে আর কিছু বললেন না। শুধু যাওয়ার সময় ছেলেটার দিকে তাকালেন। আয়েশা খাতুনকে জিম বরাবরই বেশ ভয় পেয়ে এসেছে। হটাৎ তার এমন তীক্ষ্ণ চাওনিতে সে যেনো দম আটকে মরেই যাচ্ছিলো।

___________________

আদিল রুমে ঢুকতেই স্নিগ্ধা বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো।স্নিগ্ধাকে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে দেখেই আদিল এগিয়ে এলো। স্নিগ্ধার হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,” দাড়াও,কোথায় যাচ্ছো?”

স্নিগ্ধার আদিলের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,” অভ্রর রুমে যাচ্ছি। আমি সেখানেই থাকবো।”

আদিল নিশ্চুপে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,” কেনো আমার রুমে থাকা যায় না?”

” অবশ্যই,যদি আপনার প্রয়োজন হয় তাহলে তো আমি না চাইলেও আপনি আমাকে জোর করবেন। কি ঠিক বলিনি? বলুন, আবরার ফাইয়াজ আজ রাতে কি আপনার আমাকে প্রয়োজন?”, তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো স্নিগ্ধা।

আদিলের দৃষ্টি আরো কঠিন হলো। স্নিগ্ধার কথার ইঙ্গিত সে ঠিকই বুঝেছে। স্নিগ্ধা তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো কিন্তু আদিল স্নিগ্ধাকে শক্ত করে ধরে কোলে তুলে নিলো। হটাৎ আদিলের এমন কাণ্ডে স্নিগ্ধা হকচকিয়ে তাকালো। আদিলের চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। স্নিগ্ধা হাত পা ছুরে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতেই আদিলের বাঁধন আরো শক্ত হলো।

স্নিগ্ধাকে এনে বিছানায় বসাতেই স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। আমি কি এতটাই তুচ্ছ যে আপনার যখন যা ইচ্ছে তাই করবেন আমার সাথে। আমার জীবনটা তো নাটকীয়তায় ভরিয়ে দিয়েছেন। আমি চুপ থেকেছি তাই বলে আপনার যা ইচ্ছে আপনি তাই করবেন?”

স্নিগ্ধার কথা যেনো আদিলের কর্ণপাত হলো না সে স্থির দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে থেকে স্নিগ্ধার আরো কাছে এগিয়ে এলো। স্নিগ্ধার কঠিন দৃষ্টি আস্তে আসতে ভীত হয়ে গেলো।চোখ নামিয়ে সে পিছিয়ে যেতেই আদিল স্নিগ্ধার হাতের বাহু ধরে একদম টেনে নিজের সামনে নিয়ে এলো। স্নিগ্ধা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।

আদিল স্নিগ্ধার মুখ বরাবর এসে কঠিন গলায় বললো,” তুমি যদি তুচ্ছ হতে তাহলে তোমাকে খোজার জন্যে আমি এতোটা পাগলামি করতাম না। তোমার অনুপস্থিতে আমার কি অবস্থা হয়েছিলো সবটাই তোমার অজানা। হতে পারে তোমার আমার দেখা হয়েছে কোনো এক ভুল সকালে কিন্তু আমি যে সেদিন ঠিক মানুষটিকে বেছে নিয়েছি সেটা আমি জানি। নয়তো আবরার ফাইয়াজ কেনো এক দিনের পরিচয়ে একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে? সেটা তুমি কখনই বুঝতে পারবে না।কারণ এটা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।” বলেই আদিল স্নিগ্ধার হাত ছেড়ে দিলো তারপর সরে গেলো।

স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে বসে রইলো। প্রতিটি কথা যেনো তার কানে বাজছে। স্নিগ্ধা চুপচাপ আদিলের প্রতিটি কাজ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

আদিল স্নিগ্ধার পাশে শুয়ে পড়তেই বললো,” আর কতক্ষন এইভাবে বসে থাকবে? তুমি নিশ্চই চাও না যে আমি উঠে এসে তোমাকে শুইয়ে দেই। তখন তো আবার বলবে তোমার উপর জোড় খাটাচ্ছি। এই রূমের বাইরে তোমার যাওয়া হবে না তাই শুয়ে পরো।”

স্নিগ্ধা আড় চোখে একবার আদিলের তাকালো তারপর আদিলের দিকে পিঠ করে শুয়ে পড়লো। ঘরের বাতি নিভে গেলো। জ্বলে রইলো টেবিলের এক কোণে আধো আলোর একটি টেবিল ল্যাম্প। স্নিগ্ধা এক মনে সেইদিকেই তাকিয়ে রইলো। মনে এখনো তার ক্ষোভ। সবসময় লোকটা শুধু তার উপর হুকুমই করে গেলো।

আদিল ঘাড় ঘুরিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো। এতক্ষনে কি ঘুমিয়ে পড়েছে স্নিগ্ধা? আদিল চুপ থেকে হটাৎ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,” আমার জীবনে তোমার প্রয়োজন আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত থাকবে।” বলেই আদিল নিশব্দে নিশ্বাস ফেললো।

স্নিগ্ধার বুকের ভিতরটা অস্থির হয়ে গেলো।আদিলের কথাগুলো সে টেবিল ল্যাম্পের ওই আবছা আলোর মতোই শুনেছে কিন্তু কথাগুলো সাজিয়ে উঠতেই তার আবার সেই আগের অনুভূতিগুলো অনুভব হচ্ছে। এতোক্ষণ আদিল তার এতো কাছে থাকার ফলেও নিজের মধ্যে সে কোনো অনুভূতির সৃষ্টি পায়নি কিন্তু শেষ কথাটি যেনো তার মনের মধ্যে লুকায়িত কোনো এক নাম না জানা অনুভূতি নামক ফুলটির সৌরভ ছড়িয়ে দিলো। স্নিগ্ধার আদিলের চোখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে সে ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেবার সাহস যে তার নেই।

___________________

স্নিগ্ধা আনোয়ার সাহেবের সামনে বসে আছে। অন্যদিনের মতো লোকটা আজও হাসিখুশি কিন্তু স্নিগ্ধা চুপচাপ, সে বাধ্য হয়েই লোকটির সামনে বসে আছে। নিজেকে সংযত রাখার সম্পূর্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। লোকটাকে সরাসরি প্রশ্ন করতে মন চাইছে বার বার। কিন্তু সে সব সম্ভব নয়। স্নিগ্ধা চুপ করে নির্বিকার ভঙ্গিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে আনোয়ার সাহেবের কথায় চোখের পাতা ফেলছে।

আনোয়ার সাহেব স্নিগ্ধার এই মৌনতা লক্ষ্য করেছে। মেয়েটি চুপচাপ কিন্তু ঠিক এতটা চুপচাপ তাকে এর আগে কখনো দেখেনি সে। হয়তো এমন দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার কারণে মেয়েটি মানসিক ভাবে একটু ডিস্টার্ব আছে। তবুও স্নিগ্ধার আচরণ খুব অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। যেই দৃষ্টিতে স্নিগ্ধা তাকিয়ে আছে সেই দৃষ্টিতে আজও একজন তাকে দেখে প্রতিনিয়ত। আনোয়ার সাহেবের ভয় হলো কিছুটা। ফাহাদ কি কোনোভাবে স্নিগ্ধাকে সবটা বলে দিয়েছে?

ফাহাদকে আরোহীর জীবন থেকে সরাতে সে অনেক কিছু করেছে ঠিকই কিন্তু তার ফল সে পেয়েছে। আরোহীকে সে একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আদিল এইসবের কিছুই জানে না। জানলে হয়তো কোনদিন আনোয়ার সাহেবের মুখ দেখবে না সে। ছেলেকে হারানোর ভয়ে সে প্রচুর মিথ্যে বলেছে কিন্তু দিন দিন সেই ভয় তাকে গ্রাস করছে।

আদিল সেই সময় দেশের বাইরে পড়াশোনায় ব্যাস্ত। আরোহীর মৃত্যুর সংবাদে সে দেশে ফিরে। তখন অভ্র ছয় মাসের শিশু। লোকলজ্জার ভয়ে আরোহীর বিয়ে ও সন্তান দুটো বিষয় গোপন রাখেন তিনি। আদিলের কাছে সে সবটা মিথ্যে বলে, ফাহাদ জানতে পারলে অভ্রকে মেরে ফেলবে এই ভয় আদিলের মনে ঢুকিয়ে দেয়। মিথ্যে বলার আরো একটি বড় কারণ ছিল মিডিয়াতে আবারার পরিবারের মান সম্মান রক্ষা।

কিন্তু বোন হারিয়ে আদিল প্রতিশোধের এমন নেশায় মেতে উঠবে সেসব আনোয়ার সাহেবের আন্দাজের বাহিরে ছিলো। নিজের বিছানো জালে যেনো এক এক করে তিনি নিজেই আটকা পরে যাচ্ছেন।

[ #চলবে ]

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৩২
#নবনী_নীলা।

স্নিগ্ধা ফোনে ফাহাদের নাম্বার খোঁজায় ব্যাস্ত। অনেকদিন আগে একবার তার মোবাইলে ফাহাদ কল করেছিলো। ভালো করে খুঁজলে কল হিস্টরি থেকে নিশ্চই নাম্বারটা পাওয়া যাবে। ফাহাদকে এই মুহূর্তে তার ভীষন দরকার। লোকটার সাথে কথা বলতে না পারলে তার শান্তি হচ্ছে না। সেদিন অনেক প্রশ্নই তাকে করা হয়ে উঠেনি সেসব প্রশ্ন যে তার মনে জমাট বেঁধে আছে ।

স্নিগ্ধা ঘণ্টা খানেক ফোন ঘাটাঘাটি করলো। যত সহজে খুজে বের করা যাবে সে ভেবেছিল বিষয়টা এতটা সহজ নয়। কিছুতেই তারিখটা মনে করতে পারছে না সে। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা পাশে ছুড়ে মারলো স্নিগ্ধা। অসহ্য লাগছে তার সব কিছু।

রুম থেকে বেরিয়ে একটু অবাক হলো সে। সামনে এগিয়ে এসে দেখতেই বুঝলো যে আজ আরোহীর ঘরটা তালা মারা নয়। দরজাটা চাপিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ আগ্রহ নিয়েই স্নিগ্ধা রূমের ভিতরে দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো। জিম সিড়ি দিয়ে উঠতেই স্নিগ্ধাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে এগিয়ে যাচ্ছিল স্নিগ্ধাকে থামাবে বলে কিন্তু পাশেই আদিলকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে।

তারপর সিড়ি বেয়ে উপরে এসে বললো,” আটকালেন না কেনো ওকে?”

আদিল বুকের কাছে দুই হাত ভাজ করে দাড়িয়ে ছিলো। জিমের প্রশ্নে দুই হাত পকেটে ভরে বললো,” আটকানোর প্রশ্ন উঠছে কেনো যখন আমি নিজেই রুমটা স্নিগ্ধার জন্যে খুলে দিয়েছি।”
_______________

রুমে ঢুকেই বিস্মিত চোখে চারিপাশ দেখতে লাগলো স্নিগ্ধা। আজ প্রথম সে আরোহীর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলো। সামনের বড় দেওয়ালটায় বিশাল এক ছবি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। আরোহী যে খুব রূপবতী ছিলো বলাই বাহুল্য। স্নিগ্ধা অবাক হয়ে চারিদিক দেখতে লাগলো। রুমটা যেনো অন্য এক জগৎ। যেখানে শুধু এই একটি মানুষের বসবাস। শুধু তার অস্তিত্ব রয়েছে এই রুমটায়। স্নিগ্ধা সব কিছু বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। একপাশের টেবিলে পড়ে থাকা ডায়রিটি তার নজর কাড়লো। হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে গিয়ে প্রথমে দ্বিধায় পড়তে হয়েছে তাকে।

তবুও সে হাত বাড়িয়ে ডায়রিটা নিলো। পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখলো তারিখ দিয়ে দিয়ে কিছু ছোটো ছোটো ঘটনা লিখে রাখা। বেশ আগ্রহ নিয়ে স্নিগ্ধা পড়তে লাগলো। মাঝখানের ডায়রির একটি পাতায় লেখা,

” আজ আমার জীবনের অনেক সুন্দর এক মুহুর্ত। আমি মা হতে যাচ্ছি। আজ আমি অনেক খুশি হলেও এই খুশি আমি কারোর সাথে ভাগাভাগি করতে পারছি না। আমার ভালোবাসার মানুষটির কানে কানে গিয়ে লাজুক হেসে বলতে পারছি না যে,” তুমি বাবা হতে চলেছ।”

চাইলে এখন মধ্যরাতে ফাহাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাকে আমি অন্য এক ভালোলাগার স্বাদ দিতে পারি কিন্তু আজ না। আমি অপেক্ষায় আছি কারণ সামনে ফাহাদের জন্মদিন। সেই বিশেষ দিনে এর থেকে বেশি দামী উপহার কি আমার পক্ষে তাকে দেওয়া সম্ভব? কখনই না।

ফাহাদকে যেহেতু বলিনি তাই কাউকেই আমি এই মন ভালো করে দেওয়ার মতোন খবরটা দিতে পারছি না। হটাৎ যদি কেউ মুখ ফসকে ফাহাদকে বলে দেয় তখন আমার সারপ্রাইজটা মাটি হয়ে যাবে না?”

ডায়রি পড়তে পড়তে যেনো স্নিগ্ধা অন্য এক জগতে হারিয়ে গেছে। কি সব ছেলেমানুষী কথা বার্তা লেখা আছে তবুও যেনো পড়তে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আরোহী যেনো তার পাশে বসেই তাকে সব গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। ডায়রির পাতা থেকে চোখে সরাতেই একটা গ্রামোফোন চোখে পড়লো স্নিগ্ধার। এতো আধুনিক যুগেও গ্রামোফোন রাখা কেনো এই ঘরে? স্নিগ্ধা আগ্রহ নিয়ে উঠে দাড়ালো।
সেই ছোটো বেলায় নানুর কাছে প্রথম গ্রামোফোন গান শুনেছে স্নিগ্ধা। এটা দেখে তার খুব গান শুনতে ইচ্ছে হলো।

গ্রামোফোনের পাশেই কতো কেসেট রয়েছে। স্নিগ্ধা একটা হাতে নিয়ে দেখলো উপরে মার্কার পেন দিয়ে গানের নাম লেখা আছে। রবীন্দ্র সংগীতের নাম দেখেই বেশ লোভ হলো স্নিগ্ধার। কোনো কিছু না ভেবেই স্নিগ্ধা একটি কেসেট গ্রমফোনে বসিয়ে দিলো। প্রথমে বেজে উঠলো না। স্নিগ্ধা আরো কয়েকবার চেষ্টা করলো এতো সুন্দর গ্রামোফোন আছে চলবে না কেনো? স্নিগ্ধা সময় নিয়ে বার বার চেষ্টা করতে লাগলো।

এতবারের চেষ্টায় হটাৎ গান বেজে উঠলো সেই গ্রামোফোন থেকে। পুরো বাড়িটা যেনো মধুর এক আওয়াজে ভরে উঠলো। এমন মধুর কণ্ঠ যে স্নিগ্ধার চোখ জোড়া ভালো লাগার আবেশে বন্ধ হয়ে এলো।

অভ্র নিজ রুমে বসে আঁকিবুকি করছিলো। হটাৎ এই গানের আওয়াজে সে মুখ তুলে তাকালো। এই গানগুলো তার খুব প্রিয়, অভ্র দৌড়ে রূমে এসে হাজির হলো।

স্নিগ্ধা মনোমুগ্ধ হয়ে গানগুলো শুনছিল। হটাৎ তার পাশে কারোর উপস্থিতি বুঝে চোখ খুলে তাকালো। দেখলো অভ্র খুব আগ্রহ নিয়ে বসে বসে গানের সঙ্গে পা দুলাচ্ছে। স্নিগ্ধার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এইটুকু শিশুটা জানেই না তার জীবনের আসল সত্যিগুলো। এদিকে আদিল অনেক ভালো একটা কাজ করেছে। সে অভ্রকে কিছুই জানতে দেয় নি। এইটুকু বাচ্চাটা কি বা বুঝে এইসবের। স্নিগ্ধা হাত বাড়াতেই অভ্র ঝাপিয়ে পড়লো তার কোলে। দুই হাতে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে স্নিগ্ধা বসে রইলো।

গ্রামোফোনটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর শত চেষ্টা করেও আদিল সেটা সারাতে পারেনি। এতো পুরোনো যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি কতো বছর। তাই অনেক চেষ্টা করেও সারানো গেলো না সেটা। গ্রামোফোনটা আরোহীর বড্ড শখের ছিলো। তাই শখের বসে কিছু গান সে নিজ কন্ঠে রেকর্ড করেছিলো। গানটা আজ বেজে উঠতেই চমকে উঠলো আদিল। কতো বছর পর শুনছে সে এই কণ্ঠস্বর। আদিল নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। চোখে মুখে তার বিষ্ময়। আরোহীর রুমটার সামনে এসে সে বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। এটা কি করে সম্ভব?

গ্রামোফোনে গান বাজছে! রূমের ভিতরে স্নিগ্ধা আর অভ্রকে দেখে আদিল আর তার কৌতুহল বাড়লো না। সে রূমের একটি কোণায় চুপটি করে দাড়িয়ে শ্রুতিমধুর সেই গান শুনতে লাগলো। স্নিগ্ধার ক্ষমতা আছে বলা যায়। যেই গ্রামোফোন শত চেষ্টা করেও গত কয়েকবছরে একটিও রেকর্ড প্লেয়ার বাজানো যায় নি। আজ হটাৎ স্নিগ্ধা আসতেই সেই গ্রামোফোন সুর ধরলো!

আনোয়ার সাহেব ইজি চেয়ারে বসে ছিলেন। চুপ করে সে গান শুনছেন। নিজেকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছেন না। এই গানটি শোনার পর যেনো সে আরো অসহায় বোধ করছে। কি করেছে সে এইসব? নিজের মেয়ের জীবনটা তো সে নিজেই বিষিয়ে দিয়েছিল। আজ তারই মুল্য সবাইকে দিতে হচ্ছে। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন তিনি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। কি করতে পারে সে? কীই বা করার আছে তার?

গ্রামোফোনের সেই গান দীর্ঘস্থয়ী হলো না। মিনিট দশেক পরেই কেসেট প্লেয়ার বন্ধ হয়ে গেলো। এর পর স্নিগ্ধা বেশ কিছু চেষ্টা করলো কিন্তু এইবার আর কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। স্নিগ্ধা হাল ছাড়লো এই গ্রামোফোনটা তাকে দয়া করে দশ মিনিট গান শুনিয়েছে বার বার সে দয়া করতে প্রস্তুত নয়।

আদিল গান থামতেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। স্নিগ্ধা পিছন ফিরে তাকালো তবে কাউকে দেখলো না। গানগুলো শুনে স্নিগ্ধার ধারণা এই সুর অন্য কারোর নয় নিশ্চই আরোহীর এই সুর। যত জানছে কৌতূহল যেনো তার আরো বেড়েই যাচ্ছে। সব কয়টি ডায়রি পড়লো সে। ডায়রি পড়ে এতটুকু সে ঠিকই বুঝেছে যে আরোহী ফাহাদকে এক সমুদ্র ভালোবাসলেও শেষ সময়টুকু তার চেয়েও বেশি ঘৃনা করে গেছে।

স্নিগ্ধা চুপটি করে ছাদে কিছুক্ষণ বসে রইলো আজ সে কারোর সাথেই কথা বললো না। এই ডায়রি যদি আদিল পড়ে থাকে তাহলে ফাহাদের প্রতি তার হিংস্র হয়ে উঠা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ কাছের মানুষকে কষ্ট কেউই সহ্য করতে পারে না।

কিন্তু সবটা তাকেই কেনো জানালো প্রকৃতি। এই সত্যটা কেনো আদিল জানতে পারলো না। ফাহাদের সত্যি কি করে সামনে আনবে সে? কেউ কি তাকে বিশ্বাস করবে। ফাহাদের সেদিনের সেই চোখ মিথ্যে বলতে পারে না। আচ্ছা সে যদি আদিলকে সবটা বলে আদিল বিশ্বাস করবে?
ভাবনার অতল সাগরে ডুবে যাচ্ছে সে।

____________________

আজ সারাদিন স্নিগ্ধা একবারের জন্যেও আদিলের দেখা পায় নি। তার রাগ স্থির আছে কিন্তু মন মানছে না। একটিবারও দেখা পেলো না লোকটার? রাত কম হয় নি। বেশ রাত হয়েছে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। স্নিগ্ধা চুপ করে রুমে বসে আছে। কিন্তু এখন তার বেশ অসহ্য লাগছে।

স্নিগ্ধা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বের হতেই জিমকে দেখে এগিয়ে এলো সে। প্রথমে ইতস্তত করলো সে। পরে একটা ঢোক গিলে বললো,” কোথায় সে?”

এ কথার মানে জিম বুঝেছে ঠিকই কিন্তু তবুও না বোঝার ভান করে বললো,” কার কথা বলছেন?” বলেই আসে পাশে তাকালো।

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকালো জিমের না বোঝার ভান সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। স্নিগ্ধা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” আবরার ফাইয়াজ।”

জিম ঠোঁট প্রশস্ত করে একটু হাসলো তারপর অভ্রর রূমের দিকে হাত দিয়ে ঈশারা করতেই স্নিগ্ধা আর এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে এগিয়ে গেলো। আদিল বাড়িতেই আছে অথচ সে জানেই না। তার সঙ্গে কি লোকটা রাগ দেখাচ্ছে?

স্নিগ্ধা অভ্রর রুমে এসে দাড়ালো। রুমে এক পলক চোখ বুলিয়ে তার রাগটা হালকা হলো।দুজনে কতো আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। অভ্র আদিলের একদম বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে এক হাতে আদিলকে জড়িয়ে আছে। আদিল ও দুহাতে আগলে ধরেছে ছোট্ট দেহটিকে।
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কয়েক পলক।

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here