রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১৮+১৯

0
343

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৮
#নবনী_নীলা

স্পৃহা ইট হাতে নিয়েই বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” ভাগ্যিস দেখে মারতে গিয়েছিলাম। নয়তো সারা জীবন আপনাকে কপাল কাটা জিম নামে বাঁচতে হতো।”

জিম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,” মানে?”

স্পৃহা বাকা হাসি দিয়ে ইটের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি তো ভেবেছিলাম আজ কপালই ফাটিয়ে দিবো। না দেখে যদি আপনার কপাল ফাটিয়ে দিতাম পরে তো ডাক্তারের কাছে গিয়ে কপাল সেলাই করা লাগতো তারপর সবাই আপনাকে ডাকতো কপাল কাটা জিম। ঐযে নাম শুনেন না আঙ্গুল কাটা জগলু, গাল কাটা জসিম। আপনারটাও তেমন হয়ে যেতো।”

স্পৃহার কথায় জিম রেগে গিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,” হাতের এইটা ফেলে দাও বলছি।”

স্পৃহা ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বললো,” ভয় পেয়েছেন বুঝি? তা রোবট সাহেব আপনি এইখানে কি করছেন শুনি। আমার জন্যে এসেছেন?” একটা ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলো সে।

জিম উত্তরে কিছু বললো না এগিয়ে এসে স্পৃহার হাত থেকে টান দিয়ে ইটটা নিয়ে এক পাশে ফেলে দিয়ে বললো,” তোমার মত মেয়ের পিছু যে কে নেয় তাকে এইবার সত্যি দেখতে ইচ্ছে করছে। তার নিজের জীবনের ভয় নেই মনে হচ্ছে।”

স্পৃহা ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে বললো,” ও আচ্ছা। এতো পেচিয়ে কথা বলার কি দরকার বললেই পারেন আপনি আমার জন্যে এসেছেন।”

স্পৃহার এমন হাসিতে জিম বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। মেয়েটা এত অদ্ভূত কেনো? জিম দৃষ্টি সরিয়ে আশে পাশে তাকালো। আশে পাশে কেউ নেই বললেই চলে। এই রাস্তায় এবার স্পৃহাকে কে বিরক্ত করতে আসবে?

জিম স্পৃহার পিছু পিছু হাটছে কেনো সে বুঝতে পারছে না। স্পৃহা কিছুদুর গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে জিমের দিকে তাকালো। জিম স্পৃহাকে দাড়িয়ে পড়তে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। দাড়িয়ে পড়লো কেনো মেয়েটা? জিম এগিয়ে এসে বললো,” হটাৎ দাড়িয়ে পড়লে কেনো? কোনো সমস্যা?”

স্পৃহা চিকন গলায় বললো,” একসাথে হাটি, চলুন।” চ উচ্চারণ করতেই জিম তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” নাহ্। যাও আগে হাটো।”

স্পৃহা ভ্র কুচকে বললো,” আপনি না ভালো কথার মানুষ না।”

জিম ভাবলেশহীন ভাবে বললো,” আমার সাথে ভালো কথা বলতে হবে না তোমায়। তুমি চুপ চাপ হাটো।”

স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। এই লোকটা এমন ভাব করে যেনো, তার সাথে হাঁটলে মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আস্ত একটা ঘাউরা কোথাগারের!

স্পৃহা যেতে যেতে খেয়াল করলো হঠাৎ দুটো ছেলে তার দুপাশে এসে একই গতিতে তার সঙ্গে হাঁটা দিয়েছে। স্পৃহা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো এদের মধ্যে একজনই তো রোজ তার পিছু নেয়।
অসভ্যটা আজ আবার আরেকটাকে সঙ্গে করে এনেছে। স্পৃহা বেশ জড়সর হয়ে দাড়িয়ে পড়তেই ছেলে দুটি শব্দ করে হেসে উঠে স্পৃহার সামনে এসে দাড়ালো। স্পৃহা দাতে দাত চিপে ছেলে দুটোর দিকে তাকালো। এদের চুল টেনে ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। প্রতিদিন ঠিক এইভাবে তার পিছু পিছু আসে আর উল্টা পাল্টা বকে।

ছেলেগুলো দুষ্ট চোখে স্পৃহার দিকে তাকাতেই স্পৃহার রক্ত টগবগ করে উঠলো। সে শুধু অপেক্ষা করছে কখন জিম এসে এদের আচ্ছা করে দু ঘা লাগিয়ে দিবে। দেখে সে একটু তৃপ্তি পাবে।

জিম ভাবলেশহীন ভাবে পকেটে দুই হাত ভরে স্পৃহার পাশে এসে দাড়ালো। ছেলে দুটো জিমকে দেখে একটু নার্ভাস হয়ে গেলো। প্রতিদিন এই সময় রাস্তা ফাঁকা থেকে আজ হটাৎ জিমকে দেখে একজন বলে উঠলো,” এ আবার কই থেকে এলো?”

স্পৃহা রেগে গিয়ে বললো,” মহাকাশ থেকে এসেছে। কেনো তোদের যেতে ইচ্ছে করছে?”

আরেকজন স্পৃহার কোথায় বিচ্ছিরি ভাবে হেসে উঠে বললো,” গেলে কি আর একা যাবো? তোকে তো সাথে নিয়েই যাবো।”
বলেই স্পৃহার দিকে এগিয়ে যেতেই জিম সানগ্লাস খুলে হাতে নিলো তারপর এক হাত মেলে বাধা দিয়ে সামনে এসে দাড়ালো। নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” কি সমস্যা? এভাবে পথ আটকে দাড়িয়ে আছো কেনো? রাস্তা ছেড়ে দাড়াও।”

স্পৃহা জিমের এমন স্বাভাবিক আচরণে ক্ষেপে গিয়ে বললো,” কি আশ্চর্য! ওরা কি আপনার ভাই লাগে নাকি? এভাবে কোমল কণ্ঠে বলার কি আছে? দু চারটে দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে পারছেন না?”

ছেলেগুলো হটাৎ স্পৃহার এমন উক্তি শুনে ঘাবড়ে গেল। জিমকে দেখে তাদের সুবিধার মনে হচ্ছে না। জিম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” এরপর থেকে যেনো এই মেয়ের আশে পাশে না দেখি। নয়তো হাঁটার জন্যে পা থাকবে না। বাকি জীবন হুইচেয়ারে কাটাতে হবে ।” বলেই ছেলে দুটোকে চলে যেতে ঈশারা করতেই ছেলে দুটো বেশ ঘাবড়ে গেলো জিমের এমন গাম্ভীর্যতা দেখে। একজন হুট করে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতেই আরেকজন ও ছুটে পালালো।

স্পৃহা হতভম্ব হয়ে জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” এই আপনাকে ডায়লগ দিতে কে বলেছে? হাত পা নেই মারতে পারলেন না?”

জিম নিজের সানগ্লাস পড়তে পড়তে বললো,” এরা আমার স্ট্যান্ডার্ড না, যে মারামারি করে এদের ভয় দেখাবো। এদের জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট।”

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,” আমি কোথায় ভাবলাম এই দুইটাকে মেরে ভর্তা করে দিবেন তা না..”বলেই নিরাশ চোখে জিমের দিকে তাকালো।

জিম আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” বেশি বড় বড় কথা বলো না। আমাকে তো ইট দিয়ে মারতে এসেছিলে আর এদের বেলায় হাতে তো একটা পাথরও তুললে না। এদের কি ভাড়া করে এনেছো নাকি?”

” ফালতু বলবেন না তো। আমাকে কি বাংলা সিনেমার হিরোইন পেয়েছেন যে টাকা দিয়ে গুন্ডা ভাড়া করবো।”, চটে গিয়ে বললো স্পৃহা।

জিম ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” উইল ইউ স্টপ নাও?” স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে হাঁটতে লাগলো। কোথায় ভেবেছিলো ছেলেগুলোর মার খাওয়া দেখে মজা নিবে কিন্তু না এই লোকটা কিছুই করলো না। আর এই বদমাইস দুটো এতো ভীতুর ডিম জানা থাকলে সে নিজেই এদের পিটিয়ে লাল করে দিতো। এই লোকের সামান্য কথায় ভয় পেয়ে পালালো।

_________

ফাহাদ রেজওয়ান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আফজাল সাহেব একমাত্র মেয়ের জামাই। আফজাল সাহেবের এই পজিসন টিকিয়ে রাখতে ফাহাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ফাহাদের ক্ষমতার কারণেই এই পজিসন এখনও তার দখলে, বয়স কম হলেও ফাহাদের ক্ষমতার কারণেই তাকে সবাই মান্য করে। বিশাল এই বাড়িটিতে সে বলতে গেলে একাই থাকে। সঙ্গে জিসান মানে তার ডান হাত বলা যেতে পারে, সে থাকে।

জিসান বেশ হন্তদন্ত করে ছাদের পুল সাইডে এলো। জিসান ফাহাদকে সুইমিং করতে দেখে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

মিনিট পাঁচেক পর, ফাহাদ জিসানকে খেয়াল করলো তারপর দুই হাতে সামনের চুলগুলো সরিয়ে বললো,” কি হয়েছে? এতো রাতে এইখানে কি করিস?” বলতে বলতে সুইমিং পুল থেকে উঠে দাড়িয়ে পড়লো তারপর সাদা তোয়ালে দিয়ে হাতে মুখ মুছে নিলো।

জিসান মাথা তুলে তাকালো তারপর একটা ঢোক গিলে বললো,” বস, রুহুল সাহেব মানে যার কাছ থেকে টাকা পাওনা ছিলো। চিনতে পারছেন? ভদ্র লোকের দুটি মেয়ে আছে।”

ফাহাদ তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে বললো,” হুম, চিনতে পেরেছি। কিন্তু কি হয়েছে?”

জিসান পুনরায় মাথা নিচু করে ফেলে বললো,” স্যার, উনি আত্মহত্যা করেছেন। এই মাত্র খবর পেয়েছি। ”

ফাহাদ চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ জিসানের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর পাশেই মদ্যপানের একটি বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে হাতে নিয়ে নিশ্চুপে বসে রইলো। তারপর এক চুমুক দিতেই জিসান বললো,” বস্, এইবার কি করে টাকা আদায় হবে। রুহুল সাহেবের স্ত্রীকে চাপ দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।”

ফাহাদ গ্লাসে আরেক চুমুক দিয়ে গ্লাসটা টেবিলে রেখে বললো,” নাহ্, ওনার স্ত্রী কে চাপ দেওয়ার দরকার নেই। রুহুল সাহেবের বড় ভাই শুনেছি বিশাল ব্যাবসা করে। দরকার পড়লে অনেক চাপ দাও নয়তো ছেলে মেয়েকে তুলে আনো। যে করেই হোক আগামীকালের মধ্যে টাকা আমি চাই। তার জন্যে যা করা লাগে করো।”

জিসান হা সূচক মাথা তারপরও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বলার আছে তার কিন্তু কীভাবে বলবে সেটাই মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে। জিসান চিকন গলায় বললো,” বস্ , সুনেয়রা ম্যাডাম শুনছি দেশে ফিরছেন। যদিও তিনি কিছু জানান নি আমাদের তবে আমি খবর পেয়েছি।”

ফাহাদ চোয়াল শক্ত করে একটা ভ্রু তুলে বললো,” মানে? আমাকে না জানিয়ে দেশে ফিরছে?।” বলেই চুপ করে গেলো তারপর জিসানকে হাতের ঈশারায় চলে যেতে বললো।
গ্লাস হাতে নিয়ে এক চুমুকে সম্পূর্নটা শেষ করে গ্লাসটা এক পাশে রেখে ফোনটা হাতে নিলো। তারপর কয়েকবার কল করলো কিন্তু সুনেয়রা ফোন তুললো না। কয়েকবার কল করেই ফাহাদ ভীষন রেগে গেলো দাতে দাত চেপে ফোনটা ছুঁড়ে মারলো। মেঝেতে পড়তেই ফোনটি চূর্নবিচূর্ণ হয়ে গেলো। রাগে চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে তার। সুনেয়রা সবটাই ইচ্ছে করেই করছে বুঝতে বাকি রইলো না তার।

_______

এতো রাতে স্পৃহার কল পেয়ে স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকালো। এই মেয়ের তো এই বেলায় ফোন দেওয়ার কথা না। স্নিগ্ধা তার পাশের টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিলো। তারপর ফোন কানে ধরতেই স্পৃহা ভয়ার্ত গলায় বললো,” আপু জানিস। রুহুল সাহেব আছেন না। উনি ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনে হয় বাঁচবেন না।”

স্নিগ্ধা অভ্রর পাশে বসেছিলো। মৃত্যুর কথা শুনে স্নিগ্ধা ফট করে দাড়িয়ে পড়লো। বুকের ভিতরে ধুক করে উঠলো তার। স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করে বললো,” মানে? কি আজে বাজে বলছিস। এভাবে বলে নাকি?”

স্পৃহার কণ্ঠ আরো কাতর হয়ে উঠলো সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,” আপু এই গলিতে কান্নার আওয়াজ পর্যন্ত ভেসে আসছে। বাবা মা মিতু আর নিতুর বাড়িতে গেছে। আমার না ভীষন ভয় লাগছে। তুই আয় না আপু।” বলেই অঝোরে কাদতেঁ লাগলো স্পৃহা।

[ #চলবে ]

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৯
#নবনী_নীলা

কলিং বেল বাজতেই উঠে দাড়িয়ে পড়লো স্পৃহা।ভয় তার এখনো কমেনি। কিছুক্ষণ পর পর সে কেপে কেপে উঠছে। ফরিদা আপা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, তার এইসবে কোনো মাথা ব্যাথা নেই।ঘুমানোর আগে প্রতিদিনের মতন আজও সে মুখে পাউডার মেখে, একদম সাদা বিড়াল সাজতে ভুলেনি। স্পৃহার মাঝে মাঝে মনে হয় এই মেয়ের সঙ্গে জ্বীন থাকে। সে এফএম রেডিওতে এমন গল্প অনেক শুনেছে তাই ফরিদা আপাকে সে সবসময়ই সন্দেহ করে। জ্বীন না থাকলে আপা নিশ্চয়ই মানসিক ভাবে অসুস্থ নয়তো কেউ এতো নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারে?

স্পৃহা কাপা কাপা গলায় দরজার ওপাশ থেকে বললো,” কে? আপু..?”

ওপাশ থেকে এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,” নাহ্। আমি…. দরজা খুলো।”

স্পৃহা একটু ভয় পেলো। এই কন্ঠটা সে চেনে না নাকি অতিরিক্ত ভয়ের কারণে তার মস্তিষ্ক সব কিছুতেই আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে।

স্পৃহা ধীর গলায় আবার প্রস্ন করলো,” কে আপনি…? নাম বলুন।”

পুরুষালী কণ্ঠটি আবার বললো,” আমি জিম। তোমার আপু পাঠিয়েছে তোমাকে নিয়ে যেতে। দরজা খুলো।”

স্পৃহা নামটা শুনে ফট করে দরজা খুললো। তারপর এগিয়ে এসে জিমকে সম্পূর্ন অবাক করে দিয়ে জিমের হাত ধরে ফেললো। তারপর তাড়া দিয়ে বললো,” চলুন।” এই বাড়িতে আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো সে দম আটকে মরেই যাবে।

জিম একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বললো,” এইটা লক করবে না? তোমার বাবা মায়ের কাছে চাবি আছে?”

স্পৃহা চোখ তুলে জিমের দিকে তাকিয়ে হা সূচক মাথা নাড়লো। স্পৃহার দিকে তাকিয়ে হটাৎ জিমের কেনো জানি একটু মায়া লাগলো। মেয়েটা কতটা ভরসা করেই না তার হাত ধরেছে।

_________

স্পৃহা প্রায় রাত দুটো পর্যন্ত জেগে বসে ছিলো। মাঝে একবার একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল তার কিছুক্ষণ পর ভয় পেয়ে উঠে পড়েছে। স্নিগ্ধা পাশেই বসে ছিলো এতক্ষণ। স্পৃহা যতই হাসিখুশি মেয়ে হোক না কেনো ছোটো ছোটো ব্যাপারে সে ভীষন ভয় পায়। অভ্রকে জড়িয়ে ধরে স্পৃহা আপাদত শান্তিতেই ঘুমাচ্ছে। অভ্র মুখ হা করে ঘুমায়, দেখতে কি যে সুন্দর লাগে।

স্নিগ্ধার আজ রাতে আর ঘুম আসবে না। সে স্পৃহার মতন না, চাইলেই নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে পারে না। নিজের রাগ, দুঃখ, কষ্ট সবকিছুই সে মানুষের চোখের আড়ালে রাখতে ভালোবাসে।

স্নিগ্ধার মন বেশ বিষণ্ণ হয়ে আছে। রুহুল সাহেব লোকটা তাদের খুব পরিচিত একজন ছিলো। স্নিগ্ধার সাথে কখনো তার তেমন কথা হয়নি তবে তিনি দেখলেই খুব আদুরে গলায় ডাকতেন তাকে। স্পৃহাকে বেশ আদর করতেন।

হটাৎ রুহুল সাহেব আত্মহত্যা করতে যাবে কেনো? কি সুন্দর একটা পরিবার ছিলো। কি করে পারলো এদের এইভাবে ফেলে চলে যেতে? আচ্ছা মানুষের জীবনে কি এমন কষ্ট থাকে যে তাকে মৃত্যু বেছে নিতে হয়। যারা অন্ধ, পৃথিবীর আলো কোনোদিন দেখেনি তারাও তো বেচেঁ থাকতে লড়াই করে। আর সেখানে সব পেয়েও মানুষ এত সহজে হাল ছেড়ে দেয় কেনো?

স্নিগ্ধা করিডোরে এসে দাড়ালো। মধ্যরাতে চাঁদের আলোয় আকাশটা কি সুন্দর লাগছে। কিন্তু এই সুন্দর রাতে কত মানুষ যে তার প্রিয়জন হারিয়ে অসহায় হয়ে গেছে। প্রতিটা রাত যে কারো না কারো জীবনে অভিশাপ হয়ে আসে সেটা আজ স্নিগ্ধা উপলদ্ধি করতে পারছে। আজ এমন বাতাস বইছে কেনো? কেমন এক হিম শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।

স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস নিলো। তারপর চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকালো পরক্ষনেই এক তপ্ত নিশ্বাস ঘাড়ে এসে পড়তেই শিউরে উঠলো স্নিগ্ধা। পিছনে তাকাতেই দেখলো আদিল কিছুটা ঝুকে এসে দৃষ্টি সামনে রেখে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা পিছনে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের। কয়েক মুহূর্তেই স্নিগ্ধা দৃষ্টি সরিয়ে ফেললেও আদিল একই ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্নিগ্ধা একটু অবাক হয়ে বললো,” আপনি এখনো জেগে আছেন?”

আদিল রেলিংয়ের দুপাশে হাত রেখে একটু ঘনিষ্ট হয়ে এসে বললো,” আমার প্রিয় কারোর মন খারাপ থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না।”

স্নিগ্ধা আড় চোখে তাকাতেই আদিলের শীতল চাওনির শিকার হলো। স্নিগ্ধার কেনো জানি কান্না পাচ্ছে। তার সবসময় কান্না পায় না। খুব কাছের কেউ যদি তার মন খারাপের সময় তার পাশে এসে দাঁড়ায় কেনো জানি তখন খুব কান্না পায়।

কিন্তু এখন তার কেনো কান্না পাচ্ছে? আদিল কি তার কাছের কেউ হয়ে উঠেছে, তার নিজের অজান্তেই?

স্নিগ্ধা মাথা নুইয়ে রাখলো। চোখ ভিজে এসেছে তার। হটাৎ এই নিরবতায় কিছুই যেনো আদিলের দৃষ্টিগোচর নয়। তার কাছের মানুষটি প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজের অনুভূতি তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে। তার সামনে কেঁদে ফেললে হয়তো লজ্জায় পড়ে যাবে এই মেয়েটি। তার কি উচিত না এই মেয়েটিকে এমন লজ্জার হাত থেকে বাঁচানো?

আদিল স্নিগ্ধার দুই বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। স্নিগ্ধা নিজের অনুভূতির উপর থেকে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই আদিল নিজের দুই বাহুতে আগলে নিলো স্নিগ্ধাকে। আজ আর স্নিগ্ধার অভিযোগ করার সুযোগ নেই। সত্যি তার কাউকে প্রয়োজন ছিলো। যে তাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে একটুখানি উষ্ণতা দিবে।

স্নিগ্ধা কেঁদে ফেললো কিন্তু খুব নিরবে। আদিলের পিঠের শার্ট তার মুষ্টিবদ্ধ। মিনিট কয়েক পরেই সে নিজেকে সামলে নিলো যখন এক হৃদ কম্পন অনুভব করতে লাগলো সে। স্নিগ্ধা কান পেতে রইলো, হটাৎ এতো জোরে জোড়ে হার্ট বিট করছে কেনো আদিলের? স্নিগ্ধা সেই ধ্বনিতে যেনো হারিয়ে গেলো। আচ্ছা আজকে এই ছেলেটা এতো চুপচাপ কেনো? আজ কেনো সে হাজারটা কথা বলছে না? যদিও এই নিরবতা স্নিগ্ধার ভীষন ভালোলাগছে। এভাবেই থাকতে ইচ্ছে করছে। যেনো কোনো এক নেশা গ্রাশ করে নিয়েছে তাকে এইভাবেই কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে এই রাত।

কিন্তু তার এই ইচ্ছে বাধাপ্রাপ্ত হলো।নিজেকে সামলে নিয়ে বাধন ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ালো সে।সঙ্গে সঙ্গে তীব্র লজ্জা তাকে ঘিরে ধরলো। এখন তার মনে হচ্ছে সে কেনো এই কাজ করলো।হটাৎ লোকটার এতো কাছে যাওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিলো? কিভাবে করলো সে এইটা?

স্নিগ্ধা আড় চোখে আদিলের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলো আদিল তার বুকের কাছে শার্টের ভেজা অংশের দিকে তাকিয়েছে। তারপর না জানার ভান করে মৃদু হেসে বললো,” আমি সত্যিই কিছু দেখিনি।” বলেই স্নিগ্ধার দিকে তাকালো।

স্নিগ্ধা লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ফেললো। এইযে মুখ খুলেছে, এইবার তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলবে। স্নিগ্ধা নিজের এ মুখ এইবার কোথায় লুকাবে? গর্ত খুঁড়ে মাটিতে লুকিয়ে পড়তে পারলে মন্দ হতো না। এই সবের মাঝে তার মন খারাপের কারণটাই যেনো কোথায় হারিয়ে গেছে।

______________

সকালে ঘুম ভাঙলো স্নিগ্ধার। ভোর বেলায় তার ঘুম এমনিতেই ভেঙে যায়। আজ একটু দেরী হলো। ঘুম ভাঙতেই চোখ আস্তে আস্তে খুললো সে। চোখ খুলে তাকাতেই আদিলের ঘুমন্ত মুখটা তার একদম সামনে। স্নিগ্ধা কিছুক্ষণ তাকালো আদিলের ঘুমন্ত মুখটির দিকে। ঘুমালে তো কি ভদ্র আর নিষ্পাপ লাগে আর জেগে উঠলেই হয়েছে। স্নিগ্ধার হটাৎ কাল রাতের ঘটনাটা মনে পড়লো। মনে পড়তেই স্নিগ্ধা চোখ মুখ কুচকে ফেললো। ইস কি একটা লজ্জা! জীবনে কিছু ঘটনা থাকে যেগুলো হটাৎ ঘুমাতে গেলে মনে পড়ে আর তখন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। কাল রাতের ঘটনাটা স্নিগ্ধার কাছে অনেকটা এমনই।

স্নিগ্ধা শব্দ না করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। নিজেকে সে গুছিয়ে নিয়েছে। জীবন মানেই লড়াই করে বাঁচতে হবে হোক সেটা নিজের অনুভূতির সাথেই।

স্নিগ্ধা যতোটুকু শুনেছে যে, এক লোকের কাছে থেকে রুহুল সাহেব টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু সঠিক সময়ে টাকা ফেরত দিতে পারেন নি। কয়েক মাস ধরে নাকি সে ভীষন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। ডাক্তারের ধারণা মানসিক চাপের কারণে রূহুল সাহেব আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

স্নিগ্ধা প্রতিদিনের অভ্যাস মতন কিচেনে গেলো। আজ ভাবছে সবার জন্যে চা বানাবে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে তার মানসিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কিছুটা সস্তি দরকার তার। কিচেনের শেফ দুইজন বরাবরের মতন একপাশে দাড়িয়ে মনোযোগ নিয়ে স্নিগ্ধার চা বানানো দেখছে। তারা ভেবে পায় না তাদের বানানো চা স্নিগ্ধা কেনো পছন্দ করে না। তারা কি এতো জঘন্য চা বানায়?

স্পৃহা ঘুম থেকে উঠেই কিচেনে চলে এলো। ঘুম থেকে উঠেই এই মেয়ের চা লাগবে। স্পৃহা কিচেনে এসে হাজির। চায়ের ট্রে থেকে এক পেয়ালা নিয়ে বললো,” ধন্যবাদ আপু।” স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কি সুন্দর তিনটা কাপ নিয়ে উপরে যাবে ভেবেছিলো এখন দুটো কাপ নিয়ে যেতে হবে।

স্পৃহা ঘুম ঘুম চোখে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো সে রুমে গিয়ে জানালার পাশে বসে চা খাবে তাই যাচ্ছিল। রূমের দিকে যাওয়ার সময় বেখেয়ালে জিমের সাথে ধাক্কা লেগে চায়ের কাপ ফ্লোরে পরে চূর্ন বিচূর্ণ হয়ে গেলো। এক ধাক্কায় যেনো স্পৃহার ঘুম উড়ে গেলো। মাথায় রক্ত ওঠে গেলো তার। রাগে ফুলতে ফুলতে বললো,” আপনি কি বলুন তো? আপনি আর কাউকে পান না ধাক্কা খাওয়ার জন্যে? মানে খুঁজে খুঁজে আমাকেই ধাক্কা দিতে হয় আপানার।”

জিম তীব্র বিরক্তি নিয়ে তাকালো। মানে এখন সব দোষ তার? বলার ভাষাই সে খুঁজে পাচ্ছে না। স্নিগ্ধা পিছনেই ছিলো। ট্রে হাতে উপরে এসে বললো,” একি এই অবস্থা হলো কি করে?”

স্পৃহা কোনো কথা বললো না। স্নিগ্ধার ট্রে থেকে এক পেয়ালা চা নিয়ে মুখ কালো করে বললো,” সকাল সকাল মেজাজটাই খারাপ করে দিলো।” তারপর বলেই রূমের দিকে চলে গেলো।

জিম বিষ্ময় নিয়ে তাকালো। কি আশ্চর্য! এইখানে তার দোষ কোথায়? স্নিগ্ধা কিছুই বুঝলো না। জিম আর স্পৃহা যে কি করে বেড়ায় সে বুঝতে পারে না। স্পৃহা চায়ের শেষ পেয়ালাটা জিমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” তোমরা এতো ঝগড়া করো কেনো?”

জিম নিরাশ চেহারায় পেয়ালে হাতে নিয়ে বললো,” আমারও একই প্রশ্ন।” জিম কঠিন গলায় করলেও স্নিগ্ধা ঠোঁট চেপে হাসি থামলো। স্নিগ্ধার হাসিতে জিম অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর বললো,” আমি স্টাফকে বলে দিচ্ছি জায়গাটা ক্লিন করে দিবে।” বলেই স্নিগ্ধাকে পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলো।

স্নিগ্ধা ফোঁস করে হেসে ফেললো। তারপর পা বাড়িয়ে রূমের দিকে যেতেই মনে হলো কিছু একটা তার পায়ে বিধেছে। স্নিগ্ধা খুব আস্তে আর্তনাদ করে উঠলো। ইশ না দেখে পা বাড়ালো কেনো সে? পা ফেলতেই ভীষন যন্ত্রণা হচ্ছে। স্নিগ্ধা পায়ে বিধে যাওয়া কাচের টুকরো বের করতে গিয়ে বসে পড়লো।

কিন্তু হটাৎ কারোর শক্ত বাহুতে নিজেকে আবিষ্কার করে অবাক হয়ে তাকালো স্নিগ্ধা। আদিলের দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে উঠে গেলো তার। শুধু একটা ট্রাউজার পড়ে আছে সে। আদিলের মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে যার কারণে শরীর বিন্দু বিন্দু পানি স্নিগ্ধার শরীর স্পর্শ করছে। স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে বললো,” কি করছেন? ছাড়ুন।”

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here