#যখন_তুমি_এলে
লেখা: জাহান লিমু
পর্ব : ৪৪
দুটো টিকিট হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সায়াহ্ন। কিন্তু রুমে এসে দেখে,বিরুনিকা নেই। এই বিকাল বেলায় আবার কোথায় গেলো মেয়েটা?
ভেবেছিলো রুমে এসেই সারপ্রাইজ দিবে। পরশু ওরা সিলেট যাচ্ছে ঘুরতে। ছোটখাটো হানিমুনও বলা যায় অবশ্য। ঐ ইডিয়ট তো জীবনেও মুখ ফুটে কিছু বলবেনা। ভালোবাসে, সেটাই তো এতোদিনে বলতে পারলনা। শুধু ইশারা-ইঙ্গিত করে গেলো। যেন আমি বাক প্রতিবন্দি। ইডিয়ট কোথাকার!
সায়াহ্ন সব বুঝেও,না বুঝার ভান করতো। মাঝে মাঝে কষ্ট হতো। আবার হাসিও পেতো স্টুপিডের একেক কান্ডে। যদি সায়াহ্ন না বলতো,তবে এই স্টুপিড দিব্যি মায়ের কথায় টাক, ভুড়িওয়ালা আঙ্কেলকে বিয়ে করতেও,দু’বার ভাবতনা। আর সারাজীবন বিরহে পার্বতী সেজে থাকতো।
রুমে কিছুক্ষণ বসে থেকে,সায়াহ্ন মহা বিরক্ত হলো। হঠাৎ কিছু একটা ভাঙ্গার আওয়াজ পেলো সে। কি যেন ভেবে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে শিউড়ে উঠলো। দ্রুতগতিতে বিরুনিকার পাশে গেলো। ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে হাত কেঁটে বসে আছে ইডিয়ট। আবার কাউকে ডাকও দিচ্ছে না। সায়াহ্নর মন চাইছিলো, কষিয়ে দুইটা থাপ্পড় লাগাতে। কিন্তু বিরুনিকার চোখের দিকে তাকিয়ে সেটা আর পারলনা৷ এই গভীর চোখই,সায়াহ্নকে ডুবিয়েছে।
ঝাড়ু এনে বেলচা দিয়ে কাঁচের টুকরাগুলো ময়লার বালতিতে আগে ফেললো সে। যদিও মনে হচ্ছে,অনেকটাই কেঁটে গেছে।
তবুও আগে ব্যান্ডেজ না করে, রাগে সায়াহ্ন বিরুকে এতটুকু সময় শাস্তি দিলো। স্টুপিড মেয়ে কোথাকার। সবসময় স্টুপিডিটি করে। বিরুনিকা তখন ব্যাথা ভুলে,চুপ করে বসে আছে। জানে এখন কিছু বললেই বকা খাবে। সায়াহ্ন আচমকা কোলে তুলে নিলো বিরুনিকাকে। তখন বিরুনিকা মুখ খুললো। ভীত কন্ঠে আমতা আমতা করে বললো,
” হাতই তো কেটেছে, পা তো কাটেনি। আমি হেটে যেতে পারবো।”
সায়াহ্নর তৎক্ষনাৎ মন চাইছিলো বিরুকে কোল থেকে ফেলে দিতে। এমন নিরস হয়ে,ওর প্রেমে কিভাবে হাবুডুবু খাচ্ছিলো,এটাই সে ভেবে পাচ্ছে না। কোন কথা না বলে,সায়াহ্ন বিরুর চোখের দিকে একবার তাকালো কেবল। তাতেই বিরুর যা বুঝার বুঝে গেলো। সাথে সাথে সে গলার স্বর একেবারে মিইয়ে গিয়ে বললো,
” আমিতো এমনি বলেছি। চিকন ঠোঁট জোড়া জোর করে প্রসারিত করার চেষ্টা করে বলতে লাগলো,আমার কত শখ সিরিয়ালের মত, আমার বরও আমাকে যখন তখন কোলে নিবে। কথাটা বলে একটা ঢোক গিললো সে। সায়াহ্নর চোখের দিকে একপলক তাকিয়েই,সেকেন্ডেই চোখ সরিয়ে নিলো সে। কারন সে জানে,সায়াহ্ন তার কথাটার মানে ধরে ফেলেছে।”
অন্যদিকে সায়াহ্ন অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার তাকালো কেবল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে,ইডিয়ট কেন এই কথাটা বলেছে। তাই সে আর কথা বাড়ালোনা। সামনে পা বাড়ালো।
কিন্তু দরজার কাছে আসতেই,সাচীর সামনে পড়ে গেলো। সাচী প্রথমে বুঝতে পারেনি বিষয়টা। তাই ভাবীকে খুঁচা দেয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
” একমাসেই কুনোব্যাঙ কে কোলাব্যাঙ বানিয়ে ফেললে? এখন ঘরের বাইরেও রোমান্স!”
বিরুনিকা অসহায় চোখে সাচীর দিকে তাকিয়ে রইলো। আর সায়াহ্ন গম্ভীর মুখে একবার সাচীর দিকে, একবার বিরুনিকার দিকে তাকাচ্ছে। বিরুনিকা ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। পরিবেশটা কেমন যেন সুবিধার ঠেকলো না সাচীর কাছে। হঠাৎ বিরুনিকার হাতের দিকে নজর গেলো ওর। আঁতকে উঠলো সে!
প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো, “কি হয়েছে ভাবীর?”
সায়াহ্ন তখন দাঁত কটমট করে বললো,কিছু হয়নি তো। রোমান্স করছিলাম। তো একটু আগে হঠাৎ আমি ভাম্পায়ার হয়ে,তোমার সুইট ভাবীকে কামড়ে দিয়েছি। শেষের কথাটা সায়াহ্ন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো বিরুর চোখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সে তো তখনো চোখ কুঁচকে বন্ধ করে রেখেছে। যদিও মিটমিট করে মেলে,সায়াহ্নর মুখটা ঠিকই দেখছে। আর মনে মনে বকে চলেছে,ছোট বোনের সামনে এমন অসভ্য কথা বলার জন্য।
বেহায়াব্যাঙ কোথাকার!
আবহাওয়া সুবিধার না বুঝতে পেরে,সাচী কেঁটে পড়লো। স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার-স্যাপার তারাই বুঝুক। থার্ড পারসন হয়ে না থাকায় বেটার। কিভাবে হাত কেটেছে,সেটা না হয় পরে জেনে নেওয়া যাবে। এটা ভেবে সাচী হনহন করে ওর রুমে চলে গেলো। ওর মেজাজও ঠিক নেই আজকাল। অযথাই তুহিনের সাথে কথা কাঁটাকাঁটি হচ্ছে। তুহিন চাইছে,এ বছরই বিয়ে হয়ে যাক। কিন্তু সাচী ভাবছে,গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করেই হোক না হয়। কিন্তু তুহিন নাকি আর কোন রিস্ক নিতে চাইছেনা। সাচী বুঝতে পারলোনা,এখানে রিস্ক নেয়ার কি আছে?
আর মনে এতোই ভয় থাকলে,তাহলে কোন সম্পর্কে না জড়ানোই ভালো। তুহিন ছেড়ে চলে গিয়েছিলো,তবুও তো সে অপেক্ষা করেছে। যদিও তার ভুল ছিলো বটে। হুঁট করে কারো কথায় এভাবে তুহিনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। কিন্তু তুহিন এতোটা রিয়েক্ট করবে,ভাবতে পারেনি।
তুহিনও অবশ্য টিপকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো। যদিও তুহিনের রেডিওতে রি-জয়েনের কথা শুনে,আরজে টিপ রেজিগনেশন লেটার দিয়ে দেয় আগেই। হয়তো তুহিনের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে। কিন্তু তুহিন ঠিকই ওকে খুঁজে বের করে। তখন টিপের সহজ সরল স্বীকারোক্তিতে সে বোকা বনে যায়। টিপ সরাসরি বলে ফেলে যে,সে তুহিনকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে। তুহিনের কাজিনের ফ্রেন্ড হিসেবে,টিপ তুহিনকে আগে থেকেই চিনতো। ইনফ্যাক্ট সে তুহিনকে প্রতিদিন দেখার জন্যই ঐ রেডিওতে আরজে হয়েছিলো। কিন্তু তুহিন কখনোই ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু সাচীকে মাত্র একবারের দেখাতেই কিনা সে ভালোবেসে ফেললো?
এটা টিপ মানতে পারছিলোনা। সেও স্মার্ট,শিক্ষিত,সুন্দরী। সাচীর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বরং বেশি। তাই হিংসার বশবর্তী হয়ে সে ঐ জঘণ্য কাজটা করে ফেলেছিলো। কিন্তু তুহিন যে সিরিয়াসলি সাচীকে এতোটা ভালোবাসে,সেটা নাকি সে বুঝতে পারেনি। টিপ সাচী,তুহিন দুজনের কাছেই ক্ষমা চেয়েছিলো সেদিন। সাচীর সেদিন কেন যেন নিজেকে অপরাধী লাগছিলো। কারন সে টিপের চোখে তুহিনের জন্য স্পষ্ট ভালোবাসা দেখতে পেয়েছিলো। তাই মনে হচ্ছিলো,সে অন্য কারো ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়ে গেছে। সে না আসলে,তুহিন একসময় না একসময় টিপের ভালোবাসা অনুভব করতে পারতো। কিন্তু তুহিনতো বলেছে,সে টিপকে ভালোবাসেনা। তাহলে এতে সাচীর দোষ কোথায়?
মানুষের জীবনটা কত অদ্ভুত। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ থাকা স্বত্বেও, কিছু কিছু মানুষের একজন ব্যক্তিকেই ভালো লাগে। তার প্রেমে পড়ে,তাকেই ভালোবাসে। এর কোন কারন সাচীর জানা নেই। কিংবা কেউই এর জবাব দিতে পারবেনা। সে যাকে ভালোবাসলো,তার আগে থেকেই অন্য কেউ তাকে ভালোবাসতো। সবকিছুর পরেও কেন যেন মনে হয়,সেই মেয়ের ভালোবাসাটা সাচী ছিনিয়ে নিয়েছে।
সত্যিই কি তাই?
নাকি এটা সাচীর মনের অবান্তর ধারণা। সেটা হলেই ভালো।
একতরফা ভালোবাসাগুলো ভীষণ অদ্ভুত। কোন পূর্ণতা পাবেনা জেনেও,গোপনে ভালোবেসে যায়। কিংবা কেউ সহ্য করতে না পেরে,টিপের মতো কাজ করে ফেলে। আবার কেউ কেউ কখনো জানায়ই না ভালোবাসার কথা।
ঠিক যেমন আরাদ এই জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে আছে এখন। কিন্তু সাচী সেটা কোনদিনও টেরই পাবেনা। আরাদ পেতে দিবেনা। টিপের জন্য সাচী কষ্ট পাচ্ছে,নিজেকে অপরাধী ভাবছে। কিন্তু যদি আরাদের মনের অনুভূতি সে জানতো,তবে তাহলেও কি নিজেকে অপরাধী ভাবতো?
নাকি আবারও আরাদের গালে কষে কয়টা বসাতো!
.
রাত বারোটার সময় টিভিতে চ্যানেল পাল্টাচ্ছিলো অযথাই,কিন্তু মূলত কিছুই দেখছিলো না আরাদ। সহসা দেখতে পেলো সবগুলো চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে।
চোখে হালকা ঘুম ঘুম ভাব এসে গিয়েছিলো। তাই শিরোনামটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো না। চোখ কঁচলে ভালো করে দেখতে লাগলো। নেপাল থেকে ইন্ডিয়াগামী একটি বিমান মুম্বাই এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে গিয়ে, বৈরি আবহাওয়ার কারনে ক্রেশ করেছে। হতাহতের খবর এখনো পাওয়া যায় নি,তবে পুরো বিমানটাতেই আগুন লেগে গেছে,এবং পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।
কোন যাত্রীর বাঁচার সম্ভাবনা একেবারেই কম। একমাত্র উপর-ওয়ালা অলৌকিকভাবে যদি কাউকে বাঁচাতে পারেন।
নিউজটা দেখে আরাদের বেশ খারাপ লাগলো। ইদানিং প্রায়ই বিমান দুর্ঘটনা হচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সে। ঘুম ভাঙলো সকালে ফোনের বিকট শব্দে। সে ফোন সাইলেন্ট করে রাখে না কখনো। ঘুম ঘুম চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে,ত্রিশটা মিসডকল। এবার সে দপ করে উঠে বসলো। তাড়াতাড়ি লক খুলে নাম্বারটা দেখলো। নাম্বারটা দেখে মনে কেমন কূ ডাকতে লাগলো। কাছের কোন মানুষের বিপদ,তার প্রিয়জনরা ঠিকই টের পায়। গতকাল রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি সে। অবশ্য বিগত একমাস ধরেই ওর চোখে ঘুম নেই। মাঝে মাঝে ঘুমের ট্যাবলেটও খেতে হয়।
মানুষের মন শরীরের উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করে,সেটা আরাদ এখন বেশ বুঝতে পারছে।
তড়িঘড়ি করে নাম্বারটা ডায়াল করলো সে। কিন্তু বিজি দেখাচ্ছে। একসময় ওপাশ থেকেই আবার কল আসলো।
আরাদ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোনটা রিসিভ করলো। বুকের ভেতর ঢিব ঢিব করছে। আর সেটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
ফোনের ওপাশ থেকে শুধু একটা কথা আর বিলাপ শুনতে পেলো সে। মুহুর্তেই ওর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেলো পুরো। একসময় দপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো সে। চোখদুটো জ্বলছে। মাথাটা ভীষণ ভারী লাগছে। গলাটা ধরে আসছে। ভেতরটা ভেঙে চুরে যাচ্ছে। কখনো কখনো আমরা ভাবি,তার জন্য আমাদের মনে কোন অনুভূতি নেই। অথচ কাছের মানুষদের কখনোই আমরা মন থেকে সরাতে পারিনা,পারবোও না। মনের অতলে তাদের জন্য রাখা অনুভূতিগুলো, হয়তো ক্ষণিকের জন্য চাপা পড়ে থাকে। কিন্তু একসময় ঠিকই অনুভূতিরা দপ করে জ্বলে ওঠে। তখন সব অভিমান ম্লান হয়ে যায়।
বিছানা হাতড়ে আবার ফোনটা হাতে নিলো সে। কাঁপাকাঁপা হাতে আবার কল দিলো। একসময় ফোনের দুপাশে দুজন ব্যাক্তি নীরব কান্নায় ভেঙে পড়লো। গুমড়ে ওঠা কান্না। যে কান্নার কোন আওয়াজ নেই। আছে শুধু বুকভাঙা হাহাকার। কেউ কোন কথা বলতে পারলনা,কেবল ফোনের দুপাশে দুজন দুজনের বুকের ছাঁইছাপা কষ্টটা গুনে চলেছে।
কখনো কখনো আমরা নিজেদের ভুল বুঝতে,খুব বেশি দেরি করে ফেলি। এতোটা দেরি যে,হয়তো তখন আমাদের হাতে কিছুই করার থাকেনা। খুব কাছের কেউ হারানোর ব্যথা, মানুষ সহজে সইতে পারেনা। এতোটা ধৈর্য আল্লাহ মানুষকে দেন নি!
#চলবে…
গল্পতো প্রায় শেষের দিকে। এখনতো অন্তত ঘুমন্ত পাঠকরা মতামত জানান।?