যখন_তুমি_এলে পর্ব: ৪২।

0
543

#যখন_তুমি_এলে
লেখা: জাহান লিমু
পর্ব: ৪২।

সাচী!
আরাদের মনে হলো, আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বজ্রপাত হচ্ছে। আর সেই শব্দ কেবল, আরাদের কানেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

সাচী, সাফুয়ানের ক্রাশ! লাইক সিরিয়াসলি?
এটাও দেখার বাকী ছিলো?
আরাদ এবার জোরে হেসে দিলো। তবে সাফুয়ানের গম্ভীর মুখ দেখে, পরক্ষণেই নিজের হাসিকে মনে মনে বোম মেরে উড়িয়ে দিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললো,

” সে তো তোমার অনেক বড়,প্রায় দশ বছর প্লাস বয়স বেশি তোমার চেয়ে। সে ক্রাশ কি করে হয়?”

হয়, হয়। তুমি বুঝবেনা। নিক জোনাসও তো, প্রিয়াংকা চোপড়ার থেকে দশবছরের ছোট।
তাতে কি?
সাফুয়ান কেমন একটা অদ্ভুত এটিচিউড নিলো এটা বলে। যেটা আরাদের পেটের হাসির দরজাগুলোকে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো। তবুও সে হাসি আঁটকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টায় নিয়োজিত রইলো।
সাফুয়ান তখন বলতে লাগলো,
” আমাদের দুজনের নামও কত মিল দেখেছো? দুজনের নামই ‘এস’ দিয়ে শুরু। আবার আমারটা চার অক্ষরের,ওরটা দুই অক্ষরের। মানে দুজনের নামই জোড় শব্দে। আর ঐ ব্যাটার নাম কি?
তুহিন, না তুফান কি যেন। এটা কোন নাম হলো?”

সাফুয়ানের যুক্তি শুনে,আরাদ ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল। ওর না হাসতে মন চাইছে,না কাঁদতে মন চাইছে এখন। এইমুহুর্তে ওর নিজেকে গর্ধভ মনে হচ্ছে। জীবনে এসবও দেখতে হলো!
সাফুয়ান তখনো তার যুক্তির জাহাজ টু বি কনটিনিউ রেখেছে।
শুধু ফর্সা হলেই, হলো নাকি? সাদা তো মূলাও হয়। তাই বলে কি মূলার দাম বেশি? সবাই মূলা পছন্দ করে? করে না তো।
আর কি রেডিওতে গিয়ে পটর পটর করে। এসব করে বউ পালতে পারবে নাকি?

আরাদ বহুকষ্টে সাফুয়ানের কথা শুনে নিজের মুখে দুঃখী ভাব আনার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মূলত তার পেট ফেটে হাসি আসছে।
সাফুয়ান আরো বলতে লাগলো,
ওর কঙ্গোনা রণৌত এর মত কার্লি চুল দেখেই তো আমি ক্রাশ খেয়েছিলাম। এখন দেখো,ঐ তুফানের কথায় চুলগুলো কোকোলা নুডলসের মতো সোজা করে ফেলেছে। কিন্তু আমারতো ম্যাগী নুডলসের মত চুলগুলোই পছন্দ ছিলো। সাফুয়ান ভীষণ কষ্ট পেয়েছে,এমন ভাব করে কথাগুলো বলে চলেছে।
আরাদ বহুকষ্টে হাসি দমন করে,সাফুয়ানের সব কথা উপেক্ষা করে, পাল্টা প্রশ্ন করলো,

” তুমি কি করে জানলে,তুহিনের কথায় চুল সোজা করেছে?”

আমি ঐ তুফানকে বলতে শুনেছি। সে বলছে,আমি বলেছিলাম না, তোমাকে চুল সোজা করলে, আরো বেশি সুন্দর লাগবে। আরাদ এবার বিষয়টা বুঝতে পারলো।
তাই সে সাফুয়ানকে বললো,

” কিন্তু তুহিন তো ঠিকই বলেছে। সোজা চুলে সুন্দরই লাগছে তোমার ক্রাশ কে।”

আরাদের কথা শুনে, কেমন চোখে যেন সাফুয়ান তাকালো।অতঃপর মনে দুঃখ আর একরাশ বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো সে।
আরাদ মনে মনে ভাবলো,বেচারা এ বয়সেই ছ্যাঁকা খেলো! সাথে সাথেই আনমনে হেসে উঠলো সে।
কত বিচিত্র মানুষের মন। এতটুকু ছেলে,কিইবা বুঝে। অথচ কতকিছু বলে গেলো সে। অতটুকু হয়তো আরাদ নিজেও জানেনা। আজকালের আপডেট পোলাপান।
সাফুয়ানকে খুঁজতে খুঁজতে স্মরণিকা এদিকে এসে আরাদকে জিজ্ঞেস করলো, সে দেখেছে কিনা। তখন আরাদ যেটা বললো,সেটা শুনে স্মরণিকা চোখমুখ কুঁচকে তাকালো।
আরাদ বললো,

” জুনিয়র বাপ্পারাজ কিছুক্ষণ আগে এখানেই ছিলো। এখন কোথাও বসে হয়তো সেই বিখ্যাত গানটা গাইতে গেছে।
প্রেমের সমাধি ভেঙে, মনের শিকল ছিঁড়ে
পাখি যায় উড়ে যায়…

স্মরণিকার মনে হলো আরাদের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কিসব বলছে,জুনিয়র বাপ্পারাজ,প্রেম,সমাধি,শিকল!
স্মরণিকা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আরাদের দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। আরাদও আর কিছু বললোনা। হাসতে লাগলো।
ঠিক সেইমুহুর্তে দরজার দিকে চোখ যেতেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরাদ। যেন চোখের পলক ফেললেই,গোস্তাকি হয়ে যাবে। সাচী আঞ্জুমানকে ধরে ছাদে নিয়ে আসছে। দাদী এতোক্ষণ রুমেই ছিলো। বলেছিলো অনুষ্ঠান শুরু হলে তাকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু আরাদ যাওয়ার আগেই,সাচী নিয়ে আসলো। যদিও গান-বাজনার মধ্যে হয়তো উনি বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। তবুও বুড়ির শখ আছে ভালো। আরাদ বিড়বিড় করে বলতে লাগলো। ওরা বোধহয় আরাদকে দেখতে পেলো না। মোটামুটি মানুষের ভিড় হয়ে গেছে।
ছাদটা মোটামুটি বড় আছে। চতুর্ভুজ আকৃতির। তাই লম্বা বেশি
আরাদ সবার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলো।
সহসা সেখানে একটা মেয়ে এসে আরাদের প্রশংসা করতে লাগলো। যদিও আরাদ তাকে চিনেই না। কোনদিন দেখেছে বলেও,মনে হয়না। তবুও ভদ্রতার খাতিরে হাস্যমুখে জবাব দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আরাদ বুঝলো,মেয়েটা সাচীর ফ্রেন্ড। সাচী হয়তো শর্টফিল্মের কোন ক্লিপ আপলোড করেছে,আর সেটাই দেখেছে এই মেয়ে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর,মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো। আরাদ অবশ্য তাতে খুব একটা অবাক হলো না। বরং চলে যাওয়াতেই হাঁফ ছাড়লো। মেয়েদের সাথে কথা বলতেই তার হেজিটেট লাগে। প্রথম রোহানী এবং দ্বিতীয় সাচী এই দুজনের সাথেই হয়তো কথা বলেছে ঠিকঠাক। প্রথমজন বেস্টফ্রেন্ড,দ্বিতীয়জন…!
আরাদের ভাবনায় আঘাত হানে সামনের বক্স থেকে ভেসে আসা মিউজিকটা। তবে তার চেয়েও বেশি অবাক হয় লাল শাড়ি আর সোনালি চুলের সাচীকে দেখে। সাচী চুলগুলোও কালার করেছে?
এটাও হয়তো তুহিনের ইচ্ছেতেই। আরাদ ম্লান হাসলো। ভালোবাসার মানুষের আবদার পূরণ করাতেও , হয়তো ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।
তখন সহসা আরাদের কি হলো কে জানে। কোন দমকা হাওয়া বইলোনা,পাতারা উড়ে গেলো না। উড়ে গেলো কেবল কারো মন! অপরাধী মন!
নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে একটু একটু করে স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো আরাদ। তখন গান চলছে,সাচী,স্মরণিকা আরো বেশ কয়েকজন মেয়ে নাইনটিজের সেই বিখ্যাত গানের ছন্দে নাচতে লাগলো। যদিও গানটা খুব ধুমধাড়াক্কা নাচের নয়। কিন্তু কথাগুলো আর সুর, হৃদয় স্পর্শ করে যায়। মৃদু তালে নাচার জন্য পারফেক্ট। আরাদের অনেক প্রিয় একটা গান। মিউজিকটা বাজার সাথে সাথে সব শোরগোল থেমে গেলো। সবাই গানের সুরে আর নাচে ডুবে রইলো।

Chhoti chhoti raatein,
Lambi ho jaati hai,
Baithe bithaaye yunhi
Neendein kho jaata hain,
Dil mein bechaini..
Aankhon mein intezaar hota hai…
Jab kisi kho,kisi se pyaar hota hai.

Deewanon si halat hai apni,
Poochho na kya chaahat hai apni,
Thaam li maine teri yeh baahein,
In baahon mein jannat hai apni,
Phool sa khilke, meheka hai yeh dil
Phir tujhe chhooke, baheka hai yeh dil,
Dil ka kya hai,
Yeh tho har pal beqaraar hota hai,
Jab kisi kho,kisi se pyaar hota hai.

Paanchi banke udta hai yeh dil,
Milti hai jab sapnon ki manzil
Sapne to phir sapne hote hain
Sach hai yeh kab, apne hote hai,
Jaagti aankhen
Dekha kare sapna,
Jab koi dilko, lagta hai apna
Na dil pe qaabu,
Na khud pe ikhtiyaar hota hai,
Jab kisi kho,kisi se pyaar hota hai… (2)
Chhoti chhoti raatein
Lambi ho jaati hain…..

আরাদ একদম স্টেজের কাছাকাছি চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু ওর সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। যেন সে রোবট,কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণ অন্য কারো কাছে। সে তো কল্পনায় বিভোর তখন। মনের গহীন চরের লুক্কায়িত প্রজাপতিরা, বাঁধনহারা হয়ে ছুটোছুটি করছে অনবরত। যার উপর আরাদের কোন হস্তক্ষেপ নেই।
ভিড়ের মধ্যেই একেবারে সাচীর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো সে। নাচের মধ্যে সহসাই থেমে গেলো সাচী। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো আরাদের দিকে। কিন্তু আরাদ!
সে তো তখন হাওয়ায় ভাসছে।
সে সাচীর গাঢ় কাজলে ঢাকা ধূসর চোখ,বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা নাক,চিবুক,কপালের চিকচিক করা টিকলির লাল পাথর, এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা চুল, সর্বোপরি সাচীতে ডুবে আছে। সাচী হাত নেড়ে বারবার কথা বলে চলেছে। কিন্তু সেসব আরাদের কর্ণকুহরে বিন্দুমাত্রও আঘাত হানলো বলে মনে হলো না। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে,একমুঠো অন্যায় ভালোবাসার দাবী নিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো, উদ্ভাস্তুু পথিকের ন্যায়। কোন কথা নেই মুখে। শব্দরা নিশ্চুপ আজ। যে ভালোবাসার দাবী নিয়ে, সে কোনদিনও সাচীর মুখোমুখি হতে পারবেনা। শুধু দূর থেকে সেই ভালোবাসার ব্যাথা বয়ে বেড়াতে পারবে। সাচী কি আরাদের সেই অব্যক্ত চোখের চাহনি বুঝতে পারবে কখনো?

সহসা একটা চেয়ারে ধাক্কা খেয়ে,আরাদের হুঁশ ফিরলো। সে ঘামতে লাগলো অনবরত। কি সব ভাবছিলো সে?
আর সাচী কোথায়? এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলো সে।
বামহাত দিয়ে কপালের ঘাম মুঁছতে মুঁছতে, সামনে তাকাতে নিলো। কিন্তু সাচীকে তো দেখা যাচ্ছে না।
আচমকা খেয়াল করলো, তুহিন ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটুর জন্য তুহিনের সাথে ধাক্কা লাগেনি ওর। শরীরটা কেমন ঝিম মেরে উঠলো। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো।
আরাদ তৎক্ষনাৎ ঘোর থেকে বের হয়ে, বিষাদ চোখে এক পা এক পা করে আবার পেছাতে লাগলো।
কি করতে যাচ্ছিলো সে?
কোথায় যাচ্ছিলো?
নিজের আচরণে নিজেই হতবিহ্বল হয়ে পড়লো সে।
এমনতো কখনো হয়নি?
নিজের উপর তো সে কখনো নিয়ন্ত্রণ হারায় নি?
কি হচ্ছে ওর সাথে!
সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগছে। যেন মুহুর্তেই ভয়াল কোন ঝড় এসে, ভেতরটা চুরমার করে দিয়ে গেলো। আর কেড়ে নিয়ে গেলো নিজের সর্বস্ব,নিজের তপ্ত হৃদয়। শূণ্য করে রেখে গেলো নিজেকে। নিজের অস্তিত্বকে।

সবার থেকে দূরে গিয়ে, ছাদের এক কোণায় উদভ্রান্তের মতো বসে পড়লো সে। কোন কথা বলার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। আবেগগুলো গলায় আঁটকে আসছে যেন। চোখগুলো ভীষণ জ্বলছে। অসহ্য লাগছে সব। যেন আরাদের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে ক্রমশ।
নাহ,সে এ সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিবে। নিতেই হবে। কোন মানে হয় না,এসব অবান্তর ভাবনার।
হ্যাঁ,ও যা ভাবছে,সেটা অবান্তরই। শুধু অবান্তর নয়,এটা অপরাধ। মারাত্মক অপরাধ!
কেউ কাউকে ভালোবাসে,সেটা জেনেও তার জন্য মনে বিশেষ অনুভূতির ঝড় ওঠা,এটা অপরাধ বৈ আর কিছু নয়।
আর সে কখনোই এমন করতে পারেনা।
আচ্ছা, অনুভূতিকে বন্দি করার জন্য, কোন তালা,খাঁচা নেই কেন?
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত খাঁচা,তালা তো অনুভূতিকে বন্দি করার জন্য বানানো প্রয়োজন। যেন সে খাঁচা ভেঙে, কোন অন্যায় আবদার না করতে পারে।
সে তো অনুভূতিহীন হয়েই বাঁচতে চায়।
তবে কেন অনুভূতিরা শঠতা করছে তার সনে!
কেন সে পিঞ্জিরা ভেঙ্গে উড়াল দিতে চাইছে?
কেন! কেন! কেন!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here