#যখন_তুমি_এলে
লেখা: জাহান লিমু।
পর্ব: ৩৭।
পরেরদিন।
একটু ছাদে আসতে পারবেন কাইন্ডলি?
মেসেজটা সন্ধ্যা থেকে বেশ কয়েকবার পড়েছে বিরুনিকা। মেসেজটা পড়ার পর থেকেই একটা অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। বারবার নামটা চেক করছে,যে মেসেজটা কুনোব্যাঙই পাঠিয়েছে কিনা। সায়াহ্নর নাম্বার বিরুনিকা ‘আমার কুনোব্যাঙ’ লিখে সেইভ করে রেখেছে।
কেন যেতে বলেছে? কি বলবে? রাতে কেন? এসব হাজারটা প্রশ্ন বিরুনিকার মন অশান্ত করে তুলেছে। ব্যালকুনি জুড়ে সে অনবরত পায়চারি করছে । স্মরণিকা বারবার জিজ্ঞেস করছে,কি হয়েছে? কোন সমস্যা কিনা। বিরুনিকা কোন কথায় বলছেনা। একপর্যায়ে স্মরণিকা বিরক্ত হয়ে বললো,
” তোমার কি রাদ ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
কথাটা শুনে চমকে তাকালো বিরুনিকা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। এখন কিছু বলা যাবে না। যা বলার, আরাদই বলবে। তাই স্মরণিকাকে পাশ কাটিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। যেন আর কোন প্রশ্নের সম্মুখীন না হতে হয়। কিন্তু সেখানেও সে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মেসেজটা দেখে চলেছে। আর ভাবছে,সে কি আরেকটা মেসেজ করে কারন জানতে চাইবে?
না,না!
তার পুরোপুরি ভরসা আছে সায়াহ্নর প্রতি। সে ভরসা থেকেই সাহস করে চলে গেলো। তবে জানেনা কি ঘটতে চলেছে সেখানে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সেটা ঠিক কিসের,তা ঠাহর করতে পারছেনা। কেন ডেকেছে কুনোব্যাঙ?
কি বলতে চায়?
বুঝতেই চায় না আমাকে। স্পষ্ট অবহেলা করে। আর আমার বেহায়া মন তবুও তাকেই চায়। কাউকে ভালোবাসলেই কি, এমন বেহায়ায় হয়ে যায় মানুষ?
.
” এইযে রাত-বিরাতে আমার সাথে কথা বলছেন,আপনার লাভার ওয়েটিং-এ পেলে তো সমস্যা।”
মাত্র সাতটা বাজে। এটা রাত-বিরাত কোন এঙ্গেল থেকে? মাত্র সন্ধ্যা। আর তাছাড়া, ওয়েটিং পেলেই সমস্যা হবে কেন? এতো সন্দেহ করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। আর তুহিন এমন নয়।
সাচীর কথায় আরাদ ফোনের ওপাশ থেকে নিঃশব্দে হাসলো। মেয়েটা বুদ্ধিমতী হলেও, আসলে সরল। প্রচুর বিশ্বাস করে তুহিনকে। অথচ কোন ছেলেই তার গার্লফ্রেন্ড কে অন্য কোন ছেলের সাথে কথা বললে,সেটা মেনে নিতে চাইবেনা। কেউ সেটা প্রকাশ করে,কেউ করেনা। কেউ সন্দেহ করে,কেউ সন্দেহ না করার ভান করে।
“হ্যালো,কোথায় হারালেন?”
” হুম,বলুন। শুনছি।”
দ্রুত এসে পড়ুন এবার। না হলে ট্রেইলার মিস করে যাবেন। সাচীর কথা শুনে আরাদ হাসলো।
সাচীও হেসে ফোন রেখে দিলো। তবে দুজনেরই সে হাসির আড়ালে কিছু একটা ছিলো বোধহয়। কিংবা হয়তো নেই!
সাচী ফোন রাখার সাথে সাথে রোহানী ফোন দিলো। রোহানী ক্ষেপে বললো,
” কি রে প্রেমটেম করছিস নাকি? ফোন এতোক্ষণ ধরে বিজি কেন?”
রোহানীর কথা শুনে আরাদ অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো। সেটা দেখে রোহানীর গা জ্বলে গেলো। হাসি থামিয়ে আরাদ বললো,
” হ্যাঁ,করছিতো। দিপিকা পাডুকোনের সাথে!”
রোহানী আরাদকে একটা ধমক দিলো জোরে। আরাদ ভয় পেয়েছে,এমন ভাব করে চুপসে গেলো।
ওপাশ থেকে রোহানীর গম্ভীর আওয়াজ ভেসে আসলো।
সত্যি করে বলতো, “তুই প্রেমে পড়িস নি?”
” কার? আরাদের শীতল কন্ঠ।”
” সাচীর! রোহানী সরাসরি বোম ফাটিয়ে দিলো।”
ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা। সেটা রোহানীকে আরো উদ্বিগ্ন করে তুললো। সে মনে মনে এই ভয়টাই করছিলো। সে আকাশ-পাতাল ভাবনা ভেবে ফেললো। দরকার পড়লে সে বন্ধুর জন্য, আবার ওদের ব্রেকআপ করিয়ে দিবে। আগে আরাদ করেছিলো,কোন কারন ছাড়াই। এবার রোহানী করবে, নিজের বন্ধুর জন্য। আরাদ ওর ভালোবাসাকে এনে দিয়েছে সেজন্য নয়,বন্ধুত্বের দাবীতে করবে। রোহানীর ভাবনারা ফুঁস হয়ে গেলো,যখন আবার আরাদের অট্রহাসির শব্দ শুনতে পেলো। ছেলেটা এমন অদ্ভুত কেন!
রোহানী বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিলো। এমনিই মায়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। এদিকে আরাদের বিষয়টাও ওকে বেশ ভাবাচ্ছে। ছেলেটা নিজেই হয়তো বুঝতে পারছেনা,নিজের অনুভূতি। আর বুঝার চেষ্টাটাই বা করে কখন! রোহানীর মাথা কাজ করছেনা। আরাদ আবার ফোন দিলো।
” আন্টির কি অবস্থা এখন মুটি?”
আরাদ এখনো আগের নামগুলোই ডাকে রোহানীকে। রোহানীও হাল ছেড়ে দিয়েছে। জানে কোন লাভ নেই।
রোহানী জবাব দিলো,
” ভালো না রে। এখনো সেন্স আসেনি। আমি এখন হাসপাতালেই যাবো। তুই আজকে আসবি?”
” না রে,আজকে আসতে পারবোনা। একটা জরুরী কাজ আছে।”
রোহানী আর ঘাটালো না বিষয়টা। ওরও সময় নেই হাতে। তানিম এসে পড়বে এখনি।
.
ছাদের দরজাটার কাছে দাঁড়িয়ে বিরুনিকার শরীর কাঁপতে লাগলো অনবরত। আরেকবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো,কেউ এদিকে আসছে কিনা। ওর মায়ের আসার সময় হয়ে গেছে প্রায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো এসে যাবে। তখন বিরুনিকাকে রুমে না দেখতে পেয়ে যদি ছাদে চলে আসে,তাহলে সর্বনাশ!
সেসব ভেবেই বিরুনিকার গলা শুকিয়ে আসছে। একবার ভাবলো চলে যাবে। পরক্ষণেই মত পাল্টালো। কি জন্যে ডেকেছে ,সেটা অন্তত শুনে যাক। এক কদম ছাদের দিকে আগায় সে,দুইকদম সিঁড়ির দিকে পেঁছায়। একপর্যায়ে সিঁড়ির উপরই বসে পড়লো। কতক্ষণ চোখ বুজে বসে রইলো। নিজেকে নিজে সাহস দিতে লাগলো।
বিরু ইউ লাভ কুনোব্যাঙ, সো ইউ মাস্ট ট্রাস্ট অন হিম। জাস্ট গো….!
নিজেই নিজেকে ধাক্কা দেয়ার মত করে, ছাদের দরজা খুলে প্রবেশ করলো সে। কিন্তু সেখানের দৃশ্য দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা!
ধীর পায়ে সামনে এগুতে লাগলো। ছাদটাতে ছোটবড় বেশ ভালোই গাছ আছে। সেই সবগুলো গাছে লাল,নীল,সবুজ মরিচবাতি জ্বলছে। আবার কিছু কিছু লাইট প্রজাপতির মত দেখতে। সে লাইটগুলো ফুল গাছগুলোর উপর বসানো হয়েছে আবার। ডালিয়া,চন্দ্রমল্লিকা,রঙ্গন, গোলাপের ফুলগুলোর উপর যেন রঙ্গিন প্রজাপতি বসে আছে। পুরো পরিবেশটা কেমন মোহময় লাগছে। আজ বোধহয় অমাবস্যা। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিরুনিকা প্রবেশ করার সাথে সাথেই লাইটগুলো জ্বলে উঠে। পায়ের নিচে তাকিয়ে দেখে লাল গোলাপের আস্তরণ। কি হচ্ছে এখানে!
কারো জন্মদিন কি আজকে?
এটা ভাবতেই বিরুনিকার মনে হলো,আজকে তো কুনোব্যাঙরই জন্মদিন ছিলো!
এটা সে কি করে ভুলে গেলো!
বিরুনিকা উইশ পর্যন্ত করেনি। এজন্যই কি সায়াহ্ন ডেকেছে?
কিন্তু একা ডাকবে কেন?
আর জন্মদিন সেলিব্রেট করার হলে,আর মানুষ কোথায়?
হাজারটা প্রশ্ন যখন বিরুনিকার মাথায় ঘুরছে,তখন আচমকা লাইটগুলো সব নিভে গেলো। সাথে সাথেই দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনতে পেলো বিরুনিকা। ভয়ে আঁতকে উঠলো সে!
অন্ধকারে দরজার দিকে ছুটে যেতে নিলে,দরজার কাছে কারো বাহুতে আবদ্ধ হয়ে যায় সে। শরীর কেঁপে উঠে পুরো!
চিৎকার দিতে যাবে,তার আগেই সেই ব্যক্তির কন্ঠ ভেসে আসে কানে। একদম কানের কাছে গিয়ে বলে উঠে,
” কুনোব্যাঙ! তোমার কুনোব্যাঙ। ”
সায়াহ্নর বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে, চোখ বড় বড় করে তাকালো বিরুনিকা। যদিও সেটা সায়াহ্ন দেখতে পেলো না। কিন্তু বিরুনিকা সব ভুলে এখন অন্য ভাবনায় ডুবে গেছে। সায়াহ্ন কি বললো এটা?
” তোমার কুনোব্যাঙ! কথাটা বিরুনিকার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। হৃদয় শীতল করা কথা। যে কথা শুনার জন্য চাতক পাখির ন্যায়, ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেছে সে। সে কি ভুল শুনেছে? একরকম ঘোরে চলে গেছে বিরুনিকা। তার এটাও খেয়াল নেই যে,সে যে সায়াহ্নকে কুনোব্যাঙ ডাকে, সেটা সায়াহ্ন জানলো কি করে?
সায়াহ্ন মুচকি হেসে চলেছে। লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে আবার। সায়াহ্নকে দেখে বিরুনিকা আরেকদফা ঘোরে পড়ে গেলো। বিরুনিকার অবস্থা দেখে,সায়াহ্নর বেশ লাগছে। বেচারী বোধহয় ভাবতেও পারছেনা,এখানে কি ঘটতে চলেছে।
বিরুনিকার কানের কাছে গিয়ে বললো,
” আমার শুধু দুইটা জামায় নয়,আরো আছে। এটা বলেই কানের থেকে মুখ সরিয়ে নিলো। আবার বলতে লাগলো,
তবে ঐ দুইটা রঙ পরতেই আমার ভালো লাগে। তবে আজকের দিনটা একটু স্পেশাল। তাই ভাবলাম,ভিন্ন কোন রঙ পরি। কিছু কিছু মানুষের আমার শুধু এই দুই রংয়ের কাপড় পরা নিয়ে,সমস্যা আছে। কথাটা যে বিরুনিকাকেই বলেছে,সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিরুনিকা রোবটের মত দাঁড়িয়ে আছে। কোন কথাও বলছেনা। সায়াহ্নর দিকে আজ তাকাতেও পারছেনা বেচারী। একবার তাকিয়েছিলো কেবল। কিন্তু ঐ চোখে আজ সে অন্যকিছুই দেখতে পাচ্ছে। আর সেটা বিরুনিকার ভেতর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এই দৃষ্টির কুনোব্যাঙকে বিরুনিকা চিনেনা। বড্ড ভয়ংকর লাগছে। তবে ভয় করছেনা। মানুষটা যে নিজের মানুষ। সে মানুক,আর নাই মানুক!
” ভালোবাসি,ভালোবাসতাম আর ভালোবাসতে চাই। একটা সুযোগ দেয়া যায় না কি আমায়? একটা সুযোগ?”
সায়াহ্ন বিরুনিকার সামনে হাঁটুঘেরে বসে এসব বলে চলেছে। লাইট এখনো নেভানো,তাই কেউ কারো মুখ দেখতে পারছেনা। অন্ধকারে প্রপোজ!
বিরুনিকা বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। চারদিকে কেমন অন্ধকার,ভুতুড়ে স্বপ্ন দেখছে বোধহয়। একটু পর সামনের মানুষটা ভূত হয়ে বিরুনিকার ঘাড় মটকে দিবে বোধহয়। ম্যাসেজটাও বোধহয় ভূতেই পাঠিয়েছে। সায়াহ্ন কোন দুঃখে এই মেসেজ দিতে যাবে। ব্যাটাকে কি সাপে কামড়িয়েছে!
দেখুন,আমি জানি আপনি আমার কুনোব্যাঙ নয়। আপনি ভূত। আমার কুনোব্যাঙকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন বলুন জলদি।
বিরুনিকার এমন ধরনের কথা শুনে সায়াহ্নর পিলে চমকে যাবার যোগাড়! এই মেয়ের উদ্ভট কথা বলার স্বভাবটা এখনো গেলো না দেখছি। আমি নাকি ভূত!
আর সে ভূতের সামনে দাঁড়িয়ে এতো সুন্দর করে কথা বলছে।
হাউ কিউট!
এই ইডিয়ট মেয়েটাকে তুই কি করে ভালোবাসলি সায়াহ্ন?
স্টুপিড একটা!
যেখানে স্কুল,কলেজ লাইফে আরো স্মার্ট,ইন্টেলিজেন্ট মেয়েও তোর পিছনে মরেছে প্রতিনিয়ত। আর তুই কিনা শেষে এই স্টুপিড মেয়েতে আঁটকে গেলি?
একটা কষিয়ে থাপ্পড় দিয়ে বিরুনিকার মাথা থেকে ভূত সরিয়ে দিতে মন চাইছিলো। কিন্তু নাহ! অনেক কষ্টে রোমান্টিক মুডে সে নিজেকে এনেছে। কিন্তু এই মেয়েতো উদ্ভট কথাবার্তা বলে, মুডের চব্বিশটা বাজিয়ে দিচ্ছে। কুল সায়াহ্ন কুল!
আজকে তোর মুড যে করেই হোক,কুল রাখতে হবে। এই ইডিয়ট যা বলার বলুক। সায়াহ্ন লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিলো আবার। একদম বিরুনিকার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর বললো,
” আমাকে কোন এঙ্গেল থেকে তোমার ভূত মনে হচ্ছে? কালো স্যুট পরেছি বলে?”
সায়াহ্নকে অবাক করে দিয়ে, বিরুনিকা একটা ভয়ংকর কাজ করে বসলো। সায়াহ্নর হাতে আচমকা চিমটি কেটে বসলো। সায়াহ্ন পুরো বোকা বনে গেলো। সে কাকে কি বলছে?
অনেকটা এমন,আমি কি বলি,আমার সারিন্দা কি বাজায়!
এবার আর সায়াহ্ন নিজের মুড ধরে রাখতে পারলোনা। কোনকিছু না ভেবেই, একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো বিরুনিকার গালে। এবার বিরুনিকা হতভম্ব হয়ে গেলো!
গালে হাত ধরে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, এটা কুনোব্যাঙই তাহলে!
প্রপোজ করছে,তাও থাপ্পড় মেরে! হোয়াটা অ্যা ইউনিক প্রপোজ স্টাইল!
কুনোব্যাঙ কি নেশা করেছে?
মাথা খারাপ হয়ে যায় নি তো উনার?
জিজ্ঞেস করবে কি সে?
সাহস করে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করেই ফেললো বিরুনিকা। কিন্তু সায়াহ্নর উত্তর শুনে সে এবার, একেবারে চুপসে গেলো। লজ্জায় তাকাতে পর্যন্ত পারছেনা।
বিরুনিকার প্রশ্নের জবাবে সায়াহ্ন বললো,
” নেশা করিনি। তবে করতে চাই। তুমি কি আমার নেশার কারন হবে? আমি তোমাতেই ডুববো,তোমাতেই ভাসবো। নিজেকে বিলীন করে দিবো তোমাতে। আর আমার অস্তিত্বে মিশে রবে শুধু তুমি।”
কথাগুলো শুনে বিরুনিকার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেলো। মন চাইছে এখান থেকে দৌঁড়ে পালাতে। কিন্তু পা গুলো বড্ড অবাধ্য, স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
পা দুটিকে মনে মনে ভয়ংকর গালি দিলো সে।
সায়াহ্ন হেসে বিরুনিকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ওদের ঠিক সামনেই ছাদের দরজার পাশের দেয়ালটাতে একটা আয়না আছে। ওদের দুজনকে সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিরুনিকা খেয়াল করেনি অবশ্য। আবছা আলোতে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। এবার আয়নার পাশের ড্রিমলাইট দুটো জ্বালিয়ে দিলো। এতে দুজনকে মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। সায়াহ্ন বিরুনিকার বাহু ধরে আয়নার কাছাকাছি নিয়ে গেলো। ঐখানেও ঝুলে রয়েছে বিভিন্ন অর্কিডের টব। এগুলো রাখার ব্যবস্থা,সাচী কাঠমিস্ত্রী ডেকে করেছে। ড্রিমলাইট আর মরিচবাতির আলোতে পার্পল আর ব্লু রংয়ের অর্কিডগুলো এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছে।
বিরুনিকার পেছনে দাঁড়িয়ে সায়াহ্ন বলতে লাগলো,
” কেন যেন বেশি আলো আমার ভালো লাগে না। হয়তো অন্ধকারে থেকে অভ্যাস, তাই। হয়তো নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রাখতে ভালোবাসি, তাই। এটার বিশেষ কোন কারন নেই। জাস্ট আমার এভাবেই থাকতে ভালো লাগে। এতো কোলাহল আমার সহ্য হয় না। নীরবতা ভালোবাসি। শান্ত নদীর মতো বয়ে যাক না জীবন।
সেই জীবনের সঙ্গী হবে কি তুমি?
বিরুনিকার কাঁপাকাঁপি দ্বিগুণ হয়ে গেছে এবার। সে চোখ বন্ধ করে বারবার বিড়বিড় করে বলছে,
এটা যেন স্বপ্ন না হয়,এটা যেন স্বপ্ন না হয়!
সায়াহ্ন সেটা ঝাঁপসা বুঝতে পারলো। আর মনে মনে বললো, বুঝেছি। এবার এমন কিছু করতে হবে,যেন তোমার এই উদ্ভট ভাবনাগুলো থামে। অনেক হয়েছে,আর না। এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে। সায়াহ্ন আচমকা বিরুনিকার বাহু দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। থরথর করে কাঁপতে লাগলো বিরুনিকা। সায়াহ্ন সেসবে পাত্তা না দিয়ে বিরুনিকার মুখের দিকে এগুতে লাগলো। বিরুনিকা অত্যাশ্চর্য হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তবে সায়াহ্ন কোন অসভ্যতামি করলো না। সে কানে কানে বিরুনিকাকে বললো,
” বারবার প্রশ্ন করতে না,প্রজাপতি কোথায় থাকে? ওদের বাসা আছে কিনা? তাহলে শোন। প্রজাপতি কোথায় থাকে,তা আমার জানা নেই। তবে অন্য একটা প্রজাপতির কথা জানি। যার বসবাস সবার বুকের বা-পাশে। যে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকে সেখানে। কিন্তু কেউ কাউকে ভালোবাসলে, সে প্রজাপতি তার ডানা ঝাপ্টে জানান দেয়,সে ব্যক্তি প্রেমে পড়েছে। তখন তাকে বন্দি করে রাখা যায় না। সে উড়ে উড়ে কেবল তার কাছে ছুটে যেতে চায়,যেখানে তার সঙ্গী আছে। তার ভালোবাসার কাছে।
তুমি কি আমার বুকের বা-পাশের সেই রঙ্গিন প্রজাপতি হবে?
কথা দিলাম আগলে রাখবো,জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত। হবে কি আমার হৃদয়ের প্রজাপতি?”
বিরুনিকা এইমুহুর্তে হাওয়ায় ভাসছে। তার দীর্ঘ চারবছরের অপেক্ষা সার্থক। সে তার কুনোব্যাঙ কে জয় করে নিয়েছে অবশেষে। আবেগে সে কথা বলতে পারছেনা। কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। সায়াহ্ন ওর অবস্থা দেখে হেসে খুন। যদিও বিরুনিকা কোন উত্তর দেয় নি,কিন্তু সায়াহ্ন জানে এই ইডিয়ট মেয়েটা তাকে গভীরভাবে ভালোবাসে। আর সেটা এতোদিন একতরফা ছিলো। অন্তত তার দিক থেকে। সায়াহ্নর দিক থেকে তো দু’তরফাই ছিলো। অবশ্য সায়াহ্ন এটা জানেনা,বিরুনিকা ওকে আরো আগে থেকেই ভালোবাসতো। আর ঠিক এ কারনেই প্রাইভেট পড়তে চেয়েছিলো। প্রতিদিন নিয়ম করে একটু দেখতে পারবে, তার কুনোব্যাঙ কে। কথা শুনতে পারবে। ব্যস,এতটুকুই অনেক ছিলো বিরুনিকার জন্য। আজ অনেক বেশি সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে।
এতো সুখ কপালে সইবে তো?
আচমকা ছাদের দরজায় কেউ করাঘাত করতে লাগলো। বিরুনিকা ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ালো। সায়াহ্ন বিরুনিকাকে আশ্বস্ত করে দরজা খুলতে নিলো। কারন ভয়ে বিরুনিকা সায়াহ্নর হাত খামচে ধরেছিলো। বিরুনিকা ঘামছে।
দরজা খুলার পর, ওপাশে কোমলকে দেখতে পেয়ে বিরুনিকা স্তব্দ হয়ে গেলো পুরো! ঠিক এই ভয়টাই করছিলো সে। দরদর করে ঘামতে লাগলো সে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। পা থেকে মাথা অবধি কেমন অবশ হয়ে আসছে। কোন এক অদ্ভুত কারনে, কোমল সায়াহ্ন কে খুব একটা পছন্দ করেনা,আর সেটা বিরুনিকাও জানে। কিন্তু মন কি আর বাঁধা মানে!
যেখানে যত বাঁধা, সেখানে মনের তত অবাধ বিচরণ!
#চলবে…