#যখন_তুমি_এলে
#পর্ব- ০২।
লেখা- জাহান লিমু।
শ্রাবণের জলধারার বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। আকাশ ছেঁয়ে আছে ঘন কালো মেঘে। চারদিকে পানি থৈ থৈ। এবার প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ভোররাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে,থামার নাম নেই। মনে হচ্ছে শহরটা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এরমধ্যে আবার ইলেকট্রিসিটিও চলে গেছে। রাতে ফোনে চার্জ দেয় নি সাচী,এখন তুহিনের ‘শো’ টা শুনবে কি করে? পাওয়ার ব্যাংকটাতেও তেমন চার্জ নেই। তবুও সেটাতে কতক্ষণ গুতাগুতি করলো। দশমিনিট চার্জ করার পর ফোনটা অন হতেই, সাথে সাথে এফএম রেডিও অন করলো সে। কিন্তুু তখন একটা গান বাজছিলো,
” Baarishein yun achanak huyi
Toh laga tum shehar mein ho,
Raat bhar phir woh jab na ruki’n
Toh laga tum shehar mein ho,
Kahin ek saaz hai goonji
Terj aawaaz hai goonji
Meri khamoshiyon ko ab kar de bayaan.
Tere bin bewajah sab hai
Tu agar hai to matlab hai
Nehi tho tootha sa adura karba
Ek tera rasta,ek mera rasta
Nayun rehna ba judha….
বৃষ্টির দিনে বৃষ্টির রোমান্টিক গান শুনে মনটাই ফুরফুরা হয়ে গেল সাচীর। একটু আগের বিরক্তিকর ভাবটা কেটে গেল মুহুর্তেই। গান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ভেসে এলো সেই জাদুকরী কন্ঠ। বুঁদ হয়ে সেই কন্ঠের অধিকারীর কথাগুলো শুনতে লাগলো সে। এতো নেশা ধরানো কন্ঠ কারো হয়?
কেমন যেন একটু ভাঙা ভাঙা গলায় কথা বলে,সেটাই ভালো লাগে। কেমন যেন ভিন্নতা কন্ঠে। সেটাই হয়তো ভালো লাগার কারন। অথবা ভালো লাগার কোন কারনের প্রয়োজনই নেই। ভালো লাগে সেটাই সবচেয়ে জরুরি,কেন লাগে সেটা জরুরি নয়। হুঁট করে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। মরার ফোন,তোকে ফাঁসিতে লটকাবো আজকে। আর মরার কারেন্ট এখনো আসে না কেন? ঢাকা শহরেও যদি সামান্য বৃষ্টিতে কারেন্ট চলে যায়, তাহলে সারাদেশের কি হবে?
ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে, মাথার এলোমেলো চুল
আরো এলোমেলো করে বাথরুমে ঢুকলো সে। সকালে ঘুম থেকে উঠলে,ওকে পুরো ভূত মনে হয় চুলের জন্য। যে কেউ দেখলে ভয় পাবে। বান্ধবীরা বলে চুল সোজা করার জন্য, সে করেনা। সে ভ্রু প্লাকও করেনা। যেমন আছে তেমনি,চেহারায় কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই। সাচীর মতে, আমরা আধুনিক হবো কাজে,চেহারায় নয়।
একটু আগে শোনা গানটা বাথরুমে ঢুকে গুণগুণ করতে লাগলো সে। গানটা জানি কার,হুঁট করে মনে করতে পারছেনা। নিজের মাথায় নিজে থাপড়াচ্ছে সমানে। কোনকিছু মনে না পড়লে,এই এক স্বভাব তার। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই জোরে ইয়েস বলে উঠলো। এটাতো আমার এক্স ক্রাশ আতিফের গান। সাচী এমনভাবে আতিফ বললো,যেন সে তার পাশের বাসায় ভাড়া থাকে।
যেদিন শুনলো আতিফ আসলাম বিয়ে করেছে,সেদিন থেকে সে তার এক্স ক্রাশ হয়ে গেছে। আর বউটাও এতো সুন্দরী, যে হিংসাই হয় মাঝে মাঝে। তবে দুজনকে দারুণ মানিয়েছে,এটা স্বীকার করতে হবে।
সাচী বাথরুম থেকে শুনতে পেল, ওর আব্বু ডাকছে।
” আম্মাজান কি মাত্র ঘুম থেকে উঠলেন?”
” বাথরুম থেকেই চিৎকার করে সাচী উত্তর দিলো,না আব্বাজান। ঘন্টাখানেক আগেই উঠেছি।”
” শফিকুর রহমান আর কিছু বললেন না। বিছানায় বসলেন। পুরো বিছানা এলোমেলো। মোবাইল,চার্জার,পাওয়ার ব্যাংক, ডায়েরি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে বিছানায়। কাঁথা-বালিশ পর্যন্ত এলোমেলো। মেয়েটা এতো অগোছালো হয়েছে না। এটা বলতে বলতে শফিকুর মেয়ের বিছানা ঠিক করতে লাগলেন। হঠাৎ মেয়ের বালিশের নিচে কালো টি-শার্ট, ব্লু জিন্স পরা এক ছেলের ছবি দেখতে পেলেন। কিছুক্ষণের জন্য একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন, এটা কে?
বন্ধুর ছবি এভাবে বালিশের নিচে রাখার কিছু নেই। তবে কি তার মেয়ে…শফিকুরের ভাবনার ছেদ ঘটে মেয়ের ডাকে। তাড়াহুড়ো করে ছবিটা বালিশের নিচে রেখে দেন তিনি। মেয়েকে অসস্থিতে ফেলতে চান না তিনি। বলার মত কিছু হলে,মেয়ে নিশ্চয়ই বলবে। এতটুকু ভালো সম্পর্ক আছে মেয়ের সাথে। তাই হাসিমুখ করে বললেন,
” নাস্তা করতে আসেন, আম্মাজান। অনেক বেলা হয়েছে। আজকে তো ভার্সিটি নেই,শুক্রবার।”
” তুমি যাও,দুইমিনিটে আসছি। শফিকুর প্রস্থান করলেন। সাচী ফোনটা তাড়াতাড়ি চার্জে লাগিয়ে, নাস্তা করতে গেল।”
” বিকালে ছাদে দাঁড়িয়ে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছিলো সাচী। হাতে কফির মগ। তখন নিচতলার ফ্ল্যাটের বিরুনিকা আপু এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। সাচীর দুইবছরের বড়। ইডেনে বাংলাতে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। সাচীদের তিনতলা বাসার,প্রথম ও দ্বিতীয় তলা পুরোটা ভাড়া দেয়া। তৃতীয় তলায় ওরা থাকে। বাবা,ভাইয়া আর সে। বিরুনিকা জিজ্ঞেস করলো,
” কি গান শুনছো?”
সাচী কান থেকে একটা এয়ারফোন সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কিছু বলছো?” বিরুনিকা হেসে বললো, এতো বেশি ভলিউম দিয়ে গান শুনোনা,কানের জন্য ক্ষতিকর।”
” সাচী এয়ারফোন খুলে গলায় ঝুলিয়ে রাখলো। কফির মগে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে মগটা ছাদের ওয়ালের উপর রাখলো। ওয়ালে হেলান দিয়ে বললো,
” তারপর,কেমন চলছে তোমার দিনকাল?”
সাচীর প্রশ্নের ধরনটা বিরুনিকা ঠিক ঠাহর করতে পারলনা। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,এইতো ভালোই।”
তখন সাচী বিরক্ত হয়ে বললো,তোমার আর ভালো থাকা। এখন অব্দি আমার ভাইটাকে পটাতে পারলেনা। কত বুদ্ধি দিয়ে দিলাম আমি,তবুও পারোনা। ভালোবাসতে পারো,আর সাহস করে বলতে পারো না, হুহ! বিরুনিকা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। এই মেয়েটা যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছে,আমি তার ভাইকে ভালোবাসি, সেদিন থেকে আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। একেকবার একেক বুদ্ধি দিবে,তার ভাইকে প্রপোজ করার জন্য। আর আমি বরাবরই ওর ভাইয়ের গম্ভীর মুখটা দেখেই,সব ভুলে যায়। যতটুকু সাহস নিয়ে যায়, তার সব ফুঁস করে হাওয়া হয়ে যায়। এই গম্ভীর, উদাসীন, কাটখোট্টা লোকটাকে যে কি করে ভালোবাসলাম, কে জানে। সারাদিন পড়ে থাকে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লিখা নিয়ে। বারবার বিভিন্ন জায়গা থেকে তার স্ক্রিপ্ট রিজেক্ট হওয়ার পরেও,সে থেমে নেই। সে তার মতো চেষ্টা করেই যাচ্ছে। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়েছে আরো বছর তিনেক আগে। সেও বাংলার ছাত্র ছিল। বিরুনিকা তার কাছে প্রাইভেট পড়তে আসতো। সেখান থেকেই ভালোলাগার সূত্রপাত। তবে আজ তিনবছরেও বলার মত সাহস করে উঠতে পারেনি। সাচীর চোখে ধরা পড়েছে গতবছর। ওর ভাইয়ের রেখে দেওয়া চায়ের কাপ থেকে লুকিয়ে চা খেয়ে ফেলেছিলো। সেটা দুর্ভাগ্যক্রমে সাচীর নজরে পড়ে যায়। ব্যাস,তারপর থেকে সারাক্ষণ লেগে আছে বিরুনিকার পিছনে। সাচী বিরুনিকার সামনে আঙুল দিয়ে তুবড়ি বাজিয়ে বললো,কল্পনায় ঐ নিরশের সাথে সংসার করে লাভ নেই। পারলে আমার ভবঘুরে ভাইটাকে একটু আঁচলে শক্ত করে বাঁধো। তারপর তাড়াতাড়ি নিচতলা থেকে তৃতীয় তলায় শিফট হয়ে যাওতো। দারুণ মজা হবে, তাই না? একই বাসায় বর, বউ দুজনই। গাড়ি করে বরকে যেতে হবেনা,তোমাকেও কোলে করে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে চলে আসবে। শাহরুখ খানের চেন্নাই এক্সপ্রেসের মত। উফফ…সিনটা জাস্ট একবার ভাবো! আমারতো এখনি সেটা সরাসরি দেখে ফেলতে মন চাইছে।বিরুনিকা লজ্জায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছেনা। মেয়েটার মুখে কিছু আটকায় না। মনে যা আসে,তাই বলে দেয়। একদম স্বচ্ছ জলের মত পরিষ্কার মনটা। আর নয়তো অন্য কোন মেয়ে হলে,ভাইকে কোন মেয়ে পছন্দ করে সেটা বুঝতে পারলে,আঙুলে তুলে নাচাতো। তারমধ্যে বিরুনিকা অনেক খাটো। টেনেটুনে চার ফিট এগারো হবে। ওর ভাই কম করে হলেও,পাঁচ ফিট আট তো হবেই। গায়ের রঙ ও আহামরি নয় তার, উজ্জ্বল শ্যামলা। মানে চোখে লাগার মত কোন সৌন্দর্যই বিরুনিকার নেই। অথচ মেয়েটা কত সহজে ওকে গ্রহণ করে নিয়েছে। বিরুনিকাকে শুধু একটা কথাই বলেছিল,
তুমি আমার ভাইকে ভালোবাসো,সেটাই বড় কথা। আর সেই ভালোবাসার জোর দিয়েই, পারলে আমার ভাইটাকে একদম শক্ত করে বেঁধে ফেলো। জানো তো, রুপে মানুষ বাঁধা পড়ে ক্ষণিকের জন্য, আর ভালোবাসায় সারাজীবনের জন্য। মেয়েটার সাথে কথায় পারেনা বিরু। বিরু নামটাও সাচীর দেয়া। বিরুনিকা নাকি অনেক বড় নাম,তাই সংক্ষেপে বিরুপু ডাকে। অবশ্য ভাবীও ডাকতে চেয়েছিল,কিন্তু পরে নিজেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো। বিরুকে বললো,যেদিন তুমি আমার ভাইকে ভালোবাসায় ফাঁসাতে পারবে,সেদিনই ভাবী ডাকবো। তার আগে নয়।
আগে তো কোনভাবে ফাঁসাও, পরের কাজ সম্পূর্ণ আমার। এটা বলে চোখ টিপলো সাচী। বিরুনিকা কি বলবে,কিছু বুঝতে পারছিলনা। তবে ভরসার একটা জায়গা পেয়েছে অন্তত।
বারান্দায় বসে একমনে মাউথ অর্গান বাজাচ্ছিল আরাদ। আরাদ কে ছোট করে রাদ ডাকে সবাই। প্রতিদিন রাতে বারান্দায় বসে করুণ স্বরে এই মাউথ অর্গান বাজাবে। যেন বিষাদের কালো মেঘ জমে আছে তার ভেতর-বাহির জুরে। অথচ দিনের আলোতে সে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। ছেলেটা কেমন জানি। নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে সেই ছোট থেকেই। যা কয়েকজন বন্ধু বান্ধব আছে,তাও হাতে গোনা।
পুরো ফ্ল্যাটটাতে সে একা থাকে। মাঝে মাঝে দাদী আসেন। আর অন্য সময় উনি ফুপীর বাসাতেই থাকেন। একমাত্র ছেলের নাতীকে এভাবে বড় হতে দেখে,ভীষণ কষ্ট হয় উনার। কিন্তু কিছুই যে করার নেই উনার। তখনও ছিলোনা,এখনও না। অভিমান এতো খারাপ জিনিস সম্পর্কের ক্ষেত্রে। ছোটখাট অভিমান সম্পর্ককে মধুর করলেও,বিশাল অভিমান সেই সম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে।
নিজের মত করে জীবন কাটাচ্ছে, কোন পিছুটান নেই আরাদের। কারো মায়ায় জড়িয়ে ভবিষ্যতেও সে কোন কষ্ট পেতে চায় না। ভালোবাসা মানেই ধোঁকা,যন্ত্রণা। এরচেয়ে একা আছি,সেই বেশ। এটাই তার ধারণা।
সকাল সকাল খবরটা শুনে সাচীর চোখ কপালে উঠে গেছে। ঘরজুরে ছুটোছুটি করছে,স্থির হয়ে বসতে পারছেনা। একবার আয়নার সামনে যাচ্ছে, তো আরেকবার ওয়ারড্রব খুলছে। কি করছে না করছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। পুরো রুম এলোমেলো করে ফেলেছে। মাথার চুলগুলো পাগলের মতো এলোমেলো করে, এবার চুপ করে বসলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে। চোখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে,আয়নার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। জোরে জোরে লম্বা করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলো। দেখতে সে ফর্সাই,তবে সেটা ন্যাচারাল। কোন মেকআপ,ঘষামাজা সে করেনা। তাই তার সৌন্দর্যটাও প্রাকৃতিক। হয়তো মেকআপ কুইনদের কাছে সে টিকবে না,কিন্তু এতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। মানুষের চেহারাটা
দিয়ে বিচার না করে,তার গুণ দিয়ে করা উচিত।
তবে যাদের মেকআপ ভালো লাগে,তাদের নিয়ে সাচীর কোন অভিযোগ নেই। কারন কি জানি একটা কথা আছে,মেয়ে আর মেকআপ অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। এটা বলে সাচী নিজেই হাসলো। শফিকুর দরজা থেকে মেয়ের অদ্ভুত কান্ড কারখানা সব দেখছিলেন। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। মেয়েটার কি তবে মাথা খারাপ হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত!”
#চলবে…