যখন তুমি এলে
লেখা – জাহান লিমু।
পর্ব – ২৮।
উফফ…কি ভয়ংকর বিয়ের কাহিনী আপনাদের। আপনাদের পরবর্তী প্রজন্ম,বিয়ের কাহিনী শুনে একটুও বোরিং হবে না।
পুরাই রোমাঞ্চকর!
একেবারে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।
আমার মনে হচ্ছে, আমি কোন গল্প শুনছি। না না, ঠিক গল্প নয়। কোন নাটক। জীবন্ত নাটক। যে নাটকে আমারও ছোট্ট একটা ভূমিকা আছে। সেটা ভেবেই আমার ভালো লাগছে। কোনদিন নাটকে অভিনয় না করলেও,কারো জীবনের নাটকে সরাসরি একটু অংশগ্রহণই বা কম কিসে?
আচ্ছা স্যার, আপনার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কি, আমার এই ছোট্ট রোলটার কথা তুলে ধরবেন? যদিও আমি পার্শ্ব চরিত্র, প্রধান চরিত্র তো আপনারাই। আর পরিচালক তো মিস্টার আরাদ ইনজামুল। যদিও আমি ভেবেছিলাম, আপনি আমার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ভেগে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমার ভাবনায় জল ঢেলে দিলো মিস্টার আরাদ। উনাকে দেখতে খুব মন চাইছে। এতো চমৎকার করে পরিকল্পনা করলেন,সেটা বাস্তবায়নও হয়ে গেছে প্রায়। নিশ্চয়ই ভীষণ বুদ্ধিমান। তা উনি কোথায় আছেন এখন, স্যার?
এই বাদল নামক পাগল লোকটা যে কেন তানিমের সব বিষয়ে ঢুকে পড়ছে,সেটা তানিম নিজেও ভেবে পাচ্ছে না।
তানিমের সাথে বউয়ের বেশে রাস্তায় রোহানীকে দেখতে পেয়ে, বাদল পিছু করা শুরু করে। ব্যাস,এখন বাদল তানিমের বাসায় উপস্থিত। কোনকিছু বলারও সুযোগ নেই। কারন সেটা অভদ্রতা দেখায়। আর অফিসের কলিগ বলে কথা। তাই চুপচাপ কথার ঝড় সহ্য করতে হচ্ছে। রোহানী ভ্রু কুঁচকে তানিমের দিকে তাকিয়ে আছে। তানিম বুঝতে পারলো,রোহানী বিরক্তবোধ করছে। এমনিতেই বেচারী যে স্ট্রেসের মধ্যে ছিলো এ কয়দিন। এখনও হয়তো কোনকিছু বিশ্বাস করতে পারছেনা। তানিমের সাথেও বেশি কথা বলছেনা। বুঝাই যাচ্ছে, সেই অভিমান করে আছে। তানিমেরও অভিমান হচ্ছে। ছেলে হয়েছে দেখে কি,অভিমান থাকতে নেই নাকি। কিন্তু তানিম অভিমানটা এখন দেখাবেনা।
মোক্ষম সময়ে দেখাবে।
তানিম যখন বাদলের কথায় জর্জরিত,তখন এক রমণীকে দেখে বাদলের কথা পুরো থেমে যায়। সে হা করে তাকিয়ে তাকে,সামনের নারী মূর্তিটির দিকে। মেয়েটির কোঁকড়া চুল,তার চেহারায় একটা ভিন্ন সৌন্দর্যের আবহ এনে দিয়েছে। বাদলের কথা থেমে গেছে পুরো। হঠাৎ এভাবে বাদলের কথা থেমে যাওয়ার দরুন,তানিম, রোহানী দুজনেই বেশ অবাক হলো। এতোক্ষণ যে খই ফোটাচ্ছিলো,তার সেই খই ফোটানোতে কে জল ঢেলে দিলো?
যার ফলশ্রুতিতে সে খই ফোটানি এভাবে চুপসে গেলো?
সেটা ভেবে দরজার দিকে তাকাতেই রোহানী চমকে যায় পুরো।
সাচী!
সাচীর পেছনেই আরাদ এসে দাঁড়ালো। রোহানী চোখ বড় বড় করে আরাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মানে সে ঠিকই দেখেছিলো। ঐটা সাচীই ছিলো। সবকিছু এত কম সময়ের মাঝে ঘটেছে যে,রোহানীর সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সকাল পর্যন্তও জানতোনা,আরাদের মাথায় ঠিক কি ঘুরছে। ইনফেক্ট আরাদ রোহানীকে কিছুই জানায়নি আগে। যা প্ল্যান করার,সোহানী আর ওই করেছে। সোহানীর কথা মনে হতেই,রোহানীর মন খারাপ হয়ে গেলো। ঐদিকে কি হয়েছে পরে,তার কিছুই জানেনা সে। আরাদ এসেছে,এখন জানা যাবে সব। কিন্তু সাচী আরাদের সাথে কি করে বা কি করছে,সেটা সোহানীর গিলুতে ধরছেনা। আবার সবার সামনে কোনকিছু জিজ্ঞেসও করা যাচ্ছে না। আরাদের সাথে একা কথা বলতে হবে। কিন্তু এখন সেই সুযোগ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই নিজের কৌতূহলটা দমন করে নিলো রোহানী।
ঐদিকে বাদলকে এভাবে সাচীর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে,আরাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আরাদ তানিমের কাছে গিয়ে আস্তে করে বললো,
” এই মালটা কে ভাই?”
আরাদের কথা শুনে,দুঃখে তানিমের হাসি পাচ্ছিলো। আরাদ ঠিকই বলেছে,একটা মালই বটে। যে মালটা, তানিমের মাথায় জোর করে চেপে বসেছে। তানিম ধীর স্বরে বললো,” আমার কলিগ।”
আরাদ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,” উনাকে দাওয়াত কে দিলো? আপনি নিজেই তো জানতেন না,কপালে বিয়ে আছে কিনা।”
এবার তানিম শব্দ না করে, কেবল ঠোঁট দুটি প্রসারিত করলো। তারপর বললো,” উনি হলেন, বিনা দাওয়াতের মেহমান। আর তারা,যেকোন জায়গায় উড়ে এসে, জুড়ে বসতে অভ্যস্ত।”
আরাদের যেটা বুঝার,এবার বুঝতে পারলো। বাদলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখে,বাদল সাচীর দিকে এগুচ্ছে। আরাদ হুঁট করে বাদলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। এতো বাদল আর সাচী, দুজনেই বেশ ভড়কে গেলো। আরাদ বাদলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” আরে,কলিগের বিয়েতে এসেছেন,কব্জি ডুবিয়ে তো আর খেতে পারবেন না। যেহেতু সেরকম ব্যবস্থা নেই। তবে অন্তত আঙুল ডুবিয়ে তো খেতে পারেনই।”
বাদল একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বললে,” আপনিই মিস্টার আরাদ?”
আরাদ মাথা বাঁকিয়ে বললো,” জ্বি,আমিই এই অধম।”
বাদল উৎসুক গলায় বললো,” আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতোক্ষণ ধরে।”
আরাদ কপাল কুঁচকে তাকালো। ওর জন্য অপেক্ষা করছে মানে? ওকে চিনে কি করে?”
আরাদের চিন্তিত হওয়ার কারন বুঝতে পেরে তানিম বললো, ” উনি এতোক্ষণ তোমার প্ল্যানিং শুনছিলো বসে বসে। সে কারনেই তোমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলো।”
এবার আরাদ বুঝতে পারলো।
তবে তখন থেকে বাদল সাচীতেই আঁটকে আছে। বারবার সাচীর দিকে তাকাচ্ছে। সেটা যে সাচীর অসস্থি লাগছে,আরাদ বেশ বুঝতে পারলো। বাদল লোকটাকে মোটেও সুবিধার ঠেকছে না আরাদের।
হুঁট করেই আরাদ বলে উঠলো,
” এখনতো ফটোশ্যুট হবে,আপনি কি করবেন মিস্টার বাদল সাহেব?”
” কে করবে ফটোশ্যুট?”
আরাদ সাচীর হাতের ক্যামেরাটার দিকে ইশারা করলো। বাদল এতোক্ষণ সাচীকে দেখার তালে,এটা খেয়ালই করেনি। সে মনে মনে ভাবলো,ওয়াও!
এতো সুন্দর লেডি ফটোগ্রাফার। সে ছবি তুললে তো, ছবি অটোমেটিক সুন্দর হবেই। বাদল সাচীকে দেখে যতটা না বিস্মিত হয়েছে,সাচী ফটোগ্রাফার শুনে আরো বেশি অবাক হয়েছে। এতোটুক মেয়ে, এতো গুণী। মোটকথা বাদলের এক দেখাতে, সাচীকে পছন্দ হয়ে গেছে। এতোদিন বোধহয়, এমন কোন মেয়ের অপেক্ষাতেই ছিলো সে। যদিও এতোদিন কোঁকড়া চুলী মেয়েদের বাদলের পছন্দ হতো না। কিন্তু সাচীকে দেখে সেসব লাপাত্তা। বরং কোঁকড়ানো চুলের কারনেই সাচীকে অন্যরকম সুন্দর লাগে। বাদল সাচীর ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে পুরো।
তানিমের মা এসে সবাইকে খেতে ডাকলেন। তানিমের বাবা বিছানায় শয্যাশায়ী। গতবছর এক্সিডেন্টে পা দুটো অচল হয়ে গেছে। তিনিও ব্যাংকে চাকুরী করতেন।
খাবার টেবিলেও বাদলের এভাবে তাকানোটা আরাদকে ক্ষুব্ধ করে তুলছিলো। কিন্তু কিছু বলতে পারছিলোনা। সাচী অবশ্য আরাদের ক্ষোভটা টের পেয়েছিলো বটে। যখন বাদল সাচীর দিকে তাকাচ্ছিলো বারবার,তখন আরাদ তাকাচ্ছিলো বাদলের দিকে। আরাদের রিয়্যাকশান তখন এমন যে,পারলে বাদলকে মেঘের সাথে প্যাকেটিং করে উড়িয়ে দেয়।
সাচী কেন জানি মনে মনে হাসলো।
রাত দশটায় আরাদ সাচীকে বাসায় পৌঁছে দিলো। বাসার সবাই টেনশনে পড়ে গিয়েছিলো। সাচী ফোন করে জানিয়েছিলো বাবাকে,যে দেরি হতে পারে। কিন্তু তাই বলে এতো রাত!
শফিউর বাসার নিচের খালি জায়গাটুকুতে পায়চারি করছিলেন। আজকাল বাইরের যে পরিস্থিতি। মেয়েটা যে কেন এমন কাজ পছন্দ করলো। আর আজকালের বিয়েও বলিহারি। এতোরাত পর্যন্ত ফটোগ্রাফি করতে হয়। যেন বিয়ে মানেই ফটোগ্রাফি। বাসার গেইট খুলাই রেখেছিলেন শফিউর।
আধাঘন্টা ধরে পায়চারি করছেন তিনি। বারবার গেইটের বাইরে উঁকি দিচ্ছেন। সায়াহ্ন এসে বাবাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো। যে সাচীকে যে লোক নিয়ে গিয়েছিলো,সেই আবার দিয়ে যাচ্ছে। সাচী ফোন দিয়েছিলো,বলেছে কোন চিন্তা না করতে। শফিউর তবুও দাঁড়িয়ে রইলেন। বাবার মন,সন্তানের চিন্তা থেকে সহজে বিরত হতে পারেনা। সায়াহ্নকে ঘরে পাঠিয়ে, তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন ঠাঁই।
কিছুক্ষণ পর গাড়ির আওয়াজ আসলো। শফিউর তড়িঘড়ি করে গেইটের কাছে এসে দেখেন,একটা যুবক ছেলে তার মেয়েকে দিয়ে যাচ্ছেন। সেটা দেখে শফিউর এবার ভেতরে চলে গেলেন। সাচী আরাদের থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ঢুকে, গেইট লাগিয়ে দিলো। ঠিক তখনি আবার গেইটে শব্দ হলো। সাচী জিজ্ঞেস করলে,” কে?”
আরাদ উত্তর দিলো, আমি। সাচী গেইট হালকা খুলে, মুখটা একটু বের করলো। জিজ্ঞেস করলো,
” কোন সমস্যা?”
আরাদ কি যেন বলতে গিয়েও,থেমে গেলো। মাথা চুলকে সরি বললো। সাচী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর আর কিছু না বলে সে গেইট লাগিয়ে দিলো। আরাদ পেছন হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে গিয়ে, গাড়ি স্টার্ট দিলো। নিজের কাজে,নিজেই হাসলো সে। পরক্ষনেই ভাবলো,কি হলো ওর?
এভাবে বোকার মতন হাসছে কেন?
নিজের মাথায় নিজেই টোকা দিলো। একবার ভেবেছিলো স্মরণিকাদের সাথে দেখা করে যাবে। সেজন্যই গেইটে আবার টোকা দিয়েছিলো। পরক্ষণেই ভাবলো,নাহ অনেক রাত হয়ে গেছে। এমন সময় কারো বাসায় যাওয়াটা ঠিক হবে না।
আর স্মরণিকার মায়ের আচরণ বেশ সন্দেহজনক। উনি কি উল্টাপাল্টা কিছু চিন্তাভাবনা করছেন কিনা,কে জানে। সেখানে আগবাড়িয়ে নিজে গিয়ে আরো ঝামেলার সৃষ্টি করার কোন মানে হয় না। আর বিরুনিকার বোধহয় আরাদকে কোন কারনে ভালো লাগেনা। সেটার সঠিক কারন অবশ্য আরাদের জানা নেই। সবার সবাইকে ভালো লাগতে হবে,সেটারও কোন আবশ্যকতা নেই।
#চলবে…