যখন তুমি এলে পর্ব- ২৬।

0
642

যখন তুমি এলে।
লেখা- জাহান লিমু।
পর্ব- ২৬।

পুরো হলরুম জুরে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। উপস্থিত সকলেই বাকরুদ্ধ!
বিয়ের দিন,বিয়ের কনের মর্মান্তিক ট্রাক দুর্ঘটনায় মৃত্যু।
সবাই আফসোসের সুর তুলেছে।
ইতিমধ্যে কেউ কেউ অবশ্য কানাঘুঁষা শুরু করে দিয়েছে যে, মেয়ে হয়তো বিয়েতে রাজি ছিলো না। আর এটা হয়তো এক্সিডেন্ট নয়,সুইসাইড। আজকালের ছেলে মেয়েদের উপর জোর খাঁটাতে গেলে,পরিণতি এমন ভয়াবহ হয়। আর রিতি চৌধুরী যে ভয়ানক মহিলা। দেখতে এতো সুন্দরী যে,বুঝাই যায় না এই মানুষটা এমন ভয়ংকর। অবশ্য চেহারাতে তো আর মানুষের, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ থাকেনা।
রায়হান সাহেব খবরটা শুনে,সেখানেই ধপ করে বসে পড়লেন। সেটা দেখে ঐ পরিস্থিতিতেও স্বামীকে ধমকে উপরে বসালেন রিতি। স্বামীর কানের কাছে গিয়ে ধীর স্বরে বললেন,
” বস্তির লোকেদের মত বিহেভ করছো কেন? বাবা,মেয়ে মিলে আমার স্ট্যাটাসের, পুরো মজা বানিয়ে দিলে!”

রায়হান সাহেব বিস্ফোরিত চোখে রিতির দিকে তাকালেন। তিনি চিনতে পারছেন না এই মহিলাকে। মানুষ কতটা মনুষ্যত্ব শূন্য হলে,নিজের মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেও,নিজের স্ট্যাটাসের কথা ভাবতে পারে?
রায়হান সাহেব জানতেন,রিতির মধ্যে কোন আবেগ নেই। তাদের সম্পর্কটা কেবল লোক দেখানো। কোন ভালোবাসা নেই সেখানে। শুধু বাহ্যিক চাকচিক্য ছাড়া। তবুও ভেবেছিলেন, একদিন হয়তো সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। স্বামীর ভালোবাসা পেলে নাকি, মেয়েরা গলে যায়। শত কষ্টের স্মৃতি থাকলেও,তা ভুলে যায়। কিন্তু এই রিতি নামক মেয়েটা কোন ধাতুর তৈরী?
ভালো বাসেনি,তবুও সংসার ঠিকই করেছে। দুইটা মেয়ে আছে। তবুও এতবছর পরও,তার চরিত্র একটুও বদলায় নি। বরং আরো কাঠিন্যতা বেড়ে গেছে। মায়া,মমতা নামক যে কোন জিনিস আছে,সেটা বোধহয় এই মহিলার জানা নেই। রায়হান সাহেব ভেবেছিলেন,সন্তান হলে অন্তত রিতি বদলে যাবে। কিন্তু আজ এতবছর পরেও যে একচুলও বদলায়নি,তার কাছে বদলের আশা করা, নিছক মজা ছাড়া কিছুই নয়। তবুও রায়হান সাহেব মজা করেই, আশা রাখছেন। কোন একদিন রিতি বদলাবে।
মেয়েটার জন্য আজ ভীষণ করুণা হচ্ছে রায়হান সাহেবের। বাবা,মার ভালোবাসাতো পেলোই না। যাকে ভালোবাসলো,তাকেও পেলো না।
তাই সব অপ্রাপ্তি,অভিমান নিয়ে চলে গেলো মেয়েটা।
অথচ তাতেও,তার মায়ের চোখে একফোঁটা জল নেই। কেমন নির্লিপ্তভাবে আরাদকে একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছে। যেন সে মা নয়,তদন্তকারী। যার কাছে তদন্তের রহস্য উদঘাটন করাই প্রধান বিষয়। রায়হান সাহেবের মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখে ঝাঁপসা দেখছেন। ঝাঁপসা চোখে দেখতে পেলেন,রিতি আরাদের সাথে কোথাও একটা যাচ্ছে। কিন্তু উনি উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু পেলেন না। এরপর কি হলো,তিনি আর বলতে পারলেন না। এর আগেই জ্ঞান হারালেন। কিন্তু রিতির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
তিনি বোধহয়, মেয়ের মৃত্যুর সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে গেলেন। মা, এমনও নয়!

.

সোহানী একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। হাসপাতালের মর্গের সামনে বসে আছে সে। সেখানে হুঁড়মুড়িয়ে রিতি চৌধুরী প্রবেশ করলেন। হাসপাতালটার অবস্থা বেশি ভালো না। এটা হাসপাতালও না বোধহয়,ছোটখাটো ক্লিনিক। এখানে কেন উনার মেয়েকে নিয়ে এসেছেন?
আর কেইবা এনেছে?
রিতি চৌধুরী সোহানীর কাছে গিয়েই,আচমকা একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। সোহানী গালে হাত ধরে কাঁদতে লাগলো। আরাদও স্তম্ভিত!
রিতি চৌধুরী হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,
” তোমাকে সাথে পাঠিয়েছিলাম কেন শুনি? তোমাকে ফাঁকি দিয়ে সে পালাতে গিয়েছিলো কেন?”
পালানোর কথা শুনে সোহানী ভয়ে চুপসে গেল। রিতি চৌধুরী পুনরায় ধমকে উঠলেন সোহানীকে।
” কি ভেবেছো? তোমাদের চালাকি ধরতে পারবনা? আমার চোখকে ফাঁকি দেয়া এতোটা সহজ?”
সোহানী ভয়ে একঢোক গিললো।
রিতি চৌধুরী বলতে লাগলেন,”রোহানীর লেহেঙ্গাতে আমি গোপন ক্যামেরা বসিয়ে দিয়েছিলাম। আর আমি সারাক্ষণ ওর ওপর নজর রাখছিলাম। ও যে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো,সেটাও আমি দেখেছি। কিন্তু এরপরই আর কানেকশন পাচ্ছিলাম না। তোমাকে অনেকগুলো ফোন দিয়েছি,ধরোনি কেন?”
সোহানী বুঝালো, ওর ফোন সাথে নেই। রাস্তায় কোথাও পড়ে গেছে হয়তো। যার ফলস্বরূপ মায়ের হাতের আরেকটা থাপ্পড় হজম করতে হলো। সোহানী চুপচাপ কেঁদেই যাচ্ছে।
রিতি চৌধুরী ধমকে বললেন,
” বেয়াদবটা কোথায়? আমাকে নিয়ে চলো। শেষ দেখাটা দেখে দিই। মরেও আমার সম্মান ধূলোয় লুটিয়ে দিয়ে গেলো।
মেয়ের মৃত্যুতে কোন শোক তো নেই-ই। বরং তার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। সোহানীর মাঝে মাঝে মনে হয়,ওর মায়ের কোন অসুখ হয়েছিলো। যে কারনে এমন অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। কিন্তু কি সে অসুখ,তা তার জানা নেই।

আরাদ মর্গের ভেতর নিয়ে গেলো রিতিকে। সেখানে বেশ কয়েকটা লাশ সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। রিতি চৌধুরী নিজেই কাপড় উঠিয়ে দেখতে লাগলেন একের পর এক। মহিলার কি কোন ভয়ভীতিও নেই? একজন সুস্থ সবল মানুষও তো মর্গে প্রবেশ করলে,অসস্থি অনুভব করে। অথচ ইনার কোন কিছুতেই কোন প্রভাব পড়ে না কি করে? এমনভাবে কাপড়গুলো সরাচ্ছে, যেন সবজির উপর থেকে কাপড় সরাচ্ছে। নিচে বিভিন্ন সবজি রাখা। উনি সেগুলো কিনতে এসেছেন। এই মহিলাকে নিয়ে আরাদ আর একবিন্দুও ভাবতে চায় না। ভাবতে গেলেই ওর মাথা ভোঁ ভোঁ করে।
তৃতীয় কাপড়টা উঠিয়েই উনি দূরে ছিটকে সরে দাঁড়ালেন। উনার শাড়ি দিয়ে দিয়ে উনার চোখ,মুখ ঢেকে ফেললেন।

লাশটার চেহারা চেনার কোন উপায় নেই। পুরো মুখ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। যেটা রিতির মনে একটু সন্দেহ ঢুকিয়ে দিলো। তাই তিনি পুরো কাপড়টাই সরিয়ে ফেললেন।
কিন্তু এবার তিনি স্তব্দ হয়ে গেলেন!
রোহানীর পরনের লেহেঙ্গা, আর এটা একই রংয়ের।
তবে রিতি চৌধুরীর জহুরি চোখ বডিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। আরাদ একটা তাচ্ছিল্য ভাব করে রিতি চৌধুরীর দিকে তাকালেন।
মেয়ের শরীরে কোন গয়না নেই কেন? গলার ছোট চেইনটা দেখা যাচ্ছে কেবল। বিষয়টা কেমন খটকা লাগলো রিতির।

সাথে সাথে সোহানীকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার বোনের শরীরের গয়না কোথায়?”

সোহানী বিস্ময় নিয়ে মায়ের চোখের দিকে তাকালো। সে জানে,তার মার থেকে এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। সে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, যখন আমি দুর্ঘটনাস্থলে যায়,তখন দেখি কিছু মানুষ আপুর শরীর থেকে গয়না খুলে নিয়ে পালাচ্ছে। কারও সর্বনাশ,তো কারো পৌষ মাস।
কিছু মানুষ আবেগহীনতায় মায়া-মমতা কি তা ভুলে যায়। আর কিছু মানুষ, আবেগহীন হয়ে প্রয়োজন মেটায়। কথাটা যে রিতিকে উদ্দেশ্যে করে বলেছে সোহানী,সেটা রিতি বেশ বুঝতে পারলেন। ছোটটা বেশ কথা শিখেছে। কিন্তু এখন এখানে কিছু বলবেন না তিনি। তাই শুধু চোখ গরম করে তাকালো সোহানীর দিকে। কিন্তু তখন সোহানীর দৃষ্টি নিম্নগামী।
সোহানী পুরো ঘটনা খুলে বললো কাঁদতে কাঁদতে।
পার্লারের ভেতর থেকে রাস্তায় মানুষের শোরগোল শুনতে পায় সে। বের হয়ে শুনতে পায়,সামনে একটা দুর্ঘটনা হয়েছে। অতটা গুরুত্ব দেয়নি সে। কিন্তু যখন শুনতে পেলো,দূর্ঘটনার স্বীকার একটি মেয়ে। এবং সে বউয়ের বেশে সজ্জিত। তখন সোহানীর মন কেমন কুঁ ঢেকে উঠলো। কারন রোহানী সকালেও একবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। তাই সে দৌঁড়ে রাস্তায় বের হলো।
তখন রাস্তায় একটা লোককে জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটার পরনে কি রংয়ের পোশাক ছিলো?”
যখন শুনলো সাদা আর কফি কালার,তখনি সে দৌঁড়ে আগে পার্লারের ভেতর গেলো। পুরো পার্লার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সে তার বোনকে পেলো না। তখন সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সে ছুটে গেলো দুর্ঘটনার স্থানের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।
সোহানী সাদা লেহেঙ্গাটা রক্তে ভেসে যেতে দেখেছে। মুখের অবস্থা দেখার মত না। পুরো থেতলে গেছে। নাক,মুখের অস্তিত্ব নেই। মুখোমুখি ধাক্কা লেগেছে হয়তো। সুইসাইড বলে কথা!
সোহানী কান্নার কারনে কথা বলতে পারছেনা,হেঁচকি উঠে গেছে ওর। আরাদ সোহানীর সামনে পানির বোতল এগিয়ে ধরলো। সোহানী ঢক ঢক করে অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে ফেললো। ও ঘামছে।
রিতি চৌধুরী পেছনে দাঁড়িয়ে কি যেন হিসেব কষছেন।
আচমকা উনি সোহানীর হাত ধরে টান মারলেন। সোহানী পানির বোতলের মুখটা তখনো লাগায়নি। যার ফলে পানি পরে ওর জামার সামনের অংশটুকু পুরো ভিজে গেল। কিন্তু সেদিকে ওর মায়ের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সোহানী ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”আমরা কোথায় যাচ্ছি মা?”
যেখানে আমি নিয়ে যাবো। বোনের মত তর্ক করতে শিখো না। সোহানী তাচ্ছিল্যের সুরে মনে মনে বললো, আপু যদি তর্ক করতে জানতো,তবে তো হতেই। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সোহানীর বুক ছিড়ে। যেটার মানে,সেই জানে। রিতি চৌধুরী যখন সামনে আগাতে নিবে,তখন আরাদ পেছন থেকে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,” লাশ নেয়ার ব্যবস্থা করবেন না, আন্টি?”
রিতি একটু থেমে, পেছনে আসলেন। আরাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন,
” যে মেয়ে মরে গিয়েও মানসম্মান নষ্ট করে গেলো,সে মেয়ের কোন অস্তিত্বই আর নেই আমার কাছে। এটা বলে সোহানীর হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। মায়ের আচরণ কেন যেন সুবিধার লাগছে না সোহানীর। কেন যেন মনে হচ্ছে, মা আরো বড় কিছু করতে চলেছে। তবে সেটা ঠিক কি,তা সোহানী অনুমান করতে পারছেনা। একটা অদ্ভুত আতঙ্কে, ওর ভেতর শুকিয়ে আসছে। সোহানী চোখ মুখ শুকনো করে, আরাদের দিকে পিছু ফিরে তাকিয়ে রইলো। সোহানী কিছু বলতে চাইছে,এমন দৃষ্টি নিয়ে আরাদের দিকে তাকিয়েছিলো। যে দৃষ্টিতে ছিলো, অজানা আতঙ্ক। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে গিয়েও, সেটা কাঁটার মত গলায় আঁটকে রইলো আরাদের। আবার কি করতে চলেছেন রিতি চৌধুরী?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here