মোহমেঘ পর্ব ১

0
1761

#মোহমেঘ
বিয়ের জন্য বানানো জামদানি ব্লাউজটার উল্টোপিঠ সোজা করতে করতে রশ্নি মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে।
নিশাত মোবাইলটা ধরতে গেলেই রশ্নি কিছুটা রেগে বললেন,
-শুভ কাজের সময় অপরিচিত নাম্বারের ফোন ধরিস না। অশুভ হয় এসব।

-ব্লাউজ পরাটা কোনো শুভ কাজ নয়। সাধারণ কাজ। নিশ্চয় দাওয়াতের কেউ ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছে।

সে আর এক মুহুর্তও দেরি না করে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কেউ একজন চাপা কন্ঠে বলতে শুরু করে,
-আপনি নিশ্চয় নিশাত? আহিরের সাথে যার বিয়ে হতে যাচ্ছে।
-জ্বি, ঠিকই বলছেন। কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না।
-আমি আহিরের প্রেমিকা। আমরা দুজন পালিয়ে এসেছি। আহির আপনাকে বিয়ে করতে পারবে না। জানি,আপনি এখন প্রশ্ন করবেন-আহিরের কোনো প্রেমিকা ছিল না। হ্যাঁ, কথা সত্য। আমি ওর খুব কাছের একজন ফ্রেন্ড ছিলাম। মনের অজান্তেই দুজন দুজনকে ভালোবেসেছি। কিন্তু বলার সাহস হয়নি কারোরই। শেষ মুহুর্তে আর চুপ থাকতে পারলাম না। আপনি কোনো ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেলুন। অল দ্যা বেস্ট।

অপর পাশ থেকে ফোন রেখে দিলো। নিশাত যেন হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা একটানা গড়গড় করা মেশিনের মত বলে গেল। বিপরীতে কিছু বলার সুযোগ রাখেনি আর। নিশাতের শরীরটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো একবার। শরীরে তখনো শুধুমাত্র শাড়ির আঁচল পেঁচানো। গায়ে এখনো জামদানি ব্লাউজটাও ওঠেনি।
চেয়ারে ধড়মড়িয়ে বসে সে রশ্নির দিকে চেয়ে বললো,
-আহিরের নাম্বারে একটু কল দিবে, ভাবি?

রশ্নি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। একরকম মশকরা করেই সে বলে ওঠে,
-বিয়ের আগেই এত পিরিত? বিয়ের পর তো তাহলে আমাদের আর পাত্তাই দিবি না। নিজের ফোন দিয়ে দিলেই তো হয়।

কিন্তু পরক্ষণেই নিশাতের চোখের দিকে তাকিয়ে সে অনুভব করতে পারে, তার এ মশকরা এ পরিবেশে মানানসই হয়নি। ঘটনা ভিন্ন কিছু। সে আর কথা না বাড়িয়ে আহিরের নাম্বার ডায়াল করে। নাম্বার বন্ধ। ফোনটা কানে ধরেই সে নিশাতের দিকে চেয়ে বললো,
-ব্যাপারটা কী?

-আহির তার নতুন প্রেমিকার সাথে পালিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে যেই মেয়েটি আমাকে কল দিয়েছিল, সে তার প্রেমিকা।

রশ্নি ভাবি কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার কিছু বলা উচিত। কিন্তু বলতে পারছেন না। মূলত গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না আর। নিশাত তার ননদ-এটাও যেমন সত্য, তেমনি প্রায় কাছাকাছি বয়স হওয়ায় মেয়েটিকে সে নিজের বোনের মতই পরম স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে।

মেয়েটির এই অবস্থায় কী সান্ত্বনা দেবে সে! ভাবনার কূল কিনারা খুঁজে পায় না। বিয়ের দিন একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে যায়, তার হবু স্বামী পালিয়ে যায়। কোনো মেয়ের জন্য এর চেয়ে কঠিনতম দূর্ভাগ্যের সাজা আর কীইবা হতে পারে?

নিশাতের কাঁধে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা স্বরে সে জিজ্ঞাসা করে,
-এবার উপায়?
-কী উপায় খুঁজতে বলছো ভাবি? তাকে প্রেমিকার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবো? এও কী সম্ভব, বলো? একজন নারী তার স্বামীকে ভালো না বেসেও দাঁতে দাঁত চেপে দিব্বি সারাজীবন সংসার করে যেতে পারে, শরীরের অধিকারও দিতে পারে। ও খুবই সাধারণ কাজ। কিন্তু যে পুরুষটি তার সঙ্গিনীকে ভালোবাসতে পারেনি, তাকে বিয়ের বন্ধন দিয়ে নিজের করে আটকে রাখা যায়? যায় না।

হুট করে মেয়েটা শক্ত কথা বলতে শুরু করেছে। শক্ত কথা বলার অভ্যাস তার নতুন নয়। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে এত শান্ত কীভাবে আছে সে! রশ্নি খেয়াল করে, নিশাত তার শাড়িটা একপাশে নামিয়ে একটা জামা পরে নিলো। তারপর বিয়ের সাজগোজ ধুয়েমুছে একেবারে বিয়েতে আসা অতিথিদের চেয়েও অতি সাধারণ হয়ে এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে।
-ভাবি, চলো। বাবার কাছে যাবো।
-কী বলবে?
-বলবো এই যে-বাবা, আমি আহিরকে বিয়ে করবো না।
-দোষ তো তোমার নয়।৷ বিয়ে ভেঙেছে আহিরের কারণে। কিন্তু তুমি কেন দায় নিবে?
-কারণ আমি আহিরকে ভালোবাসি।

জবাব দিয়েই সে বাইরে বেরিয়ে যায়। মেয়েটা আহিরের প্রতি এত অল্পদিনের ব্যবধানেই গভীর ভালোবাসার মায়ায় পড়ে গেছে! আহা, কী ভাগ্য আহিরের!

রশ্নির এই ভাবনার বাইরেও আরও যে কিন্তু থেকে যায়, তা সে জানে না। বিয়ে ভেঙেছে আর পাত্রী বিয়ে ভেঙে দিয়েছে- এই বিষয় দুটির বিস্তর পার্থক্য হয়তো তার পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। নিশাতের বাবা রনজু হাবীব কীভাবে সামলাবেন, কে জানে!

(২)
রাত সাড়ে এগারোটা পার হয়ে গেছে। আহির পিছু পিছু হাঁটছে। কিছুক্ষণ আগেই কাজী অফিস চক্কর দিয়ে এলো সে। কিন্তু, বিশেষ লাভ হয়নি। কাজী অফিসে টানা সাড়ে চার ঘন্টা বসে থেকে অবশেষে ফিরে আসতে হলো। আহিরের বিয়ে হয়নি। আরোশী তাকে বিয়ে করেনি।

আহির যখন বিয়ের শেরওয়ানি পরতে ব্যস্ত,তখন হঠাৎই তার ঘরে এসে হাজির হয়েছিল আরোশী। দুই চোখ ফুলে আছে, মুখটা মলিন। দেখেই বুঝাই যাচ্ছে, মেয়েটা প্রচুর কান্নাকাটি করেছে। আহিরের বুকের ভিতর কেমন যেন ধক করে উঠলো।

-কান্না করেছো আরোশী?
-করেছি।
-কেন?
-তোমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সেই শোকে। তুমি বিয়ের পিঁড়িতে বসছো কেন আহির?

আরোশীর কান্না আহিরের সহ্য হচ্ছে না। মেয়েটা তার কারণে কাঁদছে। একটা মেয়ে তার জন্য কাঁদছে! এই মুহুর্তটি তার কাছে পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্যের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মনে মনে আরোশীর জন্য এক সমুদ্র অনুভূতির বীজ বপন করেছিল সে। কিন্তু আরোশীর পক্ষ থেকে কোনোদিন উপযুক্ত সাড়া না পেয়ে অনুভূতির সবটা ভিতরেই কবর দিয়ে ফেলেছে সে। আজ সেই মৃত গোরস্থানে কীসের যেন শীতল পরশ বয়ে যাচ্ছে!
-আমি বিয়ে করলে তোমার ক্ষতি কী?

-আমি যে তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। আহির, তোমাকে আমি একেবারে হারাতে পারব না। প্লিজ, দোহায় লাগি। আমাকে একা করে দিও না।
-ভালোবাসো?

আরোশী জবাব দিলো না। অঝোরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। আহির ক্ষণিক মুহুর্ত বিয়ের পাগড়ীর দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
-আমি তোমাকে ভালোবাসতাম আরোশী। কিন্ত তুমি কোনোদিন ধরা দাওনি। ভয়ে আমি পিছিয়ে গেছি শুধু। আজ যদি তোমাকে নিয়ে পালাতে চাই, তবে রাজি হবে?
-কখন পালাবে? আমি কি ব্যাগ নিয়ে আসবো? নাকি এভাবেই যাবে?

তার এমন অকস্মাৎ প্রশ্নে আহির যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সে কী সত্যি বলছে!
আহির আর বিন্দুমাত্র ভাবনার অবসর নেয় না। পাত্রীপক্ষকে যদি এখন ফোন দিয়ে বিয়ে ক্যান্সেল করা হয়, তবে নির্ঘাত একটা অনাস্থা ঘটবে। এর চেয়ে আরোশীকে নিয়ে আজকের রাতের জন্য দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়াই উত্তম হবে।
-আরোশী, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
-বিয়ে না করলে তোমার কাছে কেন ছুটে এলাম!

আরোশীর জবাবে আর প্রশ্ন করার দুঃসাহস পায় না আহির। সবার সামনেই খুব স্বাভাবিক আচরণ দেখিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে দুজন।

অথচ এই দীর্ঘ সময়েও আর বিয়ে করা হয়নি তাদের। ফাঁকা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আহির জিজ্ঞাসা করে,
-কী হচ্ছে বলো তো? এভাবে বিয়ে না করে কাজী অফিস থেকে ফিরে এলাম কেন আমরা? আমি একটা ছেলে হয়ে বিয়ের দিন আরেকটি মেয়েকে ধোকা দিয়ে কাপুরুষের মত তোমাকে নিয়ে পালিয়েছি, তাও আবার নিজের বিয়ের দিনে। আর তুমি আমাকে এভাবে ঘুরাচ্ছো?

-আহির, আমরা আগামীকাল বিয়ে করবো। ততক্ষণ পর্যন্ত ফুপির বাসায় থাকবো। ওখানে কেউ থাকে না। ফুপিও গত সপ্তাহে সিলেট গেছেন। তোমার কি কোনো আপত্তি আছে?

-না। দুজন একসাথে পড়াশোনা করেছি। একে অপরকে সাপোর্ট করেছি। আর তোমাকে এখন আমি আমার করে পেতে যাচ্ছি। সেখানে তুমি জিজ্ঞাসা করছো-আমার আপত্তি থাকবে কি-না! কী যে বলো না আরোশী!

কিন্তু আহিরের ভুল ভাঙে আরোশীর সাথে ওর ফুপির বাসায় পৌঁছানোর পর। আশেপাশে অন্ধকারে তাকিয়ে যা দেখা যায়, অধিকাংশই আন্ডার কনস্ট্রাকশনে। ফুপির বাসাটা সম্ভবত বছর বিশের মত পুরনো। খালি চোখে স্থানীয় বাসিন্দাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

ঘরের ভিতর ঢুকতেই আরোশী ওকে জাপ্টে ধরে। আহির তাকে সামলাতে না পেরে সোফাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আহির টের পায়, আরোশী তার দুই হাত দড়ি দিয়ে শক্ত বাঁধন দিচ্ছে।
-আরোশী, কী করছো তুমি? এভাবে হাত বাঁধছো কেন?

আরোশী ওর দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসে।
-আজকে আমরা ওয়াইল্ড কিছু করবো আহির।

-সিরিয়াসলি? তাও আবার বিয়ের আগে, এইভাবে!

আহির যেন একরকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েই আরোশীর কাছে আত্মসমর্পণ করে চোখ বন্ধ করে কল্পনায় ভেসে সাঁতরাতে থাকে। কিন্তু আরোশী ওর দিকে এগিয়ে আসে না। বেশ কিছুক্ষণ পরেও মেয়েটির সাড়াশব্দ না পেয়ে আহির চোখ মেলে তাকায়।
তার সামনে আরোশী দাঁড়িয়ে। ওর হাতে ইলেকট্রিক তার।
-বিদ্যুতের লাইন! এসব কী করবে তুমি?

-তোমাকে বৈদ্যুতিক শক দেবো। তুমি যন্ত্রণায় কাঁতরাবে। আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো। কী সুন্দর, তাই না?

(চলবে…)

“মোহমেঘ” পর্ব:-০১
– সুহাসিনী
সুহাসিনী ডায়েরী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here