এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৮

0
1332

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৮
মহিমা বেগম ও মাশরিফ তাদের টাঙ্গাইলের বাড়িতে গেছেন। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পরপরই কাশফাদের পরিবারের সাথে বৈঠকে বসেছে। বৈঠকের সবাই নীরব। মহিমা বেগমই প্রথমে কথা তুললেন,
“দেখো কাশফা, তোমাকে এটা বুঝতে হবে যে ভালোবাসা জোর করে হয় না। যে তোমাকে ভালোবাসে না তার সাথে বিয়ে হলে না তুমি সুখে থাকবে, না সে। মানসিকভাবে প্রচণ্ড কষ্টে থাকবে। মাশরিফ যাকে ভালবাসে আমরা তার সাথেই ওর বিয়ে ঠিক করেছি। আমি আশা করব, তুমি দুইজন ভালোবাসার মানুষের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে না। তুমি বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?”

মহিমা বেগম বলার পর সভা আরো কিছুটা সময় নীরব থাকে। তারপর কাশফার মা বলেন,
“ভাবি, আপনি তো জানেন আমার মেয়েটা মাশরিফকে কতোটা ভালোবাসে। ও তো দুইবার সু*ই*সা*ইড এটেম্প্টও করেছিল। আমাদের খুব আদরের মেয়ে। ওর কষ্ট দেখতে পারি না। দুইদিন ধরে ওর বেহাল দশা দেখে আমার ও ওর বাবার নাওয়া-খাওয়া, ঘুম সব উড়ে গেছে। তাই জন্য আপনাদের এতো অনুরোধ করে আসতে বললাম।”

“দেখেন ভাবি, আপনি আপনার মেয়ের কথা ভাববেন এটা স্বাভাবিক। আমিও আমার ছেলের কথা ভাবব এটাও স্বাভাবিক। এখন জোড় করে তো কিছু হয় না। জোড় করলে বরং হীতের বিপরীত হবে। আমার ছেলে অনেক আগে থেকে বরং প্রথম থেকেই বলছিল, সে আপনার মেয়েকে পছন্দ করে না। এখন যদি আমি আমার ছেলেকে জোড় করি তাহলেও কিন্তু আপনার মেয়ে সুখী হবে না। আলটিমেটলি দুজনেই অসুখী। সেই সাথে দুটো পরিবারও অসুখী। তাই সময় থাকতেই যদি সেটা ঠিক করা যায় তবে কেন নয়?”

মহিমা বেগম বলার পর কাশফার মা-বাবা মাথা নিচু করে মৌন রইলেন। কাশফা কিছুটা সময় নিজের কথাগুলো গুঁছিয়ে ইতস্তত করে কণ্ঠে অসহায়ত্ব এনে জবাবে বলে,
“জি আন্টি আমি বুঝতে পেরেছি। আমার ভুল হয়েছে। আমি আর কখনো মাশরিফ ও তার ভালোবাসার মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়াব না।”

কাশফার হঠাৎ বদল দেখে মাশরিফের কিঞ্চিত খটকা লাগল। এখানে আসার পূর্বেও তো নাছোড়বান্দার মতো কাঁদছিল! তাহলে এই কিছু ঘণ্টার মধ্যে এমন আমূল পরিবর্তন! তাও শুধু একবার বলাতে! কেমন রহস্যময় লাগছে। তাও মাশরিফ নিজের মনের সন্দেহ প্রকাশ্যে আনল না। কাশফা ঝামেলা করেনি তাতে তার জন্যই তো ভালো হয়েছে।
কাশফার কথায় মহিমা বেগম বেশ খুশি হন। তিনি প্রসন্নসূচক বলেন,

“তুমি সিচুয়েশনটা বুঝেছ তার জন্য ধন্যবাদ মা। দোয়া করি তোমার জীবনে তোমাকে বুঝবে, ভালোবাসবে এমন কেউ আসুক। সুখী হও জীবনে।”

কাশফা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,
“দোয়া করবেন আন্টি। আজ তাহলে আসি। আপনারা সাবধানে থাকবেন।”

তারপর কাশফা তার বাবা-মাকে উঠতে বলে। কাশফার বাবা-মা বিদায় নিয়ে চলে যায়। মাশরিফ এতোটা সময় যাবত তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কাশফার আচরণ লক্ষ্য করছিল। কিছুতেই তার মনের সন্দেহ দূর হচ্ছে না। সে তো জানে কাশফা কেমন মেন্টালিটির! মনের মধ্যে খচখচ বেড়েই চলেছে।
মহিমা বেগম টি-টেবিলটা গুঁছিয়ে নিয়ে ছেলেকে এখনো সোফায় বসে থাকতে দেখে কাছে গেলেন। দেখলেন মাশরিফ অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। তিনি ছেলের পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বললেন,

“কী-রে? এভাবে বসে আছিস কেন?”

মায়ের ডাকে মাশরিফের সম্বিৎ ফিরে। সে বলে,
“এমনিতেই। আচ্ছা মা,”
“হ্যাঁ বল।”
“কাশফা এতো সহজে মেনে গেলো! কেমন উইয়ার্ড না?”
“আরে কী-সের উইয়ার্ড! মেয়েটা বাস্তবতা ও সত্য বুঝতে পেরেছে।”
“না মা। তুমি বুঝতে পারছ না। সবকিছু এতো সহজ না। দুইদিন ধরে সে বুঝল না। এমনকি আমরা এখানে আসার আগে দিয়েও সকাল থেকে দুইবার কল করে জিজ্ঞেসা করেছে আমরা কখন আসব। তাহলে এখন তো কনভারসেশন লেংদি হওয়ার কথা। কিন্তু এতো ইজিলি মেনে গেল!”

মহিমা বেগম এবার ছেলের মাথায় চা*টা মে*রে বলেন,
“রাখ তোর আর্মি বুদ্ধি। ভালোয় ভালোয় অল্পতে বুঝে গেছে তাতে তো আমাদেরই ভালো হয়েছে।”

মাশরিফ চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা এলিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,
“মা বুঝার চেষ্টা করো, সামনাসামনি কী এমন বুঝিয়েছ যে ফোনে ওকে বুঝাওনি? তাছাড়া ওর মেন্টালিটি এমন না। ও নিজের সকল চাওয়া যেকোনো মূল্যে পূরণ করেই ছাড়ে। এর আগেও ও এমন করেছিল। আমার কেমন জানি খটকা লাগছে।”

“বসে থাক তুই তোর খটকা নিয়ে। আমি যাই রাতের খাবার গরম করি গিয়ে। কাল তো খুব সকালে বের হতে হবে।”

এটা বলে মহিমা বেগম ছেলের পাশ থেকে উঠে রান্নাঘরে চলে গেলেন। আর মাশরিফ তার আপন ভাবনায় মশগুল।

________

তিতিরের মা সব আয়োজনে ব্যাস্ত। সপ্তাহ জুড়ে উনি কাজ আগাচ্ছেন। তিতির এসব দেখে ক্লান্ত হয়ে বলে,
“মা, এতো অস্থীর হচ্ছো কেন? জাস্ট আকদ হবে, তাতেই যদি এক সপ্তাহ ধরে ঘোরদোর উলট-পালট করে ফেলো! তবে অনুষ্ঠান হলে কী করতে?”

নাজমা বেগম ধ*ম*কে তিতিরকে চুপ করিয়ে দিলেন। বললেন,
“থাম তুই। আমরা মাত্র তিনজন মানুষ। বিয়ে ছোটো হোক বা বড়ো কাজ তো আছেই। আপাদের বাড়ি থেকে মানুষ কম আসলেও তখন ওরা কুটুম হিসেবে আসবে। নতুন জামাইয়ের জন্য ঘর সাঁজাতে হবে তো। দেখ দুইদিনে কতোকিছু কিনেছি।”

“হু ভালো করেছ। আমাকে বারবার কল, মেসেজ করে বিরক্ত করবা না। আমি ক্লাস, ল্যাবে থাকি। সামনে প্রফ। আমার পড়তে হবে।”

তিতিরের বিরক্ত কণ্ঠে নাজমা বেগম তেমন একটা পাত্তা দিলেন না। তিনি নিজের মতো কাজ করতে থাকলেন। তিতির নিজের পড়াতে মনোযোগ দিতে গিয়েও মনে পরে সকালে ইনায় তাকে ডেকে অভিনন্দন জানিয়েছিল সেই সাথে কিছু বলেছিল। কথাগুলো মনে পরতেই তিতির হেসে ওঠে।

ফ্ল্যাশব্যাক,
“কনগ্রাচুলেশন তিতির। আই অ্যাম সো হ্যাপি ফর ইউ। এটলাস্ট তুমি রাজি হয়েছ।”
ইনায়ার কথা শুনে তিতির হালকা হাসে। ইনায়া আবার বলে,
“কারও ভালোবাসার পূর্ণতা দেখেও শান্তি লাগে। ইশ যদি আমারটাও এতো সুন্দর হতো!”

“আরে আপু হবে। ধৈর্য ধরো।”
“আর ধৈর্য! এতো বছরে কেবল ভালো ফ্রেন্ডশিপটা হয়েছে। তারপর মন লেনাদেনা হতে হতে আমার সবগুলো চুল মনে হয় ঝরে যাবে!”

ইনায়ার কথাটাতে দুঃখ ও রম্যতা যেন পারস্পরিক মেলবন্ধনে আছে। তিতির হেসে ফেলে। অতঃপর বলে,
“দুইজনেই নাহয় টাক হয়ে বিয়ে করবে! দারুণ হবে বলো?”

ইনায়া কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“মজা করছ আমার সাথে? তোমার রাফি ভাই লোকটা যে এতো বদ! তুমি তো জানো না। এই লোক আমাকে ঘুরিয়ে আনন্দ পায়।”
“তাহলে এক কাজ করো। এক সপ্তাহ ওই লোকটাকে একদম পাত্তা দিবে না। দেখবে সে নিজে থেকে তোমাকে পাত্তা দিচ্ছে।”

ইনায়া একটু মজা করে বলে,
“এর আগেও করেছিলাম তখন ফ্রেন্ডশিপটাও ছিল না। তবে তখন তার কোনো হেলদোল ছিল না। কিন্তু এখন তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে কিছু তো হবে। কারণ তুমিই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ!”

শেষোক্ত কথাটা তিতির বুঝল না। তাই জিজ্ঞেসা করল,
“মানে?”
“মানে কিছু না। আমার রাউন্ড আছে। গেলাম। অনেক অনেক শুভ কামনা তোমাদের জন্য।”

ইনায়া চলে গেলে তিতিরও তখন নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে সেসব আর ঘাটে না।

ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড,,

তিতির এবার নিজে নিজেই বলে,
“আপু, কী তবে বুঝাতে চাইল যে মাশরিফ আমাকে ইগনোর করাতে আমি..! কিন্তু! থাক যা খুশি হোক। আমি রাফি ভাইয়ের সাথে কথা বলব।”

________

রাতের খাবার শেষে যখন রাত ১০.৩০টার বেশি বাজে তখন পুরো এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। ঠিক তখনি হুট করে মাশরিফদের বাড়ির আইপিএসটাও চলে গেছে। হুট করে এর কারণটা মাশরিফ বুঝতে পারল না। তার মনে এতেও খটকা লাগছে। কারেন্ট চলে যাওয়ার দরুণ মাশরিফ তার মায়ের রুমে গিয়ে বলল,

“মা চলো গার্ডেনে বসি।”

“কেন? এতো রাতে হঠাৎ বাহিরে যাব কেন? আইপিএসটাও চলে আসবে তো।”

বলতে বলতে চলেও আসল।
“দেখলি। চলেও এসেছে।”

“তাও চলো মা। বাসার দক্ষিণ সাইডের ওখানে বসি। অনেকদিন বসি না। বছরেরও বেশি হবে। ওখানে বাতাস অনেক। চল না প্লিজ।”
“আচ্ছা চল।”

মহিমা বেগম আর রাজি না হয়ে পারলেন না। বাহিরে যাওয়ার সময় ঘরের লাইট বন্ধ করে দিল কিন্তু নিজের ও মায়ের ঘরের ফ্যাস চালু রাখল যাতে বুঝা যায় সবাই ঘুমে। সদর দরজা বাহির থেকে সিটকিনি লক না করে চাবির লক করল যাতে বাহির থেকে মনে হয় ভেতরে কেউ আছে। সবটাই আসলে তার সন্দেহের বহিঃপ্রকাশ। ওরা শব্দহীন পায়ে বাগানের দক্ষিণ পাশে গিয়ে বসে। বসে বসে ছোটোবেলার গল্প করছে।

এদিকে আরও কিছুটা সময় পর রাত ১১টার বেশি বাজে। এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। পুরো নীরব। এখন টে*রো*রি*স্ট দলের লোকদের কাশফা দিকনির্দেশনা দিয়ে মাশরিফদের বাড়ির মেইন গেইটে নিয়ে আসে তারপর খুব নিচু আওয়াজে বলে,

“শব্দ ছাড়া একটা জানালা খুলে গ্যাসটা ভেতরে দিয়ে দিবেন। এতো সময়ে ওরা ঘুমিয়ে গেছে। পুরো বাড়ি অন্ধকার। এখনই সুযোগ। সারারাত কেউ বুঝবে না। প্রতিটা শ্বাসপ্রশ্বাসে গ্যাসটা নিবে। অতঃপর সকালে ওদের লা*শ বের হবে!”

“জি। আপনি এবার যেতে পারেন।”

“কোনো দরজা জানালা খোলা রাখা যাবে না। অবশ্য ওরা খোলা রাখেও না। জলদি কাজে লেগে পরুন।”

টে*রো*রি*স্ট দলের লোকেরা দ্রুত একটা জানালা খুলে গ্যাসের উৎসটা ভেতরে ফেলে দিয়ে চলে গেল। কাশফা শান্তির শ্বাস নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেল। সে তো জানেও না যে বাড়িটা এই মূহুর্তে ফাঁকা!

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ। সমাপ্তি আসন্ন পাঠকমহল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here