মেহের পর্ব-২

0
1202

#মেহের
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২

আচ্ছা? এমন যদি হত, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ আগে থেকেই চিনতে পারত তার ভাগ্যে থাকা প্রিয় মানুষটাকে। তাহলে কেমন হত? বেশ হত না? না কাউকে হারানোর দম বন্ধ করা কষ্ট নিয়ে জীবন্ত লাশের মতো বাঁচতে হত, আর না পৃথিবী জুড়ে আত্মহত্যার অভিশাপ নামত। কিন্তু আফসোস, সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই অলৌকিক ক্ষমতা দেননি। কপালের লিখন যে আগে থেকেই ঠিক করা। পৃথিবী উলটে গেলেও তা পালটানো সম্ভব না।

একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস চেপে নড়েচড়ে বসল মেহের। চোখে-মুখে তার নিদারুণ বিরক্তি। টেবিলের ওপাশে তার মুখোমুখি বসে আছে আদ্রিশ। প্রচন্ড তাপমাত্রার সুবাদে তার পরনের কালো টি-শার্টটা ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। চোখে-মুখে কিছুটা গাম্ভীর্যের ছাপ ফুটে উঠেছে। ঘর্মাক্ত ফরসা মুখটা হালকা গোলাপি আভা ধারণ করেছে। দুহাত ভাঁজ করে টেবিলে রেখে সে সূক্ষ্ম চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। টানা পাঁচ মিনিট ধরে মেহের এই লোকের ওপর বিরক্তি নিয়ে অন্য দিকে মুখ করে বসে আছে। গতকাল মেহেরের পুরো পরিবার ঢাকায় তার চাচার বাড়ি এসেছে। আর আজ সকালেই হঠাৎ করে তার বাবা বলে বসেছে আদ্রিশও ঢাকায় এসেছে। তাই সে না কি মেহেরের সাথে দেখা করতে চায়, একে অপরকে জানার জন্য। কথাটা শুনেই মেহেরের মাথাটা ধপ করে উঠেছিল। কিন্তু বাবার মুখের ওপর কোনো কথা বলার সাহস তার আজ পর্যন্ত হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই আজ বিকেলে আদ্রিশের বলা রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে। যদিও সে একা আসেনি। তার চাচাতো ভাই তাকে রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দিয়ে গেছে, আর বলে গেছে আদ্রিশ তাকে বাসায় পৌঁছে দিবে। মেহের মুখ খুলে কিছু বলতেও পারেনি। টানা সতেরো মিনিট অপেক্ষা করিয়ে আদ্রিশ এসেছে। তা-ও এসেই গা জ্বালা করা কান্ড করছে। কথা নেই বার্তা নেই হা করে তাকিয়ে আছে। মোহরের বিরক্তি বুঝতে পেরে আদ্রিশ চমৎকার একটা হাসি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“তো অ্যাংরি বার্ড? কেমন আছো?”
মেহের গোমড়া মুখে জবাব দিলো,
“ভালো। কী বলবেন বলুন। আমি বেশিক্ষণ বসতে পারব না।”
“আরে ধৈর্য ধরো। অলরেডি সতেরো মিনিট বসে ছিলে। আরও সতেরো মিনিট বসলেও কোনো প্রবলেম নেই। ওভার অল, উডবি হাসবেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছ তো।”
মেহেরের মুখটা শক্ত হয়ে এল। নিজেকে সংযত রেখে পুনরায় বলল,
“যা বলার আছে বলুন।”
আদ্রিশ মাথা দুলিয়ে একটু নড়েচড়ে বসে বলল,
“হ্যাঁ, মূল কথায় আসি। তো তুমি হানিমুনে কোথায় যেতে চাও বলো।”
মেহের যেন বেকুব বনে গেল। চোখ দুটো গোলাকার করে বলল,
“আপনার সাথে আমি এসব ফালতু কথা বলতে এসেছি? আশ্চর্য!”
“ফালতু! ফালতু বলছো কেন? এটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। তুমি জানো আমি সেই ছোটোবেলা থেকে হানিমুন নিয়ে কতশত প্ল্যান জমিয়ে রেখেছি? তুমি আমার হবু বউ হয়ে আমার এত সাধের স্বপ্নকে ফালতু বলছো? ইটস নট ফেয়ার”, ভারি অবাক হবার ভান করে বলল আদ্রিশ।

মেহের বার তিনেক চোখ ঝাপটে এবারও বেকুবের মতো তাকিয়ে বলল,
“ছোটোবেলা থেকে মানে? আপনি তো দেখছি অকালপক্ব ছিলেন। এবার তো ফালতু না, দ্যা ফালতু বলব।”
“বাহ্! হবু বউ এখনই চার আনার দাম দিচ্ছে না। ওয়াও, নাইস, অসাধারণ, অতুলনীয়, অভাবনীয়, অকল্পনীয় ইত্যাদি!”
মেহের এবার দাঁতে দাঁত চেপে বিরক্তি দমানোর চেষ্টা করল। আদ্রিশ পুনরায় বলল,
“দেখো, শেষমেষ আমার সব প্ল্যান ভেস্তে দিয়ো না। আমি কিন্তু সব প্ল্যান করে রেখেছি। তুমি জাস্ট প্লেস সিলেক্ট করবে।”
মেহের বড়ো করে একটা দম নিয়ে বলল,
“এসব কথা বন্ধ করুন প্লিজ। আপনাকে আমি বারবার বলেছি যে এই বিয়েতে আমার মত নেই।”
“তা গিয়ে তোমার বাবাকে বলো। আমাকে কেন বলছো?”
“আপনাকে তো এটাও বলেছিলাম যে বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস আজ পর্যন্তও আমার হয়নি।”
“আমাকে বলে তো কোনো লাভ নেই। আমিও তোমাকে বারবার বলেছি যে এই বিয়েটা হবেই। এখনও যদি তুমি ভেবে থাকো যে আমি স্ব-ইচ্ছায় বিয়েটা ভেঙে দিব। তবে সেটা নিতান্তই বোকামি।”

মেহেরের চোখে-মুখে অসহায়ত্বের ছাপ পরিলক্ষিত হলো। চুপসানো মুখে সে বলল,
“আপনি কেন এমন বেপরোয়ার মতো করছেন বলুন তো। একবার আমার দিক থেকে ভাবুন। আমার বড়ো আপুর এখনও বিয়ে হয়নি। চোখের সামনে ছোটো বোনের বিয়ে দেখলে ওর মনের অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছেন না? বোন হয়ে আমি ওকে এমন আঘাত কীভাবে দিব?”
“ব্যাস এটুকুই তোমার অমতের কারণ?”
অগত্যা মেহের ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। আদ্রিশ সহজভাবে বলল,
“এটা তোমার ফ্যামিলি ম্যাটার। এখানে আমার কিছু বলার নেই। সরি।”
পুনরায় মেহেরের মাথায় রাগ চেপে বসল। চোয়াল শক্ত করে বলল,
“দুনিয়ায় এত এত সুন্দরী মেয়ে থাকতে আপনি আমার পেছনে কেন পড়েছেন বলুন তো? কী মধু পেয়েছেন আমার মধ্যে?”
আদ্রিশ দুষ্টু হেসে বলল,
“এখনও তো বিয়েই হলো না সুইটহার্ট। বিয়ের পর না হয় এই প্রশ্ন কোরো। এখনই এমন প্রশ্ন করে আমায় লজ্জায় ফেলো না গো।”
মেহের এবারও আহাম্মক বনে গেল। অসভ্য লোকটা কোন কথার কী মানে ধরে! আদ্রিশের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সে রাগে আর লজ্জায় মুখ কুঁচকে বিড়বিড় করল,
“ছিহ্!”
আদ্রিশ ভ্রু জোড়া নাচিয়ে বলল,“কী ব্যাপার সুইটহার্ট? এখনই এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? বাসর রাতের জন্যও কিছু লজ্জা তুলে রাখো। তুমি জানো? আমার কত ইচ্ছে বাসর রাতে ঘোমটা উঠিয়ে তোমার লাজুক মুখটা দেখার।”

মেহেরের গা জ্বলে উঠল। অধৈর্য হয়ে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পার্স হাতে নিল। আদ্রিশ ব্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আরে, কোথায় যাচ্ছ?”
মেহের উত্তর দিলো,
“বাড়ি যাচ্ছি।”
“কফিটা তো পড়ে আছে। খেয়ে যাও।”
“আপনি খান আপনার কফি।”

কথাটা বলেই মেহের গটগট করে হাঁটা ধরল। অগত্যা আদ্রিশ তাড়াহুড়ো করে কফির বিলটা পরিশোধ করে ছুট লাগাল রেস্টুরেন্টের বাইরে। মেহের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছে। দৌড়ে গিয়ে আদ্রিশ মেহেরের সামনে দাঁড়াল। রাস্তার কিনারায় পার্ক করা একটা গাড়ি ইশারায় দেখিয়ে বলল,
“আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। তুমি তো একা যেতে পারবে না। তোমার বাবাকে বলেছি আমি তোমাকে পৌঁছে দিব।”
“প্রয়োজন নেই”, তিক্ত মুখে বলল মেহের।
আদ্রিশ দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
“সম্পর্কে তুমি আমার উডবি ওয়াইফ। তাই তোমার রেসপন্সিবিলিটিও আমার। আর আমি আমার রেসপন্সিবিলিটিতে কোনো খাঁদ রাখি না। সো জেদ কোরো না। চুপচাপ চলো।”
“আমি কারো রেসপন্সিবিলিটি নই। আর আপনার তো নই-ই। দয়া করে সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।”
“তুমি কি চাও এই পাবলিক প্লেসে আমি তোমাকে কোলে তুলে গাড়িতে উঠাই?”
আদ্রিশের শান্ত স্বরের হুমকিতে মেহের চোখ বড়ো করে তাকাল। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“কীসব বলছেন?”
“আমার কিন্তু কোনো প্রবলেম নেই। তোমারও যদি প্রবলেম না থাকে তো চলো কোলে তুলেই নিয়ে যাই। আফটার অল আমার হবু বউ বলে কথা। এটুকু যত্ন তো করতেই পারি।”
আদ্রিশ দুপা এগিয়ে আসতেই মেহের হাত উঠিয়ে বাঁধা দিয়ে দ্রুত বলে উঠল,
“এই খবরদার, এগোবেন না বলছি। আপনি কি লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েছেন না কি?”
“স্ব-ইচ্ছায় গাড়িতে উঠবে কি না?”
আদ্রিশের কথায় সিরিয়াসনেস টের পেয়ে মেহের কিছুটা হকচকিয়ে গেল। লোকটা যা অসভ্য, একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেহের বাধ্য হয়ে রাগে গজগজ করতে করতে গাড়ির দিকে পা বাড়াল। আদ্রিশ ঠোঁট এলিয়ে হেসে দ্রুত পায়ে হেঁটে মেহেরের আগে গাড়ির কাছে পৌঁছল। মেহের আসতেই গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। আদ্রিশের দিকে না তাকিয়ে মেহের গাড়িতে উঠে বসল। দরজা বন্ধ করে আদ্রিশ গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল। মেহেরের দিকে তাকিয়ে তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে আসতেই মেহের চমকে উঠল। মাথাটা দ্রুত পিছিয়ে নিয়ে চোখ দুটো বড়ো করে বলল,
“কী করছেন আপনি?”
“রোমান্স।”
বাঁকা হেসে কথাটা বলেই আদ্রিশ মেহেরের সিটবেল্ট লাগাতে ব্যস্ত হলো। মেহের চোখ-মুখ কুঁচকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। আদ্রিশ নিজের সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বলল,
“এখনই এত নেগেটিভ চিন্তা-ভাবনা করো কেন সুইটহার্ট? ওসব বিয়ের পরে কোরো।”
মেহের চরম বিরক্তি নিয়ে বলল,
“দয়া করে আপনার এই মুখ নামক মেশিন গানটা একটু বন্ধ রাখুন, আর গাড়ি স্টার্ট করে আমাকে উদ্ধার করুন প্লিজ।”
আদ্রিশ দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসতে হাসতে গাড়ি স্টার্ট করল। সেই হাসিতে যেন মেহেরের রাগের আগুনে ঘি ঢালা হলো। দাঁতে দাঁত পিষে সে বিড়বিড়াল,
“নির্লজ্জ!”
____________________________

মঙ্গলবার দিনটা যে মেহেরের কপালে শনি ডেকে এনেছে, এখনও তার এটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। এইতো দুদিন আগেই সে আদ্রিশের সাথে দেখা করে এল। তখনও জানত না তার দুদিন পরেই ঠিক কী ঘটতে চলেছে তার সাথে। আদ্রিশের সাথে দেখা হবার পরদিন সকালেই হঠাৎ তার চাচার বাড়িতে আদ্রিশের পুরো পরিবার এল। মেহেরকে সেজেগুজে তাদের সামনে যেতে হলো। এই পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল। কিন্তু যখন শুনল তার পরদিনই আদ্রিশের সাথে তার বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে, তখন মেহের দিশাহারা। মেহের আর আদ্রিশের পরিবার মিলে ঠিক করেছিল তারা নিজেদের মধ্যে ছোটো-খাটো অনুষ্ঠান করে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবে। কারণ দুই পরিবার ঢাকায় এসেছেই শুধুমাত্র বিয়েটা সহজভাবে সম্পন্ন করার জন্য। এসবের কিছুই মেহের জানত না। তার মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই যে। গায়ে হলুদ হলো না। পরিকল্পনামতো ছোটো-খাটো অনুষ্ঠান করে বিয়ে সমাধা হলো। বিয়ের আগেরদিন যখন মেহের জানতে পেরেছিল আগামীকালই তার বিয়ে। তখনও তার কিছুই করার ছিল না। তবে সে কেঁদেছিল। প্রচুর কেঁদেছিল। এমনকি এখনও কাঁদছে। কান্নাই যে তার একমাত্র সঙ্গী। বাকিটা সে আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছে। পরিবারের ইচ্ছেমতো বিয়ে করে আজ সন্ধ্যায় সে তার পরিবারকে ছেড়ে চলে এসেছে। তবে শ্বশুরবাড়ি নয়, মামা শ্বশুড়বাড়ি। আদ্রিশদের বাড়ি সিলেট। বিয়ের জন্যই তারা ঢাকায় মামার বাড়ি এসেছে। বিদায়ের সময় চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মেহের মূর্ছা গিয়েছিল। তারপর যখন হুঁশ ফিরছিল, তখন সে নিজেকে সম্পূর্ণ এক অপরিচিত রুমে আবিষ্কার করেছিল। রুম দেখেই বুঝেছিল এটা বাসর ঘর। সাজানো বাসর ঘরে চোখ বুলিয়েই সে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। কিন্তু সবাই ভেবে নিয়েছিল নতুন বউ তার পরিবার ছেড়ে চলে এসেছে বলেই কাঁদছে। হুঁশ ফেরার পর তার সমবয়সী দুজন মেয়ে এসে তার বিয়ের সাজ পালটাতে সাহায্য করেছিল। তারপর থেকে অনেকেই রুমে এসে তার সাথে পরিচিত হয়ে গেছে। এরমধ্যে তার বড়ো বোনের বয়সী বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে এসেছিল তাকে খাওয়ানোর জন্য। মেয়েটা না কি তার একমাত্র ননদ। আদ্রিশের ছোটো বোন আরোহী। মেয়েটা তার সাথে নানা গল্প করতে করতে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মেহের খেতে পারেনি। দু লোকমা খেয়েই নাকোচ করায় আরোহী চলে গিয়েছিল। তারপর আর কেউ আসেনি। আরোহী যাওয়ার সময় বলে গেছে কিছুক্ষণ পর আদ্রিশ আসবে। এদিকে মেহেরের কান্নারা আজ বাঁধ মানতে নারাজ। স্নিগ্ধের সাথে যে ভারী অন্যায় করে ফেলেছে সে। তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে শেষে অন্য কারো অপেক্ষায় বাসর ঘরে বসে আছে! একদিকে স্নিগ্ধের জন্য বুকে তোলপাড়, আরেকদিকে আদ্রিশকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। দুটো মিলিয়ে মেহের পড়েছে অকূল সাগরে। আদ্রিশ যা ছেলে, সে তার অধিকার আদায় করে ছাড়বে। কিন্তু মেহের? সে যে পারেনি ওই লোকটাকে নিজের স্বামী হিসেবে মানতে। তার পুরো হৃদয়টা জুড়ে যে একজন স্নিগ্ধেরই বসবাস, তা সে কীভাবে বুঝাবে? তবে কি স্নিগ্ধকে তার সারাজীবনের জন্য ভুলে যেতে হবে? এ-ও কি সম্ভব? সে তো চেয়েছিল অপেক্ষা করতে। বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে। কিন্তু পারল না। পরিবারের কাছে হার মানতে হলো। রাত প্রায় এগারোটার সময় মেহের যখন হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই তার পাশে পড়ে থাকা মায়ের ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। তার নিজস্ব ফোন নেই বলে আপাতত তার মায়ের ফোনটা তাকে দিয়েছে বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলার জন্য। বাড়ি থেকে কেউ ফোন করেছে ভেবে মেহের দ্রুত নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিল। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তার পুরো পৃথিবী থমকে গেল। হাত-পা-মস্তিষ্ক যেন কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে শুকনো ঢোক গিলতেই ওপাশ থেকে অতিপরিচিত সেই ডাক,
“জান।”
মেহেরের কন্ঠনালি আটকে গেল। কেন জানি কথা বেরোচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ ওপাশ থেকে ডাক পড়ার পর হঠাৎ মেহের ‘স্নিগ্ধ’ বলে ফুঁপিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে স্নিগ্ধের উদ্বিগ্ন কন্ঠ ভেসে এল,
“মেহের, কাঁদছো কেন জান? প্লিজ এভাবে কেঁদো না। আমি জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখিনি। মেহের, শুনছো তুমি?”
মেহের একইভাবে কেঁদে চলল। স্নিগ্ধ পুনরায় বলল,
“রাজশাহী চলে আসার পর আমার ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছিল। এনআইডি কার্ড বাড়িতে ফেলে রেখে এসেছি। তাই আগের সিম উঠাতেও পারছিলাম না। আসার পরপরই কাজে জয়েন হতে হয়েছে, তাই সঙ্গে সঙ্গে ছুটিও নিতে পারিনি। নতুন সিম কেনার পর মনে পড়েছিল যে তোমার মায়ের ফোন নাম্বার আমার মুখস্থ নেই। মামার থেকে বাবার নাম্বার নিয়ে বাবার সাথে কথা বলেছি। ভেবেছিলাম বাবার থেকে মামুলির নাম্বার নিব। কিন্তু বাবার কাছে ওর নাম্বার নেই। আর ও না কি তখন ওর নানাবাড়ি গিয়েছিল? তুমি তো তা জানোই। ফিরেছিল পনেরোদিন পর। বাবাকে আমি বলেছিলাম মামুলির সাথে কথা বলিয়ে দিতে। কিন্তু তখন ও কেন জানি আমার সাথে কথা বলতে নারাজ। অনেক চেষ্টা করেও আমি তোমার নাম্বার জোগাতে পারিনি। গতকাল আমি গ্রামে এসেছি। তোমার খোঁজ করে জানতে পেরেছি তুমি ঢাকায় গেছ। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। কবে ফিরবে?”
শেষের কথাটুকু যেন মেহেরের পোড়া ঘায়ে নুনের ছিটা দিলো। তার কান্না থামাথামির নাম নিচ্ছে না দেখে স্নিগ্ধ করুণ কন্ঠে বলল,
“অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি জান? ঠিকই তো, দু-দুটো মাস তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ ছিল। আমি জানি এর কষ্ট কেমন? তোমার মতো আমিও কষ্ট পেয়েছি জান। প্রচন্ড মিস করেছি তোমায়। খাওয়া-ঘুম সব হারিয়ে গিয়েছিল আমার। তোমার কন্ঠ শোনার জন্য সারাক্ষণ মনটা অস্থির লাগছিল। এখনও কি একটু কথা বলবে না? মিষ্টি কন্ঠটা শুনে আমার মনটা শান্ত করতে দিবে না? আমি তো ফিরে এসেছি তোমার কাছে।”
“দুদিন আগে কেন ফিরলে না স্নিগ্ধ? আজই কেন আমাকে ফোন করলে? সবকিছু শেষ করে দিয়েছ তুমি।”
কাঁদতে কাঁদতে কিছুটা জোরেই কথাগুলো বলল মেহের। স্নিগ্ধ অসহায় গলায় বলল,
“আমার ওপর অনেক রাগ জমে আছে, তাই না? অভিমানের পাল্লা ভারী হয়ে গেছে? তুমি একবার আমার সামনে এসো, আমি শতবার কান ধরে উঠ-বস করব। প্রমিস।”
“ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে স্নিগ্ধ। আমি ফিরতে পারব না। তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও না প্লিজ। আমি তোমার কাছে যাব।”
“এই পাগলি, এসব কী বলছো? কী হয়েছে, বলো আমাকে।”
“আজ আমার বিয়ে হয়ে গেছে স্নিগ্ধ”, হেঁচকি তুলে কথাটা বলল মেহের।
স্নিগ্ধ যেন হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। এইমাত্র শোনা কথাটা কোনোমতেই সত্যি মনে হলো না। সে সন্দিহান কন্ঠে বলল,
“ফাজলামি করছো তুমি? আমি সরি জান। আর রাগ করে থেকো না। এবার একটু মিষ্টি করে কথা বলো তো। অস্থির মনটাকে একটা শান্ত করো।”
“আমি এখন বাসর ঘরে বসে আছি, হাসবেন্ডের অপেক্ষায়। এখনই সে চলে আসবে।”
এবার স্নিগ্ধর রাগ উঠে গেল। কন্ঠে কিঞ্চিত রাগ মিশিয়ে সে বলল,
“মেহের, এবার কিন্তু আমার রাগ উঠছে। তুমি জানো এই দুটো মাস আমি কীভাবে কাটিয়েছি? একদিকে কাজের চাপ, আরেকদিকে তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার কষ্ট। অভিমান ভেঙে একটু ভালোভাবে কথা বলো না জান। আর ফাজলামি কোরো না।”
“আমি ফাজলামি করছি না স্নিগ্ধ। সত্যিই আজ আমার বিয়ে হয়ে গেছে, আর এখন আমি বাসর ঘরে আছি। মায়ের ফোন আমার কাছে। কীভাবে বললে তুমি বিশ্বাস করবে?”
“কী? তুমি সত্যি বলছো?” কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল স্নিগ্ধ।
“আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও প্লিজ। আমি এখানে থাকতে পারব না। ওই লোকটা এখনই আসবে। আমি এই বিয়ে মানতে পারব না। ওই লোকটা আমাকে স্পর্শ করলে আমি মরে যাব। সত্যিই মরে যাব। শুনছো তুমি? তুমি ছাড়া কাউকে আমি ভালোবাসতে পারব না।”
স্নিগ্ধর হৃদস্পন্দন যেন থেমে যেতে চাইল। মিনিট খানেক থম মেরে থেকে সে শান্ত স্বরে বলল,
“স্পষ্ট করে সব খুলে বলো। ঠিক কী হয়েছে?”
মেহের নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করল। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে পুরো ঘটনা খুলে বলল। স্নিগ্ধ শুধু চুপচাপ শুনে গেল। মেহেরের কথা শেষ হতেই সে ব্যথিত কন্ঠে বলল,
“আমাকে মাফ করে দাও জান। সব দোষ আমার। কিন্তু তুমি চিন্তা কোরো না জান। শোনো, আমি কালই ঢাকা আসছি। আজকের রাতটা কষ্ট করে পার করো। ওই ছেলেকে যেভাবে হোক দূরে রাখবে। একদম কাছে ঘেঁষতে দিবে না। দরকার পড়লে থাপ্পড় মেরে দূরে রাখবে। তুমি শুধু আমাকে অ্যাড্রেস দিবে। কাল গিয়ে আমি তোমাকে রাজশাহী নিয়ে যাব। সবকিছু ভুলে আমরা সংসার গড়ব। বুঝেছ? একদম ভেঙে পড়বে না। আমি আছি তো।”
“কীভাবে স্নিগ্ধ? আজই নতুন বিয়ে হয়েছে আমার। কাল এটা নিয়ে ঝামেলা করলে বাবার সম্মানহানি হবে।”
“এখনও তুমি তোমার ওই বাবার সম্মানের কথা ভাববে? দরকার পড়লে পালিয়ে নিয়ে যাব তোমাকে। তুমি শুধুমাত্র আমার। দ্বিতীয় কারো অধিকার নেই তোমাকে পাওয়ার। এই জান শোনো, একদম ভয় পেয়ো না। ওই ছেলে যেন তোমাকে না ছোঁয়। আমার নিঃশ্বাস আটকে যাবে তাহলে। প্রচন্ড ভালোবাসি তোমায়।”
স্নিগ্ধর কাঁদো কাঁদো কন্ঠ শুনে মেহেরের বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। টানা দুই মাস পর ভালোবাসার মানুষটার মুখে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শুনে যেন বহুকালের পিপাসা মিটল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে সেও বলল,
“আমিও প্রচন্ড ভালোবাসি স্নিগ্ধ। অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আমার সব ভালোবাসা শুধু তোমার জন্য।”
স্নিগ্ধ কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠল,
“বাহ্! বাসর ঘরে বসে নববধূ তার হাসবেন্ড রেখে পরপুরুষের সাথে প্রেম বিনিময় করছে। ইম্প্রেসিভ!”
মেহের মাত্রাতিরিক্ত চমকে উঠল। এতটাই চমকাল যে ভয়ে ফোনটাই হাত ফসকে পড়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই অদূরে আদ্রিশকে দেখে তার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেল। লোকটা দুহাত পকেটে গুঁজে শান্ত, গম্ভীর মুখে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহের ফাঁকা শুকনো একটা ঢোক গিলল। আড়চোখে বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটার দিকে তাকাল। কল বোধ হয় কেটে গেছে। কিন্তু এখন? এখন কী হবে? এই আদ্রিশকে সে কীভাবে সামলাবে?

চলবে……………….?

(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রেসপন্স করার অনুরোধ রইল। আর হ্যাঁ, এই গল্প ঠিক কবে-কবে দিব তার ঠিক নেই। সময় পেলে তবেই লিখব।)

পার্সোনাল গ্রুপ লিংক:
https://www.facebook.com/groups/935884643636506/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here