❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#চতুর্থ_পর্ব❤
রাত এগারোটা বাজে, তৃণা নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনের গ্যালারি ঘেঁটে কয়েকটা পুরোনো ছবি দেখছিল। মাঝে মাঝে এই রাতের বেলায় এরকম ছবিগুলো দেখতে দেখতে কত পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেল একটা ছবির দিকে, একটা স্ক্রিনশট। নীল-কালো চেকশার্ট আর জিন্স পরে একজন সুদর্শন ছেলে দাঁড়িয়ে। এটা স্যারের মানে সৌমাভর ছবি, ওনার হোয়াটস অ্যাপ ডিপি। কী মনে হতে ছবিটা সেভ করে রেখেছিল তৃণা, এখন কারণটা আর মনে পড়ছেনা। তবে যতটা খারাপ তৃণা মুখে বলে অতটাও খারাপ দেখতে নন ইনি, এই রাত্রি বেলা একা ঘরে শুয়ে, তৃণার মনে হল, ক্লাসের সব মেয়েগুলো যে নতুন স্যার বলতে অজ্ঞান সেটাও এমনি এমনি নয়। দেখতে ভালো, গম্ভীর ব্যক্তিত্ব, গলার আওয়াজ সুন্দর, তার সাথে এত সুন্দর করে পড়া বোঝান, যে কারোরই ভালো লাগতে বাধ্য। কিন্তু তৃণার মন এতে একদমই গলবে না, সে যেটা ভেবেছে সেটা করেই ছাড়বে। যাই হয়ে যাক না কেন।
সৌমিক এখনো ফোনটা করলনা। অন্যদিন মাঝে মাঝে নিজে থেকেই তো ফোন করার কথা বলে। আজ যখন তৃণার দরকার তখন আর তেনার পাত্তা নেই! তৃণা বুঝতে পারেনা, তার ক্লাসের ঐ স্যার আর এই সৌমিকের নামার এত মিল কেন! যাকে ভালো লাগেনা তার নামের কাছাকাছি নাম বলতে যে কি বিরক্তি লাগে।
তারমধ্যে আজ ভালোভাবে কিছু খাওয়াও হয়নি, পেটে খিদে থাকলে মাথার তার গুলো আরো বেশি নড়াচড়া শুরু করে দেয়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে, বাধ্য হয়েই ফোনের এবার ফোনটা বন্ধ করে তৃণা শুয়ে পড়ল। আর ঠিক তার সাথে সাথেই, ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। সৌমিক ফোন করছে….
-‘এতক্ষণ পর, সময় হল? আরেকটু পরে করলে আমি ঘুমিয়েই পড়তাম।’
-‘ সরি সরি, আসলে অনেকদিন পর দাদা ফোন করেছিল, মা কথা বলছিল আমার ফোন থেকে, ঐ জন্য একটু সময় লাগল। সরি, হুম বলো এবার’
-‘ তোমার আবার দাদাও আছে, কই বলোনি তো! ”
-‘ওহ তোমাকে বলা হয়নি না? আসলে এটা আমার জ্যেঠুর ছেলে, জ্যেঠিমা চলে যাওয়ার পর আমার মা ই কোলেপিঠে মানুষ করেছে দাদাকে, তাই টানটা একটু বেশী রয়েই গেছে, বুঝতেই তো পারছ!”
-‘হুমম বুঝলাম। তো যাই হোক, তোমার দাদার বাকি কথা পরে একদিন শুনবো খন। কিন্তু এদিকে তুমি এটা বলো, যে আমার কাজটা ঠিকমত হবে তো?”
-‘কোন কাজ টা?’ সৌমিক অবাক হয়ে যায় ।
-‘আরে বাবা ঐ যে নম্বর টা তোমাকে দেব, বলেছিলাম, তুমি বললে তোমার বন্ধুদের কাছে দিয়ে দেবে যারা ঐ বিজ্ঞাপনের কাজ করে, মনে নেই নাকি?”
-‘ওহ আচ্ছা আচ্ছা। তুমি এখনো ওটাতেই পড়ে আছো?তা নম্বর টা কার সেটা তো বলো? মানে কেন শুধু এরকম করছ আরকি তাই বলছি। কেউ কি তোমাকে বিরক্ত করছে?’
-” আরেহ বাবা না। কেউ বিরক্ত করেনি, একটা অন্য দরকারে এমনটা করতে বলছি। তোমাকে সবটা বলতে পারছিনা এখনি, প্লিজ কাজটা করে দাও, দেন সবটা বলব, প্লিজ”
-‘ওকে ওকে। দাও নম্বরটা, আমি দেখছি কী কথা যায়!’
সৌমিক নম্বরটা চাইতেই, ফোন কেটে ব্যস্ত হাতে তৃণা সৌমাভর নম্বরটা হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিল তৃণা। মিস্টার সৌমাভ যে এইবার কী অসুবিধাতে পড়তে চলেছে তা মনে পড়লেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে। মানে জাস্ট কল্পনা করা যায়? যে অমন রাগী রাগী মানুষটাকে রাতদিন সবাই ফোন করে জিজ্ঞেস করছে,
-‘দাদা আপনি ঘরের লাইট, পাখা সারান?’
-‘দাদা ,আপনিই কি কমদামে সুন্দর ঘর রঙ করেন?’
ইত্যাদি আরো কত কিছু…..
ভাবতে ভাবতে অন্য জগতে যেন হারিয়ে গিয়েছিল তৃণা, হঠাৎ সম্বিত ফিরল রিংটোনের আওয়াজে। সৌমিক মেসেজ পাঠিয়েছিল, এখন আবার ফোন করছে? কী ব্যাপার? কাজ কি তাহলে হবে না? চিন্তিত মুখে ফোনটা রিসিভ করল তৃণা।
-‘হ্যাঁ বলো সৌমিক, আবার কী হল?’
-‘তৃণা এই নম্বর তুমি কোথা থেকে পেলে?’
-‘মানে ?তোমাকে তো বললাম আমি পরে সব বলব, তাহলে আবার কী সমস্যা হল? তুমি কি কাজটা করতে চাও না? তাহলে বলে দাও”
-‘আরে সমস্যাটা সেইটা নয় যেমনটা তুমি ভাবছ। এই নম্বরটা আমার নিজেরই ভীষণ চেনা মানুষের নম্বর, তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, যে তুমি কোথা থেকে”
-‘ এই এক মিনিট দাঁড়াও দাঁড়াও, চেনা মানুষের নম্বর মানে? কার নম্বর? ” তৃণা তো বিস্ময়ে একদম আকাশ থেকে পড়ল, মনে হল। সৌমিকের কথাবার্তা তো কিছুই মাথায় ঢূকছেনা তার।
-‘আরে এটা আমার দাদার নম্বর, মানে যেই দাদার কথা একটু আগেই বলছিলাম তোমাকে, সেই দাদা। সৌম্যদা, ওর পুরো নাম সৌমাভ, আমার মা-ই মিল দিয়ে আমাদের দু’জনের নাম রেখেছে। দাদা চাকরিসূত্রে আলাদা থাকে, আর দাদা বেশি ভিড়ভাট্টা পছন্দ করেনা তাই, নাহলে সেদিন দিদির জন্মদিনেই হয়তো আলাপ করিয়ে দিতাম। বুঝলে?”
-‘হ্যাঁ বুঝলাম, খুব ভালো করে বুঝলাম” নিস্পৃহ গলায় বলে উঠল তৃণা।
-‘কী বুঝলে? আর আমার দাদার নম্বর নিয়ে এরকম কেন করতে যাচ্ছিলে সেটাই তো বললেনা?’
-‘নাহ্, সেরকম কোনো কারণ নেই, তোমাকে একটাই রিকোয়েস্ট, তুমি এসব কথা তোমার দাদাকে বলোনা প্লিজ। আমি সম্পর্কে ওনার স্টুডেন্ট ”
-‘সেকি, দাদা যে কলেজে পড়ায় তুমি ঐ কলেজের স্টুডেন্ট? মাই গড। আর ভয় নেই দাদা ভীষণ ভালো, কিচ্ছু বলবেও না এটা জানলে”
-‘না প্লিজ, তুমি বলবেনা। সৌমিক প্লিজ, ”
-‘ওকে ওকে, ডোন্ট ওয়ারি, আমি কিছু বলবনা। হ্যাপি? তোমার যেদিন বলতে ইচ্ছে হবে, বলো কারণটা”
-‘হুম, এখন তাহলে রাখছি ফোনটা। খুব ঘুম পাচ্ছে”
এই বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে শুয়ে পড়ল তৃণা। মাথাটা যন্ত্রণা করছে তার। একটাও ইচ্ছা পূরণ হলো না। পুরো প্ল্যান, সবটাই বেকার চলে গেল। এরকম একটা পরিস্থিতিতে যে পড়তে হবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
**************
লাঞ্চটাইম শুরু হতে আর, মিনিট দশেক বাকি। টিচার্স রুমের বাইরে করিডোরে কাছে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সৌমাভ আর তৃণা। খুব স্বাভাবিকভাবেই সৌমিক কথাটা বলে দিয়েছে ওর দাদা অর্থাৎ সৌমাভকে। আর সে কারণেই আজ কথা বলার জন্য তৃণাকে ডেকে পাঠিয়েছে সৌমাভ। সৌমিক তার দাদাভাইকে ঘরের মধ্যে বেশ হাসিখুশি,ভালো বলে জানলেও প্রফেশনাল ফিল্ডে সে কতটা কঠিন সেটা বোধহয় তার জানা ছিলনা। সৌমিক ভেবেছিল, ব্যাপারটা ইয়ার্কির, সেইটা ঐ মজাটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা হলনা, বরং উল্টোটাই হল।
মাথা নীচু করে তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে তৃণা। মাথা তুলতেও পারছেনা, আর বুঝতেও পারছেনা সৌমাভর মুখের ভাবভঙ্গি। আজ যে ভালোমত একটা শাস্তি হবে তার, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কতটা কী হবে, সেটাই বোঝা যাচ্ছেনা।
-‘তৃণা বোস, তাই তো তোমার নাম?’
-‘হুমম”
-‘মাথাটা তুলে তাকাও, এখন এত বেশি সম্মান না দেখালেও চলবে।”
ধমকের সুরে কথাটা বলল সৌমাভ। তৃণা ভয় না পাওয়ার চেষ্টা করলেও, এই হঠাৎ ধমকটা শুনে একটু চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি করে সে চোখটা তুলে তাকাল সামনের দিকে। সৌমাভ তখনও একটা শীতল, কঠিন চোখের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে একইভাবে।
-‘এবার বলো, যে তোমার মতলবটা কী ছিল? এত পরিশ্রম কখনো পড়াশোনার পেছনেও তো করতে পারো, দেখবে সাফল্য আসবে”
-‘সরি”
-‘আমি সরি শুনতে চাইনি, এক্সপ্লেইন মি, কেন করেছ এগুলো? ইটস এ টাইপস অফ ক্রাইম, ইউ নো?’
-‘বললাম তো সরি, আর কখনো হবে না এরকম”
-‘সরি বলাটা বন্ধ করো তৃণা। এরপর নাহলে ক্লাসে ডিস্টার্বের জন্য প্রিন্সিপালের কাছে কমপ্লেইন করতে বাধ্য হব কিন্তু। তাড়াতাড়ি বলো”
-‘আপনি আমাকে প্রথম দিন বের করে দিয়েছিলেন ক্লাস থেকে, সেই রাগে আমি ভেবেছিলাম এটা করব”
-‘কী?!!!”
-‘বললাম তো” মিনমিন করে নীচুগলায় উত্তর দিল তৃণা।
-‘তৃণা? সিরিয়াসলি? আর ইউ ম্যাড?”
সৌমাভ ভেবে পেল না কী উত্তর দেবে। সকালের প্রচন্ড রাগটা হঠাৎ করেই কমে গিয়ে তার বদলে হাসি পাচ্ছে এখন। কলেজে পড়া একটা মেয়ে কী করে এতটা চাইল্ডিশ ব্যবহার করতে পারে, তাই তো মাথায় আসছেনা ওর। ভালো করে একবার তৃণার মুখের দিকে তাকালো সৌমাভ। এখন বেশ একটা ভয় ভয় ভাব রয়েছে মুখের মধ্যে। হয়তো আজকের এই বকা দেওয়ার জন্য কালকে আরো নতুন কোনো ফন্দি বের করবে মেয়েটা। কি মুশকিল! তৃণাকে কোনো কথা না বলতে দেখে, সৌমাভ হাসিটা চেপে, মুখে গম্ভীর ভাবটা এনে আবার একটু জোর গলায় বলল,
-‘ তাহলে বলো এবার কোন শাস্তি দেওয়া উচিত তোমাকে?”
-‘জানিনা”
-‘না মানে, তোমার মাথায় শুধু এসবই ঘোরে? ভাই বলছিল, সেদিন তুমি পুপু মানে ওর দিদির জন্মদিনেও নাকি হঠাৎ করে চলে গিয়েছিলে?”
-‘সৌমিক এসব কথাও বলেছে আপনাকে?”
তৃণার অপমানে কান দুটো একেবারে লাল হয়ে গেল, এই মুহূর্তে সৌমিকের উপরে এত রাগ উঠছে তা বলার মতো নয়। আজ এই ঝামেলা মিটলেই ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে। দরকার নেই কাউকে, যাকেই বিশ্বাস করবে সেই এরকম করবে।
-‘না,আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার মত মানুষের সাথে ওর দেখা-পরিচয় হল কীভাবে, তখনই ও বলল। যাই হোক, এত কথা বলার টাইম নেই। শুধু তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি, যে আর এরকম কোনো যেন কাজ আমি করতে না দেখি, মনে থাকবে?’
-‘হুমম”
-‘ওকে, দেখা যাক। এর শাস্তি তো পেতেই হবে তোমাকে, তবে সেটা কী শাস্তি দেব, পরে জানতে পারবে। আমার নজর তোমার উপর রইল, এটা মাথায় রেখো। যাও ক্লাসে যাও”
(ক্রমশ)