❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#তৃতীয়_পর্ব❤
তৃণা বুঝতে পারল আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এই মানুষটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এনার মধ্যে দয়া-মায়ার ভীষণ অভাব, মিষ্টি কথাবার্তা তো অনেক দূরের ব্যাপার। ব্যাগটা নিয়ে তৃণা বড়ো বড়ো পা ফেলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এল, এখন ক্যান্টিনে বসে থাকতে হবে পর্ণা না আসা অবধি। বিরক্তির শেষ নেই। কী যেন নাম স্যারটার! হ্যাঁ, সৌমাভ….. নামটা তো বেশ একটা রেখেছে বাড়ির লোক, এদিকে একটু নম্রতা-ভদ্রতা শেখায়নি। প্রথম দিন ক্লাসে এসেই কেউ এরকম করে? পুরো ব্যাপারটা পর্ণাকে না বলা অবধি শান্তিও হচ্ছেনা। ক্যান্টিনের টেবিলটায় হাত রেখে মাথাটা নীচু করল তৃণা। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করলেই, ওর সেই বিয়েবাড়ি না না জন্মদিনবাড়ির ঘটনাটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। নেহাত ছেলেটা ভালো ছিল তাই, নাহলে কী যে অপমানের ব্যাপার হত! কিন্তু সেইদিনের পর আরো একটা নতুন ব্যাপার হচ্ছে তৃণার সাথে। সৌমিকের কথাবার্তা ধরন ঠিক সুবিধের লাগছে না তার, ঘটনাটা তাহলে একটু গোড়া থেকেই বলা যাক–…
সেইদিন সৌমিকের দিদির জন্মদিনে ও অনেকবার অনুনয় বিনয় করার পরেই অনুষ্ঠানে থাকতে রাজী হয়েছিল পর্ণা আর তৃণা। সৌমিককে দেখে প্রথমেই যেমন মনে হয়েছিল, বেশি কথা বলা, ছটফটে একটা ছেলে….কিন্তু পরে দেখা গেল ও তার থেকেও আরো বেশী। কেক কাটার পরে ,তৃণা আর পর্ণাকে, বিশেষত তৃণাকে সবার সাথে পরিচয় করাতে শুরু করে দেয় সৌমিক। এমন ভাবেই কথা বলছিল সে, যে হঠাৎ করে দেখে কেউ বুঝতেও পারবেনা ওদের আলাপটা সবেমাত্র তিনঘন্টার। তৃণার তো রীতিমত অস্বস্তি শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। বিভিন্ন কথাবার্তা আর পরিস্থিতি চাপেই ও ভুলেই গেল যে একটু আগে, ভীষণ খিদের চোটে পাগলের মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল তার। খিদেটা যেন বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে জীবনে প্রথমবার দাঁড়িয়ে কীরকম যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল তৃণার। ঘরভর্তি লোক, তারা একে অপরের পরিচিত, পরস্পর আত্মীয় স্বজন, আর তার মাঝখানে সে আর পর্ণা হঠাৎ করে চলে এসেছে। তৃণাকে ঘরের কোণায় অনেকক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটা, সৌমিক দূর থেকেই লক্ষ্য করেছে অনেকক্ষণ। সে এবার থাকতে না পেরে, এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
-‘ তৃণা? আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখানে? চলুন, খাওয়া দাওয়া করে নিন কিছু, আপনাদের তো আবার ফিরতে হবে।’
-‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। কেক তো খেলাম। আর কিছু খাবনা, প্লিজ। আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
-‘না, আপনি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছেন, যে খেয়ে তবেই বাড়ি যাবেন। আর দেরী হলেও বা কী, দরকার হলে আমি পৌঁছে দিয়ে আসব বাড়ি অবধি। আমার সাথে গাড়ি আছে, কোনো অসুবিধা নেই।’
সৌমিক ছেলেটাই এমন জেদী, যে বারণ করেও উপায় নেই- এই ব্যাপারটা প্রথম দিনেই বুঝে গিয়েছিল তৃণা। সেদিন অনেক বারণ সত্ত্বেও আলাদা আলাদা করে দুজনকেই দায়িত্ব নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছিল সৌমিক। সত্যি কথা বলতে গেলে, না চাইতেও সেই মুহূর্তে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিল তৃণার মধ্যে। যে কোনো মানুষই গুরুত্ব পেতে পছন্দ করে, তৃণাও তার ব্যতিক্রম নয়। সৌমিক তাকে নিয়ে আলাদা করে যে ভাবছে, এটা মনে পড়লেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে মনের মধ্যে।
পরের দিন সকালেই সৌমিক ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় তৃণাকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটা একসেপ্টও করে তৃণা। আর তারপর থেকেই একটা দুটো করে কথা বলতে বলতে কথার সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তৃণা না চাইতেও এটাতে বাধা দিতে পারছেনা। আর দেবেই বা কীভাবে? শুধুমাত্র দুটো বন্ধু হিসাবেই তো কথাবার্তা হয়। আর সৌমিক ছেলেটাও এমনিতে খারাপ নয়, কথাবার্তা ভালো, পড়াশোনাও করছে ভালো জায়গায়। এরকম আচমকা একটা ভালো বন্ধু পাওয়াটাও কম ভাগ্যের নয়! তাই তৃণা ভেবেই নিয়েছে, এই নিয়ে আর বেশি চিন্তা ভাবনা করবেনা সে, যা ভাগ্যে আছে হবে….
ক্যান্টিনে বসে এসব কথাবার্তা চিন্তা করতে করতেও যে কখন টেবিলে মাথা রেখে আরো এক রাউন্ড ঘুমিয়ে নিয়েছে তৃণা, তা সে নিজেও জানেনা। ঘুম ভাঙল পর্ণার ধাক্কায়। মাথাটা তুলে কোনো রকমে উপরের দিকে তাকিয়ে তৃণা দেখল, ভীষণ বিরক্ত একটা মুখ নিয়ে পর্ণা দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
-‘কী হয়েছে ডাকলি কেন? কখন এলি তুই?’
-‘ কখন এলি মানে, কখন থেকে ফোন করছি, কোথায় তোর ফোন? আমি তো ভাবলাম মরে-টরে গিয়েছিস বোধহয়। ছাগল কোথাকার। এখানে বসে কেন?”
-“এত চিৎকার করিসনা। যা দু’কাপ কফি নিয়ে এসে বস। সব বলছি। আজকের দিনটাই বেকার”
পর্ণা আর কথা না বাড়িয়ে কফি আনতে চলে গেল। তৃণার মুড সুইং গুলো ও বোঝে, এখন ওকে বেশি ঘাঁটানো সম্ভব না। দুটো কফিকাপ এনে টেবিলে রেখে পর্ণা বলল,
-‘হুমম এবার বল, কী খবর। মুখটা এমন করে আছিস কেন?? ‘
তৃণা একে একে সব কথা খুলে বলল পর্ণাকে। কথাগুলো বলার সময় আরো একবার মাথা গরম হয়ে গেল তৃণার। সবকথা চুপচাপ শুনে নেওয়ার পর পর্ণা হাসিতে ফেটে পড়ল। মুহুর্তটা কল্পনা করলেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে তার। পর্ণার হাসি দেখে তৃণার রাগটা আরো বেড়ে গেল। সে চাপা গলায় বলল,
-‘ হাসছিস তুই?”
-‘হাসি পেলে হাসবো না? আরে বাবা, উনি একটু রাগী তাই। তাছাড়া দেখে ভালোই মনে হয়”
-” মনে হচ্ছে তোর সৌমাভকে হেব্বি পছন্দ? ওকে তুই হাসতে থাক, আমি চললাম। তবে মনে রাখিস আজকের এই অপমানের প্রতিশোধ আমি তুলবই”
-‘আরে, দাঁড়া। আমি মজা করছিলাম। তৃণা…..শোন…”
কিন্তু পর্ণা ডাকলেও আর কথা শুনল না তৃণা। হনহন করে পা ফেলে ও ক্যান্টিন ছেড়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল কোথায় একটা। পর্ণা বুঝতে পারল, এই রাগ ভাঙাতে বেশ বেগ পেতে হবে এবার।
*************
ক্লাসে পড়াতে পড়াতে শেষ মুহূর্তে সৌমাভ একবার চারিদিকে তাকিয়ে নিল, বিশেষ করে ঐ তৃণা নামের মেয়েটার জন্য। ভীষণ ডিস্টার্বিং একটা মেয়ে। ক্লাসের মাঝখানে ঘুমোবে, কথা বলবে, ফোন ঘাঁটবে….. এরকম আরো কত কী….। বলতে বলতে সৌমাভ নিজেই হাঁপিয়ে গেছে এখন, তাই খুব বেশী পাত্তা দেয়নি আর। তবু ভাগ্য ভালো আজ মহারাণী জেগে আছেন ক্লাসে, এবং শুধু জেগেই নয়, মুখ দেখে মনে হচ্ছে পড়াও শুনছে। কি সৌভাগ্য! আজকে পুরো ক্লাসেই মেয়েটা একইভাবে বসে ছিল, পড়া শুনছিল। এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না, তাই অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে সবে হাঁটতে শুরু করেছে সৌমাভ, এমন সময় শুনতে পেল পেছন থেকে কে একজন ডাকছে স্যার বলে। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই সৌমাভ অবাক হয়ে দেখল, তার ক্লাসের স্টুডেন্ট তৃণা বোস দাঁড়িয়ে আছে রেলিং বরাবর। হাঁটা থামিয়ে, ভ্রু কুঁচকে সৌমাভ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘হ্যাঁ বলো, কী হয়েছে? ”
-‘স্যার, বলছি আজকে যে সিস্টেমটা ডিসকাস করলেন, ওটার একটা পিডিএফ বা নোটস দেবেন প্লিজ আলাদা করে? তাহলে পড়তে সুবিধা হত!”
-‘তুমি পড়বে?” সৌমাভ খানিকটা অবাক হয়ে গেল।
-‘হ্যাঁ আমি, আমি ছাড়া কে পড়বে?”
-‘না ঠিক আছে, আমি তোমাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে তো অ্যাড নেই। আমার নম্বর টা দিচ্ছি, সেভ করে হাই পাঠিও একটা। আমি কনটেন্ট সার্কুলেট করে দেব।’
-‘ওকে, নম্বর টা বলুন”
-‘হুম, নাইন ফোর সেভেন জিরো…..”
নম্বরটা বলার সময় সৌমাভ এই প্রথম তৃণাকে এতটা সামনে থেকে, ভালো করে লক্ষ্য করল। সবসময় দুরন্তপনা করে করে, চোখে মুখে যেন সেই ছাপটা লেগে রয়েছে। এমনিতে মুখটা বেশ মিষ্টিই দেখতে। তবে সেই প্রথম দিন যখন সৌমাভ ওকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিল, তখন রাগে ওর মুখটা যেরকম হয়ে গিয়েছিল… ঘটনাটা আজও মনে আছে সৌমাভর। সেদিন বোধহয় একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল সে, তবে সেটুকু করাটাও হয়তো প্রয়োজন ছিল।
নম্বরটা ফোনে সেভ করেই, মনে মনে একবার হেসে উঠল তৃণা। এইটাই সে চাইছিল এতক্ষণ ধরে, নম্বরটা পেয়েছে হাতের কাছে, এবার এই নম্বরটা এমন এমন জায়গায় পৌঁছে যাবে না, প্রতিদিন ফালতু ফোনের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ফোন নম্বর চেঞ্জ না করে শান্তি পাবেনা মিস্টার সৌমাভ বাবু। সারাক্ষণ এই মুখ গম্ভীর করে ঘুরে বেড়ানো, আর ছাত্রছাত্রীকে জ্বালানো তখন বেরিয়ে যাবে।
এই নিয়ে সৌমিকের সাথে কথা হয়েও গেছে, ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো, প্রথমে রাজি হচ্ছিলনা এই আইডিয়াটায়। পরে তৃণা খুব জোর করায় বেচারা রাজি হয়েছে কাজটা করতে। কার নম্বর, কীসের নম্বর এসব কিছুই সে জানেনা। শুধু তৃণা ওকে বলেছে একটা নম্বর দেবে আর সেটা দিয়ে বিভিন্ন মজার বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দিতে,
এই যেমন- বাড়ি রঙ করাতে এই নম্বরে ফোন করুন, বা বাড়ি পরিস্কার করতে এই নম্বরে যোগাযোগ করুন এরকম। প্রতিশোধ যেমনই হোক না কেন, সেটা পূর্ণ করতে পারলে একটা আলাদাই শান্তি আসে মনে। প্রথম দিন ক্লাস থেকে সবার সামনে অপমান করে বের করে দেওয়ার মজা এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে। কিন্তু তৃণা নিজেও তখন জানেনা আরো বড়ো কী সারপ্রাইজ তার নিজের জন্য অপেক্ষা করছে।
(ক্রমশ)