মেঘ বসন্তের মায়া?পর্ব:১৭

0
443

#মেঘ_বসন্তের_মায়া?
#লেখিকা:#তানজিল_মীম?
— পর্বঃ১৭ #স্পেশাল_পর্ব

দেয়াল জুড়ে থাকা কিছু ফটোফ্রেমের দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ,তিথি আর গ্র্যান্ডমা। তিথির কাছে ছবিগুলো একদম নতুন লাগলেও আকাশ আর তার গ্র্যান্ডমার কাছে এক একটা ছবি যেন স্মৃতির পাতা। ছবিগুলো হলো আকাশ আর তার গ্র্যান্ডমার, আকাশের সাথে কাটানোর সেই ছোট বেলার ছবি। যেখানে আছে গ্র্যান্ডমা তার নাতিকে খাইয়ে দিচ্ছে, কোনোটায় আছে গোসল করিয়ে দিচ্ছি, কোনোটায় ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে,কোনোটায় গ্র্যান্ডমা রান্না করছে আর তাকিয়ে তাকিয়ে সেটা দেখছে আকাশ এইরকম নানা ধরনের ছোট বেলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে ছবিগুলোতে।’

গ্র্যান্ডমা আর আকাশ এগিয়ে গেল সেই ছবিগুলোর দিকে। আকাশ আর গ্র্যান্ডমাকে এগোতে দেখে তিথিও আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল তাদের সাথে। সব ছবিগুলোর দিকে তাকাতেই যেন সব স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে আসলো আকাশ আর তার গ্র্যান্ডমার। গ্র্যান্ডমার তো চোখে পানি চলে এসেছে আপনাআপনি। গ্র্যান্ডমা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো,

‘ এই ছবিগুলোর কথা মনে আছে আকাশ যখন তুমি খুব ছোট ছিলে তখনকার তোলা।’

গ্র্যান্ডমার কথা শুনে আকাশও বলে উঠল,

‘ হুম গ্র্যান্ডমা মনে থাকবে না কেন বলো সেইসময়গুলো সত্যি খুব সুন্দর ছিল।’

আকাশের কথা শুনে গ্র্যান্ডমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললোঃ

‘ হুম।’

হঠাৎই গ্র্যান্ডমার চোখ যায় সেই পুরনো রান্নাঘরের দিকে। গ্র্যান্ডমা বেশি কিছু না ভেবে এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে। একদমই গ্রামীন ঘরের রান্নাঘর। এই বাড়িটা ছিল গ্র্যান্ডমার শশুরের অনেক পুরনো একটা বাড়ি। মানুষগুলো সবাই চলে গেছে দুনিয়া ছেড়ে কিন্তু এই বাড়িটা যেমন ছিল তেমনই আছে এই বাড়ির উঠোন,ওপরে ওঠার সিঁড়ি, বারান্দা, ছাঁদ নেই এই বাড়িটায় যেটা আছে সেটা হলো টিনের তৈরি চাল সবকিছুই যেন স্মৃতিতে বোঝাই করা। বাড়িটা রিপেয়ার করা হয়েছিল অনেকবার কিন্তু কিছুই পাল্টানো হইনি যেমন ড্রয়িং রুমের চেহারা,বাড়ির রং,টিনের তৈরি চালের রং কিছুই না। শুধু বাড়িটার ছোট ছোট ক্ষতগুলো রিপেয়ার করে ঠিক করা হতো।

পুরো বাড়িটায় একবার চোখ বুলালো গ্র্যান্ডমা তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সে তার নিজের রুমের দিকে। এবার আর গ্র্যান্ডমার পিছন পিছন যায় নি আকাশ তিথি। তিথি পুরো বাড়িটা দেখতে এগিয়ে গেল সামনে আর আকাশ চলে গেল তার রুমের দিকে আর গ্র্যান্ডমা তার রুমে।’

আস্তে আস্তে নিজের রুমের কাঁঠের দরজাটা ঠেলে খুললো গ্র্যান্ডমা। সাথে সাথে এক চিরচেনা গন্ধ ভেসে আসলো নাকে। গ্র্যান্ডমা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে পা রাখলো ভিতরে। তাঁর রুমটা বিভিন্ন আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো সাথে বিভিন্ন রকমারি মাটির তৈরি সাজানো সরঞ্জাম। এগুলোর কোনোটাতেই শহরের গন্ধ নেই কারন এই সরঞ্জামগুলোর বেশির ভাগই গ্রামীন মাটি দিয়ে তৈরি। এগুলো সবই গ্র্যান্ডমার স্বামী আশরাফুলের নিজ হাতের তৈরি। গ্র্যান্ডমার স্বামীর একটা শখ বা প্রতিভা বলা যায় উনি বিভিন্ন ধরনের ভেঙে যাওয়া জিনিসপত্রকে রং করে সেটাকে সুন্দর বর্নে সাজাতে পারতেন। গ্র্যান্ডমার পুরো রুম জুড়েই তার স্বামীর সেই তৈরি করা সরঞ্জামে ঘেরা। গ্র্যান্ডমা আস্তে আস্তে তার বিছানার পাশ দিয়ে থাকা কাঁঠের জানালাটা খুলে ফেললেন সাথে সাথে সেই জানালার পাশেই থাকা বড় শিমুল ফুলের পাপড়িরা এসে পড়লো তার রুমে। এই গাছটার জন্য কতবার যে গ্র্যান্ডমা তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করেছে তার হিসাব নেই। এমনিতে গাছটা খুব সুন্দর কিন্তু এটার জন্য গ্র্যান্ডমার কাজ বাড়তো তখন কারন একটু বাতাস আসলেই গ্র্যান্ডমার পুরো রুমে ফুলের পাপড়িতে ভরে যেত।এর জন্য মাঝে মাঝে কিছুটা বিরক্তিতা ফিল করতো এই কারণে মাঝে মাঝে টুকিটাকি ঝগড়াও হতো গ্র্যান্ডমার সাথে তার স্বামীর। তবে ঝগড়া করলেও কখনো এই গাছটাকে কাটার কথা ভাবে নি গ্র্যান্ডমা কারন গাছটাকে ভালোও খুব বাসতেন উনি হয়তো এখনও বাসেন। এই গাছটাও তার স্বামী যত্ন করে বড় করেছিল গ্র্যান্ডমা ভাবে নি এত এতবছর পরও এটা অক্ষত থাকবে। পুরো বাড়িটা ঘিরেই রয়েছে এই বিশাল বড় শিমুল ফুলের গাছ। পুুরো বাড়ির টিন বোঝাই করা এর ফুলের পাপড়ি দিয়ে। আগে তো এই শিমুল ফুলের ঘ্রাণ ছাড়া কিছু ভালোই লাগতো না গ্র্যান্ডমার। পুরো রুম জুড়েই জর্জিত থাকতো এই শিমুল ফুলের ঘ্রাণে। গ্র্যান্ডমা জোরে এক নিয়ে নিশ্বাস ফেললেন যেন উনি হারিয়ে গেছেন তার সেই যৌবনকালের সময়ে।

গ্র্যান্ডমা কিছু একটা ভেবে তার বিছানার পাশে থাকা আলমারিটা খুললেন। সেখানে ছিল তার স্বামীর একটা ছবি। গ্র্যান্ডমা বেশি কিছু না ভেবে সেটাকে হাতে নিয়ে আস্তে বসে পরলেন বিছানায় তারপর ছবিটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘ আজ অনেকদিন পর যেন তোমায় অনুভব করছি আমি,সেই সময় সেই স্মৃতি সবই যেন চোখের সামনে ভাসছে আজ।’

এমন সময় জোরে এক দমকা হাওয়ার আসলো গ্র্যান্ডমার রুমে সাথে এক মন মাতাল করা শিমুল ফুলের সুবাস। আজ বহুদিন পর সব পুরনো স্মৃতিগুলো অনুভব করতে পেরে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে গ্র্যান্ডমার ভিতর।’

____

বাড়ির পিছনে থাকা একটা সরু রাস্তায় হাঁটছে তিথি। তিথির পরনে পেস্ট কালার জর্জেট থ্রি-পিচ,খোলা চুল, হাতে চুঁড়ি। বিয়ের পর আজ প্রথমই থ্রি-পিচ পড়ে হসপিটালে গিয়েছিল তিথি আর সেখান থেকে এখানে এসেছে। তিথি ভাবে নি আকাশদের এই পুরনো বাড়িটা এত সুন্দর। তিথি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সরুর রাস্তার পথ পেরিয়ে, রাস্তাটার দু’দিকেই রয়েছে বিশাল বিশাল গাছপালা। গাছের পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে খুব প্রকৃতির এমন সুন্দর রূপ দেখে আনন্দে মনটা ভরে উঠলো তিথির। হঠাৎই কিছুদূর এগোতেই এক বিশাল পুকুরের দিকে চোখ যায় তিথির। তিথি বেশি কিছু না ভেবেই এগিয়ে যায় সেই পুকুরটার দিকে। পুকুরের সৌন্দর্য দেখে অটোমেটিক মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তিথির,

‘ ওয়াও।’

_____

নিজের রুমের বিছানায় পা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে আকাশ কিছুটা ক্লান্ত লাগছিল নিজেকে কিন্তু এখন এই মুক্ত প্রকৃতির বাতাস আর শিমুল ফুলের ঘ্রাণ পেয়ে সবই যেন দূরে সরে গেছে তাঁর। আজ বহুদিন পর যেন আকাশ নিজেও সেই ছোট বেলার স্মৃতিতে আঁটকে গেছে। আকাশ শুয়ে থেকেই তার রুমের চারদিকে চোখ বুলালো পুরো রুমটার দেয়াল জুড়েই পেন্সিল দিয়ে এঁকে প্রায় ভুত বানানো। এগুলো সবই আকাশ নিজে করেছে এখন সেই সময়ের কথাগুলোর কথা ভেবে ভীষণ হাসি পাচ্ছে আকাশের। হঠাৎই তার চোখ গেল দুইটা রং পেন্সিল দিয়ে আঁকা ছবির দিকে আকাশ ছবিটা দেখেই শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর এগিয়ে গেল ছবিটার কাছে এই ছবি দুইটাও আকাশ নিজে একে দেয়ালে টানিয়ে রেখেছিল। এই দু’টো ছবির মধ্যে একটায় রয়েছে আকাশ আর তার বাবা মা আর অন্যটায় রয়েছে সে, তার গ্র্যান্ডমা আর গ্র্যান্ডফাদার। আনমনেই মুচকি হাসলো আকাশ। আজ বহুদিন যেন সে পুরনো সেই সব স্মৃতি অনুভব করছে যেসব স্মৃতিতে শুধু তার ছোটবেলা আছে।’

এমন সময় হঠাৎই আকাশের ফোনটা বেজে উঠল আকাশও বেশি কিছু না ফোনটা তুললো উপরে তার অফিস এসিস্ট্যান্ট এর ফোন দেখে চটজলদি ফোনটা তুললো আকাশ। তারপর বললো,

‘ হ্যালো।’

কিন্তু উওরে ওপর পাশের ব্যক্তি কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল। সাথে সাথে কিছুটা বিরক্তিতা ফিল করলো আকাশ। এই হলো গ্রামের একটা সমস্যা এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। আকাশ বেশি কিছু না ভেবে এসিস্ট্যান্টের নাম্বারে কল করতে করতে বাহিরে বেরিয়ে গেল।’

___

পুকুর পাঁড়ের সিঁড়িতে বসে আছে তিথি। প্রকৃতির রূপ দেখে মুগ্ধ সে কারন তার সামনেই পুরো পুকুরের অর্ধেক জুড়ে রয়েছে শাপলা ফুল। তার সাথে রয়েছে অনেকগুলো সাদা রঙের হাঁস। হয়তো আশেপাশে কারো বাড়ির কাছ থেকেই এসেছে এঁরা। পুকুরের মধ্যে গোল হয়ে খেলা করছে হাঁসগুলো তিথি জাস্ট হা হয়ে তাকিয়ে রইলো ওগুলোর দিকে। খোলা ধবধবে সাদা আকাশ,তার সাথে পুকুরের চারদিকে ঘিরে থাকা বড় বড় গাছপালা,পুকুরের চারিদিকে শাপলাফুল, তাদের ঘিরে থাকা হাঁস সাথে মন মাতাল করা প্রকৃতির এই মুক্ত বাতাস। প্রকৃতির প্রেমে পড়তে যেন বাধ্য আজ তিথি। তিথি কিছু একটা ভেবে আস্তে তাঁর চোখ দুটো বুঁজিয়ে নিলো। সাথে সাথে তার কানে আসতে লাগলো অনাকাঙ্ক্ষিত পাখির সুর। উফ! যেন এক অন্যরকম ভালো লাগা।’

এরই মধ্যে সেই সময়ই সেখানে ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিল আকাশ। হঠাৎই তার চোখ যায় তিথির দিকে তিথি চোখ বন্ধ করে কিছু একটা করছে কিন্তু কি করছে সেটাই যেন বুঝতে পারছে না আকাশ। আকাশকে চুপ হয়ে যেতে দেখে অপরপাশে মোবাইলের ভিতর বলে উঠল আকাশের এসিস্ট্যান্ট,

‘ হ্যালো স্যার।’

ফোনে কারো কন্ঠ কানে আসতেই চমকে উঠলো আকাশ তারপর চটজলদি বললো সে,

‘ হুম হ্যালো শরীফ তোমায় যেভাবে বললাম সেভাবে করো।’

‘ ঠিক আছে স্যার, আপনি কবে ফিরবেন?’

‘ দেখি কবে ফেরা যায় যখন ফিরবো তোমায় কল করে বলে দিবো আমি।’

‘ ওকে স্যার।’

‘ ওকে শরীফ বাই।’

‘ ওকে স্যার বাই।’

উওরে আকাশ আর কিছু না বলে ফোনটা কেটে সেটাকে পকেটে রাখতে রাখতে এগিয়ে গেল সে তিথির দিকে। সে সত্যি বুঝতে পারছে না তিথি ওখানে বসে কি করছে?’

____

‘ তুমি ওখানে বসে কি করছো তিথি?’

আচমকা আকাশের কন্ঠ কানে আসতেই তিথি তার চোখ খুলে ফেললো। তারপর পিছন ফিরে তাকাতেই আকাশকে দেখে বললো সে,

‘ না তেমন কিছু নয় এমনি বসেছিলাম।’

তিথির কথা শুনে আকাশও গিয়ে বসলো তিথির পাশ দিয়ে তার বললো,

‘ এমনি এমনি কেউ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে নাকি।’

‘ হুম এমনি বসেছিলাম।’

‘ কোনো কারন ছাড়া?’

‘ হুম।’

‘ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না বলো আমায় কি কারনে তুমি চোখ বন্ধ করে ছিলে?’

‘ আরে সত্যি বলছি তেমন বিশেষ কোনো কারন নেই, আমি তো জাস্ট কিছু ফিল করার চেষ্টা করছিলাম।’

তিথির এবারের কথা শুনে আকাশ অবাক হয়ে বললো,

‘ কি ফিল করার চেষ্টা করছিলে?’

‘ এই যেমন ধরুন পানির শব্দ, বাতাসের প্রবনতা, পাখির কিচিরমিচির শব্দ সাথে ওই দেখুন শাপলা ফুলের সুবাস।’

তিথির কথাগুলো শুনে আকাশ বেশ আগ্রহের স্বরে বললো,

‘ এগুলো ফিল করা যায় নাকি?’

‘ হুম যায় তো আপনি কখনো করেন নি?’

উওরে ‘না’ নামক মাথা নাড়ায় আকাশ। আকাশের কথা শুনে তিথি বলে উঠল,

‘ কোনো ব্যাপার না কখনো করেন নি কিন্তু আজ করবেন।’

তিথির কথা শুনে আকাশ বিস্ময় ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো,

‘ কিভাবে?’
!
!
!
!
!
!
!
#চলবে…..

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ!’আর গল্প কেমন লাগছে সবাই কমেন্ট করে জানাবে]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here