মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব ৪

0
76

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৪

🍁
মীরা থমকালো, ভড়কালো। অন্তরাত্মা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। স্তব্ধ হয়ে আছে তার মুখাবয়ব। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে দ্রুত গতিতে। অশান্ত হলো তার মন। হৃদয় মাঝে হানা দিয়েছে অজানা অনুভূতি। কি বলে গেলো লোকটি! বেশি চিন্তা করতে পারলো না। বাবার ডাকে দ্রুততার সহিত হাঁটা ধরলো সে।

___________

দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে গভীর নিদ্রায় উর্মি এবং মীরা। খোলা জানালা ভেদ করে মৃদু বাতাস আসছে। মীরার চোখে মুখে খেলা করছে কিছু ছোট বড় চুল। যেখানে বিছানার এক পাশে মীরা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সেখানে উর্মি তার একেবারেই বিপরীত। হাত পা ছড়িয়ে বিছানার অর্ধেক এর বেশি জায়গা টুকুই দখলে তার। আসরের আজান ধ্বনি আসছে পাশের মসজিদ হতে। মীরার ঘুম পাতলা হলো এবার। নড়েচড়ে পাশ ফিরল। চোখ মুখ ডলে উঠে বসলো। পিঠের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুল গুলো হাত খোঁপা করে ছোট একটা ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল। বালিশের পাশ থেকে ওড়না গলায় জড়িয়ে ফ্লোরে পা রেখে উঠে দাঁড়াতেই কোমড়ের ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে গেলো তার। হাত রাখলো কোমড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সকালের দৃশ্যপট। সে তো ভুলেই গিয়েছিলো লোকটির আচমকা কাছে এসে বলা কথাটুকু। আশ্চর্য হচ্ছে মীরা বার বার। কাথাটার মানে সে বুঝে। বোঝার মতো ম্যাচুরিটি তার এসেছে অনেক আগেই। অসভ্য লোক! বাসা থেকে আর বের হবে না এখান থেকে গেলে। মানলো সে ভুল করেছে, তাই বলে যখন তখন কথা শোনাবে নাকি। ভুল তো তার ও ছিলো। মীরার চোখ না হয় দেখে নি,তার চোখ কই ছিলো। কপালে নাকি মাথায়!এই লোককে আর কোনো ভাবেই প্রশয় দিবে না সে।

_________________

রাইফ বসে আছে দেশের সনামধন্য এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের অফিস ভবনে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনের পাঠ চুকিয়েছে তিন বছর আগে। চাকরিতে যোগদান করেছে দেড় বছর হলো। যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সহিত দ্বায়ীত্ব পালনের জন্য উর্ধতন কর্মকর্তা কর্তৃক প্রমোশনও লাভ করেছে। মোটা অংকের বেতন পায় সে। মা আর তার সংসার বেশ ভালো চলে। রাইফ হাতঘড়িতে চোখ বুলালো। সেল ফোন হাতে নিয়ে বন্ধু পল্লব কে কল দিলো। লাউড স্পিকারে রেখে চোখ রাখল ল্যাপটপের স্কিনে।। পর পর দুই বার কল দিয়ে যখন টুট টুট করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো তখনি ভাইব্রেট এ কেঁপে উঠলো ফোনটি। বৃদ্ধ আংগুলের সাহায্যে রিসিভ করে কানে ফোন ধরার সাথে সাথেই অপর পাশে হট্টগোল শোনা গেলো,

-‘রাইফ মাম্মা, কখন আসবি শালা?’

-‘কোনটা নিবি সেইটা আগে ডিসাইড কর আঙ্গেল। বোনতো নাই, দুইটা মামী আছে চল্লিশ এর উপরে। দুইজন ই দেখতে তোর ছোট দাদীর মতো। কোন মামীকে নিবি সেটা বল। তরপর না হয় আমাকে জানাস, ঢাকঢোল পিটায়ে যাবো তোকে আনতে। কোলে পিঠে মানুষ করবে।’

রাইফের উত্তর শুনে পল্লবের মুখ ছোট হয়ে গেলো। পাশে বসে থাকা রাজন আর ফাহাদ এর অট্টহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। পল্লব আফসোসের সুরে বলল,

-‘তোর বোন না থাকা টা বিরাট অপরাধের পাল্লায় পরে বুঝলি। তুই যেমন সুন্দর, তোর বোনটা না জানি কতো সুন্দর হতো রে। আফসোস আফসোস! একটা সুন্দরী মাইয়া আমারে পাইলো না।’

কলার উঁচু করে মিছেমিছি ভাব ধরলো পল্লব। রাইফ ল্যাপটপ বন্ধ করে ফাইল গুছিয়ে জবাব দিলো,

-‘থাকলে কি তোর মতো মানুষবেশি শয়তান কে বোন দিতাম রে হাঁদারাম। যারে দেখস তার উপ্রেই তো তোর দিলের লাড্ডু ফুটে।’

মুখ টা চুপসে গেলো পল্লবের। কিছু বলবে তখনি রাজন ফোন কেড়ে নিলো। তড়িঘড়ি করে বলল,

-‘আহ দোস্ত, তুই ও ওর সাথে পাগল হলি নাকি! তোর অফিসের নীচে আছি। নাম দ্রুত।’

-‘আসছি।’

ফোন কেটে দিলো রাইফ। বন্ধুরা জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে বিরাজ করে। হাসি কান্না, সুখে দুঃখে সবসময় এরা সাক্ষী থাকে। এই যে, অনার্স পড়া কালীন যখন রাইফের বাবা ইন্তেকাল করেন তখন একেবারেই ভেঙ্গে পরেছিলো মা-ছেলে। সে সময় এই বন্ধুগুলো পাশে না থাকলে ঘুড়ে দাঁড়ানো সহজ হতো না। মানসিকভাবে এরা অনেক সাপোর্ট করেছে রাইফকে। রাইফ কললিস্ট থেকে ‘আম্মা’ নামে সেভ করা নাম্বারে কল দিলো। রিসিভ হতেই বলল,

-‘আম্মা, কি করো?’

-‘ছাদ থেকে তোর কাপড় গুলা এনে ভাঁজ করছি। একেবারে শুকিয়ে ম’রম’রা হইছে। একটুও মনে ছিলো না আনতে।’

– ‘তুমি আনতে গেলা কেনো আম্মা। উঠতে কষ্ট হইছে না? আমি গিয়ে কাপড় নিয়ে একেবারে বাসায় ঢুকতাম।’

-‘কষ্ট একটু হয়েছে আব্বা। তবে এখন ঠিক আছি।’

-‘খাইছো আম্মা?’

-‘হ্যাঁ রে। তুই খাইছিস?’

-‘হ্যাঁ। আম্মা আজ আমার আসতে দেড়ি হবে। ফাহাদ রা আসছে। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যেয়ো। আমি খেয়েই ফিরবো।’

-‘তাড়াতাড়ি আসিস, ওদের কেউ আনিস পারলে। অনেক দিন হলো দেখি না। আর শোন সাবধানে থাকবি। আর গাড়ি আস্তে চালাবি।’

-‘আহ-হা আম্মা, আমি ঠিক থাকবো তোমার দোয়ায়। টেনশন করো না তো। রাখছি।’

-‘ঠিক আছে।’

রাইফ উঠে দাঁড়াল। অফিসের অনেকেই চলে গেছে, কেউ বা প্রস্তুতি নিচ্ছে। টেবিলে রাখা ওয়ালেট পকেটে ঢুকিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো বাহিরে ।

__________________

আড্ডা শেষে লং ড্রাইভে বের হয়েছিলো চারবন্ধু। মাঝে মাঝেই ঘুরতে বের হয় তারা। কোনোদিন শহরে আবার কোনো দিন শহরের বাহিরে। আজ তারা বেশ দূর পর্যন্ত গিয়েছিলো। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। বাসার সামনের টং দোকানে বসে চা খাচ্ছে দুই বন্ধু ফাহাদ আর রাইফ। ফাহাদের বাসা পাশের গলিতে। এই গলি হয়েই যেতে হয়। রাইফ বারবার নজর দিচ্ছে তিন তলার বারান্দায়। রুমে লাইট জ্বলছে এখনও। এক পলক কিংবা তার ছায়ামূর্তি ও যদি দেখা যেতো তবুও হৃদয়ের ছটফটানি কমে যেতো। যতই চেষ্টা করছে চোখে লাগাম দিতে ততই অবাধ্য হচ্ছে নজর। ফাহাদ নোটিশ করলো রাইফের বারংবার উপরে তাকানো সাথে উচাটন ভাব। রাইফের পিঠ চাপরে মুচকি হেসে শুধালো,

-কি বন্ধু, উপরে কি?

রাইফ তাকালো ফাহাদের দিকে। দু পাশে ঘাড় কাত করে গম্ভীর ভরাট কন্ঠে জবাব দিল,

-একটা পাখি। খুব মিষ্টি একটা আদুরে পাখি।

-ভাল্লাগছে?

-ভীষণ।

-আন্টিকে বলি?

-পাখিটাকে পোষ মানাই আগে।

-এতো দিন ধৈর্য ধরবি। প্রস্তাব দিলেই তোর।

-আমি যে পাখিটার সেটা তো তাকে বুঝাতে হবে।

-কিভাবে?

-তার খোলা আকাশের চেয়ে আমার এক বুক ভালোবাসা বিশাল। সেটা বুঝাতে পারলে সে একাই ধরা দিবে আমার কাছে।

-খাটনি আছে মাম্মা।

-মেহনত ছাড়া তাকে পেতেও চাই না।

-পিচলে পড়ছিস তাহলে প্রেমে?

-আমি কই পড়লাম, পড়লো তো সে।

-মানে

-বুঝতে হবে না। বাসায় যা।

-আসছি রে।

-হুম

বিল পরিশোধ করে বাইক নিয়ে গ্যারেজে আসলো। বাইক স্ট্যান্ড করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে বড় বড় পা ফেলে। তিন তলায় এসে দুই সিঁড়ি উপরে উঠে আটকে গেলো পা। যে ভাবে উঠেছিলো সেভাবেই পিছিয়ে এলো। ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ আসছে। কি মিহি সেই হাসি। কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছে প্রাণখোলা হাসির মালিক টা কে। ত্রিশ সেকেন্ড মাঝেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,
‘মীরা হাসি থামা, পরের কাহিনী তো বল। ‘

রাইফ চোখ বন্ধ করলো। বাকিটুকু শোনার প্রয়োজন নেই তার। বুকের বা পাশে হাত বুলিয়ে আপন মনে বলল,

‘আমাকে আরো এক নির্ঘুম রাত্রী উপহার দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ লাজুকলতা।’

চলবে…..

ভালো লাগলে মন্তব্য জানাবেন আশারাখি।
🤍🤍

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here