#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৫৭
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“অসহায় বন্দী মানুষ যে মুক্তির পথ খু্ঁজে বেড়াচ্ছে তাকে যদি বলেন তোমার আরো কিছুদিন কারা’বাস হলো।তখন সেই মানুষটা যেমন ভেতরে শেষ হয়ে যাবে।ঠিক এমন লাগছে এখন কবীর শাহ।বলুন তো সত্যি শেষ দেখা আমাদের?”
তোশার কণ্ঠে উৎসুকভাব।কবীর ও সে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটির উষ্ণ নিশ্বাস নিজের ত্বকে অনুভব করছে সে।নাহ তার বেলাডোনার সুগন্ধ যেকোনো ফুলের থেকেও বেশী।শক্ত হাত দিয়ে নরম গালটিতে তামাটে পুরুষটি স্পর্শ করে শুধালো,
“খুব খারাপ লেগেছে কথাটিতে?”
“হুম।”
“আমি তো এমনি বলছিলাম।”
“কখনো বলবেন না কবীর শাহ।বলেন আমাকে যে বলবেন না।ওয়াদা করেন।”
“ওকে লিটল ফ্রুট।আপনি সত্যি করে বলেন তো কীভাবে বুঝলেন আমার উপস্থিতি?”
রুমে থাকা ডিভানে গিয়ে বসলো কবীর।তোশাকেও টেনে নিজের হাঁটুর উপর বসালো।এতোটা কাছাকাছি বসা হয়নি তাদের কখনো।লাজুক তোশার ভেতরে অনুভূতির সূর্যোদয় ঘটলো যেন।রঙীন প্রজাপতি শত রঙের পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছে।কবীরের কাঁধে হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো তোশা।
“ওইযে বললাম টেলিপ্যাথি।আপনি আশপাশের আছেন সেটা মন বলছিলো।আপনি কীভাবে এলেন?”
“বিষয়টা একটা ইতিহাস বেলাডোনা।তোমার নানা অযথা একটা লোহার পাইপ ঠিক এই পাশের বারান্দা বরাবর সেই শুরু থেকে রেখে দিয়েছে।আশ্চর্য যে তা এতো বছর পরেও আমার ভার বহন করতে পেরেছে।”
তোশাকে অতীতের ঘটনা গুলো বললে হো হো করে হেসে দিলো মেয়েটা।কী অনাবিল সেই হাসি।অথচ কবীর খেয়াল করলো তোশার চোখের নিচে কালি।মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত।তার চোয়ালে হাত রেখে কবীর বলল,
“তুমি কেমন বড় হয়ে গেলে তোশা।চিন্তা করছো?”
“হ্যাঁ।বাসায় সকলে স্বাভাবিক কথা বলে।কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে।মা কথা বলেনা আমার সাথে।সব কবে ঠিক হবে?”
“হয়ে যাবে।আহনাফ তোমার জন্য ফুলগাছ লাগিয়েছে ছাদে।যখন তুমি ওই বাড়ীতে চলে যাবে তখন দুজন একসাথে বড় গোলাপ বাগান করবে।এসব ছেলেটির স্বপ্ন।”
তোশা কিছু বলতে যাবে এর পূর্বে বাহিরে গেইট খোলার শব্দ হলো।দুজনে সতর্ক হয়ে গেলো।
“এতো রাতে কে এলো তোশা?”
“সেটাই ভাবছি।আপনার গাড়ী কোথায়?”
“দূরে ড্রাইভার সাথে আছে।”
“এক মিনিট আমি দেখে আসছি।শব্দ করবেন না।”
তোশা সতর্ক পায়ে জানালার সাইডে এলো।পর্দা সরিয়ে দেখলো চার জন মানুষ সহ একটি গাড়ী এসেছে।অবয়ব দেখেই সে অনুমান করতে পারলো এটা তার খালা শিউলি ও তার পরিবার।এতোদিন আসতে পারেনি।ভয়ে আ’ত্মা শুকিয়ে গেলো তার।কারণ খালা এলে সর্বপ্রথম তার খোঁজ করবে।
“কবীর শাহ।তাতান এসেছে।”
“মানে শিউলি?”
“হ্যাঁ।এখন কী হবে?আপনি চলে যাবেন তাও সম্ভব হবেনা কারণ দারোয়ান আঙকেল জেগে আছে।”
ভয়ে তোশার মুখটা পাংশু বর্ণ ধারণ করলো।আশ্চর্য ভাগ্যের উপর মনে মনে একচোট হেসে নিলো কবীর।যদি জীবন রঙীন না হতো তাহলে কেন এই বয়সে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হবে আর কেন বা আজকে অন্যের বাসায় বিনা অনুমতিতে ঢোকার ব্যাপারে অভিযুক্ত হবে?তোশা চট জলদি কবীরকে বাথরুমে ঢুকে অপেক্ষা করতে বলল।মেয়েটার ভয় মাখা মুখ দেখে কবীরও নিষেধ করলো না।
মিনিট পাঁচেক পর তোশার রুমের দরজাতে করাঘাত শোনা গেলো।ইচ্ছে করে মেয়েটা পাঁচ মিনিট দেরীতে দরজাটা খুললো।
“কী ব্যাপার তোশা?তোমাকে না বলেছিলাম রুমের দরজা সবসময় খোলা রাখতে।”
“আম্মু আসলে..।”
শিউলি মা মেয়ের কথার মধ্যে বিরতি দিয়ে বলল,
“থাক না আপু।তোশামণি কেমন আছো আম্মু?”
“ভালো আছি তাতান।তুমি কেমন আছো?”
তোশাকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে প্রবেশ করলো শিউলি।বিরোধ করে বলল,
“ভালো থাকলে শরীর আরো শুকিয়ে গেলো কেন?মনে হচ্ছে এইট /নাইনে পড়ো।এক মিনিট তোমার রুমে এই অদ্ভূত ফ্রেশনারের সুগন্ধ আসছে।কোথা থেকে নিয়েছো?দারুণ তো গন্ধটা।”
একে বলে ভাগ্য সদয় না হলে কোনো কিছু ভালো হয়না।তোশা ভুলে গিয়েছিল কবীর শাহ এর পারফিউম এর কথা।যা সে প্যারিস থেকে এনে ব্যবহার।যা মানুষটা চলে গেলেও রুমে দশ মিনিট স্থায়ী হয়।শিউলি পূর্ব থেকে ঘ্রাণ সংবেদনশীল।
“তাতান এটা বাহির থেকে আসছে।”
তাহিয়া তাদের মাঝের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
“তাই তোশা?তাহলে তোমার রুমের ফ্লোরে জুতার ছাঁপ কেন?”
সকলের দৃষ্টি রুমের ফ্লোরের উপর পড়লো।তোশা সম্ভবত বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।শুকনো ঢোক গিলে অন্য একটা মিথ্যা বলবে কী?যা সফল হওয়া অনিশ্চিত?শিউলি সামান্য হেসে বলল,
“আমার জুতার ছাঁপ এটা আপু।দেখো স্লিপার পড়ে এসেছি।”
“তাইনা?আমাকে বোকা ভাবিস তুই শিউলি?”
“হয়তো যেমনটা তুমি আম্মু,আব্বুকে ভাবতে।”
শিউলি স্পষ্টত খোঁচা দিলো তাহিয়াকে।কিন্তু সে ওটা গায়ে মাখলো না।রুমের এই মাথা ওই মাথা খু্জতে শুরু করলো।অবশেষে চিল্লিয়ে ডাকতে লাগলো কবীরকে।
“কবীর,কবীর বের হও।এখুনি বের হবে।”
খট করে বাথরুমের দরজা খুলে গেলো।সেখান থেকে বের হয়ে এলো কবীর।তার চিরচেনা সেই কঠিন আবহ নিয়ে।দুরন্ত দৃষ্টি গুলোতে না আছে ভয় না আছে সংশয়।
“তাহিয়া?”
“আশ্চর্য কবীর।শেষে তোমাকে এখানে পাবো কখনো চিন্তা করিনি।আমার ভুল মনে রাখা উচিত ছিল।এই রুমে আগে আমি থাকতাম ও এখানে আসার গোপন রাস্তা তুমি জানো।রোজ আসো তাইনা?”
“না।আজ প্রথম।এবং হয়তোবা শেষ।”
“তুমি নিজের বয়স অনুযায়ী তো কাজ করো কবীর।এগুলো কোন ধরণের খারাপ কাজ?”
তাহিয়া যতোটা পারছে ততোটা জোরে কথা বলছে।মানুষ রেগে গেলে হয়তোবা এমন জোরে কথা বলে।বাসার অন্য সব মানুষদের রুমে চলে আসতে সময় লাগলো না।তাহিয়া দশগুণ উত্তেজিত হয়ে বলল,
“আমার তোমার সাথে কোনো কথা নেই কবীর।কোনো কথা না।সব এই মেয়ের সাথে।আমার মেয়ে। তোশা তোমাকে আমি কষ্ট করে জন্ম দিয়েছি তার প্রতিদান এসব দিয়ে দিলে?আরে এতোটা ভালোবেসেছি তোমাকে।ভুল আমার জানো এখানে হয়নি যে তুমি দৃষ্টির আড়ালে প্রেম করেছো আমার বন্ধুর সাথে।সমস্যা হয়েছে সেখানে যখন তোমার বাবা বলেছিল গর্ভে তোমাকে মে’রে ফেলতে।বা আমার মা ঔষধ এনে দিয়েছিলো যা আমি মায়া দেখিয়ে খাইনি।তখুনি মে’রে ফেলতাম আমার এতো কষ্ট হতো না।হায় আমি এটা কেন করলাম না।”
“আপু তোর মাথা খারাপ বাচ্চা মেয়েটাকে কী বলছিস?ও তোর গর্ভে নিজ থেকে আসেনি।তোরা এনেছিস। সৃষ্টিকর্তা দিয়েছে।সন্তান খারাপ করলে তাকে জন্মের কথা বলা কতোটা ঠিক?”
“সব ঠিক।”
“তাহিয়া চুপ।আমি কিছু বলছিনা তোমার ইমোশনকে খেয়াল রেখে এর মানে বলতে পারবো না তা নয়।তোশা আর আমি ভালোবাসি।দুজনে এক হতে চাই।এতে মেয়েটাকে ম’র’তে বলছো?শুনো তুমি মা হও যাই হও।কিন্তু ওর অস্তিত্ব না থাকার কাম্য করার অধিকারটুকু নেই।”
কবীরের বলিষ্ঠ কণ্ঠে কিছু একটা ছিল।কবীর শাহ আসলে কে?একজন স্বনামধন্য মানুষ।যে নিজের সম্মানকে আদুরে বিড়াল ছানার মতোন যত্নে রাখে।সে কীনা ছোট হচ্ছে বারবার পাশে দাঁড়ানো বিশ বছরের যুবতীর জন্য?তোশা অদ্ভূত দৃষ্টিতে মা কে দেখছে।কবীরের অনেক মায়া হলো।কাওকে পরোয়া না করে তোশাকে আগলে বলল,
“কষ্ট পেও না।তাহিয়া রেগে আছে।”
“কবীর শাহ আপনি চলে যান।আর কখনো আসবেন না।”
তোশা প্রয়োজনীয় জোরে কথাটি বলেছে।যা শুনে রুমের আর সকলে তাদের দিকে তাঁকালো।তোশা কবীরের মুখপানে তাঁকিয়ে বলল,
“আমি মনে হয় আপনার থেকেও মা কে বেশী ভালোবাসি।চলে যান আপনি।আম্মু যার দুনিয়া আমি সেই দুনিয়া না থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করা সবথেকে বড় কষ্টদায়ক।চলে যান কবীর শাহ।”
কবীর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তোশাকে দেখলো।মেয়েটির দৃষ্টি এসব বলছে তো।কিন্তু মানতে পারছে?
“তুমি সব শেষ করছো তোশা?এই ভয়ং’কর সময়টিতে?”
“হ্যাঁ।আমি অনেক খারাপ প্রেমিকা তাইনা?”
“নাহ বেলাডোনা।তুমি অনেক ভালো একজন মেয়ে।চলে যাচ্ছি।আমি তর্ক করে তোমাকে কষ্ট দিবো না।”
কবীর তোশার কপালের চুলগুলো এলেমেলো করে দিলো।তাহিয়া সহ রুমের সকলে নীরব।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তাহিয়ার উদ্দেশ্যে কবীর বলল,
“আমি প্রতিদানের বিনিময়ে কিছু নেইনা তাহিয়া।তা নয় একুশ বছর আগের করা উপকারের প্রতিদান দিতে গিয়ে তুমি দুনিয়া হারিয়ে ফেলতে।তবুও তুমি অনেক ভালো বন্ধু।এবং আমি তা মানি।”
কবীর রুম থেকে বের হয়ে গেলো।কল্লোল বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল।কবীরকে বলল,
“আমি আপনাকে গেট অবধি ছেড়ে দিচ্ছি।”
কল্লোল বাহিরে তো গিয়েছিল কবীরকে নিয়ে।কিন্তু ফিরলো একা।তোশা মূর্তির অনুরুপ দাঁড়িয়ে আছে একপাশে।কল্লোলকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বলল,
“তিনি চলে গেছেন কল্লোল ভাইয়া?”
“হ্যাঁ।”
“এই বাড়ীতে নেই?”
“না।”
“কবীর শাহ কোথাও নেই।কবীর শাহ কোথাও নেই।”
সবথেকে বেদনাদায়ক কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো তোশা।ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে উঠলো।মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো।শিউলি তৎক্ষনাৎ বসে মেয়েটাকে জড়িয়ে নিলো।
” কাঁদে না তোশা।সব ঠিক হবে।”
“কিছু ঠিক হবেনা। কিছু না। কবীর শাহ চলে গেছে।আর আসবেনা কখনো।আর না।খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।মনে হচ্ছে দুনিয়ায় নিশ্বাস নেওয়ার মতো কিছু নেই।কবীর শাহ চলে গেলেন।আমি যেতে বলেছি।আমাদের আর কথা হবেনা।এতো খারাপ লাগছে কেন?আমি মনে হয় মা’রা যাচ্ছি।”
চলবে।