মিঠা রোদ পর্ব ৫৫

0
2150

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৫৫
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“তোশা আমার প্রেমিকা,ভালোবাসা।এবং বর্তমানে মায়ের পর সবথেকে কাছের নারী।তুমি চিল্লিয়ে যাই বলো তাতে সত্য পরিবর্তন হবে না তাহিয়া।”

কবীরের গলার আওয়াজে কী ছিল?হু’মকি?কিংবা স্বাবধান বাণী?তবে যা ছিল ঘরে উপস্থিত সকলকে নড়েচড়ে বসতে সাহায্য করলো।অবস্থা বেগতিক দেখে নেয়ামত উঠে এসে তোশার হাত ধরে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“বসে কথা বলো দুজনে।কারণ চিল্লিয়ে কথা বললে মানুষ হাসানো ছাড়া কিছুই হবেনা।আমরা বড়রা আছি।তারা দেখছি বিষয়টা।”

“বাবা আপনারা আমার মেয়ের সবথেকে বড় অভিভাবক নয় নিশ্চয়।কোনো কথা বলতে রাজী নই আমি।”

“চুপ থাকো তাহিয়া।”

তোশা কবীরের অন্য হাত ধরে আছে।আশ্চর্যভাবে মনে হচ্ছে এখন ছেড়ে দিলে আর কখনো ধরা হবেনা হাতখানা।

“তোশা তোমার নানুর কাছে গিয়ে বসো।তা নয় ভেতরে চলে যাও।জিদ করো না বিষয়টা ভালো হবেনা কিন্তু।”

“ঠিক আছে নানাভাই।”

নানার কথা মতোন সোফার এক কোণায় গিয়ে বসলো তোশা।কবীর এখনও দাঁড়িয়ে আছে।তাহিয়া কিছুতে শান্তি পাচ্ছে না।গলার সুর কয়েক গুণ উঁচু করে শুধালো,

“ডিভোর্সের পর তুমি আমার খেয়াল রেখেছিলে কবীর।একজন পার্ফেক্ট বন্ধু, পার্ফেক্ট জেন্টালম্যান।সে কীভাবে আমারই মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ায়?ভুলে গিয়েছো ওর জন্ম দেখেছো তুমি?মায়ান সবসময় তোমাকে ভাই বলে ডাকে।তার কথার এই প্রতিদান?ঘেন্না করলো না?”

“তোশা রক্তের কেউ না আমার।”

“রক্তের না হলেও চক্ষুলজ্জার ব্যাপার বলে কিছু আছে।”

“তাই?তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো তো চক্ষুলজ্জা শব্দের জন্য আমাকে ছাড়বে কীনা?দেখো তাহিয়া তোমরা কী বলবে বা বলতে পারো আমি সেটা জানি।কিন্তু সত্য হলো আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি।বিয়ে করতে চাই।তোশা যদি সকলকে এভাবে জানানোর পদক্ষেপ গ্রহণ কিংবা আমার সাথে দূর্ঘটনা না হতো আজ ইংল্যান্ডে থাকতাম দুজনে।কিছুই করতে পারতে না।”

“কোনোভাবে বিষয়টিকে নর্মাল বলে চালিয়ে দিতে পারো না তুমি।”

কবীর তীব্র দুঃখে বাঁকা হাসলো।গালের শক্ত পেশিগুলোতে টান পড়লো হালকা।

“আমি নিজেও জানি বন্ধুর মেয়ে।বিশ বছর বয়সী ভার্সিটিতে পড়া একজন মেয়ের সাথে বিয়ের কথা চিন্তা করা কখনো নর্মাল বিষয় না।বরং আপাতত দৃষ্টিতে দেখলে অদ্ভূত ও ভীষণ অন্যায়।আমি সেই অন্যায়টা করেছি।তা নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই।বাট আই ওয়ান্ট হার সো ব্যাডলি।”

বলিষ্ঠ পাহাড়ের সমান মজবুত বাক্য কবীরের।অধিকাংশ মানুষ তা হজম করতে পারলো না।তোশা কিছু বলার জন্য মুখ খুললে প্রথম ধমকটা কবীরই দিলো।যেন নিশ্চুপ থাকে সে।তোশার মনে হলো এতে দয়া করছে তার ভালোবাসার মানুষটা।কারণ সব দোষ কবীরের হবে।অথচ যদি এমন ভালোবাসা দোষের হয় সেখানে প্রকৃত অপরাধী তোশা নিজে।প্রথম পদক্ষেপ তার ছিল।সিক্ত কার্ণিশ আঙুলের ডগা দিয়ে মুছে তোশা মানুষটিকে পুনরায় দেখলো।লম্বা,চওড়া বাজপাখির মতো ধারালো মানুষটা নির্দোষ হওয়া স্বত্ত্বেও তাকে কারো কাছে ছোট হতে দিচ্ছে না।রুমে উপস্থিত বেশীরভাগ মানুষ কবীরকে কথা শুনাচ্ছে।অনেক বড় তর্ক তৈরী হয়ে যাচ্ছে এই ব্যাপারে কেন সে নিজে ঠিক থাকলো না?উল্টো তোশাকে ভুলভাবে বুঝিয়েছে নিশ্চয়।পুরো ব্যাপারটিতে কেউ যদি নিশ্চুপ থেকে থাকে তবে সে হলো মায়ান।তার দ্বিতীয় স্ত্রী টিনা পাশ থেকে বলল,

“তুমি কিছু বলবেনা মায়ান?অবস্থা বেগতিক হচ্ছে।”

“বলবো।আগে তাহিয়ার কাছ থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর নিবো।”

“প্লিজ শান্ত থেকে কথা বলবে।”

টিনার কণ্ঠে চিন্তা মিশে আছে।মায়ান আগে পিছে কোথাও না গিয়ে একদম তোশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।মেয়েটা বাবাকে দেখে নিশ্চুপ হয়ে গেলো।

“সবাই একটু চুপ থাকেন।তোশার সঙ্গে কিছু কথা বলবো আমি।”

কবীর বিরোধ করে বলল,

“ওর সাথে কোনো কথা নেই মায়ান।আমি তো জবাব দিচ্ছি।”

“চুপ কবীর।আমার মেয়ের ব্যাপারে আমি বুঝবো।তোশা একটা কথা বলো শুরুটা তুমি করেছিলে তাইতো?আমি নাটক পুরোটা পাঁচবার দেখে সিচুয়েশন বোঝার চেষ্টা করেছি।”

তোশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো।ভীষণ স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলো,

“জি বাবা।”

“শুরুতে তুমি কবীরের সাথে রেস্ট্রুরেন্টে ঘুরেছো।সেটা তাহিয়া জানতো না।যাচাই-বাছাই কখনো করেনি?”

“না।”

“ওকে।এরপর সম্পর্ক হলো তোমরা তো পাব্লিক প্লেসেও চোখে চোখে কথা বলতে। আমি বাংলাদেশে এসেই বুঝেছি বিষয়টা।আর দিশা কীনা বলে জানিনা?ওর খবর আছে।কিন্তু তার আগে তাহিয়া তোর বিচার হওয়া উচিত।মা হওয়ার যোগ্যতা আছে?না থাকলে মেয়েকে আমার কাছে কেন দিয়ে দিলি না?”

তাহিয়াকে শুরু থেকে মায়ান তুই বলে সম্বোধন করতো।আজ এতো বছর পর সরাসরি কথা বলছে তারা।তাহিয়ার থেমে থাকার পাত্র নয়।মায়ানকে কোণঠাসা করার নিমিত্তে বলল,

“বড় বড় কথা বলবেন না মায়ান।কাপুরষ কোথাকার।মেয়েকে আমি সঠিক শিক্ষায় বড় করেছি।”

“হাহ?সেটা তো দেখতে পাচ্ছি।”

বিদ্রুপে কান্না চলে আসছে তাহিয়ার।যে মেয়েকে কখনো কোনো কষ্ট পেতে দেয়নি আজ তার জন্য সকলের কাছে সে ছোট হয়ে গেলো।আশেপাশে তাঁকালো।সবাই বিতৃষ্ণায় তাদের দেখছে।গা গুলিয়ে আসছে তাহিয়ার।কোনোমতন মায়ানকে বলল,

“আপনাকে কোনো জবাবদিহিতা করতে চাইনা মায়ান।অবশ্য কাওকে না।”

পুনরায় থেমে বলল,

“কবীর আমি জানি তুমি বুদ্ধিমান একজন মানুষ।বিষয়টা খুব খারাপ হচ্ছে।আমি কখনো মেয়েকে খারাপ শিক্ষা দেইনি।কিন্তু এই মানুষটা নিজেকে কী ভাবে?আজ আমার উপর প্রশ্ন তুলছে।প্লিজ তোমার কাছে বলছি তোশাকে ছেড়ে দাও।”

দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলছে তাহিয়া।কবীরের হঠাৎ মায়া হলো।পাশ থেকে চেয়ার এনে তাহিয়াকে সেখানে বসালো।এরপর মুখোমুখি নিজেও হাঁটুগেড়ে বসলো।

“তাহিয়া,তুমি আমার চমৎকার একজন বন্ধু।কিন্তু এর বাহিরে পিওর একটা সোল তুমি।সাধারণ,কোনো উচ্চ আকাঙ্খা নেই।বুদ্ধিমতী মানুষ।সাথে জানো খুব সুন্দর একটা মেয়ের মা হয়েছো।মানছি তোশা ও আমি তোমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টটা দিয়েছি।কিন্তু অনুভূতির কাছে দুজনে হেল্পলেস।তুমি আগে নিজেকে শান্ত করো।আমার এই দুনিয়াতে কাওকে মানাতে হবেনা।শুধু আমার বাবা-মা ও তোমাকে আর মায়ানকে মানানো ছাড়া।এ বাদে যে যা বলুক।তোশাকে আমি ছাড়বো না।এবং আমি তাতে সিরিয়াস।”

শেষের কথাটিতে মনে হলো কবীর হু’মকি দিচ্ছে।তাহিয়া অনেক অবাক হয়ে কবীরকে দেখছে।ওই গভীর দুই চোখে অনেক ভালোবাসা।তার ছোট মেয়ে তোশার জন্য।কবীর পুনরায় বলল,

“আমি আজ তোশাকে রেখে যাচ্ছি কারণ তোমাকে শান্ত হওয়ার সময় দিচ্ছি।এর মানে একেবারে পালিয়ে যাচ্ছি না।তাহিয়া আমি জানি নিজের মেয়ের সাথে রা’গ করে ভুলভাল কিছু করার মানুষ তুমি না।আমার তোশাকে দেখে রেখো।ঠিক আছে?”

তাহিয়া নিশ্চুপ শুধু চেয়ে রয় কবীরের দিকে।যাওয়ার আগে বেলাডোনাকে চোখে আশ্বস্ত্ব করে কবীর।যে সব ঠিক হবে।

(***)

কবীর একমনে সামনের দিকে তাঁকিয়ে আছে।চোখে তার অমীমাংসিত দৃষ্টি।তোশাকে রেখে একটুও আসতে মন চাচ্ছিলো না।পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দেখলো উল্লাস দাঁড়িয়ে আছে।

“ভেতরে কী হচ্ছে উল্লাস?”

“মেলোড্রামা।একটা কথা বলুন তো মায়ান নামের লোকটা আপনার বন্ধু হয়েছিল কীভাবে?চোখে দেখে অনেক কিছু অনুমান করা যায়।”

“তোশা কী করছে?”

“বসে কাঁদছে।না করে এলাম।ওহো আমাকে প্রেশার দেওয়া হচ্ছে নাটকটা ডাউন করে দিতে।কিন্তু অলরেডি তা ভাইরাল।বাট আমি তা করবো না।কারণ দশ জন মানুষের অন্য দশজন মানুষকে কনভেন্স করার ক্ষমতা থাকে।আমি এটা এভাবে পাব্লিকে না আনলে প্রতীক কিন্তু খারাপ ভাবে আনতো।”

“কেন?”

“ও তোশাকে পছন্দ করে।তাহিয়াকে কিন্তু এপ্রোচও করবে ভেবেছিল।সখীর হয়েছে জ্বালা সুন্দরী হয়ে ।কিন্তু চাঁদে যে গ্রহণ আছে।”

“তুমি ফর্সা দেখে আমাকে কালো বলার রাইট নেই ছেলে।”

কবীরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।উল্লাস কিছু বলতে যাবে এর পূর্বে কবীরের ফোনে কল এলো।দিশার নামটা স্ক্রিনে দেখে রিসিভ করবেনা ভেবেছিল।কিন্তু কী ভেবে ধরলো।

“হ্যাঁ দিশা বলো।”

“কবীর, সব ছেড়ে দাও।তোশাকেও ছাড়ো।আমরা আবার এক হতে পারিনা?আমি তোমার সাথে সংসারে ফিরতে চাচ্ছি।”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here