#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৫৩
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“কেমন মেয়েকে ভালোবাসো তুমি যে সবার সামনে এতো দিনে গড়া সম্মান মিশিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে?কবীর তুমি রাজা।এভাবে নিজের সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে দিও না।”
দিশার কথাকে বালুকণা পরিমাণ পাত্তা না দিয়ে কবীর মিষ্টি করে হাসলো।দুটো রুট বিয়ারের ক্যান খুলে টেবিলের উপর রাখলো।মানুষটা যেন দৃঢ় ইস্পাত।লম্বা চওড়া দেহ দেখে বয়সের অনুমান করা কঠিন।হাতে আ’ঘা’তও যাকে টলাতে পারেনি।
“তোশা যেখানে আছে সুস্থ আছে।মেয়েটা ছোট যা কিছু হচ্ছে সেসব গ্রহণ করতে পারবেনা।”
“মনে তো হয়না ছোট।বাবার বন্ধুর সাথে।”
“দিশা,আমার পরিচয় কী শুধু মায়ানের বন্ধুর?তোশা আমাকে পুরুষ হিসেবে দেখেছে।”
“আমাদের ছেলের উপর কী যাচ্ছে সেটা খেয়াল করেছো একবার?মা হিসেবে আমাকে বাধ্য করবেনা আবার আইনের আশ্রয় নিতে।তোমার উচিত তোশার সঙ্গে সব বন্ধ করে মিডিয়া থেকে অতি দ্রুত ড্রামাটা সরানোর।”
কবীর হালকা তরল গলা:ধকরণ করে জবাব দিলো,
“উপদেশের জন্য ধন্যবাদ।কিন্তু মেয়েটাকে আমি ছাড়ছিনা।দেখো তো কতো কঠিন প্রেমিকা ও।”
“তুমি ম্যানিয়াকের মতোন আচরণ করছো।বুঝেছো নিশ্চয় কীসের কথা বলছি?শরীর সব নয় কথাটা বুঝো মি.শাহ।”
“টগর,তোমার উচিত আমার জীবনে এতো দখলদারি না করার।বিয়ে করছো না কেন?সামনে কিন্তু আমি বিয়ে করবো।”
কবীরকে এহেন সোজাসাপ্টা কথা বলতে অনেকদিন শুনেনি দিশা।টগর নামটাও অনেকটা সময় পর ডাকলো।কবীরের মুখমণ্ডল ঈষৎ উজ্জ্বল হয়ে আছে।অসুস্থতা,টেনশন কিছুই তো মুখের রঙটাকে মলিন করতে পারেনি।
“তুমি সিরিয়াস তোশাকে বিয়ে করা নিয়ে?মায়ান -তাহিয়ার কথা একবারও ভাবছো না?”
“আমার ওদের সাথে এখনও কথা হয়নি তোশাকে নিয়ে। যদিও টেনশন করছে দুজনে।তবে দুজন মানুষ আমাকে এখনও ভরসা করে।তাইতো মেয়ের খোঁজ না জানলেও ভয়ে নেই।”
দিশার মুখবিবরে আক্রোশের ছায়া ফু্টে উঠলো।পা দিয়ে মেঝেতে শব্দ করে বলল,
“সেই তাহিয়ার বিশ্বাস ভাঙলে।এটা নিয়ে হালকা অনুতাপ যদি করতে।”
কবীর সেই প্রসঙ্গে গেলো না।ল্যাপটপ থেকে কিছু একটা বের করে দিশার সামনে তুলে ধরলো,
“দেখো তো।ছেলেটিকে পছন্দ কীনা?লন্ডনে আছে।আমাদের থেকে এক কী দুই বছরের বড় হবে।”
“তাতে আমার কী?”
“তোমার জন্য পাত্র দেখছি।এবার বিয়ে দিয়ে ছাড়বো।”
“মাথা খারাপ কবীর?”
“আমি কনসার্ন করে পাত্র খুঁজে চলেছি।আর তুমি মাথা খারাপ বললে?”
“আমার পার্সোনাল লাইফে তোমাকে এতো কনসার্ন করতে কে বলেছে?ভুলে যেওনা তুমি প্রাক্তন।”
হুট করে বাতাসে মুক্তো ছোঁয়ার মতোন করে কবীর বলল,
“তাহলে তুমি কেন ভুলে গিয়েছো যে আমরা প্রাক্তন?”
দিশা সহসা শব্দ খুঁজে পেলো না কিছু বলার জন্য।কিন্তু কথায় পুরোনো আমলের দড়িটা ফের টান দিলো যেন।
“তোশা তোমার বন্ধুর মেয়ে।মায়ানকে কতোবার তুমি ভাই বলে ডেকোছো।”
“ওর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক না।তোশার সাথেও না। আমি মেয়েটাকে ওয়াদা দিয়েছি বিয়ের।তোমার মনে হয় কবীর শাহ সেরকম মেরুদণ্ডহীন পুরুষ যে একটি মেয়েকে এমনি বিয়ের কথা বলবে?”
“তুমি নও।কিন্তু বিষয়টা কেউ মেনে নিবে না।”
“আমাদের পরিবার নিলে হবে।”
হাতের তালু ঘেমে যাচ্ছে দিশার।শক্ত কাঁচে উপর হাতটা ঘসে শুধালো,
“আমি তোমার পরিবার নই?”
“নাহ।সেই সম্পর্ক বহুকাল পূর্বে দুজনে নিজ হাতে শেষ করেছি।তুমি এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন।আমিও।বারবার সেখানে কথা তুলে বিব্রত করো না।তাছাড়া যে ব্যাপারটা চলছে আমি মিটিয়ে নিবো।”
“বেশ।একটা কথা বলার ছিল।”
“বলো।”
“মার্চে আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।হয়তো চিরতরে ডেনমার্কে।আহনাফকে কখনো আমার কাছে যাওয়ার অনুমতি দিবে?”
“আমার ছেলে যথেষ্ট সেন্সিবল ও বুদ্ধিমান।সে যদি নিজ মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায় তবে অবশ্যই দিবো।”
“আচ্ছা।”
দিশা পাশের চেয়ার থেকে ব্যাগটা উঠিয়ে কাঁধে তুলে নিলো।হঠাৎ বুকে ভীষণ ভারী অনুভব হচ্ছে।কবীরের সঙ্গে এটা তার শেষ দেখা।সে কখনো আর তোশার ব্যাপার হয়তো বলবেনা।কোনো রকম বিদায় সম্ভাষণ না করে হাঁটা আরম্ভ করলো।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হঠাৎ পিছন ফিরে বলল,
“সন্তানটা আমারও কবীর।কিন্তু তুমি আমাদের কেন বললে না?তুমি হয়তো তোশার স্বামী হবে।কিন্ত তোমার প্রথম সন্তান আহনাফের মা সবসময় দিশা থাকবে।সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আমাদের শব্দটা ব্যবহার করবে।”
কবীর নিশ্চুপ থাকলো।এক কালে ভীষণ পরিচিত মানুষ ডিভোর্স শব্দটায় অচেনা হয়ে উঠে।
(***)
অনেকক্ষণ ধরে তাহিয়ার মাথা ব্যাথা করছে।তীব্র যন্ত্রণায় পৃথিবী দুলে উঠছে।তার মা একটু আগে এক গ্লাস দুধ এনে দিয়েছিল।সেটা ছোট করে একটা চুমুক দিলো।অকস্মাৎ তার সামনে কেউ একটা কাগজ রাখলো।তাহিয়া চোখ তুলে দেখলো তার বাবা নেয়ামত দাঁড়িয়ে আছে।
“এটা কী বাবা?”
“তোমার সারা জীবনের অর্জন।সেসব ফিরিয়ে দিলাম।”
“হঠাৎ কেন?”
নেয়ামত অদ্ভূত করুণভাবে হাসলো।
“মানুষ কখন সবথেকে কষ্ট পায় জানো?যখন সারাজীবনের অর্জনে কেউ আ’ঘা’ত করে।”
নেয়ামতের বয়স হয়েছে।কথা অনেক থেমে থেমে বলে।মেয়ের পাশে বসে পুনরায় বলল,
“আমি খুব সুন্দর একটা মেয়ের বাবা হয়েছিলাম।কতো স্বপ্ন ছিল তাকে পড়াবো,সুন্দর করে বড় করে তুলবো।কিন্তু স্বপ্ন ভেঙেছিল আজ থেকে একুশ/বাইশ বছর আগে।কী যে বুকে য’ন্ত্র’ণা হয়েছিল আমি এই নেয়ামত আজও কাওকে তা বোঝাতে পারিনি।সেই মেয়ে আবার কিছু বছর পর তালাক নিয়েও চলে এলো।তখন ভেবেছিলাম এর শোধ তুলবো।তোমার অর্থ নিয়ে সংশয় তৈরী করে ভেবেছিলাম এইতো আমার প্রতি’শোধ শেষ।কিন্তু সৃষ্টি কর্তা ভিন্ন কিছু ভেবে রেখেছিলো তাহিয়া।আজ তুমি সেই জায়গায় যেখানে দাঁড়িয়ে আমি..। ”
নেয়ামত দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।তাহিয়া উদাসভাবে বাবাকে দেখছে।
“এজন্য ভাবলাম এই অর্থ দিয়ে আর কী করবো?ফিরিয়ে দিলাম।”
“লাগবেনা বাবা।”
“কেন?মেয়েকে তুমি ছেড়ে দিয়েছো?ভালোর জন্যও এটা করবেনা।তোমার মায়ানকে পাওয়ার অধিকার থাকলে তোশারও আছে।”
“আমাকে অনেক ঘৃ’ণা করেন বাবা তাইনা?”
মেয়ের কণ্ঠে একরাশ কান্নার সুর খুঁজে পায় নেয়ামত।আস্তে করে ক্ষয়ে যাওয়া কাঁধে তাহিয়ার মাথাটা রাখলো।
“তুমি কী তোশামণিকে ঘৃণা করো তাহিয়া?”
“একদম না বাবা।মেয়ের জন্য মনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।আমি জানি কবীরের কাছে ঠিক আছে ও।বাহিরে যা হচ্ছে তা মেয়েটার আসলেও দেখা উচিত না।কিন্তু..।”
“তাহলে আমার কথার জবাব পেয়ে যাবে তাহিয়া মামুনি।তোমার প্রতি অনুভবটা আমার কেমন।”
বাবার মুখে বছর বছর পর মামুনি ডাক শুনতে পেলো তাহিয়া।হঠাৎ পুরোনো স্মৃতি গুলো ফিরে এলো।আজ এতো বছর পর মায়ানের ও তার বাবার দুঃখটা সে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো।
(***)
তোশার দিনগুলো কয়েক দিন ধরে খুব অলস কাঁটছে।সারাদিন কথা বলার জন্য কেউ নেই।ফোনটাও দেয়নি উল্লাস।বলেছে কী যেন সারপ্রাইজ আছে।সেটা তৈরী হলে দিয়ে দিবে।তোশা বিরোধিতা করেনি।কবীর উল্লাসের পরামর্শ মতোন চলতে বলেছে।এই কথাগুলোও বলেছিল আজ বেশ কয়েক দিন হয়ে গেলো।নাহ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারছে না কবীরের সঙ্গে।মুখে তেতোমিঠা ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তোশা।নির্জন এই ফ্ল্যাটটির কিছু ভালো লাগেনি।শুধু একটা জিনিস বাদে।সুন্দর একটি মেয়ের ছবি বড় করে ড্রয়িং রুমে টাঙানো।আবার ছবির নিচে লেখা “রসে ডুবানো মধুর মৌমাছি”
লেখাটা ভারী অদ্ভূত।তোশা ভেবেছে উল্লাসকে জিজ্ঞেস করবে মেয়েটা কে?টুংটাং শব্দে কলিং বেল বেজে উঠলো।তোশা নিজেকে বিন্যস্ত করে দরজাটি খুলে দিলো।অপ্রত্যাশিত ভাবে ওপাশে কবীর দাঁড়িয়ে আছে।কেমন মন ভুলানো রঙের স্যুট পরেছে মানুষটা।কালোতে যা ফু়টে উঠে।ফর্মাল পোশাকে মানুষটাকে দেখে সবসময় পাগল হয়ে যায় তোশা।কিন্তু নিজের মনের ঝড়কে এক পাশে রেখে বলল,
“প্রবেশ করতে পাসওয়ার্ড বলতে হবে?জানেন আপনি মি.শাহ।”
কবীর মুগ্ধ চোখে নিজের প্রেমিকাকে দেখছে।দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সে।তেতো কোলনের মাদকময় সুগন্ধে তোশার পেটের ভেতর প্রজাপতি উড়ে গেলো।
“জানি।বললে ভেতরে ঢুকতে পারবো?সুন্দর ফুলটাকে নিতে।”
তোশা ভালোবাসায় সম্মতিতে মাথা দুলায়।কবীর জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“পাসওয়ার্ড হচ্ছে ভালোবাসি বেলাডোনা।ভালোবাসবো বেলাডোনা।”
চলবে।