মিঠা রোদ পর্ব ৪৭

0
1991

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৪৭
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“প্রাক্তন স্বামীকে এতোদিন পর দেখে কেমন লাগছে তাহিয়া?খুশি তো?যার দুঃখে এতোটা শোকাবহ যে এখন অবধি বিয়ে করার নাম নেই।”

আসিফের কণ্ঠে একরাশ অভিমান মিশে একাকার হয়ে আছে।বোকা পুরুষটি বুঝে না অভিমান করার ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে সহমর্মিতা থাকা জরুরি।তাহিয়া মৃদু হাসলো।অদূরে মায়ানের চোরা চোখের দৃষ্টি মিনিট খানেক পর পর তার কাছে এসে থামছে।

“আমি বিয়ে করিনি জীবনে এর মানে এটা নয় মায়ানকে ভুলতে পারিনি কিংবা তার জন্য এখনও কষ্ট পাই।”

“তোমার হৃদয়ে তবে মায়ানের জন্য কোনো কষ্ট নেই?ধরে নিবো যা আছে সবটা ভালোবাসা?”

“ভালোবাসা যেখানে আছে সেখানে বিচ্ছেদ পা রাখতে পারে?সম্ভব নয়।”

আসিফ সম্মতিতে মাথা দুলায়।পরিবেশে পো’ড়া মা’ংসের সুগন্ধে ভরে গিয়েছে।আজকে সকলকে স্টেক পার্টিতে ইনভাইট করেছে আসিফ।নেপথ্যে কাহিনী হলো তাহিয়াকে যেভাবে হোক বিয়ের জন্য মানিয়ে নেওয়া।

“তাহলে মুভ অন না করার ক্ষেত্রে তোমার গুরুত্বপূর্ণ কারণটা কী?”

“বলতে পারেন সম্পর্ক জড়ানোর মুডটা ঠিক নেই আমার।”

তাহিয়ার খামখেয়ালী কথাবার্তা আসিফের ভেতর থেকে উষ্ণ শ্বাস বের হয়ে আসে।বিবর্ণ কণ্ঠে বলল,

“ঠিক করে বলো।আসলে কী চাও তুমি।মায়ানকে দেখো জীবনে কতোটা এগিয়ে গিয়েছে।তুমি কেন একা থাকবে?”

“শুনেন আসিফ ভাই।আমার দ্বারা সংসার আর হবেনা।রোজ একটা টেনশন, কতোগুলো কার্টেসী মেইনটেইন করা।কিংবা সম্পর্ক নিয়ে সবসময়ের ভয়টা আমি চাইনা।বরং ক্লায়েন্ট ও স্টাফদের সাথে তর্কবহুল আলোচনাকে বেশী স্বস্তিদায়ক মনে হয়।আমি মায়ানকে ভালোবাসি না।সেক্ষেত্রে শোক পালনের প্রশ্নটি নেহাৎ অবাঞ্জনীয়।”

“বুঝলাম।আমাকে তাহলে সারাজীবন একা থাকতে হবে?”

আসিফের করুণ কণ্ঠে তাহিয়া হেসে উঠলো।

“আপনি ভীষণ বোকা আসিফ ভাই।যেখানে আজকাল স্বার্থের আড়ালে শত্রুকে সালাম দেয় মানুষ সেখানে ভালোবাসার জন্য সংসার ধর্ম পালন না করা বোকামো।”

“কিন্তু তোমার অনুযায়ী সংসার খারাপ।”

“যদি তাই হতো আমাদের মা-বাবা কীভাবে থাকলেন?সমস্যা টা হলো চাওয়া-পাওয়া দুই দিক থেকে থাকতে হয়।আপনি তো এক হাতে তালি বাজাতে পারবেন না।”

আসিফ বিজ্ঞের অনুরুপ মাথা দুলায়।এই জীবনে হয়তো চিরকুমার থাকতে হবে তাকে।ওদিকে দুজনের আলাপে মায়ান কৌতুহলী হয়।শুনতে মন চায় প্রাক্তন স্ত্রী কী কথা বলছে।ভরসার স্থান হিসেবে খুঁজে পেলো মেয়ে তোশাকে।যে গালে হাত দিয়ে একমনে কয়লা পুড়তে দেখছে।মায়ান তার পাশে গিয়ে বসলো।

“একা একা কী করো তোশা মা?”

“কিছুনা আসলে বোরিং লাগছে আমার।তোমরা সকলে তো ওল্ড।কীসব কথা আলাপ করো তা বুঝতে সমস্যা হয়।”

“ঠিক।সবসময় এমন ছিলনা।আসলে কবীর ইয়াং থাকতে..।”

মায়ানের কথা শেষ হওয়ার আগে জিহবায় কামড়ে নিজেকে শাসিয়ে নিলো তোশা।গোমড়া মুখে বলল,

“তোমরা ওল্ড না।কবীর শাহ তো আরো না।”

“তাহিয়াকেও তো ইয়াং লাগছে।আচ্ছা সত্যি কী তোমার মা আসিফ ভাইকে বিয়ে করবে?”

“করতেও পারে।”

“তুমি একবার বলেছিলে।মায়ের সঙ্গে এই ব্যাপারে ঠিকঠাক আলাপ কেন করো না?”

“করেছিলাম।তবে মা কী চায় সেটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।”

তাহিয়া পূর্বের জায়গা থেকে উঠে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।কী সুন্দর হাঁটার ভঙিমা,শিল্পীর আঁকা প্রতিচ্ছবিও মনে হচ্ছে চল্লিশের পরেও।সুন্দর করে কপাল থেকে চুল সরিয়ে তোশাকে বলল,

“তোমার খুদা লাগেনি তোশামণি?আমার সাথে এসো।”

মায়ান যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতে ছিল।তাহিয়াকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার জন্য গলা পরিষ্কার করলো।কিন্তু আফসোস গলা থেকে বাঘের গর্জন আসা তো দূরের কথা।সামান্যতম বিড়ালের ম্যাও টি বের হলো না।তাহিয়া অবশ্য তোশার হাত ধরে তাকে নিয়ে অন্য একটি জায়গায় এলো।যেখান থেকে কবীরকে খুব ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে।তাদের কলেজের অনেকে থাকায় গোল হয়ে বসে কবীরের সাথে পাঞ্জা লড়ছে সকলে।অথচ আফসোস তামাটে পুরুষটির শক্তির কাছে অন্য কেউ পারবে নাকী?তোশার বুক কাঁপে।দীর্ঘ শ্বাস টানে।রোদে পোড়া কবীর শাহ আজকে অন্যরকম সেজেছে।বিশেষ করে চুলে নতুন ধরণের কাটে একটু বিশেষ লাগছে না?এইযে ঠোঁট কপাল কুঁচকে অপর পক্ষের মানুষকে শক্তিতে হারিয়ে দিচ্ছে এতে তোশামণি আরো নাজেহাল যেন।সে বুঝে পায়না শৈল্পিক এই মানুষটিকে কীভাবে পটিয়ে ফেললো?

কবীর একে একে সবাইকে হারিয়ে বেশ গর্ভের সাথে বলল,

“আমাকে হারানো এতো সহজ না।আর কেউ বাদ আছে?মায়ান এক হাত হবে নাকী?”

মায়ান ইশারায় না করে দেয়।কিন্তু একটি নারী কণ্ঠ বিচলিত করে তুলে সকলকে।

“আমি পারবো হারাতে।”

কবীর তোশার কণ্ঠ শুনে ভ্রুঁ কুঁচকালো।মেয়েটি অতি কনফিডেন্টের সাথে কবীরের সামনে দাঁড়ালো।

“আমি পারবো।”

কবীর গোপনে হাসে।অহংকারী সুরে বলে,

“বুঝে কথাটি বললে নাকী না বুঝে?”

“একদম বুঝে।এবং জিতবো আমি।”

“বাচ্চা দেখে কিন্তু আমি সেক্রিফাইজ করবো না।”

পাশ থেকে আসিফ বলে উঠলো,

“তুমি কিন্তু গল্পের সেই খরগোশের মতোন করছো কবীর।হতে পারে তাইয়ুবা হারিয়ে দিলো তোমাকে।”

“এমনটা যদি হয় আসিফ ভাই তাহলে বিরোধী দলের ভাগের একশটি ভোট আপনাকে এনে দিবো।”

“গোপন কথা এভাবে বলতে হয়না কবীর।বাই দ্য ওয়ে তাইয়ুবা এবার কিন্তু জিততেই হবে।”

তোশা অতি কনফিডেন্সের জোরে কবীরের সামনে বসে পড়লো।অতি চেনা ছোঁয়ায় শিহরিত হলো।হাতের তালুতে ছোট্ট হাতখানির কম্পন কবীর বুঝতে পারে।যখন শুরু হলো শক্তির পরীক্ষা আশ্চর্যভাবে কবীর হারছেনা।উল্টো জিতে যাচ্ছে।বিশ সেকেন্ড তার হাতের ভার বহন করতে গিয়ে নাজেহাল হলো তোশা।হেরে গেলো সে।আসিফ ইশ বলে আফসোস করে উঠলো।সকলের এমনভাব যেন এমনটা হওয়ার কথা ছিলনা।তোশা অবাক হয়ে কবীরকে দেখছে।জিতে যাওয়ার খুশিতে তামাটে পুরুষটির চেহারাতে আত্মগৌরবের ছায়া ফুঁটে উঠেছে।তোশার মন বলল হেরে গেলে কী হতো কবীর শাহ এর?

(***)

অন্ধকারে পদধ্বনি বড় অদ্ভূত গম্ভীর শোনাচ্ছে।বাড়ীর সবথেকে নির্জন জায়গায় একটা মেয়ে উড়ো উড়ো চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পিছন থেকে কেউ তাকে রহস্য ভৌতিক নারী বলে বিবেচনা করে নিতে পারে।কিন্তু তামাটে পুরুষটির কথা ভিন্ন।সে এগিয়ে এসে প্রাণ ভরে তরুণীর সুগন্ধ নেয়।

“তুমি বেবি পাউডার দেওয়া বন্ধ করবে কবে?এমনি বাচ্চা তখন আরো ছোট মনে হয়।”

কবীর শাহ কাঁধ ধরে মেয়েটিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো।আলো আঁধারে দেখতে পেলো তোশার চোখদুটো অশ্রুতে ভরে গিয়েছে।ঠোঁটটি উল্টিয়ে রয়েছে।বড় মায়া হলো কবীরের।নিজের হাতখানা দেখিয়ে বলল,

“এসো আবার পাঞ্জা ধরি।এবার তুমিই জিতবে।”

“না হবেনা।সকলের সামনে আপনি জিততে দেননি আমাকে।”

“তোমার হাত দেখো আর আমার হাত দেখো।কখনো দেখেছো সিংহকে বিড়াল হারিয়ে দিতে পারে শক্তিতে?”

“আমাকে বিড়াল বললেন কবীর শাহ?”

“নাহ নিজেকে সিংহ বললাম।”

তোশার চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে গেলো।তখন হেরে যাওয়ায় মনটা কীনা এখনও খারাপ।গলাটা একটু পরিষ্কার করে কবীরের সন্নিকটে এলো।সাহস জুগিয়ে পুরুষটির কবজিতে কা’ম’ড়ে ধরলো।সময় যায় এক মিনিট, দুই মিনিট করে।কবীরের মুখের রঙ দ’ং’শ’নে বির্বণ হয়।কিন্ত তোশা নামক ছোট্ট বিড়াল সাহসী সিংহ কবীর শাহ এর কবজি ছাড়ে না।

“আহ! বিড়াল মেয়ে ছাড়ো তো হাতটা।”

তোশা নাছোড়বান্দা।ছাড়বে না হাত।নোনতা স্বাদ স্বাদগ্রন্থিতে লাগায় অবশেষে মায়া হলো।কবীরের বুকে মাথা ঠেকালো।

“আমি ভেবেছিলাম জিতে যাবো।প্রেমিকরা নিজ প্রেমিকাকে জিতিয়ে দেয়।আমি ভুলে গেছিলাম আমার প্রেমিক কবীর শাহ।”

গা দুলিয়ে হাসলো কবীর।সুন্দর করে বলল,

“আমার মধ্যে পার্থক্যটি কী?”

“কিছুনা।আপনি ভীষণ আনরোমান্টিক।”

হুট করে কবীর তোশাকে উঁচু করে ধরলো।তরঙ্গায়িত হয়ে গেলো তরুণীর মন।কোমড়ে শক্ত হাতের ছোঁয়ায় শিওরে উঠলো।মেয়েটির পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে কবীর শুধালো,

“কী বললে আমি কী?”

“আআআআআআনননননরোরোরোমা..।”

“তুমি সারে গা মা পা কেন বলছো?”

কবীরের শান্ত অথচ গম্ভীর দৃষ্টি তোশাকে বিভ্রান্ত করে তুলছে।মিনিট খানেক পর কবীর তাকে নামিয়ে দিলো।দূরে সরে গেলো।ঈগলের অনুরূপ কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষটিকে তোশার বড় মায়াময় লাগছে।

দূরে গিয়ে এমন এক জায়গায় দাঁড়ালো কবীর যেখানে তোশার ছায়া পড়ে।ঝুঁকে মেয়েটির ছায়াকে চুমো খেলো কবীর।শীতলতা ছড়িয়ে পড়লো তোশার অন্ত:করণে।শিহরণে লাফ দিয়ে অপর দেয়ালে মিশে গেলো।কবীর সোজা হয়ে দাঁড়ালো।তরুণীর নি:শ্বাস আরো গম্ভীর হচ্ছে।

“আমাদের আর তিনদিন পর বিয়ে বেলাডোনা।”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here