#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৩৬
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“তোশামণি ও কবীর শাহ এর ভালোবাসা হলো মিঠা রোদের মতোন।প্রচন্ড ঝড়ের পর ঘোলাটে আকাশ থেকে হালকা করে উঁকি দিয়ে পুনরায় মেঘের আড়াল হয়ে গিয়েছে।ক্ষণস্থায়ী রোদটি আর উঠবেনা।সেই তো বদলে গেলো কবীর শাহ।মাঝে আমি এটা করবো ওটা করবো বলে কতো ভাব।আপনি কিছু বলবেন সিয়া ম্যাম?”
চশমাটি ত্বকের সাথে চেপে ধরলো সিয়া।বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখে বলল,
“ওভার রিয়াক্ট কেন করছো?তুমি যাকে পছন্দ করো সে আবেগে গদগদ হয়ে ভালোবাসি বলার মানুষ নয়।বরং মানি মেকার,কাজ পাগল একজন মানুষ।রোজ কথা না বললে দেখা না করলে ভালোবাসা থাকেনা?”
“গত একমাসে কতোটা অবহেলা করেছে জানেন?”
“নাহ।কারণ আমি তার বোন।প্রেমিকার সাথে কেমন সম্পর্ক সেটা বলার মতোন মানসিকতা ভাইয়ের নেই।”
তোশা ঠোঁট দং শনে অশ্রু দমনের চেষ্টায় ব্যস্ত।এই বিশাল পৃথিবীতে তার ছোট্ট অনুভূতিকে কেন কেউ দাম দেয়না?মানুষটা এমন কেন?তার সঙ্গে জড়িত সকলেও কেমন অদ্ভূত।সিয়ার বড্ড বিরক্ত অনুভব হচ্ছে।সেটা কোনমতে দমন করে বলল,
“ভাইকে এতো প্রেশার দিওনা।সে তোমার পড়াশোনা থেকে সবকিছুর খেয়াল রাখছে।এটা কী যথেষ্ট নয়?”
“নয়।”
“তো কী চাও?সাথে নিয়ে চলুক সবসময়?ভাই তো তার অফিসে যেন সবসময় দেখা করতে পারো সেই ব্যবস্থাও করে রেখেছে।আসলে কী চাও তুমি?”
“থাক কিছু চাইনা।”
“গুড।তোমার পড়াশোনার খেয়াল রাখবে।ইদানীং এক্সাম গুলোতে মার্কস কম আসছে।ভাই শুনলে বকবে।”
“জি ম্যাম।”
অতি সন্তপর্ণে চোখের কার্ণিশে থাকা অশ্রু কণা মুছে নিলো তোশা।যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে তখন সিয়া ডেকে বলল,
“শুনো তোশা।তোমাদের সম্পর্ককে আমি স্বাভাবিক নিয়েছি এতোটা এনাফ।বাকী খোলামেলা আলোচনা করার দরকার নেই আমার সাথে।আমি তোমার টিচার।মনে থাকবে?”
“জি ম্যাম।ধন্যবাদ কথা বলার জন্য।”
তোশার প্রস্থানে উষ্ণ শ্বাস বের হয়ে এলো সিয়ার ভেতর থেকে।সে এতোটাও কঠোর হতো চায়নি।কিন্তু সাহেদের পরামর্শ রয়েছে যেন কবীর তোশার বিষয়ে সে কথা না বলে।হোক না পালিত পিতা।তার কথা ফেলে দেওয়ার মতোন সাহস সিয়ার নেই।এতে তোশা কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই।
(***)
“কী বলল ম্যাম?ভাইয়াকে বোঝাবে তো?”
অপ্সরার কৌতুহলী মুখ পানে গভীর দৃষ্টি সহকারে দেখছে তোশা।বারংবার নিজের ভালোবাসার মানুষের অবহেলা তৃতীয় ব্যক্তিকে বলতে ভালো লাগেনা তার।শুকনো হাসি দিয়ে এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“আমাকে এখন অনেক সুন্দর লাগে তাইনা?কবীর শাহ বলছিলো কথাটা।”
“কল করেছিল তোকে?”
“হুম।মাফ চাইলো ফোন,এসএমএস গুলোর জবাব না দেওয়ার জন্য।খুব শীঘ্রই ঘুরতে নিয়ে যাবে সেটাও বলল।”
“কোথায় যাবি তোরা?কিছু ঠিক করলি?”
“আপাতত করিনি।কিন্তু পুরো একদিন আমাকে দিবে বলল।”
“ক্লাস কিংবা শ্যুটিং তবে একদিনের জন্য বাদ?”
“হ্যাঁ।ভাবছি সেদিনের মতোন আবার শাড়ী পরে ঘুরবো।ওইযে লাল পাড়ের সাদা শাড়ীটা।”
“পড়িস।”
তোশা ও অপ্সরা ক্যান্টিনে এসে বসলো।মেয়েটির মুখের নির্জীব হাসি অপ্সসার চোখ এড়িয়ে যায়নি।ভালো থাকার কতোটা নিখুঁত অভিনয়।তোশার মনের ভেতর যে ভীষণ কষ্ট আছে সেটা সে জানে।মা,বাবার উপরও মেয়েটির অনেক অভিমান আছে।কিন্তু হাসি,দুষ্টামির আড়ালে কেউ তা বুঝেনা।কিন্তু অপ্সরা কীভাবে যেন বুঝে যায়।এইযে ফোন টিপার বাহানায় কবীরকে এসএমএস করে যাচ্ছে।আর ওপাশ থেকে পাষাণ পুরুষটি নীরবে সব সিন করে রেখে দেওয়ায় বান্ধুবীর মলিন মুখের ভাষাও পড়তে সক্ষম সে।
“তোশামণি।”
চকিত হয়ে তোশা জবাব দিলো,
“হুম বল।”
“ফোন রাখ।ব্যস্ত হয়তো।ম্যাসেজের জবাব আসবেনা।”
“রিপ্লাই তো দিচ্ছে।”
“দিচ্ছে না।রাখ ফোন।”
টেবিলের উপর ফোনটা রেখে দিলো তোশা।চোখটা বড্ড য ন্ত্র ণা দিচ্ছে।নিজেকে ঠিক রাখতে কফিতে ছোট করে চুমুক দিলো।রাত থেকে না খাওয়ায় গুলিয়ে উঠলো পেটটা।
“আর খাবো না টিকুর মা।”
“তুই খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করিস তো?”
“খেতে মন চায়না।সেই ক্লাস নাইন থেকেই এমন হয়।আমার ওয়েট এতো কম তার চিন্তায়।”
“কাওকে এতোটাও ভালোবাসতে হয়না যেখানে নিজেকে ভুলতে হয়।তুই একটু বেশীই মায়া দেখাস।আমাদের বয়সের মেয়েরা কতোটা হাসিখুশি থাকে।আর নিজের কতোগুলো ভুল সিদ্ধান্ত এর জন্য তোর অবস্থা দেখ।”
বিনিময়ে হাসলো তোশা।সত্যিই তো অনুভূতি তৈরী হওয়ার পর থেকে যেন সে নিজেকে ভুলতে বসেছে।কষ্ট গুলো কেমন বেহায়াও সবসময় তার থাকে।শেষ হয়না কখনো।আশেপাশে তাঁকালো।তার সমবয়সী মানুষের কী প্রাণখোলা হাসছে।তোশার মনে হঠাৎ প্রশ্নের উদয় হলো।এসব ছেলে-মেয়েরা কী কাওকে ভালোবাসেনা?যদি বেসে থাকে তবে এতো খুশি থাকতে পারে কীভাবে তারা?কষ্ট নেই জীবনে?
(***)
“কী ব্যাপার?এতো চুপচাপ কেন?ঘুম আসছে?যদিও রাত বাজে বারোটা।ঘুমাতে পারো কষ্ট হলে।”
কবীরের এতোগুলো কথার জবাব দিলো না তোশা।বরং সুন্দর মুখটায় নির্বিকার ভঙি বজায় রাখলো।চোখে অমীমাংসিত দৃষ্টি।খোলা চুল নরম টি-শার্টে বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে।কবীর ক্লান্ত ভরা দৃষ্টিতে নিজ প্রেমিকার এহেন রুপ দেখছে।হ্যান্ড ওয়াচ খুলতে খুলতে শুধালো,
“ঘুমাবেনা?”
“নাহ।”
“খেয়েছো?”
“হুম।”
“বেশ।থাকো ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
ঘড়িটা পাশে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে এক নিমিষেই গায়ের শার্টটা খুলে ফেললো কবীর।তামাটে দেহে ঘামগুলোতে তেলের মতোন লাগছে।লোকটার শরীর দিনকে দিন কীভাবে যে এতো সুগঠিত হচ্ছে সেই ধারণা নেই যুবতী তোশার।সে ভালোবাসার দৃষ্টি ফেলবেনা লোকটার উপর।চোখ দুটো বন্ধ করে খাটের অগ্রভাগে গা এলিয়ে দিলো।ল্যাপটপে ভিডিও কলে কথা বলছে তারা।সারাদিনে একমাত্র এই সময়টা হলো মানুষটার?অথচ তোশা নিজেও তো ব্যস্ত থাকে।তখন তো মানুষটাকে ভুলেনা।মিনিট দশেক পর গম্ভীর কণ্ঠে কবীর শুধালো,
“ঘুম এলে ঠিকঠাক বিছানায় ঘুমাও তোশা।”
“আসছেনা।”
“এতো নিশ্চুপ কেন?”
“কারণটা কী খোঁজার চেষ্টা করেছেন কখনো?”
ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে ল্যাপটপটি কোলের উপর রাখলো কবীর।হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বলল,
“আমি বহু কষ্টে আজ এই জায়গায় এসেছি তোশা।জিনিসগুলো ধরে রাখতে হলে কষ্ট সহ্য করতে হবে।আহনাফ বড় হলে তবে আমি কিছুটা স্বস্তি পাবো।বৃষ্টিও অফিসে বসার চিন্তাতে নেই।”
“আপনার এতোসব চিন্তায় তোশামণি কোথায় কবীর শাহ?”
“সব জায়গায় আছো।”
“বাবা আসছে আর তিনমাস পরে।”
“জানি আমি।”
“সকলকে জানানোর জন্য নিজেদের মধ্যেও তো বোঝাপড়া দরকার।কিন্তু আপনি..।”
“বলেছি না একবার ভাবতে হবেনা।”
“একশবার ভাববো।”
“দেখো সম্পর্ক থাকলে সারাক্ষণ কথা বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই।দিশাও একসময় তোমার সমান ছিল।কিন্তু ও তো এতোটা।”
কবীরের এতোটুকু কথা যথেষ্ট ছিল।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তোশা বলল,
“প্রাক্তনের সাথে কেন তুলনা করলেন?”
“নাহ করিনি।বেলাডোনা এই কেঁদে দিলে নাকী?”
তোশা পাশে ল্যাপটপটা রেখে বালিশে মুখ লুকিয়ে কেঁদে দিলো।অস্থির চিত্তে কবীর ডেকে উঠলো তাকে।
“শুনো মেয়ে।তুলনা করিনি।বুঝানোর জন্য বলেছি।এইযে ভালোবাসা।”
তোশার এসব মায়াময় বাক্য কানে ঢুকছে নাকী?সে কাঁদছে আর ফিসফিস করে কিছু বলছে।উষ্ণ শ্বাস ফেললো কবীর।তাদের অসম সম্পর্কের সবথেকে বড় ভিলেন হচ্ছে দুজনের মতের ও চাওয়া পাওয়ার পার্থক্য।এভাবে বিয়ে হলে বিষয়টা সুন্দর হবে তো?অনেকক্ষণ মেয়েটির কান্না বসে বসে দেখলো সে।এদিকে ঘড়ির কাঁটা তখন একটার করে।
“লিটল ক্যাট, কী করলে কান্না থামবে বলো তো?আসবো এখন দেখা করবে?”
তোশা ইশারায় না করলো।কবীর হাল ছাড়লো না।মেয়েটির সঙ্গে যে নিজেকেও ছোট হতে হচ্ছে।
“তাহলে কাল চলো দেখা করি।শুক্রবার তো।”
ভাঙা গলায় তোশা জবাব দিলো,
“শ্যুটিং আছে।”
“তাহলে কী চাও বলো?গান শুনবে?”
“আপনার গলায় সুন্দর লাগবেনা গান।”
কবীর হেসে ফেললো।মেয়েটা শুনবে সেটাও ঘুরেফিরে বলছে।সে গলাটা স্বাভাবিক করে কয়েকটা লাইন গাইলো।এতে অবশ্য কাজ হলো।যুবতী পাশ ফিরলো।ফোলা ফোলা বড় চোখ তার।গোলগাল গালদুটো ভিজে আছে।কবীর যৌবনপোড়া পুরুষ।মেয়েটিকে স্ত্রীকে হিসেবে পাওয়ার আশায় মরিয়া হওয়ার জন্য এমন বেশ গুলো যথেষ্ট।তোশা এক দৃষ্টিতে তাকে দেখে বলল,
“আপনাকে শার্টলেসে ভীষণ পঁ চা লাগে কবীর শাহ।আর একবার পিঠের মাঝ বরাবার ছোট কিসমিস সমান তিলটাকে দেখতে দিবেন?দিবেন বলেন?”
আবদার করতে গিয়েও তোশা কেঁদে বসলো।কবীরের হঠাৎ মনে হলো মেয়েটির সব কান্নাগুলো শুধু তাকে দেখলে বের হয়।সে হয়তো পেঁয়াজ জাতিবিশেষ মানব।
চলবে।
এডিট ছাড়া পর্ব।কী ব্যাপার পাঠকেরা?উপন্যাস কী ভালো লাগছেনা?সর্বোচ্চ রেসপন্স করবেন এই পর্বে।
তোশার এমন চাওয়া কী যৌক্তিক?নাকী বয়সের দোষ?কী মনে হয় পাঠক।