#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৩০
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“আমরা এখানে কেন এলাম আম্মু?কোনো কাজ আছে?”
বড্ড মিনমিন কণ্ঠসুরে কথাটি শুধালো তোশা।দিনের শুরুতে মা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে বেড়িয়েছে।যদিও জানতো না কোথায় যাচ্ছে তারা।কিন্তু গাড়ী থামার পর স্মরণে এলো এটা শাহ গ্রুপের প্রধান অফিস।জীবনে একবার অবশ্য তোশা এসেছিল।
“কবীরের সাথে আমার কিছু কথা আছে তোশামণি।এরপর তোমাকে নিয়ে হেয়ার ট্রিটমেন্টের জন্য যাবো।এতো সুন্দর চুলগুলো কাকের বাসা বানিয়ে ফেলেছো।”
“আম্মু আগে বলবেনা।আমি বড্ড উদ্ভট পোশাকে এসে পড়েছি।তিন রঙা লাগছে।”
“সমস্যা নেই।কবীর কিছু মনে করবেনা।তুমি তো বাচ্চা।”
তোশার মন খারাপ দূর হলো না।তার মা তো জানেনা লোকটার সঙ্গে আড়ালের সম্পর্কের কথা।ভালোবাসা স্বীকার করার পর এবার দিয়ে প্রথম দেখা তাদের।যদি জানতো তোশা তবে সবথেকে সুন্দর রঙের ড্রেসটা পরে আসতো।আফসোসের অনলে ভেতর থেকে উষ্ণ শ্বাস বের হয়ে এলো কন্যাটির।
অফিসটাতে বেশ টাকা খরচ করেছে কবীর।মনের মাধুরি অনুযায়ী তৈরী করেছে যেন।গতবার এতোকিছু খেয়াল ছিলনা তোশার।আজ বেশ আয়েশ নিয়ে সবটা দেখছে।লিফট থেকে বের হওয়ার পর তাদের মধ্যবয়স্ক এক লোকের সঙ্গে দেখা হলো।
“তাহিয়া চৌধুরী।কেমন আছেন?”
হাসিমুখে তাহিয়া কোনমতে ভালো আছি বলে পাশ কাঁটাতে গিয়েও পারলো না।লোকটা থামিয়ে বলল,
“কোথায় যাচ্ছেন?মি.শাহ এখন ব্যস্ত।চলুন ক্যান্টিনে গিয়ে আলাপ করে নেই।আহা বিব্রত হচ্ছেন কেন?চলুন তো একবার যতোক্ষণ না মি.শাহ ফ্রি হচ্ছে।”
“অন্য একদিন।আমার সময় নেই আলমগীর।অন্য একদিন কথা হবে।
তোশার পানে আলমগীর তাঁকালো একবার।লোকটার চাহনি ভালো না।
” এটা নিশ্চয় আমাদের মামুনী।কেমন আছো মা?আমি তোমার মায়ের বন্ধু।”
“ভালো।”
বন্ধু শব্দে মটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হলো না তাহিয়ার।মেয়ের নির্বিকার চাহনী থেকে বাঁচতে আলমগীরের সঙ্গে যাওয়ার জন্য রাজী হলো।পাছে কিছু মনে করে তোশা।তবে এটা যেন ভুল ছিল তাহিয়ার।অতীতে তাকে বহুবার আকার ইঙ্গিতে অন্যরকম প্রস্তাব দিয়েছিল আলমগীর।আজ সেটা কিছুটা সরাসরি দিলো।এতোটা সাহসের কারণ অবশ্য একটু পর অনুধাবন হলো তাহিয়ার।কবীরের সঙ্গে অনেক বড় একটা প্রজেক্টে কাজ করবে সে।
“এখানে কী হচ্ছে?সুন্দর আড্ডা আমাকে ছাড়া হয়ে যাচ্ছে?”
নিজের বিশাল দেহটা নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো কবীর।মানুষটার চেহারা,পোশাকে যত্নের ছাঁপ ও সুবিন্যস্ত পরিপাটি অবস্থা দেখে আরেক দফা কান্না এলো তোশার।আজকেই কেন সে পাগলের মতো বের হলো।ভাগ্যিস অন্তত শ্যাম্পুটা করেছিল সে।আলমগীর তাকে দেখে সুন্দর হেসে বলল,
“এমনি কথা বলছিলাম।আপনি তো জানেন কবীর।তাহিয়াকে আমার কতোটা পছন্দ।”
“আপনার ডিভোর্সটা কী হয়েছে মি.আলমগীর?শুনলাম হবেনা।গতরাতে আপনার স্ত্রী ফোন করেছিল।হোটেল সোনারগাঁ তে ইনভাইট করলো আমাকে।কী বলেন তো আপনারা রাস্তাঘাটের সকলকে পছন্দ করেন নাকী?”
“কী আশ্চর্য!আপনারা রাস্তাঘাটের নাকী?”
“একদম না।রাস্তাঘাটের মানুষ হলো তারা যাদের..।”
হুট করে তোশার দিকে তাঁকালো কবীর।আদেশের সুরে বলল,
“দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরো।”
“কেন?”
“প্রশ্ন নয় মেয়ে।”
তোশা কথা মতোন দুহাত দিয়ে কান বন্ধ করলো। তৎক্ষনাৎ কবীরের পুরু ঠোঁট দুটো নড়ে উঠলো।মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠলো আলমগীরের।
“আশা করি এরপর থেকে কাওকে পছন্দের কথা দেখেশুনে বলবেন।মিটিং শেষ অনেক আগে।সময় গড়ালে অফিস থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে খুব কষ্ট হবে আপনার।”
“জি মি.কবীর।ভালো থাকবেন।”
তড়িঘড়ি করে উঠে চলে গেলো আলমগীর।যুবতী তোশা এখনও কানে হাত দিয়ে দূরে উদাস হয়ে তাঁকিয়ে আছে।যেন ইহজাগতিক বিষয়ে সে বড় নির্বিকার।কবীর আস্তে করে তোশার হাত দুটো নামিয়ে তাহিয়াকে শুধালো,
“হঠাৎ অফিসে কেন তুমি?আর কতোবার বলেছি এসব পা র্ভা ট দে র সাথে সৌজন্যেতাবশতও কথা বলবেনা।”
“কবীর, আমার ইচ্ছে ছিলনা।মেয়ের সামনে বলে আমি নাকী তার বন্ধু।তোশা যদি কিছু মনে করে।”
“তোমার মেয়ে বেশ বুদ্ধিমতী।কিছু মনে করবেনা।যাই হোক কেবিনে চলো।”
তাহিয়া আগে আগে কেবিনের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো।কবীর প্যান্টের পকেট থেকে হাতটা বের করে আস্তে করে তোশার আঙুলে চাপ দিলো।শিওরে উঠলো মেয়েটা।ধীর কণ্ঠে বলল,
“তিন রঙের পোশাক।দারুণ ফ্যাশন।সুন্দর লাগছে আকাশী মেয়ে।”
লজ্জায় চোখে পানি আসার উপক্রম।মানুষটা তবে তার পোশাকের ক্রুটি ধরতে পারলো।তবে সে দমে যাওয়ার নয়।
“ফ্যাশনটা আজকেই আবিষ্কার।”
“গুড।”
“আচ্ছা আলমগীর আঙকেলের ওয়াইফ আপনাকে কেন ইনভাইট করলো।দুনিয়া মানুষের অভাব আছে?”
“আমি সুন্দর,ব্যাচেলর।সুগঠিত পুরুষ।এই তিনটে বাহানা যথেষ্ট নয় কী?”
“হু?সেই তো কালো।”
কবীরের অধরযুগল প্রসারিত হয়ে গেলো।সকলের অগোচরে পুনরায় কন্যাটির হাতে হাত বুলিয়ে দিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
“কালো, বুড়ো যাই বলো সুন্দর কন্যার নজরে শুধু আমিই আছি।”
“ভীষণ আত্নবিশ্বাস দেখা যাচ্ছে।”
মিষ্টি করে হাসলো কবীর শাহ।ব্যস, তোশামণির দিন সেরা হওয়ার জন্য যা যথেষ্ট ছিল।এইতো একটু একটু ভালোবাসার স্পর্শ,মায়াময় বাক্য এসবের জন্য কতোটা আকুলতা ছিল তার।দিনশেষে সব স্বপ্ন পূরণ হয়ে ওঠে।
(***)
ক্ষণবাদে বিশাল বড় একটি কেবিনে প্রবেশ করলো তোশা।কবীর নিজের চেয়ারে বসে শুধালো,
“তাহিয়া হঠাৎ এখানে এলে যে?”
“আমি একটা ভুল করে ফেলেছি।সেই কারণে এলাম।”
“কী ভুল?”
“তোমার কোম্পানিতে কাজ শুরু করার পর থেকে আমার যতোটা প্রোফিট ছিল এরমধ্যে বেশীরভাগ বাবার নামে দিয়েছিলাম।বাকীটা তোশার নামে।এখন তিনি চাচ্ছেন সেই টাকা তার আরো দুই সন্তান ও কল্লোলের নামেও দিবেন।আমি কিংবা তোশা একা কেন পাবো?অথচ সবটা আমার মেয়ের।নিজের চেনা পরিচিত বাবাকে চিনতে পারছিনা আমি।”
গম্ভীর সুরে কবীর শুধালো,
“আঙকেলকে জিজ্ঞেস করেছিলে ব্যাপারটা কেন তোমার টাকা বণ্টন করছেন?”
“করেছিলাম।সে বললেন টাকা তার নামে।আমার সত্যিই বড় খারাপ লাগছে।দিনশেষে সকলে ধোঁ কা দেয়।”
শুকনো ঢোক গিললো তোশা।কবীর মুখে একরাশ মেঘ জমিয়ে বলল,
“আমি একবার আঙকেলের সঙ্গে কথা বলে দেখবো?”
“লাভ হবেনা।দেখো না বাসাটাও আমাকে এমনভাবে দিয়েছে যে কখনো আমি দাবী করতে পারবো না।কোনো উপায় নেই টাকা গুলো ফেরত পাওয়ার?”
“আজ কালের মানুষ নিজের ছায়াকে বিশ্বাস করেনা সেখানে তুমি কাজটা ঠিক করো নি।টাকা যাক।বাবার সঙ্গে তো লড়তে পারবেনা এখন।”
“কিন্তু তোশা?ওর অধিকার সেসব।”
“মায়ান যেমন হোক বাবা হিসেবে সেরা না হলেও তোশাকে নিয়ে ভালো প্ল্যান আছে ওর।ভয় নেই।ভেসে যাবেনা।”
“একদম না।যে লোক এতোগুলো বছরে মেয়েকে দেখতে একবারও দেশে আসেনি সে কেমন বাবা হবে জানা আছে।”
প্রাক্তনকে নিয়ে আক্ষেপ কখনো মেয়ের সামনে করেনি তাহিয়া।কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন।বাবা -মা কেন যে সব সন্তানের সঙ্গে সমান হতে পারেনা।তোশা নতমুখে টেবিলের কাঁচ পানে তাঁকিয়ে আছে।
“তাহিয়া আমাকে বিশ্বাস করো?”
“করি।তুমি একজন যে কীনা স্বার্থ ছাড়া আমাকে নিরাপদ রেখেছো।”
“স্বার্থ,প্রাপ্তির বিষয় পরে।ভয় নেই আমি আছি।তোশার ক্ষেত্রে সবসময় আমাকে পাবে।”
তাহিয়া সেই কথা জানে।তবুও বাবার দেওয়া য ন্ত্র ণাগুলো বড্ড পোড়াচ্ছে।এখন কেঁদে দিবে সে বুঝতে পারছে।হুট করে উঠে দাঁড়ালো।কম্পমান কণ্ঠে বলল,
“আমি একটু আসছি।তোশা এখানেই থাকো।”
কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো তাহিয়া।কিন্তু একরাশ কষ্ট রেখে গেলো দুজন নর-নারীর মনে।কবীর চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
“কী ভাবছো তোশা?”
“নানা সত্যিই এমন করেছেন?আমি খেয়াল করেছিলাম গতকাল কিছু নিয়ে সকলের মধ্যে আলোচনা চলছে।”
কবীর এই আলোচনায় গেলো না।যতোটা টাকা তাহিয়ার চলে গিয়েছে ততোটার থেকে বেশীই বহু আগে কবীর নিজে তোশার নামে রেখেছে।কেন, কোন সম্পর্কের জোরে জানা নেই।কিন্তু মেয়েটির প্রতি অনিমন্ত্রিত দায়িত্ববোধ থেকে করেছে।
“তাহিয়া আমাকে খুব বিশ্বাস করে তোশামণি।তাকে কখনো কীভাবে জানাবো আমাদের অনুভূতির কথা?”
ভীত হয়ে উঠলো তোশা।ভেঙে যাওয়া গলায় বলল,
“আপনি কী আবার অস্বীকার করবেন সব?”
“যদি মা কে হারিয়ে ফেলো?ধরো তাহিয়া অথবা আমার মধ্যে কাওকে বেছে নিতে হলো।তবে কাকে নিবে?ভেবে বলো।”
প্রশ্নটির উত্তর তোশার জানা।নতমস্তকে ধীর কণ্ঠে বলল,
“আম্মু ছাড়া থাকতে পারবো না।”
“তাহলে তো হিসেবটা মিটে গেলো।”
হাসিখুশি মনটা মুহুর্তেই কেঁদে উঠলো।ফুঁপিয়ে তোশা পুনরায় বলল,
“কবীর শাহ কে ছাড়াও থাকতে পারবো না।দুজনকে ছাড়াই থাকতে পারবো না।”
কাছের মানুষদের কান্না ব্যস্ত করে তুলে কবীরকে।সে ভীষণ আকুলতায় যুবতীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।চট করে তাকে দাঁড়া করিয়ে পিছন দিকে থেকে আলিঙ্গন করলো।বিশাল দেহটি হালকা নিচু করে নরম ঘাড়ে চিবুকটি ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কান্না করো কেন?”
“কষ্ট হচ্ছে যে।”
“কষ্ট পাওয়ার জন্য কী আমাকে ভালোবাসনি?”
“জানিনা।”
তোশাকে আরো নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে কবীর বলল,
“কবীর শাহ এর ভালোবাসা তোশামণিকে।দিনশেষে আমার বলা শেষ বাক্যটিও এটা হবে বেলাডোনা।তুমি থাকো কিংবা না থাকো।আমি সবসময় আছি।”
চলবে।
এডিট ছাড়া পর্ব।সর্বোচ্চ রেসপন্স করুন তো দেখি পাঠকেরা।পর্বটা একটু ঠিকঠাক করে লিখতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো পোস্ট করতে।আপনার মন্তব্য সুশীল ভাষায় কমেন্টে জানাতে পারেন।