#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৩
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“তোমার সংসার ভাঙলো কেন?উত্তর হলো বনিবনা হয়নি।আমার সংসার ভাঙলো কেন?এটিরও জবাব বনিবনা হয়নি।শিউলির সংসার ভাঙছে কেন?মজার ব্যাপার হলো এই বারও সেই একই জিনিস হয়নি।বনিবনা কিংবা বোঝাপড়া।বোঝাপড়া শব্দের ভার আসলে কতো?যে আমাদের কারো হলো না?”
অন্তত গভীর প্রশ্ন করলো তাহিয়া।ঈষৎ গরমে শুভ্র মেদুর গালে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে।কবীর অতি সন্তপর্ণে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছে।প্রশ্নটির জবাবে সে বলল,
“আমি যদি জানতাম তাহলে কখনো ডিভোর্স হতো?জানো তাহিয়া এতো প্রেম,ভালোবাসা, মায়া কীভাবে হাওয়ায় মিশে গেলো।ও আমার স্ত্রী থেকে এখন প্রাক্তন।”
“খারাপ লাগে বিষয়টা ভাবলে?”
“খুব।কিন্তু যখন তিক্ততার কথাগুলো স্মরণে হয় তখন মনে আসে একা আছি বেশ আছি।”
তাহিয়া হেসে ফেললো।একই অনুভব মায়ানের সাথেও হয়।তোশামণির বাবা বলে লোকটাকে কতোদিন ডাকা হয়না।ইতস্তত করে তাহিয়া শুধালো,
“মায়ানের সাথে যোগাযোগ হয়?”
কবীর হাসলো।তাহিয়া জানে মায়ান এমন একজন বন্ধু তার নিকট যার সাথে একদিনও কথা না বলে থাকা যায়না।এইতো সকালেও তোশাকে সে ভিডিও কলে দেখিয়েছে।
“তুমি জানো এই প্রশ্নের জবাব তাহিয়া।”
“জানি।তবে একটু ফর্মালিটি করলাম।”
“হয় কথা।মাঝেমধ্যে তোশার জন্য কান্নাকাটি করে।মেয়েটাকে একবার তার বাবার কাছে যেতে দেওয়া কী খুব দোষের হবে?”
“অবশ্যই।মায়ান যা চেয়েছিল তা সে পেয়েছে।কানাডায় বসবাস করছে এখন।নতুন বিয়ে করেছে।মেয়ে না হলেও চলবে।কেন ওর স্ত্রীর বাচ্চা নেই?”
“আছে।একটা ছেলে..।
” থামো থামো কবীর।আমি শুনতে চাইনা।আমার মেয়েটা বড় হোক ভালোভাবে।এই কান দুটো শুধু তোশামণির সফলতার গান শুনতে চায়।নাকী ওর বাবার নাটক।”
কবীর গাড়ীর লুকিং গ্লাসে পিছনের সীটে ঘুমিয়ে থাকা তোশার পানে তাঁকালো।মেয়েটা উচিতের থেকে অনেক বেশী ঘুমিয়ে সময় কাঁটায়।কবীর মাথা ঈষৎ দুলিয়ে বলল,
“তোমার মেয়ে এতো ঘুমায় কেন?পড়াশোনা করে তো ঠিকমতো?”
“আরে না।সময় পায়না একদম।পড়াশোনাতে খুব ভালো।এজন্য ছুটি পেলে এরকম মাইন্ড ফ্রেশের জন্য ঘুমিয়ে কাঁটায়।”
“তোশামণিকে তুমি ঠিকঠাক বড় করছো।প্রাউড ফিল হয় তোমার প্রতি তাহিয়া।কে বলবে তুমি সেই মেয়েটা যে কলেজে মায়ানের ধমকে থরথর করে কেঁপেছিলে।বড় সোনালী ছিল সেই দিন গুলো।”
“হুঁ।”
কবীরের স্মৃতিচারণে বিশেষ সায় না দিয়ে তাহিয়া গাড়ীর জানালা দিয়ে পিছনে ছুটতে থাকা রাস্তায় দৃষ্টি রাখলো।এ জীবন কেমন বেদনার।প্রিয় মানুষ কতো সহজে অচেনা হয়ে যায়।
তাহিয়াদের বাসার সামনে এসে গাড়ী থামালো কবীর।নেমে বাহিরে দাঁড়ালো।এই বাড়ীটা তার ভীষণ চেনাজানা।মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো ব্যক্তিটার।কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের মতোন এক বালতি পানি তার উপর এসে পড়লো।তাহিয়া বিষয়টা দেখেই চিৎকার করে উপরে তাঁকালো।একজন ত্রিশ বছরের রমণী শূন্য বালতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
“শিউলি এটা তুই কী করলি?”
চেঁচানো সুরে জবাব এলো,
“আপু সরি।আমি ভেবেছিলাম শয়তানটা আবার এসেছে।”
“অন্ধ নাকী তুই?ময়লা পানি ছিল নিশ্চয়?”
“হ্যাঁ আপু।”
“কীযে করিস না তুই।”
কবীর ইশারা করে শুধালো,”শয়তানটা কে?”
“ওর হাজবেন্ড।বাড়ীতে সবসময় এমন লাগিয়ে রাখবে।অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম।”
মেজাজ খারাপ হলেও মেয়ের ঘুমন্ত মুখ দেখে নিমিষেই তা চলে গেলো।তাহিয়া যুবতী বয়সে ভীষণ রুপবতী হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিল।কিন্তু মেয়ে তোশার রুপ যেন কিছুতেই থামছেনা।বাঁধ ভাঙা নদীর জলের মতোন।শুধু বাড়ছে।উষ্ণ শ্বাস ফলে আস্তে করে ডাকলো,
“তোশামণি উঠো।বাসায় এসে পড়েছি।উঠো তোশামণি।”
ধীরে ধীরে চোখ খুললো তোশা।সর্বপ্রথম নজরে এলো পাশের জানালায় বিরক্তিকর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অতি সুদর্শন পুরুষটির দিকে।ভ্রু দুটো কতো সুবিন্যস্ত ভাবে কুঁচকে আছে।তোশার সদ্য জাগ্রত মস্তিক বিষয়টা বুঝতে পারলো না।ক্ষণবাদে খেয়াল হলো এটি তার স্বপ্ন পুরুষ নয়।বরং কবীর শাহ।কিন্তু গায়ে নোংরা পানির আভাস দেখে হেসে বলল,
“তাতিন করেছে একাজ তাইনা?আপনাকে ভেজা শরীরে খুব সুন্দর লাগছে।”
কবীরের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো।এমনকি তাহিয়াও হতভম্ব হয়ে ক্ষণিকের জন্য মেয়েকে দেখলো।কবীর বিব্রত হয়ে শুধালো,
“কী বললে তোশামণি?”
“সুন্দর লাগছে আপনাকে।”
তাহিয়া বিরোধ করলো।অপ্রস্তুত হেসে বলল,
“ও এমনি বলেছে।চলো বাসার ভেতর বাবার পাঞ্জাবী আছে।ফিট হতে পারে।ওটা পরে গোসল করে তবে যাবে।মনে হচ্ছে মাছ ধোঁয়ার পানি।”
উপর হতে উচ্ছাসিত শিউলি জবাব দিলো,”আপু ঠিক ধরেছো।মাছ ধোঁয়ার পানি।কবীর ভাই বলেন তো পানি ঠান্ডা না গরম ছিল?”
“শিউলি ফুলের বাচ্চা উপরে এসে দেখাচ্ছি।সব এক্সিডেন্ট তোমার আমার সাথেই হয়।”
“কী করবো বলেন?আপনার এতো ছোট্ট দেহ আমার বড় বড় চোখে লাগেনা।ভেতরে আসেন।বাকী কথা পরে হবে।”
তাহিয়া ও কবীর ভেতরের পথে পা বাড়ালো।পুরুষটির শরীরে লেপ্টে থাকা সাদা শার্টটি যতোক্ষণ পারলো মন ভরে তোশা দেখে নিলো।এমন অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছে কেন তার?
(***)
“তাতিন আমি তোমাকে কতো মিস করেছি জানো?”
“ওরে আমার তোশা বাচ্চাটা।আমিও খুব মিস করেছি তোমাকে।কিন্তু শুনলাম তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে?কিছু যদি হতো।”
অভিমান করে তোশা বলল,
“কিছু হয়নি তাইনা?তোমরা সকলে আমাকে বাচ্চার মতো দেখো।”
“তুমি তবে বড় মানুষ নাকী?”
“হুঁ।অনেক বড় মানুষ।”
শিউলি হেসে তোশাকে জড়িয়ে ধরলো।বোনের মেয়ে হলেও সে নিজ মেয়ের থেকে কম আদর করেনা।এমনকি তার স্বামী নিজাম যার সঙ্গে ইদানীং একটুও মিলছেনা কিছু তার।সেই লোকটাও বিভিন্ন বাহানায় তোশার খোঁজ নেয়।একটা মেয়ে প্রায় সকলের কাছে আদুরে।খালাকে ছেড়ে তোশা বিছানায় খুলে রাখা ল্যাপটপের দিকে এগিয়ে গেলো।স্ত্রীনে থেমে থাকা গানটি সচল করে দিলো।মুহুর্তে রুনা লায়লার কণ্ঠে শুনতে পেলো,
চোখ মেলে যারে পেয়েছি
স্বপ্নের নায়ক সেই তুমি,
নিশিদিন প্রতিদিন স্বপ্নে দেখি আমি
নিশিদিন প্রতিদিন স্বপ্নে দেখি
চোখ মেলে যারে পেয়েছি তারে ভালবেসেছি
স্বপ্নের নায়ক সেই তুমি
আমি জানি শুধু জানি আমি
স্বপ্নের নায়ক সেই তুমি।
স্বপ্নের নায়ক সেই তুমি
স্বপ্নের নায়ক সেই তুমি।
কিশোরী তোশা মনোযোগ দিয়ে লাইন গুলো শুনছে।চোখ মেলে সে নিজেও তো একজনকে পেয়েছে।তবে সে স্বপ্নের নায়ক?তার স্বপ্নের নায়ক এতো বড় মানুষ?কৌতুহলী হয়ে শুধালো,
“তাতিন।স্বপ্নের নায়কের বয়সে বড় হতে পারেনা?”
ভীষণ বাচ্চামো প্রশ্ন।শিউল ল্যাপটপ অফ করে বলল,
“কেন হতে পারেনা?স্বপ্নের নায়ক ছোট, বড়,অন্ধ,প ঙ্গু সব হতে পারে।সঠিক মানুষের কী আবার সুন্দর অসুন্দর বিচার?কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন।এই স্বপ্নের নায়ক টায়ক বলে কিছু হয়না।”
“আসলেও হয়না।”
“উহু,বাস্তব কঠিন।আচ্ছা তোশা দেখে এসো তো কবীর ভাই চলে গিয়েছে নাকী?তার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।”
“চাকরীর কথা বলবে তাতিন?”
“হ্যাঁ।”
“মা শুনলে খুব রা গ করবে।”
“ইশ,করবেনা।তুমি যাও তো।”
হেলে-দুলে নানার রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো তোশা।মুহুর্তেই পা দুটো থমকে গেলো তার।রোদে পো ড়া খাওয়া পেটানো তামাটে দেহের পুরুষ আনমনে চুল মুছে যাচ্ছে।বিন্দু বিন্দু জলকণা নিবারণ ত্বক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে।শিউরে উঠলো কিশোরী তোশামণি।য ন্ত্র ণা হচ্ছে তার।কানের কাছে প্রজাপতিরা ক্রমাগত বলে যাচ্ছে “স্বপ্নের নায়ক সেই তুমি।”
দরজার কাছে লজ্জামাখা তোশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিব্রত হলো কবীর।তড়িঘড়ি করে পাঞ্জাবী গায়ে জড়িয়ে নিলো।
“তোশামণি ভেতরে এসো।কিছু লাগবে?”
ঘোর ভাঙলো তোশার।সে রুমের ভেতরে এসে মাথা দুলিয়ে বলল,
“কিছু লাগবেনা।খালামণি..।”
“হ্যাঁ কী তোশামণি?”
কবীরের গায়ের সুগন্ধে নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে তোশার।সে কোনোকিছু বলতে পারছেনা।জবাব না দিয়ে তৎক্ষনাৎ রুম ত্যাগ করলো।কবীর কপাল কুঁচকে নিজের সঙ্গে বলল,
“এই মেয়ের আবার কী হলো?”
চলবে।