#মিঠা_রোদ
#পর্ব:২৪
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“আমার মিসেস এর নাম্বার।ও খুবই ভ্রমণপিপাসু।এইতো কয়দিন পর নেপাল ঘুরতে যাবে।আপনারও উচিত একবার ভ্যাকেশনে যাওয়া।ভালো সঙ্গ দিতে পারবে আমার মিসেস।”
বাক্যগুলোর সমাপ্তিতে খুব অমায়িক এক হাসি ফুটে উঠলো লোকটির মুখে।জবাবে কবীরও হাসির বিনিময় করে নাম্বারসহ কার্ডটা হাতে নিলো।লোকটি অধরযুগল আরো বিস্তৃত করে বিদায় নিলো।তৎক্ষনাৎ কবীর কার্ডটা পাশের ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেললো।সে এরকম ভ্যাকেশনের অফার বহু পেয়েছে জীবনে।কিছু ভদ্রলোক আছেন যা দারুণভাবে নিজের স্ত্রীকে অন্যের অধীনে ছেড়ে দেন শুধুমাত্র কাজ হাসিলের জন্য।প্রথম প্রথম কবীর এসব বুঝতো না।একবার তো অফার পেয়ে সেটা নিয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে নিজ ভুল বুঝতে পেরে খুব সতর্কতার সঙ্গে বিষয়গুলো সামলে নেয়।
ঘড়িতে এখন দুপুর তিনটে বাজে।লাঞ্চের জন্য বের হতে হবে এখুনি।ল্যাপটপটা বন্ধ করে কবীর উঠতে যাবে তখুনি দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো সিয়া।মুখে গুরুগম্ভীর ভাব এঁটে আছে।কবীর মিষ্টি হেসে শুধালো,
“এখানে হঠাৎ?”
“সরিষার তেলের তেহারি করেছিলাম সকালে।তখন দিয়ে যেতে পারিনি।এখন ঠান্ডাটা নিয়ে এলাম।”
“ব্যাপার না।আমি পিয়নকে ডেকে গরম করিয়ে দিচ্ছি।তুই খেয়েছিস?”
“নাহ তোর সাথে লাঞ্চ করবো ভাবলাম।আহনাফ আজকে স্কুলে যায়নি?একটু আগে ফোন করে আমাকে বাসায় যেতে বলল।”
“না।হালকা জ্বর এসেছে।তাই মা যেতে দেয়নি।কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুই অন্য কোনো কারণে এসেছিস।”
কবীরের এহেন সোজাসাপটা বাক্যে খানিকটা বিব্রতবোধ করলো সিয়া।ঈষৎ কেঁশে বলল,
“আমার মনে হয় তোশার মাথায় সমস্যা আছে।”
হেসে ফেললো কবীর।চোখকে চশমা থেকে মুক্তি দিয়ে বলল,
“এটা কেন মনে হলো?”
“আমার কাছে আজ এসেছে কিছু রোমান্টিক নভেলের নাম শোনার জন্য।তোকে বুঝাতে নাকী বেশ কাজে লাগবে।তুই বিশ্বাস কর আমি তব্দা খেয়ে গিয়েছিলাম।নাহ সে যদি আমার স্টুডেন্ট না হতো তখন না হয় কথা ছিল।”
“আমারও একসময় মনে হয়েছিল তোশার মানসিক কোনো সমস্যা আছে কীনা।যেমনটা ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের হয়।পরে ভুলটা ভেঙেছে।আমার ক্ষেত্রে মেয়েটা এমন যাকে বলে ব্রেক ছাড়া।”
“বিষয়টি এঞ্জয় করিস তুই?”
“একদম না।আবার এমন বাচ্চামো দেখতে ভালো লাগে।”
পিয়ন এসে গরম করা খাবার দুজনের জন্য প্লেটে দিয়ে গেলো।সিয়া বরাবর ভালো রাঁধুনী।কবীর মুখে দিয়ে দুপাশে মাথা হেলিয়ে বলল,
“ভালো হয়েছে।ওহ একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।আজ সকালে তোশামণি আমার সাথে কী করেছে জানিস?”
“কী করেছে?দেখা হয়েছিল দুজনের?”
কবীর সম্মতিতে মাথা দুলিয়ে সকালের ঘটনাটি ব্যাখা করলো। পুরো বিষয়টি শুনে ভ্রু কুঁচকে সিয়া শুধালো,
“তুই বলিস না যে জিনের কথাটা বিশ্বাস হয়েছে তোর।”
“এতোটাও বুড়ো হইনি।প্রথমে আমারও খটকা লেগেছিল বিষয়টি।কিন্তু পরবর্তীতে ওর ফোনের লোকেশন দেখে নিশ্চিত হয়েছি যে মেয়েটা মজা করছে।নিজের মাকে ম্যানেজ করেছে কীভাবে ও ভালো জানে।”
“কিছু বলবিনা?”
“করুক।আমি লিটল চেরীকে খুব ভালোমতন চিনি।মেয়েটা সেই যে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার পর থেকে আমাকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে।তাহিয়া মেয়ের ভালোবাসায় অন্ধ।এই কারণে যা বুঝায় তাই বুঝে।যখন আঠার হলো তখন তাহিয়াকে মিথ্যা বলে সাজেক ঘুরতে গিয়েছিল জানিস।এতো সাহস বোকাটার।ফ্রেন্ডের মামা বাড়ীতে গিয়েছে শুনে আমার তো খটকা লাগলো।খোঁজ লাগালে বের হয়ে গেলো যে কল্লোলের সাথে গিয়েছে।তখন আমার হাতে মারাত্মক কাজ জমা।তবুও ছুটলাম সাজেকের উদ্দেশ্যে।চারদিন মেয়েটার পিছন পিছন লুকিয়ে ছিলাম।ভয় ছিল বাচ্চা তো যদি কিছু হয়ে যায়।”
“এতো ভালোবাসিস মেয়েটাকে?”
খাবারের প্লেটে দৃষ্টি রেখে মলিন হাসলো কবীর।এই প্রশ্নের সম্মুখীন জীবনে কয়েকবার হয়েছে সে।তবে জবাব দিতে কখনো কার্পণ্য করেনি।
“ভালোবাসি দেখে তো দূরে আছি।”
“দেখ তুই চাইলে একত্রে থাকা সম্ভব।বয়সটা তো একটা সংখ্যামাত্র।”
“সংখ্যা নয়।এখানে গভীর অনেক কিছু যুক্ত সিয়া।আমার শরীরের চামড়া এখনও টান টান হয়ে আছে দেখে মেয়েটার এতো পছন্দ আমাকে।একটু এদিক সেদিক হোক তখন এই কালোকে পছন্দ হবেনা।তাছাড়া আমি চাইনা তাহিয়ার মনে হোক যে অন্যায় করলাম তার সঙ্গে।”
“মায়ান ভাইয়ের সাথে সব কথা খুলে বলে দেখ একবার।”
“তোশার অভিভাবক হিসেবে মায়ানকে আমি মানিনা সিয়া।বরং প্রিয় বন্ধুর নামে কথাটি বলতে খুব খারাপ লাগছে যে নিজ সন্তান, স্ত্রীর সাথে ভালো কাজ করেনি।যখন দুজনের ডিভোর্স হলো তখন একটিবারও ভাবলো না তাহিয়া সেই মেয়েটা যে কলেজে মাথা নিচু করে যেতো আর আসতো।কথা বলতে গেলে তোতলামো করতো।সম্পর্কের শুরুতে মাত্র আঠার বছর বয়সে বিয়ে করা নিয়ে আমার ঘোর আপত্তি ছিল।এরপর তোশা খুব অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তাহিয়ার কাছে এলো।মেয়েটা কিন্তু নিজের কথা ভাবলো না।বিশ বছর বয়সে এক বাচ্চার মা হয়ে গেলো।এতোটা ছোট বয়সে সংসার সামলেছে,বাচ্চাটাকে দেখেছে বিনিময়ে বিচ্ছেদ কপালে জুটলো।মায়ান ছেড়ে দেওয়ার পর ভাবেনি ভাই, বাবার ঘরে কতোটা মূল্যায়ন হবে তাহিয়ার।এদিকে আমি যোগাযোগ করলে এড়িয়ে যেতে লাগলো তাহিয়া।হয়তো ভেতর থেকে মন সায় দিচ্ছিলো না।তখন উল্টো বুদ্ধি বের করে কোম্পানিটা খোলা।এতে যাই হোক সমাজে মূল্যায়ণ আছে তাহিয়ার।আমার প্রতি ও যে খুব কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে এটা আমি জানি।সেই মানুষটা কীভাবে আমাকে নিজ মেয়ের ভালোবাসা হিসেবে মেনে নিবে?”
সিয়ার ভেতর থেকে দীর্ঘ এক শ্বাস বের হয়ে এলো।আসলেও অনুভূতিগুলো বড্ড বেহায়া।উচিত ছাড়া অনুচিত মানুষের উপর এসে যায়।
“শুন ভাই যে যার সাথে খুশি থাকে সেটাই মূখ্য বিষয়।আমার মনে হয়না তোকে হারিয়ে তোশা খুব ভালো থাকবে।তাছাড়া তুই নিজেও ভালো থাকতে পারছিস?ভালোবাসা সবসময় ষোল বছরে আসবে এমন নয়।তোর জীবনে না হয় পঁয়ত্রিশে এসেছে।”
“বাদ দে সিয়া।তোশামণিকে দেখে রাখিস।এমনিতে এখন রঙীন দুনিয়াতে পা রেখেছে।”
“দিলাম।তবে তুই যে তোশার সব ব্যাপারে কোনটা ভালো তা নিজে থেকে ঠিক করে দিচ্ছিস ওর জীবনসঙ্গীও কী নিজেই বাছাই করে দিবি?”
“দরকার হলে তাই দিবো।”
সিয়া হাল ছেড়ে দিলো।সে জানে তার ভাই কখনো এই বিষয়টি পারবেনা।মাথা নিচু করে খাবার খাওয়ার চেষ্টায় আছে কবীর।কিন্তু আশ্চর্যভাবে সিয়ার শেষ প্রশ্নটি শোনার পর থেকে খুদাটা শেষ হয়ে গিয়েছে তার।এমনকি শ্বাসটা নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
(***)
দুটো বিড়াল তুমুল ঝগড়া লাগিয়েছে।তাদের ম্যাও ম্যাও কণ্ঠে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো তোশা।একে তো রাতে ঘুম হয়নি তার।দ্বিতীয়ত সকাল হতেই ক্লাস করার জন্য ছুটতে হয়েছে।তাহিয়া জানতো না যে সে সকালে বাসায় ছিলনা।বিষয়টা কল্লোল অবশ্য সামলে নিয়েছে পরে।আপাতত মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বান্ধুবীর বাসায় কয়েকদিন থাকবে তোশা।ঘুমঘুম চোখে উঠে বসলো।মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
“অপ্সরা তোর এই টিকু এতো ঝগড়াটে কেন?এসেছি থেকে শুনছি একেকর পর এক মা রা মা রি করেই যাচ্ছে।”
অপ্সরা সবেমাত্র গোসল করে বের হয়েছে।চুলগুলো মুছতে মুছতে জবাব দিলো,
“ও এমনই।এলাকার রাণী।যাই হোক ম্যাডাম এখন উঠেন।যে বাহানায় এসেছেন সেটা কিন্ত শিখতে হবে।”
“ওটা মা কে এমনি বলেছি।”
“লাভ নেই ।আন্টি আম্মুকে ফোন করে বলেছে।এখন সে জিনিসপত্র সাজিয়ে বসে আছে।কখন তুই যাবি এরপর মিষ্টি বানানো শুরু করবে।তবে ভালোই হলো।তুই ময়রা হয়ে যা আর তোর খয়ের শাহ সেগুলো ঝুড়িতে করে নিয়ে বেঁচবে।ভালো ইনকাম হবে।আমরা তিনজন ফ্রিতে খাবো।”
“তোর নাম অপ্সরা হলে কী হবে?তুই মটেও তাদের মতো কথা বলিস না।আমার ঘুম পাচ্ছে রে।”
“লাভ নেই তোশামণি।বাকী দুইজন শুনলাম কাল আমাদের এখানে আসবে।”
“হু শুনেছি।”
“এখন উঠেন।”
তোশা পাহাড় ভাঙার সমান ক্লান্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো।ঘুম পাচ্ছে খুব। কিন্তু উপায় নেই কোনো।অপ্সরা তার খুব কাছের বান্ধুবী।ইন্টারে পরিচয় হয়েছিল।এছাড়া আরো দুজন বান্ধুবী আছে।যাদের সে খুব ভালোবাসে।
(***)
রাতেও ঘুমানোর জন্য খুব একটা সুযোগ হয়নি তোশার।রাত দুটোর সময় উঠে সাজতে বসেছে সে।উদ্দেশ্যে কবীর যখন জগিং এর জন্য আসবে তখন তাকে চমকে দেওয়া।মসৃণ, লম্বা চুলগুলোকে পিঠের উপর ছেড়ে দিয়ে আয়নায় আঁচল ঠিক করছে তোশা।আজকে সে সাদা রঙের সিল্কের শাড়ী পরেছে।অপ্সরা ঘুমঘুম চোখে বলল,
“শুন তোশা।আজ তোকে দেখে কবীর শাহ একদম পাগল হয়ে যাবে।”
“অন্য কথা বল।এটা বহু পুরোনো কথা।খুব ঘুম পাচ্ছে রে।”
“আচ্ছা তুই কেন এই জিনের ভয় দেখাবি লোকটাকে।এমনি বয়স চল্লিশ।পরে হার্টঅ্যাটাক করলে সব শে ষ।”
“আমার শাহ এর হার্ট এতো দূর্বল না।কিন্তু ছোট ছিলাম দেখে আমাকে পানি খাইয়ে মাতাল করেছিল।সেই প্রতিশোধ নিতে হবেনা?ভালোবাসা সেটা তো বাকীর খাতায় লেখা আপাতত।এখন চল।এতোক্ষণে চলে এসেছে।”
“দাঁড়া আগে দেখে নেই আব্বু কোথায়।”
অনেকটা সতর্কের সাথে ঘর থেকে বের হয়ে এলো দুটো মেয়ে।বুকের লাব-ডাব শব্দ হচ্ছে তোশার।এমনিতে কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু এতো সকালে সাজগোছের জন্য যা অস্বস্থি লাগছে।মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে তারা মাঠে এসে পৌঁছে গেলো।সকালের মিষ্টি বাতাস বইছে।দূরে লুকিয়ে পড়লো অপ্সরা।তোশা একটি গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো।তাকে সত্যিই এখন রহস্যময়ী নারী মনে হচ্ছে।
সূর্যের প্রথম রশ্মির সঙ্গে তামাটে পুরুষটির আগমণ হলো।লম্বা লম্বা পা ফেলে কবীর মৃদু ছন্দে দৌড়ে আসছে।তোশার নিশ্বাস আশ্বাস আঁটকে গেলো।কবীর এমন এক ব্যক্তি যার দর্শনে তোশার পরিবেশ এলেমেলো হয়ে যায়।কিন্তু ওইযে সবসময় একটা অবহেলা করে।এতো সৌন্দর্যের বাহার নিয়ে দাঁড়ানো রমণীকে পাশ কাঁটিয়ে চলে গেলো কবীর।তোশার ধ্যান ভাঙলো।একবার রাউন্ড শেষ করে আসলে মিষ্টি হেসে কবীরের সামনে দাঁড়ালো তোশা।
“কী ব্যাপার কবীর শাহ?আমাকে দেখেও না দেখার ভান করছেন।”
গমগমে দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো কবীর,
“একটা জিনকে দেখার মতো কিছু নেই।তারা দেখতেও তো ভ য় ং ক র হয়।”
“আমি তো আপনার প্রিয় রমণীর বেশে আছি।যাকে এই রুপে সবসময় স্বপ্নে দেখেন।আজ আপনার সব স্বপ্ন বাস্তব হবে।”
কবীর মনে মনে হাসলো।তোশাকে সে এই রুপে বহুবার কল্পনা করেছে কিন্তু তা লাল রঙের শাড়ীতে।
“আচ্ছা হোক বাস্তব।আমি স্বপ্নে আর কী দেখি বেবী গার্ল।”
তোশা দ্বিধা নিয়ে কবীরের সামনে এসে দাঁড়ালো।পরক্ষণে আস্তে করে জড়িয়ে ধরলো।বাহুবন্ধন ধীরে ধীরে শক্ত হচ্ছে।মোহাবিষ্ট হয়ে তোশা বলল,
“আপনি রোজ স্বপ্নে দেখেন তোশা নামক ভালো মেয়েটা আপনাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে।”
হেসে উঠলো কবীর।তোশা নামক বাচ্চাটা হয়তো কখনো তার কাছে বড় হবেনা।
চলবে।
এডিট ছাড়া পর্ব।সকলে রেসপন্স করবেন।অনেক বড় পর্ব দিয়েছি।