#মিঠা_রোদ
#পর্ব:২২
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“বউয়ের সঙ্গে রেডিমেড একটা মেয়ে পেলে মন্দ হয়না কী বলো কবীর?এই কারণে তাহিয়ার পিছু পিছু ঘুরছি।যদি মানুষটার আমার প্রতি মায়া জন্মায়।”
“কিন্তু তাহিয়া বিয়ে করবেনা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসিফ ভাই।মায়ান যখন পরবর্তীতে সংসার গড়ে তুললো তখন আমরা সকলে ওর জন্য পাত্র দেখা শুরু করেছিলাম।কিন্তু মেয়ের জন্য রাজী হয়না।”
“আমার কাছে তাইয়ুবার একটুও অনাদর হবেনা।মায়ান মেয়ের খোঁজ রাখে?”
“খুব ভালোবাসে।সব খোঁজ নেয়।”
“যাই হোক।তোমাদের এখানে ডেকে আমার খুব ভালোলেগেছে।বিশেষ করে তাইয়ুবাকে।মেয়েটা আসলেও ছোট্ট একটা পুতুল।”
আসিফ যে মায়া মমতা নিয়ে তোশার পানে তাঁকালো কবীর ঠিক সেটা পারলো না।বরং তার মনে একরাশ অস্বস্ত্বি এসে জড়ো হলো।গত পরশু গায়ের হলুদের রাতে ছাদে ঠিক কী হয়েছিল তাদের মধ্যে কবীরের মনে মেই।শুধু এতোটুকু স্মরণে ছিল সে তোশার কপালে চুম্বন করেছে।এবং মেয়েটির সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিল তখন।এই একটি মাত্র নির্লজ্জতায় কবীর আত্নগ্লানিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে।এরপরে বহু সময় তারা ছাদে একত্রে ছিল।ঠিক ওতোটা সময়ে কী হয়েছিল কবীরের স্মরণে নেই।তবে বিশেষ কিছু হয়েছিল তখন।তা নয় তোশা নামক কিশোরী একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনি এই দুদিন তার সঙ্গে।তাকে ভাবনার বিশাল সমুদ্র থেকে বের করে আসিফ বলল,
“রুবা চলে যাচ্ছে কবীর।”
“হু,কখন?তাকে ঠিকমতো ডোজ দিতে পারলাম না।এরকম ফেমিনিস্ট হয়েছে কেন সেটাই ভাবার বিষয়।”
“তিন বছরে দুবার সংসার ভাঙছে।ঠিক এই কারণে।তবে আমার আশ্চর্য লাগে এটা ভেবে যে তোমাদের মধ্যে কতো অদ্ভূত কথাবার্তা হয়।”
“ফেমিনিস্ট না হলে কী হবে।তেজ আগে থেকে ছিল।এই কারণে নাকানিচুবানি খাওয়াতাম।মনে আছে আমি একবার ইট ছুঁড়তে গিয়ে তার বাবার মাথা ফা টি য়ে দিয়েছিলাম।”
আসিফ হাসতে হাসতে বলল,
“খুব মনে আছে।আর আঙকেল এরপর থেকে যে বারান্দায় হেলমেট পরে ঘুরাঘুরি করতো এই দৃশ্যও মনে আছে।”
কবীর হাসিতে যোগ দিলো।আজকে বিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে।এজন্য মেহমানরা একে একে চলে যাচ্ছে।মেয়ের স্কুল মিস যাচ্ছে বিধায় তাহিয়াও চলে যাবে।কাজ সব শেষ করে কবীর ফিরবে ঢাকাতে।সকলের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলো তাহিয়া।এদিকে চুপচাপ গাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তোশা।আজ খুব সুন্দর লাগছে তাকে।গোলাপি রঙের সুঁতি থ্রি পিচ পড়েছে।মসৃণ চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে আছে।কবীর অনেকটা ইতস্তত করে তার পাশে এসে দাঁড়াল।মানুষটার গায়ের রঙ কালো হলে কী হবে?কালো শার্টেও খুব মানাচ্ছে।শক্ত ফুলে ফেপে থাকা পেশিগুলোর উপর শার্টটি আঁটসাঁট হয়ে বসেছে।গা থেকে সেই তীব্র সুগন্ধ।যা নাকে আসতে মনটা খারাপ হয়ে গেলো তোশামণির।
“চলে যাচ্ছো?খেয়েছো কিছু?”
“খেয়েছি।”
“তোশামণি একটি কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।সেদিন মানে হলুদের দিন ছাদে আমার দ্বারা তোমার সাথে কোনো অন্যায় হয়েছে?সত্যি করে বলো।”
তোশা একটি বার পাশে দাঁড়ালো শৈল্পিক মানুষটিকে দেখলো।তার থেকে বেশ লম্বা হওয়ায় তামাটে মুখশ্রীকে মনে হচ্ছে বেশ দূরে তার থেকে।
“সত্যি বলতে কালোতে আপনাকে মানায় না কবীর শাহ।”
“মজা নয় লিটল চেরী।আমি কী কোনো ভুল করেছি?এতোটা মনে আছে আমি ভুল স্পর্শ করেছিলাম।”
“এটা নিয়ে তো দ্বিতীয়বার ছিল।তবে এতো গিল্টি ফিল করছেন কেন?”
কবীর বিবর্ণ হেসে বলল,
“সম্মান ও কামনার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে লিটল চেরী।”
তোশা পুনরায় অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে কবীরকে দেখছে।এইতো সেই মানুষটা যে তার স্বপ্নের পুরুষ ছিল উহু,বরং আছে।এবং সবসময় থাকবে।কিন্তু আজকের পর থেকে বিচ্ছেদ যে শুরু হবে তাদের মধ্যে।সেটি কী কখনো মিটবে?
“আপনি কিছুই করেননি কবীর শাহ।যা আমার কাছে সুখের বিষয় সেটিকে ভুল বলবেন না।আর হ্যাঁ আপনাকে দেশ ছাড়তে হবেনা।আমি কখনো আপনার সামনে আসবো না আজকের পর থেকে।”
“কেন আসবেনা?এর মানে আমি ভুল করেছি কিছু।”
বাক্য দুটো বলতে গিয়ে কবীরের কণ্ঠ মৃদু আন্দোলিত হয়ে উঠলো।তীব্র আশংকায় বুকটি শেষ হয়ে যাচ্ছে তার।তোশা নিজেকে সামলে বলল,
“আমি বুঝেছি আপনার আমার হয়না।আর সত্যিই আবেগ ছিল কিছুটা।ভাববেন না টাকার জন্য ছিলাম।”
রেগে গেলো কবীর।মেয়েটির বাহু শক্ত করে ধরলো।দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ হলো তার।
“আমি কখনো সেটা বলেছি?এরকম অদ্ভূত মনগড়া কথা বললে ট্রাকের নিচে ধা ক্কা দিয়ে ফেলে দিবো।”
“না আপনি বলেননি।আমি কথার কথা বললাম।যাই হোক সত্যিই আবেগ ছিল।আপনি হালকা কাছে আসায় মিটে গিয়েছে।”
আশ্চর্য হয়ে তোশার বাহু ছেড়ে দিলো কবীর।শুকনো তিক্ত ঢোক গিলে শুধালো,
“এইতো বললে সময়টা সুখের ছিল।তবে আমার স্পর্শে খারাপ লেগেছে তোমার?”
“ভুলে বলেছি।কিন্তু আপনার সামনে কখনো আসবো না।টাকা পয়সার দিক দিয়ে দেখতে গেলে আমি আপনাকে ডিজার্ভ করিনা আর সৌন্দর্য বয়সের দিক দিয়ে দেখতে গেলে আপনি আমাকে ডিজার্ভ করেননা।তাই দূরে থাকা ভালো।দেশ ছাড়বেন না।অন্তত ছেলেকে সাথে নিয়ে বাঁচেন।”
কবীর যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা যে এটাই সেই ছোট্ট তোশামণি কীনা।যার সঙ্গে এইতো মাত্র কয়েকমাস আগে পরিচয় হলো তার।পুতুলের মতোন আশেপাশে মিশে থাকতো।এখন তার সামনে যে শক্ত,দৃঢ় মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তার বয়স যেন বিশ বছর বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছে।পরবর্তীতে কবীরের সম্মান আঘাত এলো।সে শক্ত কণ্ঠে বলল,
“তোমার থেকেও সুন্দর আমার টগর ছিল তোশা।সেই হিসেবে চাইলেই আরো ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করি।আজকে যা অপমান করলে আমাকে তুমি।সব কথা ভুলে গেলেও শেষের কোনো বাক্য ভুলবো না।যাও কখনো আমার সামনে আসবেনা।”
তোশা অধরযুগল কাঁ ম ড়ে ধরে অশ্রু আঁটকানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু শক্তি তো পাচ্ছে না মেয়েটা।কবীর পিছন ফিরে বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো।পুনরায় হু ং কা রের অনুরূপ বলল,
“এরপর যদি কখনো আমাদের দেখা হয় তোশা তবে হয় তুমি আমার প্রেমিক রুপ দেখবে যেখানে বয়স,সম্পর্কের কোনো প্রকার ভয় থাকবেনা।তা নয় অবহেলার রুপ দেখবে।যাই হোক দেখা হলে কী ডিজার্ভ করি আমি বুঝিয়ে দিবো।”
ব্যস এতোটুকু কথার বিপরীতে কোনো কিছু বলার সাহস হয়ে উঠেনি তোশার।কবীর আর একটিবারও তার দিকে দৃষ্টি দেয়নি।তোশাও পাথরের মূর্তির মতোন গাড়ীতে গিয়ে বসলো।শুধু যখন পাশে তাহিয়ার সান্নিধ্য পেলো তখন মাকে শক্ত জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোমাকে অনেক ভালোবাসি আম্মু।ধন্যবাদ আমাকে জীবনে রাখার জন্য।”
মেয়ের মন খারাপ দেখে তাহিয়া শুধালো,
“কী হয়েছে তোশামণি?মায়ের প্রতি হঠাৎ এতো ভালোবাসা?”
“সবসময় তোমাকে ভালোবাসি আম্মু।”
গাড়ী চলতে শুরু করলো।তোশা জানে এখন গাড়ী থেকে মাথা বের করলে কবীরের দেখা পাবে।কিন্তু সে ভুলেও এই কাজটি করবেনা।চোখ বন্ধ করে সেদিনের রাতের ঘটনাগুলো মনে করলো।কবীরের বলা প্রত্যেকটি বাক্য তার এখনও স্মরণে আছে।হয়তো আজীবন থাকবে।
(***)
সময়ের স্রোতে চারটি বসন্ত কেঁটে গিয়েছে।দুনিয়ার সমীরণের সঙ্গে মানুষগুলোও যেন বদলে গিয়েছে।এইযে তোশা নামক সেই কিশোরী বিশ বছরের যুবতী।এক সপ্তাহ পূর্বে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।বয়স বেড়েছে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শারীরিক ও মানসিক পরিপক্বতা বেড়েছে।কিন্তু এখনও যেন তাহিয়ার ছোট্ট কন্যাটি।ক্ষণবাদে ভার্সিটিতে যাবে তোশা।টেবিলে বসে আছে নাস্তার জন্য।তাহিয়া ফোনে কথা বলছে আর মেয়ের মুখে ব্রেড ভরে দিচ্ছে।পাশে কল্লোল বসে আস্তে করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।
“ফুপু তুমি কেন তোশামণিকে এখনও খাইয়ে দাও।ও তো বড় হয়ে গিয়েছে।”
তাহিয়া মুচকি হেসে বলল,
“ও আমার কাছে সবসময় ছোট থাকবে।যাই হোক ওকে ভার্সিটিতে নামিয়ে তবে তুমি যাবে।”
“তোশাকে তো কতোবার বলি ড্রাইভিং শিখে নাও।”
মুখে এতোগুলো খাবার নিয়ে তোশা জবাব দিলো,
“গাড়ী চালাতে ভালো লাগেনা আমার।তুমি না নিলে বলো আমি উবারে চলে যাবো।”
“নিয়ে যাবো তো।জলদি খেয়ে নাও।”
কল্লোল বর্তমানে মেডিক্যালে পড়াশোনা করছে।ভবিষ্যত ডাক্তার হওয়ার সমস্ত হাবভাব প্রকাশ পেয়েছে তারমধ্য।তাহিয়া গোপনে নিশ্বাস নিলো।তোশাকে যে কল্লোল পছন্দ করে সেটা সে জানে।কিন্তু মেয়েটির মতিগতি বুঝেনা সে।
গাড়ীতে বসে একমনে বাহিরে তাঁকিয়ে আছে তোশা।ঢাকা শহরকে তার অনুভূতিহীন শহর মনে হয়।কিন্তু ভালো লাগেনা আবার এখান থেকে দূরে কোথাও গিয়ে।তীরে এসে তরী ডুবার মতোন শাহবাগে এসে জ্যামে পড়লো তারা।হঠাৎ আনমনে তোশার বাহিরে ফুলের দোকানগুলোর উপর দৃষ্টি পড়লো।নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গেলো তার।সমস্ত মাদকতা নিয়ে সেই তামাটে স্বপ্নের পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছে।বাহুতে অন্য এক রমণীর হাত।প্রায় তিন বছর পর তার দর্শণ পেলো তোশা।দোকানদার একগুচ্ছ গোলাপ এগিয়ে দিলো কবীরের দিকে।সে হাতে নিয়ে পাশে থাকা রমণীর উদ্দেশ্যে এগিয়ে দিলো।এর বেশী নিতে পারলো না তোশা।চোখ ভরে এলো তার।এদিকে জ্যাম ছেড়ে গিয়েছে।পাশে বসে থাকা কল্লোলকে বলল,
“ভাইয়া একটু আস্তে কিন্তু যখন বলবো তখন জোরে চালাবে।”
“কেন?”
তোশা জবাব দিলো না।পানি ভর্তি বোতল নিয়ে জানালা থেকে কবীরের দিকে ছুঁড়ে মারলো।মুহুর্তেই ভিজে গেলো লোকটা।চমকে গাড়ীর দিকে তাঁকালে দেখতে পেলো একটি মেয়ে মুখ বের করে চিল্লিয়ে বলল,
“হেইট ইউ কবীর শাহ।”
চলবে।