#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৬৯
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।” (সুনীল গঙ্গোপধ্যায়)
বুকে জড়িয়ে তামাটে পুরুষটি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে প্রশংসায় ভরিয়ে তুলে।মৃদুমন্দ সমীরণে চারিধারের গাছপালা নেচে উঠছে।সমুদ্রে রৌদ্রের কিরণ পড়ায় স্মরণে হচ্ছে স্বর্ণের তৈরী পানি সেগুলো।তোশা একমনে সেদিকে দেখছে।রোদের সঙ্গে সে নিজের খুব মিল পায়।তাকে উদাসীন কিছু ভাবতে দেখে কবীর শুধালো,
“কী ভাবছো বেলাডোনা?”
তোশা স্থিমিত কণ্ঠে বলল,
“তেমন কিছু না।আপনার মনে হচ্ছে না কবীর শাহ ইদানীং আপনি খুব বেশী রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছেন?”
“রোমান্টিক?কীভাবে?”
“এইযে সব বাক্যের পর আমার প্রশংসাতে ডুবে যান।এটাকে রোমান্টিসিজম বলে জনাব।”
“স্ত্রীর প্রশংসা করা সকল পুরুষদের নিজস্ব দায়িত্ব।আর আমি এতো বয়সে এসে দারুণ সুন্দরী স্ত্রী পেয়েছি।সেক্ষেত্রে আমার প্রশংসা একটু বেশী করতে হবে।এতো বড় পাওয়া সেটা তো দারুণ ভাগ্য।”
“আমাকে পাওয়ার বিষয়টা আপনি সৌভাগ্য হিসেবে ধরে নিলেন?”
তোশা স্বীয় আঁখিতে বিস্ময় ফুটিয়ে কবীরের দিকে জবাবের আশায় তাঁকিয়ে রইলো।এমন নয় যে সে জানেনা কবীর তাকে অনেক ভালোবাসে।মানুষটাকে পেতেও তোশার খুব বেশী লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে।কিন্তু সেসব সে গ্রাহ্য করেনি।বরং তোশার মনের কোথাও একটা জায়গা বিশ্বাস করতো কবীর নেহাৎ ভালো মানুষ বিধায় সকলের থেকে এতো অপমান পাওয়ার পরেও বিয়ে করেছে তাকে।যে মানুষ এতো বিত্ত্বশালী কিংবা ক্ষমতাবান তার বিশেষ দরকার ছিলনা তার মতোন বোকা একটা মেয়েকে পছন্দ করার।সে তো বিশেষ কেউ কিন্তু তোশা বিশেষ নয়।যুবতীর করা প্রশ্নে কবীর হেসে উঠলো।কী মায়াময় ব্যক্তিটির দৃষ্টি!তোশাকে হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তোমাকে পাওয়া আমার জন্য সৌভাগ্য তোশা।সেই ব্যাখা আজ নয় কোনো এক বিশেষ দিনে দিবো।কিন্তু আমার ভালোবাসা নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ আছে?”
“নেই।কিন্তু আপনি ভালোবাসা প্রকাশ করেন না খুব একটা।”
“কে আমি?”
“জি খুব বেশী প্রকাশ আপনার দ্বারা হয়নি।”
“ভালোবাসা প্রকাশ করতে হলে আমার ঠিক কী করতে হবে?”
কবীরের মুখোমুখি হয়ে বসলো তোশা।একটু প্রহেলিকা করে বলল,
“আপনি দেখুন কী করতে হবে।হানিমুনে আমার কথা মতোন মরিশাস দ্বীপে আসা কিন্তু ভালোবাসা জাহির করা নয়।”
তোশাকে এতোটা খামখেয়ালি ভাবে কখনো দেখেনি কবীর।কিছুক্ষণ স্ত্রীর পানে তাঁকিয়ে সে ভাবতে লাগলো।কিন্তু এখানেও বিপদ।এতো সুন্দর মুখটাকে দেখে বারংবার সে নিজ ভাবনা থেকে সরে যাচ্ছে।ফোলা ফোলা মেদুর শুভ্র গালটাকে দেখতে সত্যি চেরির মতো লাগে।কবীরের মনে পড়ে গেলো তাদের প্রথম রাত্রীর কথা।সেদিন গাল দুটো আরো রঙিন ছিল।অজান্তে হেসে উঠলো কবীর।তোশা কী কখনো খেয়াল করেছে তার গাল দুটো আলোর সংস্পর্শে নাকী বাজপাখির ছোঁয়ায় আরো বেশী রক্তিম হয়ে উঠে।
“কী হলো কোন ভাবনায় চলে গেলেন।”
“ভালোবাসা আমি অনেক ভাবে দেখাতে সক্ষম সুন্দর মেয়ে।কিন্তু এই উপায় পছন্দ হলে বিনিময়ে কী আছে আমার জন্য?”
“সুন্দর নারীটি তো আপনার।এর বাহিরে কী আর চাওয়ার থাকতে পারে?”
কবীরের অধরযুগল প্রসারিত হলো।পুরুষটি যেন চিরযৌবনা।হাসিতে আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠে শরীর।সরু শক্ত আঙুল গুলো দ্বারা যুবতীর কানের পিঠে চুল গুলো গুঁজে দিয়ে বলল,
“এটা শুধু ভালোবাসা আমার তোমার জন্য।”
লম্বা লম্বা পা ফেলে একটু দূরে সাদা ত্বকের লোকটির সামনে দাঁড়ালো কবীর।তার মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল,
“Hey,That beautiful woman sitting there is my wife. And I love her very much.”
লোকটি কবীরের কথায় ভ্রু কুঁচকালো।বিনিময়ে কবীর হেসে সামনে অগ্রসর হয়ে অন্য আরেকজন লোককে একই কথা জানালো।এমনকি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি মানুষকে জানালো তোশা তার স্ত্রী এবং তাকে সে খুব ভালোবাসে।তোশা দৃষ্টিতে একরাশ অশ্রু নিয়ে পুরো জিনিসটা দেখছে।কবীরের চোখেমুখে কতোটা মুগ্ধতা খেলা করছে একই ভালোবাসার বাক্য ভিন্ন মানুষকে বলার সময়।অনেকজনকে বলে এসে তোশার কাছে থামলো কবীর।এতোক্ষণে প্রায় সকলের জানা হয়ে গেছে কবীরের ভালোবাসা কে।তোশা শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“আরো কেউ বাদ আছে?যাকে আপনি জানাতে চান?”
” এখনো সমুদ্র ও আকাশকে বলা বাকী।”
“তাদেরও জানাবেন?কীভাবে?”
“এ জিনিসটা খুব স্পেশাল হবে।এখন রুমে চলুন ম্যাডাম।বেশী রোদে থাকলে ত্বক কালো হয়ে যাবে।”
“আপনার মতোন?”
“আমাকে কালো বলে কী শান্তি পাও?”
“ভালো লাগে।”
কবীরের একটা হাত জড়িয়ে হাঁটতে লাগলো তোশা।এক সুখী দম্পতিকে আশেপাশের মানুষ তাঁকিয়ে দেখছে।বিয়ের তিনমাস অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর হানিমুনে এখানে আসতে পেরেছে।তা নয় এ আত্মীয়ের বাড়ী ও আত্মীয়ের বাড়ী ঘুরতে ঘুরতে সুযোগ হয়ে উঠেনি।রিসিপশনে তাদের থামিয়ে দিলো একজন লোক।হাত বাড়িয়ে একটা ফুলের তোড়া দিলো।ইংলিশে বলল,
“আপনাদের জন্য গিফট এসেছে।”
“আমাদের জন্য?”
“জি।”
কবীর হাতে নিলো ফুলগুলো।সাদা গোলাপ দেখে মুহুর্তে স্নায়ুর কোথায় স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠলো।কর্মরত লোকটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো কে এগুলো দিয়েছে।আগুন্তকের নাম ফ্রান্সিসকো শুনতে কপালে ভাঁজ পড়লো তার।পিছন থেকে তোশা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সেই লোকটা?এখানে কেন?”
“ও আমাকে বলেছিল আমার খুশির সময়টা আমার থেকে চু”রি করে নিবে।আর এখনকার থেকে বেশী খুশি বোধহয় আমি কখনো হইনি।”
“এখন কী করবেন তাহলে?”
“আমার প্রথম কাজ তোমাকে নিরাপদ রাখা।”
“কিন্তু আপনি?”
“আমিও থাকবো।ভয় নেই আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমি পূর্ব থেকে করে রেখেছি।শুধু লোকটাকে হাতের নাগালে মিলছে না।”
কবীরের কথা তবুও তোশাকে শান্ত করতে পারলো না।সে মুখটা গোমড়া করে রইলো।
(***)
অনেকক্ষণ ঘুমালো তোশা।মেয়েটার দিকে এক ধ্যানে তাঁকিয়ে আছে কবীর।চোখ তুলে ফুলগুলোকে পুনরায় দেখলো।মাথায় অহেতুক অনেক চিন্তাভাবনা ঘুরছে।বিশেষ করে সে জানে ফ্রান্সিসকো বেশ বুদ্ধিমান।যদি তোশার বা তার পরিবারের কোনো ক্ষতি করে?এই প্রশ্নটি থেকে যায়।হুট করে সোশ্যাল মিডিয়াতে এসএমএস আসার শব্দ হলো।কবীর ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অচেনা একটি একাউন্ট থেকে এসএমএস এসেছে।সে কৌতুহল হয়ে রিপ্লাই করতে ওপাশ থেকে ফোন এলো।কবীর দ্বিধা নিয়ে রিসিভ করলো,
“হ্যালো।”
“কেমন আছো কবীর শাহ?বিবাহিত জীবন কেমন কাঁটছে?”
“ফ্রান্সিসকো?”
“আমি নয় তো আর কে?”
“কী চাও?”
“কী চাইনা সেটা বলো।তোমার সুখের সময়কে কামনা করছি।যেভাবে তুমি আমার বিয়ের পূর্বে।”
“মিথ্যা বলো না।তুমি দো’ষী না হলে আইনের কী দরকার ছিল তোমাকে হে’ন’স্তা করার?”
“আমি নি”র্দোষ কখনো বলিনি নিজেকে।তবে আমার সমস্যা ভিন্ন জায়গায়।মনে আছে এখানে আসার পর একজন তোমাকে ড্রা” গ নিয়ে ফাঁসাতে চেয়েছিলো?আমি সেদিন না থাকলে তোমার কী করুণ অবস্থা না হতো।”
“মনে আছে।”
“যদি আমার সাহায্য পেয়ে তুমি আজ এমন শক্তির অধিকারী হতে পারো তাহলে আমার কথা লুকানোতে কী সমস্যা হতো?আমি উপকারের বিনিময়ে কী কিছুই প্রাপ্য ছিলাম না?”
“এখানে কথা ভিন্ন ছিল ফ্রান্সিসকো।আমি নির্দোষ কিন্তু তুমি ছিলে শয়তান।এখন নিজের গণনা শুরু করো।একবার যদি আমি ধরতে পারি।”
“কী করবে?নিজের প্রাক্তন স্ত্রীকে যেভাবে বিশেষ ঔষধ দিয়ে পা’গ’ল করে রেখেছো আমাকেও তেমন করবে?”
“তুমি এটা কীভাবে জানো?”
শব্দ করে হেসে উঠলো ফ্রান্সিসকো।কবীরের বড় রাগ হলো তাতে।
“আমি কীভাবে জানি?সেকথা না হয় বাদ থাকুক।এবার চলো আমরা যু’দ্ধ করি।একটা নিরব যু’দ্ধ।যেখানে দেখবো কার হা’র হয়।আমি তোমাকে বিশেষ সময়ে আবার দেখা দিবো।কিন্তু সেটা হবে আমাদের শেষ দেখা।আমি তোমার শেষ দেখে নিবো।ভালো থাকবে কবীর শাহ।এবং হোয়াইটকে বলো ও খুব সুন্দর।”
কলটা রেখে দিলো ফ্রান্সিসকো।সে কী করতে চাচ্ছে?আদুরে বিড়াল ছানার মতোন ঘুমের মধ্যে থেকে শব্দ করে উঠলো তোশা।এতোক্ষণ মস্তিস্কে চলা ঝড়টা থেমে গেলো কবীরের।মেয়েটির পাশে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়লো সে।ঘুমন্ত মুখটা কী দারুণ মায়াবী।ফিসফিস করে বলল,
“আমাদের জীবনের মিঠা রোদ কখনো শেষ হবেনা বেলাডোনা।একটি সুন্দর দিনের সূচনা হয়েছে।যা থামবার নয়।”
চলবে।