#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৬২
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“চল্লিশ বছরের পুরুষ হয়ে মায়ের পিছন পিছন বিয়ে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে।আমার লজ্জা করেনা আম্মু?”
কবীরকে নির্বিকার দৃষ্টিতে দেখে নিজ কাজে মনোযোগ দিলো সেতু।আজ সারাদিন তার ছেলে পিছন পিছন ঘুরেছে তোশাকে বিয়ে করার জন্য।সে এখনও মত দেয়নি।কেন দিবে?সব কথা একদিকে আর তোশার বয়স আরেক দিকে।সেতুর সোনার সংসার।বড় ছেলেটা পঙ্গু বয়স বাড়ছে।এছাড়া বাপের বাড়ীর দিকে অনেকের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে রেখেছে সে।সব দিক বিবেচনায় যখন তার স্বামী আর সে চোখ বন্ধ করবে তখন আদৌ কী কবীরের স্ত্রী রুপে থাকা তোশা সব সামলাতে পারবে?কবীর পুনরায় জবাবের আশায় বলল,
“মা তুমি কিছু তো বলো।”
“কী বলবো?তুমি চাও আমি যেন হ্যাঁ বলি।কিন্তু আমার মনে আছে না উত্তর।সেটা তো মানবেনা।”
“তোশা ভালো মেয়ে।এসব ভাবনা বাদ দাও।”
“দিলাম।কিন্তু বউ পেয়ে দুদিন পর আমার আহনাফকে যে ভুলে যাবে।সেটা কীভাবে বাদ দেই?”
কবীর আহত সুরে বলল,
“তোমার মনে হয় আমি এমন বাবা?”
“বউ পেলে সবাই বদলে যায়।”
ড্রয়িং রুমে বসে থাকা সেলিম গলার সুর উঁচু করে বলল,
“তোমার মা ঠিক বলেছে কবীর।বউ পেলে সকলে বদলে যায়।আমার শ্বশুর মশাই তো বদলে গিয়েছিলেন।তাই তোমার মায়ের ভয়।”
সেতু শুষ্ক চাহনি ও বিতৃষ্ণাতে জর্জরিত হয়ে শুধালো,
“আপনি জানেন যে আমার বাবা বদলে গিয়েছিল?ভুলভাল কথা বলবেন না।বরং আমার নতুন মা নিজেও আমাকে আর ভাইকে আগলে রেখেছিলেন।তাদের শিক্ষা ও ব্যক্তিত্ব ছিল এমন।”
“তাহিয়ার মেয়েরও ব্যক্তিত্ব ঠিক এমন সেতু।তুমি জানো না কিন্তু একদিন ও বিশদভাবে আমার সাথে আলোচনা করেছিলো এই সম্পর্ক নিয়ে।ওই মেয়ের ভেতর কোনো তিল পরিমাণ অন্য ভাবনা নেই।বিয়েটা তো হচ্ছে।কিন্তু যদি আহনাফের বি’রু’দ্ধে উল্টোপাল্টা মনোভব নিজে ডেকে আনো সেক্ষেত্রে কারো কিছু করার নেই।কবীর আমি তাহিয়ার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি।তাই চিন্তা ছাড়া অফিসে যাও।”
“কিন্তু আব্বু চিন্তা আছে।এই মানুষটা আমার মা।তার অনুমতি ছাড়া কিছু কীভাবে করি?”
ব্যস এতোটুকু ছিল সেতুর মনের শীতল বরফ খন্ডকে মাতৃ উষ্ণতায় মুড়িয়ে গলিয়ে দেওয়ার জন্য।কবীর মা কে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বয়স কম হোক।তোমার তো পুত্রবধূ হবে।মে” রে তুমি কাজ শেখানো বা ভদ্রতা শেখানো জানো না।কিন্তু আমি জানি তুমি কয়লা থেকে হীরা বের করতে পারো মা।প্লিজ রাজী হয়ে যাও।আহনাফকে তোশা অনেক ভালোবাসে।”
সেতু কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলো।এখন বৃদ্ধ বয়স তার।নতুন করে পুত্রবধূকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়ার মতোন শক্তি শরীরে নেই।কিন্তু তবুও আস্তে করে মাথা নাড়ালো।ছেলের কষ্ট সে চায়না।কবীর তৃপ্তিদায়ক হেসে মা কে ধন্যবাদ জানালো।
“আম্মু ধন্যবাদ আমাকে বোঝার জন্য।মামাদের হ্যান্ডেল করে নিও প্লিজ।”
“তা করবো।কিন্তু শর্ত আছে।”
“সেটা কী?”
“দিশার সঙ্গে যোগাযোগ আমি বন্ধ করবো না।মেয়েটা অসুস্থ।উল্টোপাল্টা জিনিস দেখে সারাদিন।ওর মৃ’ত দাদাকেও দেখে।সে বলে এসে কথা বলে রোজ ওর সঙ্গে।”
“পারভেজকে দেখাচ্ছে না কেন?যেহেতু মানসিক সমস্যা।”
“জানিনা।এই কারণে একটা বয়সের পর একা থাকতে হয়না।”
সেতু আরো নানান কথা বলতে লাগলো দিশার সমন্ধে।সবগুলো ওর অসুস্থতা নিয়ে।কবীর বাহিরের মনোভাব সাধারণ হলেও ভেতরের মনে সবকিছুর হিসেব মিলাচ্ছে।হয়তো আর কিছুদিন।এরপর দিশা পুরোপুরি মানসিক ভাবে পাগল হয়ে যাবে।যদিও দুই তিন বছরে সুস্থ হয়ে পড়বে।কিন্তু নিজ কাজের শাস্তি পেয়ে।কতোটা অদ্ভূত।যাকে একসময় ভালোবাসার কথা বলেছে আজ তার সঙ্গে কবীরের এমনটা করতে হলো।
(***)
কবীরের একমাত্র সিংহাসনে বসে আছে তোশা।তবে এখানে আসনটি সোনায় মোড়ানো না হলেও দামী কালো রঙের কাঠে তৈরি।এই অফিস রুমের এক পাশে বিশাল কাঁচের জানালা আছে।যা দিয়ে মিঠা রোদ আসে।সুন্দর আকাশ দেখা যায়।খোলাচুলে সাদা রঙের পোশাক ও অধরযুগলে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে চেয়ারে গাল ঠেকিয়ে বাহিরে তাঁকিয়ে আছে তোশা।এতো উঁচু হওয়া স্বত্ত্বেও আকাশে কোনো পাখি নেই।শুধু শরতের খন্ড খন্ড মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে।তোশা নিজে থেকে চিন্তা করে নিলো।সুবিশাল আকাশে রঙীন ঘুড়ি উড়ছে।পাশে এক ঈগল ও চড়ুই একই সাথে ডানা ঝাপটে চলছে।কতো অসম্ভব জিনিস।কিন্তু তোশার ভালো লাগছে ভাবতে।যদিও বাজপাখির সঙ্গে চড়ুই পেরে উঠছেনা।
“তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে মেয়ে।”
মীরার কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো তোশার।মিষ্টি সুরে বলল,
“কেমন আছো আন্টি?”
“ভালো।বেশ ভালো।কিন্তু তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।কিন্তু শুনেছি প্রায় এক মাসের মতোন অসুস্থতায় ভুগলে।হসপিটালে ছিলে।”
“এক মাস নয়।বিশ দিন হসপিটালে ছিলাম।গত পরশু রিলিজ পেয়েছি।”
“অবশ্য এতো অসুস্থ থাকার কথা।কারণ যা গেলো উপর দিয়ে।আমি কিন্তু শুরু থেকে তোমাদের সাপোর্টে ছিলাম।স্যার তোমাকে এখানে বসতে বলেছে?”
“নাহ এটা তার জন্য সারপ্রাইজ।”
তোশা লাজুক হাসলো।আশ্চর্য তার মধ্যে এখন লজ্জা কাজ করে।যা কয়েক মাস পূর্বেও ছিলনা।বেশী অবাক লাগে যখন মনে পড়ে অল্প দূরত্বে আছে নববধূ হওয়ার।নিজ খেয়াল থেকে বের হয়ে তোশা মীরার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো।উল্লাসের চেহারার সঙ্গে শুধু নাকটায় মিল আছে।একটু বিব্রত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি একদিন তুমি উল্লাসের কথা আমাকে বলেছিলে তাইনা?ও তোমার ছেলে।”
মীরা উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ।”
“ওর সাথে কবীর শাহ এর এতো ভালো সম্পর্ক কীভাবে?”
“ব্যাপারটা আমিও জানিনা।কিন্তু দুজনে একে অপরের ক্রা”ই”ম পার্টনার বলতে পারো।আচ্ছা পরে কথা হবে।এই ফাইলগুলো রাখতে এসেছিলাম।”
মীরা অনেকটা জলদিতে বের হয়ে গেলো।যেন কথাটিতে সে বিব্রত।তোশা সেদিক থেকে মনটা সরিয়ে পুনরায় আকাশ দেখতে লাগলো।ভাবনায় বুঁদ মেয়েটিকে হঠাৎ উষ্ণতায় জড়িয়ে নিলো।কবীর নিজ শক্ত হাত দ্বারা তাকে শূন্যে নিজ কোলে তুলে নিলো।তোশা ভয় না পেয়ে বরং তামাটে পুরুষটির গলা জড়িয়ে ধরলো।এক সময় ছিল যখন এতোটা কাছাকাছি আসতে ভয় লাগতো দুজনের।কিন্তু আজকে কোনো বাঁধা নেই।যেন বালির বাঁধের মতোন সব মলিনতা ভেঙে গিয়েছে। তোশাকে কোলে নিয়ে নিজেই চেয়ারে বসলো কবীর।
“আপনি কখন এলেন বেলাডোনা?সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম।”
“এসেছি অনেকক্ষণ হলো।কী হলো বাড়ীতে?”
“মা মেনেছে।”
“সত্যি?”
তোশার নাকের সঙ্গে নিজের নাকটি ঘষে জবাব দিলো।
“সত্যি লিটল চেরী।শেষমেশ আমাকে পাওয়ার লড়াইতে জিতে গেলেন।”
“উহু আমরা জিতে গেলাম।বিয়ের ডেট কবে দিবেন?”
কবীরকে একটু অশান্ত দেখা গেলো।তোশার মাথাটা বুকে রেখে বলল,
“মায়ান এখনও হ্যাঁ বলেনি।যতোকিছু বলো না কেন?সে তোমার বাবা।মতামত জরুরি।”
“হুঁ।”
“বাই দ্য ওয়ে তর্নি কে তোশা?আমি তোমার মুখে শুনেছি নামটা।”
কবীরের মুখে প্রশ্নটি শুনে তোশার গালে লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো।যেন সত্যি সে টমেটো।
“আমাদের মেয়ে।যে দেড় বছরের মধ্যে আমার কোলে থাকবে।কতো মজা হবে তাইনা?”
“নাহ।কারণ আপনি পড়াশোনা শেষ করবেন।এরপর বাকী বিষয়।”
“আপনার কথা মতোন?”
“জি হ্যাঁ।”
তোশা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“বউয়ের কথা শুনবেন না আপনি?এতো বড় সাহস।”
কবীর আরো তিনগুণ চোখ ছোট করলো।এরপর তোশার ছোট্ট নরম হাতের সঙ্গে নিজের তামাটে শক্ত হাত মিলিয়ে বলল,
“কোথাও দেখেছো সিংহকে টিয়া পাখি শা’স’ন করে?আমাদের দুজনের হাত দেখো।শক্ত এই হাতকে নরম এই হাত শা’স’ন করতে পারবে?বিষয়টি অসম্ভব।”
“শুনবেন না সত্যি আমার কথা?”
“কখনো না।বরং ভয় পাও যে তোমাকে পানি খাইয়ে মা’তা’ল করতে পারে তার সাথে সংসার জীবনে কয়বার হারবে?”
তোশা আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
“হারবো কীনা জানিনা।কিন্তু কবীর শাহ এর প্রাণ ভোমরা তোশা পাখি।সে জানে তামাটে পুরুষকে কীভাবে বশে রাখতে হয়।”
“সত্যি?তবে ভয় পাওয়া উচিত সুন্দরী ছোট্ট শয়তান।কারণ বিয়ের পর অন্য রকম কবীরকে দেখতে পাবে তুমি।যে উত্তাল ভালোবাসাতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তার বেলাডোনাকে।”
চলবে।