#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০১:
রাত দুইটা। বারান্দায় নির্ঘুম বসে আছে সীমান্ত। আশেপাশে কোনো বিল্ডিং-এ আলো জ্বলছে না। মোটামুটি সবাই এখন ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। সিগারেটের শেষ অংশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বারান্দার মেঝেতে। ঠান্ডা হাওয়া আর শান্ত পরিবেশও সীমান্তের অশান্ত মনকে শান্ত করতে অক্ষম হচ্ছে।
আজ তিনমাস হলো তার চাকরী নেই। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এই ব্যয়বহুল শহরে কীভাবে জীবন পার করবে, সেই চিন্তায় অস্থির সে।
সীমান্ত খুব নামকরা কোম্পানিতে চাকরী করতো। এই বছরেই তার প্রমোশন হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু হঠাৎ তাকে জব থেকেই বের করে দেয়৷ আর তার উপর ঘুষ খাওয়ার মিথ্যে মামলাও দেওয়া হয়, যেখানে আজ পর্যন্ত সে অন্যের এক পয়সাতেও হাত দেয় নি। খুব সৎ ছেলে হওয়ায় বরাবরই তার সুনাম ছিলো। কিন্তু যারা একটা সময় তার সুনাম করতো, আজ তারাই, তাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করতে পারছে না। ঘুষের মামলায় দুই রাত জেল খানায় রাত কাটিয়েছে সীমান্ত।
দুই দিন পর তার শাশুড়ির পরিচিত উকিলের সহযোগিতায় তাকে বের করে আনা হয়।
সীমান্তের বাবা-মা নেই। অনাথ আশ্রমে বড়ো হয়েছে। নিজ পরিশ্রমে পড়াশুনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে। সীমান্তের শাশুড়ি রোকেয়া হোসেন তার স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন।
রোকেয়া হোসেন শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য বিয়ে করেন নি কখনো। শুভ্রা তার পালিত কন্যা। তিনি শুভ্রাকে খুব ভালোবাসেন। আর সীমান্তকে খুব বিশ্বাস করেন। সেই বিশ্বাস থেকেই সে আজ শুভ্রার স্বামী।
শুভ্রা আর সীমান্তের এক ছেলে, এক মেয়ে। বর্তমানে শুভ্রা দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাদের ছেলে শিশির ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। আর মেয়ে শেফার বয়স দুই বছর চলছে। তাদের সুখের সংসারে অভাবের ছায়া নেমে আসবে তারা কখনো ভাবতেও পারে নি।
শুধুমাত্র চাকরি চলে গেলে একটা কথা ছিলো, অন্য আরেকটা খুঁজে নিতে পারতো সে৷ কিন্তু তার নামে মামলা হওয়ায় এখন নতুন কোনো চাকরি পাচ্ছে না। সাথে তার ব্যাংক একাউন্টও ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। যতোদিন মামলাটি মিথ্যা প্রমাণিত হবে না ততোদিন সে কোনো টাকাও তুলতে পারবে না ব্যাংক থেকে৷ বর্তমানে তার সংসার চালানোর জন্য হাতে কোনো টাকা নেই। বাড়ির মালিক প্রতিদিন কথা শুনায়। বন্ধুর থেকে টাকা ধার নিয়ে গত মাসের ভাড়া দিয়েছিলো সে। এখন কবে এই ধার শোধ করবে সেই চিন্তায় সীমান্ত মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে।
দরজায় খুব জোরে কেউ আঘাত করছে। শুভ্রার শরীর খুব ভারী ভারী লাগছে। মুখ দিয়েও কোনো শব্দ বের করতে পারছে না সে। নিজেকে অনেক কষ্টে বিছানা থেকে টেনে তুলেছে শুভ্রা। পা দুটি বার বার কেউ টেনে ধরছে, তাও কোনো এক অদ্ভুত মায়ায় সে নিজেকে টেনে টেনে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো শুভ্রা। দরজাটা সাথে সাথে খুলে গেলো। আর সাথে সাথে ঠান্ডা শীতল হাওয়া তার শরীর ভেদ করে বের হয়ে গেলো। আশেপাশে প্রচুর শব্দ তার কানে আসছে। শব্দগুলোতে কান ভারী হয়ে আসছে তার৷ পুরো ঘর জুড়ে শব্দগুলো হাওয়ার মতো উড়ছে। সাথে শুভ্রাও নিজেকে ভাসতে দেখছে। শক্ত কিছু ধরে পা দুটি মাটিতে আনার বৃথা চেষ্টা করছে সে। হঠাৎ শুভ্রার মনে হচ্ছে তার আশেপাশে বহু মানুষ। তারা কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। সে বোঝার চেষ্টা করছে কথাগুলো। অনেক কষ্টে একটি কথায় তার কানে এসেছে, সেটি ছিলো ওই দরজার সামনে যাওয়া বারণ। শব্দটা এতো বেশি ভয়ংকর ভাবে তার কানে এসেছিলো যে, সে ভয়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হয় নি, শুধু সে চোখ দুটি খুলতে পেরেছে বহুকষ্টে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার। তার পাশে সীমান্ত নেই। পুরো শরীর ভিজে গেছে ঘামে। বিছানা ছেড়ে উঠতেই সে খেয়াল করলো বিছানায় পানির মতো কিছু। বুঝে উঠে সে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সীমান্ত বারান্দা থেকে দৌঁড়ে এলো শুভ্রার কাছে।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুভ্রা কাঁদছে। সীমান্ত খুব শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। শুভ্রার মিসক্যারিজ হয়েছে। এই নিয়ে আটবার এমন হয়। প্রতিবারই এমন উদ্ভট স্বপ্ন দেখে সে। স্বপ্নগুলো ঘুরে ফিরে একই ধরণের হয়। দরজায় কারো আঘাত।
দরজাটা দেখতেও খুব অদ্ভুত। এমন দরজা সে আগে কখনো দেখে নি। অনেকটা পুরনো বাড়ির দরজার মতো। যার গায়ে অনেক ধুলো জমে আছে৷ মনে হয় অনেকটা বছর কারো স্পর্শ লাগে নি।
সীমান্ত শুভ্রাকে কোনো প্রশ্ন করেনি৷ সে বুঝেছে এবারও হয়তো কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখে এমন হয়েছে৷ শিশির হওয়ার আগেও এমনটি হয়েছিলো। তারপর শিশিরের জন্মের পর শুভ্রা আর খারাপ স্বপ্ন দেখে নি। পরের বার কনসিভ করলেও ঠিক এমন ঘটনা ঘটে। তারপর শেফা হয়। এখন আবার সেই সমস্যা। বারবার শুভ্রা কনসিভ করলেই কেন এমন স্বপ্ন দেখে এর কোনো হিসাব মেলাতে পারে নি সীমান্ত। অনেকে বলেছে শুভ্রার শরীরে কোনো অদৃশ্য ছায়া আছে। কিন্তু এসব কথা শুভ্রা আর সীমান্ত দুজনই বিশ্বাস করে না।
শুভ্রা কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,
শুভ্রা: সীমান্ত।
সীমান্ত: হ্যাঁ বলো। আমি আছি তোমার পাশে।
শুভ্রা: আমার না ওই দরজায় হাত দেওয়া উচিত হয় নি। শিশির আর শেফার বেলায় আমি ওই দরজায় হাত লাগায় নি। কিন্তু অন্য সময় প্রতিবার লাগিয়েছি। আমার হাতের স্পর্শে ওই দরজাটার মধ্যে প্রাণ আসে। আর সেই প্রাণ আমার বাচ্চার প্রাণ কেঁড়ে নেয়। আমি এসবে বিশ্বাস করি না সীমান্ত। আমি জানি তুমিও করবে না। কিন্তু ব্যাপারটা আমার খুব উদ্ভট মনে হচ্ছে।
সীমান্ত: এসব তোমার মনের ভুল। আচ্ছা, পরের বার ওই দরজায় হাত দেবে না, কেমন?
শুভ্রা: আমি পারি না। অদৃশ্য মায়া কাজ করে৷ এই মায়া কিভাবে ছাড়বো আমি?
সীমান্ত: শুভ্রা, এসব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। তুমি অতিরিক্ত চিন্তা করছো তাই এসব বাজে বাজে স্বপ্ন দেখছো।
পরের দিন বাসায় আসলো তারা। বাড়ির মালিক তাদের অপেক্ষায় ছিলো। এই মাসের ভাড়ার জন্য তিনি অনেক চেঁচামেচি করছেন। তার উপর সীমান্তের মামলা আছে জানার পর থেকে তাদের এই বাসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য খুব জোর করছেন। সীমান্ত কয়েকদিন সময় চায় তার কাছে।
বিপদ আসলে একদম চারদিক থেকে সব একসাথেই আসে। এদিকে শুভ্রা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে, তার উপর সংসারের চাপ, সবকিছু মিলেমিশে সীমান্ত পাগল প্রায়৷ শেষমেশ সেলসম্যানের একটা জব নেয় সে। কিন্তু যে স্যালারি পাবে তা দিয়ে শুধু ক্ষুধা মেটানোর উপায় আছে। শিশিরের স্কুলের খরচ সহ বাকী প্রয়োজন মেটাতে হলে তাদের রাস্তায় থাকতে হবে।
শহরের নিম্ন মানের ঘরগুলোর আজকাল ভাড়া বেশি। আর পরিবেশও ভালো না। অসুস্থ পরিবেশে বাচ্চা দুটিকে বড়ো করতে চায় না সীমান্ত। এই মুহূর্তে মাথার উপর একটা ছাদ লাগবে তার। বাড়ির মালিক থেকে এক সপ্তাহ সময় নিয়েছে৷ বাসা না পেলে শুভ্রা আর বাচ্চা দুটিকে রোকেয়া হোসেনের কাছে রেখে, সে রাস্তায় থাকার একটা চিন্তাভাবনা করে ফেললো। যেহেতু রোকেয়া হোসেন তার বোনের সাথে থাকেন তাই সেখানে সীমান্ত উঠতে পারবে না। এতোগুলো মানুষ থাকার মতো জায়গা ওই বাসায় নেই।
সিগারেট খাওয়ার মতো টাকাও নেই পকেটে এখন। অনেক ক্লান্ত লাগছে তার। বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূর এসে গেছে। আশেপাশে ঘন বসতি নেই। দুই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে শিশিরের স্কুল অনেক দূর হয়ে যাবে। তাই অন্য জায়গায় খুঁজার জন্য মনঃস্থির করলো। চলে আসার সময় এক বৃদ্ধ লোকের সাথে দেখা।
সীমান্তকে দেখে তিনি বললেন,
বৃদ্ধ লোক: তোমাকে তো চিনলাম না বাবা? কোন বাড়িতে এসেছো তুমি?
সীমান্ত: আমি কোনো বাড়িতে আসি নি। বাসা খুঁজতে এসেছি এদিকে।
বৃদ্ধ লোক: এখানে তো কোনো খালি বাসা নেই। ওই দেখছো বাড়িটি, আমি ওই বাড়ির দারোয়ান। বহু বছর ধরে আছি এই এলাকায়। এখানে সহজে কোনো বাসা খালি হয় না৷ আর খালি হলেও সহজে ভাড়া হয় না।
সীমান্ত: ওহ, আমার আসলে একটা বাসা খুব দরকার ছিলো। ফ্যামিলি বাসা, কম দামের।
বৃদ্ধ লোক: আর্থিক সংকটে আছো?
সীমান্ত: হ্যাঁ।
সীমান্ত তার অভাবের কথা খুলে বললো। সবশুনে বৃদ্ধ লোকটি খানিক্ষন চুপ করে থাকলেন৷
তারপর বললেন,
বৃদ্ধ লোক: আমি তোমায় একটি বাড়ির সন্ধান দিতে পারি। ওই বাড়ির কোনো মালিক নেই। পরিত্যক্ত পড়ে আছে বহুবছর ধরে। ওই বাড়িতে তুমি পরিবার নিয়ে উঠতে পারো।
সীমান্ত: ভাড়া?
বৃদ্ধ লোক: কাকে দেবে ভাড়া? ওই বাড়ির তো কোনো মালিক নেই।
সীমান্তের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কথাটি শুনে। কয়েকমাস এইখানে থেকে আবার কিছুটা স্বচ্ছল হওয়ার পর নতুন বাসা নিবে এই পরিকল্পনা করে ফেললো সে।
সীমান্ত: আমায় নিয়ে যাবেন সেই বাড়িতে?
বৃদ্ধ লোকটি সীমান্তকে নিয়ে আসলো বাড়িটিতে। বাড়িটি সীমান্তের খুব পছন্দ হলো।
বৃদ্ধ লোকটি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
বৃদ্ধ লোক: কিন্তু একটা সমস্যা আছে। এই বাড়ির ইতিহাস খুব খারাপ।
সীমান্ত: মানে। কেমন খারাপ?
বৃদ্ধ লোক: এই বাড়িটি জমিদারদের বাড়ি ছিলো। তাদের পূর্ব পুরুষ থেকে শেষ বংশ এই বাড়িতেই ছিলো। অনেক বছর আগের ঘটনা, এক রাতে এই বাড়ির সবাইকে খুন করা হয়। কে এই খুন করেছে জানা যায় নি। সপরিবারে খুন হয়েছিলো তারা। তাদের পক্ষে কেউ ছিল না যে তাদের মৃত্যুর রহস্য বের করবে। যেদিন খুন হয় সেদিন এই বাড়ির মালিকের বড়ো নাতনির মেহেদী রাত ছিলো। বাড়ি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিলো। বাড়ি ভর্তি মেহমান ছিলো। সব হাসি খুশি প্রাণ সেই রাতেই শেষ হয়ে যায়। শুনেছি একজন ছাড়া বাকীদের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো। সামনে এক কবরস্থানে সবাইকে দাফন করা হয়। সেই থেকে এই বাড়ি বন্ধ। কেউ থাকতে আসে নি। সাহস করে কেউ কিনতেও আসে নি।
সীমান্ত: কোনো খারাপ কিছু ঘটে নি তো?
বৃদ্ধ লোক: এমন তো কিছু ঘটে নি বাবা। আমি শুনি নি। আসলে এদিকে কেউ আসে না। তাই জানা হয় নি।
সীমান্ত: চাচা, আমার আসলেই একটা বাড়ি দরকার এই মুহূর্তে। আর মাত্র তো কয়েকমাস থাকলেই চলবে আমার। আমার বাড়ি পছন্দ হয়েছে। আপনি কি লোক ডেকে ভেতরে পরিষ্কার করিয়ে দেবেন?
বৃদ্ধ লোক: কেন নয়, অবশ্যই দেবো।
সীমান্ত বৃদ্ধ লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলো৷ লোকটি সীমান্তের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। সীমান্তকে যতোদূর দেখা যায় ততোদূর তিনি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। সে চলে যাওয়ার পর বাড়িটির দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন,
বৃদ্ধ লোক: কিছু কথা গোপন করেছি দাদা, তোমার মায়া ফিরিয়ে দিতে।
চলবে–
(বি:দ্র- গল্পটি পুরোটাই কাল্পনিক।)