#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৩
আমার বোনটাকে কি আপনার ঘরের পুত্রবধু হিসেবে নিবেন মজিদ চাচা?
চমকে উঠলো মজিদ হাওলাদার। নিজেকে আরেকবার ধাতস্থ করে সুজন মির্জার দিকে তাকালেন।এ যেন ভাগ্য আজ নিরুপায় হয়ে তার সামনে ধরা পড়েছে।কাঞ্চনাকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে আনা মানেই ঘরে লক্ষীর ঘট তোলা।মজিদকে নিরব দেখে পুনরায় সুজন বললো।
চাচা,আমার কাঞ্চনা শ্যামকালো।যদি এই গায়ের রঙের জন্য ওকে আপনি বা আপনার ছেলে পছন্দ না করেন তাহলে বলে দিবেন।অন্য জায়গা থেকেও কাঞ্চনার সম্বন্ধ আসে,সেখানেই বিয়ে দিবো। তাতে যা লাগে।
মজিদ হাওলাদার আমতাআমতা করে বলেই ফেললেন-
গায়ের রঙ না বাবাজি।তুমি তো জানো চারুর অবস্থা।চারদিকে ধার -দেনায় ভইরা গেছে।এই অবস্থায় আরো একজনের দায়িত্ব নেওয়া তো কঠিন হইয়া পড়বে।আর পোলাডাও তো বেকার।
মুখে আলতো হাসি ফুটিয়ে সুজন বলল-
চাচা এটা তো কোনো সমস্যাই না।আপনাদের যা লাগে আমি সব দেবো।এইসব নিয়া আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।তবে একটা অনুরোধ,কাঞ্চনা যেন জানে না।
চোখ চকচক করে উঠলো মজিদ হাওলাদারের।সুজনের হাত ধরে উত্তেজিত হয়ে বললেন-
নানা,এই সব চিন্তা করার কোনো দরকার নাই তোমার।আর আমিও চাই দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার টা তোমার আর আমার মধ্যে থাকলেই ভালো হয়।
আমি কালকেই তোমারে পাকা কথা জানামু।
কথা শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন সুজন হাওলাদার।মুখে মুচকি হাসি নিয়ে ভাবছেন-
যদিও এই বিয়েটা টাকার জন্য হবে।তবুও হোক না।বোনটা তো তার একটু সুখ পাবে।তাছাড়া হয়তো চারদিকের ধার-দেনায় মজিদ হাওলাদার একটু টাকার প্রতি লোভীই হয়ে গেছে।
দুপুরবেলা,চারুলতার পাশে বসেই মজিদ আর সেলিন দুপুরের খাবার খাচ্ছে।খাবার মাঝখানে মজিদ হাওলাদার বললেন-
সেলিম,আমি একটা সিদ্ধান্ত নিছি।আশা করি তুমি না করবা না।আমাগো সবার ভালোই হইবো এইটা হইলে।
চমকে উঠলো সেলিম।ভাত চিবুতে চিবুতে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো-
কি সিদ্ধান্ত আব্বা?
তোমার বিয়ের।
বলামাত্রই অবাক হয়ে তাকালো সেলিম।ভাত দলা হাত থেকে প্লেটে রেখে বাবার উদ্দেশ্যে বললো-
তুমি কি পাগল হইছো?এই সব কেমন ধরনের কথা।চারদিকে ধার-দেনায় ডুবু-ডুবু অবস্থা আর তুমি বিয়ের কথা বলতেছো।এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার উপর আবার আরেকজন।
থেমে,
আব্বা, আমি বিসিএসের প্রস্তুতি নিতেছি তুমি তো জানোই।দয়া করে এর ভেতর আর কোনো ঝামেলা ঢুকাইয়ো না।
নড়ে চড়ে উঠলেন চারুলতা।মা বসতে চাইছে দেখে দুহাত দিয়ে আলগোছে বালিশে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল সেলিম।চারু এক হাত তুলে সেলিমের মাথায় রেখে বললো-
ও আব্বা,তুই তো সারাদিন বাইরে থাকিস।তোর বাপেও দোকানে।আমার আর একা একা ভালো লাগে না।কাঞ্চন মা আইসা সারাদিন আমার কাছে বইসা থাকে।সারাদিন সেবা-যত্ন করে।খুব ভালো মাইয়াডা।তুই বিয়াডা কইরা নে আব্বা।
চমকে উঠলো সেলিম।তাহলে কাঞ্চনার সাথে তার বিয়ের কথা হচ্ছে।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
মা,তুমি তো তোমার ছেলের জন্য পরীর মতো বউ আনতে চাইতা।তাহলে এখন কাঞ্চনাকে বিয়ে কেন করাতে চাইছো।
আব্বা,আমি জানি তুই কাঞ্চন কালা দেইখা বিয়া করবি না।কিন্তু বাপ,আইজ তুই ধলা চামড়া দেইখা বিয়া করবি,হেই মাইয়া কাইল আইয়াই আমারে দেইখা নাক ছিটাইবো,ঘেন্না করবো আমারে।ও বাবা,এমনেও তো আর কয়দিন বাচমু।তুই কাঞ্চনরে বিয়া কর।মায় আর কিচ্ছু চাইবো না তোর ধারে।
খাবার রেখে উঠে গেল সেলিম।আর খাওয়ার মতো রুচি নেই তার।হাত ধুয়ে নিজের ঘরে বিছানায় শুলো।বিয়ে তো আজ না হয় কাল করতেই হবে।তাই বলে একটা কালো মেয়েকে।সকলেই সৌন্দর্য খোজে।আবার মায়ের কথাই ফেলা যায় না।সত্যিই তো যদি সুন্দরী বউ ঘরে আনে তারপরে সে যদি মাকে অবজ্ঞা করে তাহলে কি করবে সে।কাঞ্চনা আর যাই হোক,মাকে যে খুব ভালোবাসবে সে বিষয়ে নিশ্চিত সেলিম।সারারাত ভেবে চিনতে মায়ের একজব সংগী আনার জন্য বিয়েতে রাজি হয়ে গেল সেলিম।
বেশ ঘরোয়া ভাবেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো।তবে অনানুষ্ঠানিক ভাবেই সবার থেকে লুকিয়ে মজিদ হাওলাদার সুজন মির্জার কাছ থেকে পাচ লাখ টাকা আদায় করলেন সে বিষয়ে না কাঞ্চনা জানে আর নাতো সেলিম।সুজন ও হাসিমুখে বোনের জন্য সামান্য টাকা গুলো দিয়ে দিলো।কবুল বলার পরপরই বউ নিয়ে আসা হলো হাওলাদার বাড়িতে।সামান্য কিছু আত্নীয়-স্বজন এনে ঘরোয়া ভাবে বউভাতের আয়োজন করলো মজিদ হাওলাদার।
রাত সাড়ে দশটা।অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধুমাত্র নিয়ম পালনের জন্য বাসর ঘরে প্রবেশ করল সেলিম।দামী শাড়ি-গহনা পড়ে টিনের চালার নিচে সস্তা খাটের মাঝখানে বসে আছে কাঞ্চনা।ধীর পায়ে হেটে গিয়ে বসলো কাঞ্চনার পাশে।ভীষন অসস্তি লাগছে তার।তারপরেও কন্ঠে গম্ভীরতা এনে জিজ্ঞেস করলো-
ওই রাজকীয় বাড়িঘর ছেড়ে এই টিনের চালায় আসা টা কি খুব জরুরী ছিলো।আদোও কি রাজী ছিলে তুমি?নাকি জোর করা হয়েছে।
কাঞ্চনা মাথার ঘোমটা ফেললো।সেলিমের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি উত্তর দিলো।
আমার কোনো বিষয়ে কখনো কেউ জোর খাটাতে পারেনি।ভাগ্যে ছিলো প্রাসাদে জন্মে টিনের চালায় থাকতে হবে।তাই বিয়ে হয়েছে আপনার সাথে।
দমে গেল সেলিম।এই মেয়ের যে সবার আগে মুখ চলে সেটা আগে পাড়া-প্রতিবেশীর থেকে শুনলেও আজ সরাসরি শুনলো।নিজেকে ধাতস্থ করে বললো-
এই মুহুর্তে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিলো না।মা একা বাড়িতে থাকে,সে জন্যই বিশেষ করে তোমায় বিয়ে করা।তাছাড়া মাও চায় এটাই।আশা করি, মায়ের কোনো অবহেলা করবে না।আর এখানে অনেক আত্নীয়-স্বজন আছে,তাই কারো মুখের উপর জবাব না দেওয়াটাই শ্রেয় যদি আমার অসম্মান টা না চাও।
মুখে ভেংচি দিলো কাঞ্চনা।তবে সেটা সেলিমের অগোচরে।গায়ের গহনা গুলো খুলে হাতে নিয়ে সেলিমের টেবিলে রাখলো।ফিরে আসতেই দেখলো সেলিম কপালের উপর হাত রেখে শুয়ে পড়েছে।ভ্রু কুচকে সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
আমার গায়ের রঙ নিয়ে কি আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে?
চটান করে হাত সরিয়ে কাঞ্চনার দিকে চাইলো সেলিম।কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বললো-
যদি সমস্যা থাকতো তাহলে সেটা বিয়ের আগেই বলতাম।বিয়েটা হুট করে হলেও আশা করি নিজেদের ব্যাক্তিগত রিলেশনটা হুট করে না হওয়াই ভালো।শুয়ে পড়,সময় দিলাম তোমায়।এই বাড়িতে থাকতে যদি কোনো অসুবিধা হয় তাহলে যথাশীঘ্রই বলবে।
মুখ খুলে উত্তরটা বলার আগেই সেলিম পুনরায় ধমক মারলো।বলল-
কথা বলতে বলে নি।চুপ করে ঘুমিয়ে পড়।যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে কাল সকালে বলো।
কাঞ্চনা আর টু শব্দটিও করলো না।সেলিমের ডানপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।প্রায় আধ-ঘন্টা যাবৎ বিছানায় এপার-ওপার করে শেষে উঠে বসলো সেলিম।ঘরটায় মেয়েলি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।যেটা তার সহ্যশক্তি কে ক্ষণে ক্ষণে কমিয়ে তুলছে।শেষে বাধ্য হয়ে উঠে গেল পড়ার টেবিলে।বই খুলে নির্ধিদায় পড়তে লাগলো। একসময় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো।
___________
___________
সকাল সাতটা।ঘুম থেকে উঠে হাত -মুখ ধোয়ার জন্য পিছনের পুকুরপাড়ে গেল কাঞ্চনা।খেজুর গাছের ঘাট।তার উপর জমে আছে সবুজ শেওলা যা ঘাটকে আরাও পিচ্ছিল করে তুলেছে।অনভ্যস্ত কাঞ্চনা বেশ সাহস করেই নামলো ঘাটে মুখ ধুতে।কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না।উঠতে গিয়েই ঠাস করে উলটো হয়ে পড়ে গেল পুকুরের মধ্যে।ধড়াস করে পড়ার আওয়াজ হতেই পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সেলিমের চাচি।মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগলো-
আয়-হায় হায়।এই ভর-দুপুরে উঠছো গোসল করতে। আমগো সময় তো রাইত চারটার আগে গোসল করতাম। তোমাগো লজ্জাসরম ও নাই।কি জমানা আইলো।সকাল সকাল ফরজ গোসলটাও সবাইরে দেখাইয়া করতে হবে।
মাথা ফাকা হয়ে গেল কাঞ্চনার।প্রথমে কথার আগা-মাথা না বুঝলেও শেষে কথার ইংগিত ধরতে পেরেছে সে।কিছু বলার আগেই পিছন থেকে শুনলো-
তুমি ঘাটে নামলে কেন?পানির দরকার হলে আমাকেই বলতে পারতে।
চমকে পিছনে তাকালো কাঞ্চনা।সেলিম ঘাটে নামছে।শেষ খোপে পা দিয়ে হাত বাড়ালো কাঞ্চনার দিকে।একবার চাচী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে সেলিমের হাত ধরলো।ঘাট থেকে উপরে উঠতেই হাটুর ছিলে যাওয়া অংশটা ব্যাথায় চিনচিন করে উঠলো।চোখটা পানিতে টলমল করছে। সেলিম এক দিয়ে ওর হাত ধরে গোসলখানায় নিয়ে এলো।স্বভাবতই গোসল করে এখানে পালটায় মহিলারা।
কাঞ্চনাকে রেখে দ্রুতপায়ে ঘরে প্রবেশ করলো।ব্যাগের মধ্য থেকে থ্রিপিস এনে কাঞ্চনার হাত দিলো।
পালটানো শেষ হলে পুনরায় হাত ধরে ঘরে আনলো।বিছানায় বসিয়ে মায়ের ঘর থেকে বায়োডিজেল আর তুলা আনলো।ছিলে যাওয়া অংশটা মুছে দিয়ে বললো।
ঘাটে নামার কোনো দরকার নেই।আমি বালতিতে পানি ভরে দিয়ে যাচ্ছি।আর একটু পরেই বাড়ির অতিথিরা চলে যাবে।তাদের সাথে তোমার কোনোরকম কথা বলার দরকার নেই।কিছু জিজ্ঞেস করলে ব্যাস সেটারই উত্তর দেবে।এখন এখানেই বসে থাকো।
খালা নাস্তা করছেন।পুকুর থেকে পানি তুলে তাড়াহুড়ো করে নাস্তা করলো সেলিম।তারপর কাঞ্চনার জন্য নাস্তা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলো।টেবিলের উপর নাস্তা রেখে বললো-
আমি টিউশনিতে যাচ্ছি।নাস্তাটা খেয়ে নিও।
কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।সেলিম যাওয়ার পর নাস্তা হাতে শাশুড়ির ঘরে ঢুকলো কাঞ্চনা।তার পাশে বসে গল্প পড়ছে আর অল্প কিছু নুডুলস হাত দিয়ে ডলে নরম করে মুখে তুলে দিচ্ছে চারুর।
প্রতিদিন বাপ-ছেলে কাজে যাওয়ার আগেই রান্না করে তারপর বের হয়।কিন্তু আজ আর তেমন হলো না।বেলা দশটা বাজতেই বাজার ভর্তি ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো মজিদ।বাড়িতে শুধুমাত্র কাঞ্চনা আর চারুর বোন অরু রয়ে গেছে।অরুর হাত ব্যাগ দিয়ে কাঞ্চনার সাথে হাসিমুখে দুটো কথা বলেই দোকানে গেলেন মজিদ।
প্রায় তিন কেজি ওজনের একটা ইলিশ মাছ এনেছে মজিদ।শুনেই চারুর চোখ ছলছল করে উঠলো।মুখে ঘায়ের কারনে ঝাল খেতে পারে না সে।কাঞ্চনাকে ইলিশ মাছ খাওয়ার কথা বলতেই সে শাশুড়ির জন্য আলাদা ভাবে দু টুকরো মাছা ঝাল ছাড়া রান্না করলো।
দুপুর বেলা,সবাই মিলে চারুর ঘরে বসেই খাবার খাচ্ছে।কাঞ্চনা চারুকে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছে।তার সেবা যত্ন দেখে বেশ খুশী হলো সেলিম।খাবার শেষে ঘরে আসলো বিশ্রাম নিতে।কাঞ্চনাও আসলো।আজ সারাদিন খুব খাটনি পড়েছে তার উপর।বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমেরা হানা দিলো চোখে।
হঠাৎ চিৎকার-চেচামেচির শব্দ শুনতেই লাফ দিয়ে উঠলো।চারুর ঘর থেকে আওয়াজ আসছে।ওড়না গায়ে মাথায় জড়িয়ে দ্রুতপায়ে সেদিকে চললো।
গিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল সে।চারুর চোখ উলটে আসছে।মুখ দিয়ে ঘড়-ঘড় আওয়াজ আসছে।সেলিমের চোখ পানিতে টলমল করছে।মা মা বলে চিৎকার করছে আর কতক্ষণ পর পর মুখে চা চামচ দিয়ে পানি দিচ্ছে।কিন্তু সে পানি মুখ বেয়ে গালে গড়িয়ে পড়ছে।প্রায় বেশ কতক্ষণ এমনটা করতেই হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল চারুলতা।
চলবে?