মন পিঞ্জর পর্ব ৩

0
1134

#মন_পিঞ্জর
#লেখিকাঃআরোহী_নুর
#পর্বঃ০৩

খাওয়ার টেবিলে এসে বসলো আয়ান,পাশেই মাহি বসে আছে,একটা চাকরানী খাবার বেঁড়ে দিতে ব্যাস্ত,এদিকে চারিদিকে চোখ আটিয়ে চাকরানীকে উদ্দেশ্য করে বললো আয়ান।

রহিমা খালা মা আর আয়েশা কোথায়,উনাদের দেখছি না কেনো?

স্যার আমি উনাদের ডেকেছি উনারা বললেন উনাদের এখন খিদে নেই খাবেন না,খিদে লাগলে না কি খেয়ে নিবেন।

এটা কেমন কথা,মা খাবার অনিয়ম শুরু করলো না কি?মাকে নিয়ে আর পারি না,উনি জানেন যে সময়মতো খাবার খেয়ে ওষুধ না খেলে উনার শরীর খারাপ করবে তাও এমন কেনো করছেন?তুমি বসো মাহি আমি বরং মাকে আর আয়শাকে ডেকে নিয়ে আসি,কথাটা বলে আয়ান চলে যেতে নিলে মাহি ওর হাত ধরে ওকে যেতে বাঁধা দিয়ে বলতে লাগলো।

দেখো আয়ান মা তো আর ছোটো বাচ্চা না যে নিজের ভালোটা বুঝবেন না,হয়তো ইচ্ছে করছে না তাই খাচ্ছেন না,খিদে পেলে খেয়ে নিবেন,তুমি শুধু শুধু নিজের সময় কেনো নষ্ট করছো,তোমার মনে নেই খাবার শেষ করে আমাদের বাবার বাড়ির উদ্দেশ্য বেরুতে হবে সবাই আমাদের জন্য কখন থেকে যেনো অপেক্ষা করে বসে আছেন।
কথাটার উত্তরে আয়ান কিছু বলবে এর আগেই চাকরানী মানে রহিমা খালা বললেন।

উনি ঠিক বলছেন স্যার আপনার মিরা আপাকে নিয়ে চিন্তা করা ঠিক না,উনার খিদে লাগলে উনিতো নিজেই খেয়ে নিবেন,এখনতো আর আঁখিমা নেই যে না খেয়ে আগে উনাকে টেনেধরে খাইয়ে দিবে, উনার দেখাশুনা করবে,এখন যে উনার নিজেকে নিজেরই সামলাতে হবে,আপনি বরং খেয়ে মাহি ম্যাডামের সাথে চলে যান।

কথাটা কর্নপাত হতেই মাহির মেজাজ বিগড়ে গেলো,ওর সামনে চাকরানী আঁখির প্রশংসা করছে মানে ওকে ঠেস দিয়ে কথা বলছে,এটা রহিমা খালার মনোভাব আদোও না থাকলেও তাই মনে মনে ধরে নিলো মাহি আর উঠেই ঠাস করে রহিমা খালার গালে কড়া একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো, যাতে রহিমা খালা মুখ থুবড়ে ফ্লোরে পড়ে গেলেন,এহেন কান্ডে হতবাক হলো আয়ান,এদিকে মাহি চেঁচিয়ে বলতে লাগলো।

ছুটোলোক কোথাকার তোর সাহস কি করে হলো আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলার,তাও আমাকে নাম ধরে ডাকিস,আমি মাহি ম্যাডাম না অনলি ম্যাডাম,আমার পায়ের ধুুলোর সমানও মুল্য হবে না তোর আর তেজ দেখাস কোটি টাকার।
এতোক্ষণ রহিমা খালার চুল মুঠো করে ধরে কথাগুলো বলে উনাকে আবারও ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো মাহি,আয়ান হতবাক হয়ে ছুঁটে গিয়ে উঠালো খালাকে,মাহি এখনও শান্ত হয় নি,আবারও বললো।

চলে যা ছুটোলোক,আমি যেনো তোর ওই অলুক্ষুনে মুখটা আর না দেখি।

আপনি না বললেও চলে যেতাম ম্যাডাম,আঁখি মা ছাড়া যে এ ঘরটা ঘর না বন্ধ কুটির মনে হয়,থাকবো না কাল রাতেই ভেবে নিয়েছিলাম আর এখনতো চলে যাওয়ার অনুমতিও পেয়ে গেলাম,হোকনা সেটা অপমানের সহিত,চলি সাহেব,ভালো থাকবেন আপনি,আর পারলে মিরা আপা আর আয়েশার খেয়াল রাখবেন।

কথাটা বলে কাঁদতে কাঁদতে বাইরের দিকে ছুঁটে চলে গেলেন রহিমা খালা,আয়ান এবার অনেকটা ক্ষেপে গেলো,চোখদুটো রক্তবর্ণ করে তেজি গলায় বলতে লাগলো।

এটা কি করলে মাহি তুমি,রহিমা খালাকে এভাবে তাড়িয়ে দিতে পারলে?উনি আজ প্রায় ২৫ বছর ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করেন,সেই ছোট থেকেই দেখে আসছি উনাকে,উনি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন আয়শা আর আমাকে,আর আজ তুমি উনার সাথে এমনটা করতে পারলে।

আয়ান তুমি আমাকে শ্বাশাচ্ছো?তুমি দেখলে না ওই চাকরানীটা আমাকে কেমন ঠেস দিয়ে কথা বলছিলো,ওই বজ্জাতনিটা আমাকে তোমার সামনে অপমান করলো আর তুমি কিছুই বললে না বরং এবার আমাকেই রাগ দেখাচ্ছো।

উনি তোমাকে ঠেস দিলেন কোথায়?উনি তো শুধু সহজ ভাষায় এটাই বললেন যে আঁখি মায়ের খেয়াল রাখতো,এবার আঁখি নেই তাই মাকে নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে হবে,আর এটা তো সত্য কথাই বলেছেন উনি।

তুমিও ওই আঁকির পক্ষপাতিত্ব করতে পারলে আয়ান?তুমি পারলে আমাকে এভাবে অপমান করতে?আমি কখনো ভাবি নি তুমি এভাবে আঁখির সাথে আমার তুলনা করবে।তুমিতো আমায় ভালোই বাসো না,যদি ভাসতে তবে বারবার ওই আঁখির প্রশংসা করতে না,আমার তো মনে হয় তুমি আমার বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাবে না বলে এমনটা ইচ্ছে করেই করলে,এবার খুশিতো আমায় কাঁদিয়ে, আমার মা বাবা কতো অধির আগ্রহে আমাদের পথ চেয়ে বসে আছেন আর তুমি এমনটা করলে,আমি আর কোথাও যাবো না।

কথাগুলো বলে ন্যাকাকান্না করতে করতে রুমের দিকে ছুঁটলো মাহি,আয়ান কয়েকবার ওকে পিছন থেকে ডাকলেও ওর ডাকে কোনো সাড়া দিলো না মাহি।

‌_________________

ডাক্তারের কেবিনে বসে আছে আঁখি।

কি হয়েছে ডাক্তার আপনি আমাকে হঠাৎ ডাকালেন?

আঁখি তুমি যে সেদিন কিছু টেস্ট করিয়ে গেছিলে সেগুলোর রিপোর্ট চলে এসেছে।

হুম ডাক্তার বলেন কি এসেছে রিপোর্টে?
ডাক্তার এবার গম্ভীর কন্ঠে বললেন।

তোমার সাথে কি তোমার কোনো পরিবারের সদস্য আসেন নি?আসলে এমন বিষয় আমরা রোগীর সাথে সামনাসামনি ডিসকাস করি না।

ডাক্তার আসলে আমার পরিবারের কেউ নেই,এখন আমি একা,আপনার যা বলার আমাকেই বলেন।
কথাটা কর্নপাত হতেই ডাক্তার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করে বিষয়টা আঁখিকে বলতে প্রস্তুত হলেন,রিপোর্টগুলো আঁখির দিকে এগিয়ে দিলেন আর তারপর সবকিছু খুলে বললেন,ডাক্তারের কথাগুলো কর্নপাত হতেই এক নিমিষেই থমকে গেলো আঁখির পৃথিবী,তবে কি এটারই কমতি ছিলো আঁখির জীবনে,আঁখির অধরজোড়া যেনো তখন কিছু বলার অবস্থায় ছিলো না,কানগুলোও যেনো কিছুক্ষণের জন্য বধিরতার ছোঁয়া পেলো,কঠোর এই সত্যটাকেও কি আঁখির এবার মেনে নিতে হবে,আঁখির অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে এবার ডাক্তার বললেন।

দেখেন মিসেস আনাহিতা তাবাসসুম রাহমান আঁখি এজন্যই আমি আপনাকে ডিরেক্ট কথাটি বলতে চাই নি,কথাটি আপনার মস্তিষ্কে প্রচন্ড প্রভাব ফেলেছে বুঝতে পারছি,এতে যে আপনার অনেক ক্ষতি হতে পারে।

এবার আঁখি ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুঁটিয়ে বললো।

ক্ষতি,হা হা।ক্ষতির আর কি বাকি আছে ডাক্তার,হয়তো এটারই জীবনে কমতি ছিলো তা পূর্নতা পেয়ে গেছে আজ,এটা নিয়ে আবার কি প্রেসার পড়বে আমার মস্তিষ্কে।

আপনাকে পুরো চিন্তামুক্ত থাকতে হবে এখন সবসময়,একটু চিন্তা আপনার জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে,আপনাকে সময়মতো ওষুধ সেবন করতে হবে আর হ্যাঁ নিয়মিত চেকআপ এর জন্য আসতে হবে,আপনি পারলে নিজের কোনো আপনজনকে কালকে একবার আমার কাছে নিয়ে আসবেন,উনাকেই আমি আপনার খেয়াল রাখার বিষয়টা বুঝিয়ো বললো।

আঁখি আবারও ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসিটা ঝুলিয়ে বললো।

আপনজন,আসলে আপনজন বলতে আর কেউ নেই ডাক্তার আমার,আঁখির জীবন চলার পথে যে ও এখন একদম একা,এই সংগ্রামটাও যে আঁখিকে একাই লড়তে হবে,তবে আপনি চিন্তা করবেন না ডাক্তার আমি নিয়মিত চেকআপ করাতে আসবো,আর হ্যাঁ যাবার আগে আরেকটা কথা বলি ডাক্তার,আমি মিসেস আনাহিতা তাবাসসুম রাহমান আঁখি না শুরু আনাহিতা তাবাসসুম আঁখি,জিনিসটা খেয়াল করবেন সামনে থেকে আশা করছি। তবে চলি ডাক্তার, ধন্যবাদ আপনাকে।

রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো আঁখি,একটা অটোর দরজার পাশে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে আঁখি,গাড়িটাও চলছে আপন গতিতে,আশপাশের পরিবেশটা যে ছুঁটছে মন মতো,চারপাশেই কতো হৈ হুল্লোড়, কতো শব্দ কতো আওয়াজ,শুরু নিঃশব্দ আঁখির মন পিঞ্জর খানা,কতো কঠিন হয়ে থাকে মেয়েদের জীবন,আসলেই কি মেয়েদের কোনো নিজস্ব পরিচয় নেই,বিয়ের আগে মেয়েদের নামের সাথে বাবার নামটা জুড়ে দেওয়া হয় আর বিয়ের পড়ে সেই জায়গায় চলে আসে স্বামীর নাম,আর স্বামীর নামটাও যখন চলে যায় তখন আর লোক ওই মেয়েটাকে ভালো নজরে দেখতে নারায হয়,তবে কেনো এমনটা ঘটে?মেয়েরা কি আদোও পারে না নিজের পরিচয়ে বাঁচতে?পারে না নিজেদের একটা আলাদা পৃথিবী গড়ে নিতে?কেনো নির্মম হয় ভাগ্যের এই পরিহাসটা,কেনো যার কিছুই থাকে না তার কাছ থেকেই সবাই সব কেঁড়ে নিতে চায়,তবে কি আঁখির জীবনটাও শুধু সব বিলিয়ে দেওয়াতে ব্যার্থ হতে চললো।কি দোষ ছিলো আঁখির যে ওর সাথেই এমনটা ঘটতে হলো,এমন সীমাহীন ভাবনাধারার অবসান ঘটানোর আগেই আঁখি পৌঁছে যায় নিজের গন্তব্যে।

__________________

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে চুল আঁকড়াচ্ছিলো মাহি,তখনি আয়ান এসে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।

কি আমার বেবিটা রাগ করেছে বুঝি?

আয়ানের আহ্লাদী এই কথাটার কোনো উত্তর দিলো না মাহি,মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে দাঁড়িয়ে নিজের কাজেই ব্যস্ততা দেখালো আয়ানকে,আজ যে উনি নিজের প্রাণের স্বামীর সাথে অভিমান করে আছেন,কথাও বলবেন না মনে মনে এটে রেখেছেন,এদিকে সুন্দরী বউয়ের রাগ না ভাঙিয়ে শান্ত হবে না যে সেই নরের অশান্ত মন খানা,সুন্দরী রমণীর উত্তর না পেয়ে খচ করে উঠলো নরের বুকের মাঝখানটা,এবার পকেটে হাত ঢুকিয়েই কিছু একটা বের করলো,তারপর ওটা নিজের সুন্দরী রমনীর গলায় পড়াতে পড়াতে বললো।

এটা দেখার পর মনে হয় না আমার বেবিটা আমার সাথে আর রাগ করে থাকতে পারবে।
সত্যিই যে এটাই হলো,স্বর্ণের সে হারটা দেখেই চোখগুলো যেনো বেড়িয়ে আসার উপক্রম হলো সেই রমনীর,নিমিষেই ভুলে গেলো সব রাগ,পিছন ফিরে গিয়ে বাহুডরে আবদ্ধ করলো নিজের নরকে।

কি পছন্দ হয়েছে?

হুম খুব সুন্দর।

হুম এবার আর সুন্দর মুখখানাতে মলিনতা টাঙিয়ে না রেখে ঝটফট রেডি হয়ে নাও আমি যে আবার শ্বশুরবাড়িতে যাবার তস সইতে পারছি না।

তুমিও না পারো বটে,হু হু।আমি তো রেডি হয়েই আছি,তুমি জলদি রেডি হয়ে আসো গিয়ে।যাও
__________

রাত প্রায় ২ টা,পারটাইম জবটা করে বাড়ি ফিরছিলো আঁখি,রাস্তাগুলো পুরো ফাঁকা,কোথাও কোনো যানজট নেই,একা রাস্তায় হাঁটছে আঁখি,জবে জয়েন করার আগেই যে অনেকগুলো এডভান্স নিয়ে নিয়েছিলো আঁখি যেগুলো মেডিক্যাল ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য খরচ করে দিয়েছে তাই আজ আর চেয়েও কোনো টাকা পেলো না অফিস থেকে,কোথা থেকে বাড়ির মালিকের টাকা দিবে এটাই ভাবনাতে ঘুরাচ্ছে আর গুটিশুটি পায়ে হাঁটছে আঁখি,হঠাৎই খেয়াল করতে সক্ষম হলো তিনটে লোক ওর পথ আগলেছে,আঁখির বুজতে সমস্যা হলো না ওগুলা বাজে লোক,ওদের চোখগুলো যে হায়েনার মতো আঁখিকে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখতে ব্যাস্ত,আঁখি পালাবে তার আগেই তিনজন সার্কেল করে ওর চারপাশে ঘুরতে লাগলো,আঁখি ভয় পেয়ে গেছে তবুও তার বহিঃপ্রকাশ হতে দিলো না মুখে,স্কুলের এক সময়ের কারাতে চ্যাম্পিয়ান আঁখি,তাছাড়া স্কুলের বাইরেও আঁখি কারাতে ট্রেনিং করেছে তাই মনে সাহস জুটিয়ে নিজের জানা কৌশল দিয়ে কোনোরকমে লোকতিনটার কবল থেকে বেড়িয়ে ছুঁটতে লাগলো,লোকগুলোও ওর পিছু ছাড়ছে না,আজকে যেনো ওকে ছিঁড়ে খাওয়া না অব্দি শান্তি হবে না এদের,আঁখি দৌঁড়াতে গিয়েও এখন আর পেরে উঠছে না,কেনো যেনো চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হতে শুরু করেছে,পৃথিবীটা যেনো ওর আশেপাশে ঘুড়তে শুরু করলো,শত চেয়েও নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারলো না,জ্ঞান নেই নেই অবস্থায় বুঝতে পারলো এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত ওকে ধরে নিয়েছে,হাতগুলো যেনো ওর চিরচেনা,কিন্তু তাও ঠিক অনুমান করার বা সেই বলিষ্ঠ হাতজোড়ার মালিককে দেখার ক্ষমতা হয়ে উঠলো না আঁখির,নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেলো।

পিটপিট করে চোখ খুললো আঁখি,নিজেকে একটা কেবিনে আবিষ্কার করলো,চোখ ঘুড়াতেই দেখতে পেলো পাশের চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়ান চোখ বুঝে শুয়ে পড়ে আছে,খনিকে মনে পড়লো আঁখির সে সময়ের ঘটনা,আঁখির আর বুঝতে বাকি রইলো না তখনকার সেই বলিষ্ঠ হাতজোড়া আর কারও নয় আয়ানেরই ছিলো।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here