মনমোহিণী পর্ব ৯

0
563

#মনমোহিণী
#Part_09
#Writer_NOVA

সকাল থেকে ব্যাগপত্র গোছগাছে লেগে পরেছি। আজ বাসায় যেতে হবে।হঠাৎ করে গতকাল রাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আম্মুর শরীরটা ভালো নয়। বাসায় একা একা ছোট বোন সব সামলে উঠতে পারছে না। তাই বাসায় চলে যাবো। তন্বী বিষন্ন মনে আমার গোছানো দেখছে। পাশে এসে বললো,

‘আবার এসো আপু।তোমাকে অনেক মিস করবো।’

তন্বী জাপ্টে ধরে রেখেছে। আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে উত্তর দিলাম,

‘তোরা যাস।’

ওকে ছেড়ে বোরখা পরে হিজাব বাঁধতে লেগে পরলাম। ভ্যান চলে এসেছে। তায়াং ভাইয়া বের হওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে। খালামণি রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

‘ভেবেছিলাম বন্ধ পেয়েছিস অনেক দিন থাকবি। এমন হুটহাট চলে যাবি তা কি বুঝেছি?’

‘মন খারাপ করো না খালামণি। বিয়ের আগে আরেকবার ঘুরে যাবোনি। আর যদি তা না হয় জামাই শুদ্ধি আসবো।’

খালামণি হেসে আমার কাঁধে চাপর মেরে বললো,
‘পাগলি মেয়ে।’

তায়াং ভাইয়া তাড়া দিয়ে বললো,
‘যাবি যখন জলদী চলে যা। এতো রংঢং করার কি দরকার?’

আমি চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ভাইয়া হো হো করে হেসে উঠলো। এনাজের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘সাবধানে নিয়ে যাস। মন মতলবি করলে শুনিস। নয়তো তোকে আচ্ছা করে ঘোল খাওয়াবে।’

আমি চেচিয়ে উঠলাম,
‘ভাইয়া!’

আসার সময় ভাইয়া নিয়ে এসেছিলো। এখন যাওয়ার সময় সে যাবে না। এনাজ, ইমরান, শাহেদ ভাইয়ারাও আজ চলে যাবে।তাই ভাইয়া এনাজকে বলেছে আমাকে পৌঁছে দিতে। মাওয়া ঘাট অব্দি এনাজ পৌঁছে দিবে। এরপর বাবা এসে নিয়ে যাবে।ইমরান ও শাহেদ ভাইয়া আগেই বেরিয়ে পরেছে। তারা বাইক দিয়ে যাবে। এক রাতের মধ্যে কতশত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলো। বের হয়ে ভ্যানের কাছে চলে এলাম।

‘আবার এসো। এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে সে কি আমি জানতাম।’

তন্বী জড়িয়ে ধরে ধীরস্বরে বললো। ওর চোখ দুটো যে টলমল করছে তা আমি জানি। এ মেয়েটা এমনি। যাওয়ার সময় কান্না করে দেয়। খালামণি বললো,

‘সাবধানে যাস। এনাজের সাথে সাথে থাকিস। গিয়ে কল করিস।’

ভ্যানে ব্যাগ উঠিয়ে ভাইয়া এগিয়ে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘কোন দুষ্টামি করিস না। সাবধানে থাকিস। লঞ্চে এনাজের পাশে থাকিস। আর হ্যাঁ, লঞ্চে উঠে কল করবি আমায়।আবার আসিস।’

‘তোরাও যাস ভাইয়া।’

ভাইয়া আমাকে ছেড়ে এনাজের দিকে গেলো।এনাজ আগের থেকে বিদায় নিয়ে ভ্যানে বসে আছে। বাহুতে চাপর মেরে বললো,

‘আমার বোনটার খেয়াল রাখিস। তোকে আমি বিশ্বাস করি বলে ওকে তোর হাতে ছাড়ছি। আমার বিশ্বাস তুই আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবি।’

এনাজ তায়াং ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘তোর বিশ্বাস আমি কখনো ভেঙেছি?’

বিনিময়ে ভাইয়া মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। এরপর এনাজ ভাইয়ার কাঁধে থাপ্পড় মেরে বললো,

‘তাহলে নিশ্চিন্তে থাক।’

আমি বসতেই ভ্যান ওয়ালা তার ভ্যান চালু দিলো। রাস্তার কিনারে সবাই বিষন্ন মনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালাম। এনাজ চেচিয়ে বললো,

‘আন্টি আসি। তায়াং যাই। তন্বী আল্লাহ হাফেজ।’

খালামণি বললো,
‘ওকে একটু দেখে রেখো বাবা।’

এনাজ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘জ্বি আন্টি।’

যতক্ষণ তাদের দেখা গেলো আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত নাড়াতে লাগলাম।চোখের আড়াল হতেই ডুব দিলাম গতকাল রাতের ভাবনাতে।

ফুচকা খেয়ে ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে গেলো। আকাশ তখন পরিষ্কার। এক টুকরো চাঁদ হেসে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে জোনাকি পোকার দেখা মিলছে। ভ্যানের টুংটাং শব্দে মন্দ লাগছে না। সবাই নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছে। আমি মুগ্ধ হয়ে রাতের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত।যতদূর চোখ যায় দুই পাশে ফসলি জমি। মধ্যখান দিয়ে রাস্তা।

‘কি দেখছো এতো?’

এনাজ আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো।আমি হকচকিয়ে বললাম,

‘কিছু না।’

‘কিছু তো দেখছিলে। কখন থেকে ডাকছি শুনছো না।’

‘ওহ আমি শুনতে পাইনি।’

‘তাতো দেখতেই পাচ্ছি।’

‘কিছু বলবেন?’

‘বলতাম কিন্তু এখন বলবো না।’

‘কেনো?’

‘এমনি।’

আমি সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।আমার থেকে আধা হাত দুরত্ব নিয়ে বসেছে।গায়ে এসে ঢলে পরার ছেলে সে নয়। তাই মোটামুটি আমার তাকে ভালোই লাগে।আমাকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে হেসে বললো,

‘এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আমার লজ্জা করে।’

আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। ইমরান ভাইয়া হাসির শব্দ পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি খালাতো বোন এতো খুশি কেন?’

‘এমনি ভাইয়া।’

আবছা আলোতে তার মুখাবয়ব বোঝা যাচ্ছে। সে এখনো মিটমিট করে হাসছে। সরি বলার মোক্ষম সুযোগ। মিনমিনে সুরে বললাম,

‘সরি!’

‘কেনো?’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।আমি মুখ কাচুমাচু করে উত্তর দিলাম,

‘দুপুরে আপনার নতুন টি-শার্টটা পুড়ে ফেলেছি তাই।’

‘ওহ আচ্ছা। কোন সমস্যা নেই।’

‘আমার বদলে অন্য কেউ পুড়লে সমস্যা হতো না?’

‘অবশ্যই হতো।’

‘তাহলে আমার ক্ষেত্রে ভিন্ন নিয়ম কেনো?’

এনাজ আবারো হাসলো। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। সেই হাসি! যাতে আমি ঘায়েল হয়ে যায়।পরমুহূর্তেই নিজে লজ্জা পেয়ে গেলাম। কি বোকা একটা প্রশ্ন করেছি আমি! এর কারণটা তো আমি আগে থেকে জানি। সে গুণ গুণ করে গান ধরলো,

‘সব কথা বলে না হৃদয়, কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।’

বলতে ইচ্ছে করেছিলো আমাকে বুঝতে বলেন না। আমি আবার বেশি বুঝি।কিন্তু তা আর বলা হলো না। চোখ কচলে অন্য দিকে মনোযোগ দিলাম। তবে আড়চোখে তাকে বারবার খেয়াল করতে ভুললাম না।

‘এই মেয়ে হারিয়েছো কোথায়?’

এনাজ হাত ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। আমি গতরাতের মতো হকচকিয়ে আশেপাশে তাকালাম।

‘কোথায় আমরা?’

‘চলে এসেছি, নামো।’

‘ওহ আচ্ছা।’

‘আজকাল থাকো কোথায়? মহাকাশে নাকি?’

‘পৃথিবীতে থাকি।’

‘মনে হয় না। কোথায় যে হুটহাট হারিয়ে যাও তুমি ভালো জানো।’

ভ্যানের ভাড়া মিটিয়ে বড় রাস্তার পাড়ে দাঁড়ালাম। বাসে করে এখন ঘাটে যেতে হবে। এনাজের কাঁধে নিজের ব্যাগ। হাতে আমার ল্যাগেজ। আমি খালি হাতে ড্যাং ড্যাং করে হাঁটছি। এক মুহুর্তে যে কেউ দেখলে ভাববে আমরা স্বামী-স্ত্রী। নিজের মনে মনে এসব ভেবেই জিহ্বায় কামড় দিলাম। কি ভাবছি আমি!

‘কোন ঘাট দিয়ে যাবেন?’

‘মাঝির ঘাট।’

‘এখন কি অটোতে যাবেন নাকি বাস?’

‘বাস।’

‘আমি বাসে যাবো না।’

‘কেনো?’

‘বমি করি।’

‘সিএনজিতে সমস্যা হবে?’

‘না।’

‘তাহলে সিএনজি নেই।’

‘আচ্ছা।’

বাসের কথা শুনে মুখটা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছিলো। সিএনজির কথা শুনে মনটা খুশি হয়ে গেলো। এনাজ আমার দিকে স্থির চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। আমি হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি?’ সে মাথা নাড়িয়ে কিছু না বুঝালো। একটা সিএনজির ভাড়া দরদাম করে উঠে পরলাম। আমি যতটা সম্ভব কিনার দিকে চেপে বসেছিলাম।এনাজ দুরত্ব রেখে বসেছে। ভাইয়াকে ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট জানিয়ে দিচ্ছে। সিএনজি তে উঠেও ভাইয়াকে কল করে বলে দিলো।

মাঝ রাস্তায় আরেকজন লোক নিলো। তখন এনাজ মাঝে বসে আমাকে কিনারে বসতে দিলো।তার এই যত্নটুকু ভীষণ ভালো লাগলো। আপনাআপনি মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

‘এই নোভা উঠো। আমরা চলে এসেছি।’

‘হুহ এসে পরেছি?’

‘হ্যাঁ!’

বাইরে তাকিয়ে দেখি সত্যি এসে পরেছি। বাইরের পরিবেশ দেখতে দেখতে কখন এনাজের কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছি নিজেও জানি না। ইতস্ততভাবে দ্রুত মাথা উঠিয়ে বললাম,

‘সরি ঘুমিয়ে পরেছিলাম।’

‘এতো সরি সরি করো কেনো?’

উনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো। আমি মাথা নাড়িয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললাম,

‘ঠিক আছে আর করবো না।’

‘এখন নামো।লঞ্চ ছেড়ে দিবে একটু পর।’

আমি চুপচাপ নেমে পরলাম।ঘুম চোখ থেকে এখনো যায়নি। টাল সামলাতে না পেরে কিছুটা হেলেদুলে রাস্তার পাশে দাঁড়ালাম। আমার অবস্থা খেয়াল করে সিএনজি ওয়ালা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে এনাজকে বললো,

‘ভাই, ভাবীরে হাত ধইরা সাবধানে নিয়া যাইয়েন। ঘুমের জ্বালায় চোহে দেকতাছে না।’

#চলবে

আমিও ঘুমের জ্বালায় চোহে দেকতাছি না। ঘুমের চোখে কি লিখছি নিজেও জানি না। ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here