#মনমোহিণী
#Part_11
#Writer_NOVA
মাঠ পেরিয়ে কলেজের ক্যান্টিনের দিকে যেতে নিলেই প্রাইমারি স্কুলে পড়ুয়া এক পিচ্চি সামনে এসে পথ আটকে বললো,
‘আপু, আপনাকে ডাকে।’
আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। নিজের দিকে আঙুল তাক করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আমাকে বলছো?’
‘হুম।’
‘কে ডাকে বাবু?’
‘ঐ যে গেইটের পাশে থাকা ভাইয়াটা।’
বিস্মিত নয়নে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বাচ্চা ছেলেটা যেভাবে ভৌ করে দৌড়ে এসেছিলো সেভাবে চলে গেলো। মাথায় খেললো না কে হতে পারে। উৎসুক হয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে গেইট পার হলাম। গেইটের পাশে বাইকের সাথে অনেকগুলো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ডাকেনি আমি জানি। মিনিট খানেক অপেক্ষা করে চলে যাওয়ার জন্য পথ ধরতেই পিছন থেকে কেউ ডাকলো।
‘নোভা!’
চোখ সরু করে তাকিয়ে মুখ, চোখ হা হয়ে গেলো। সে এখানে কি করে? দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বললো,
‘কখন থেকে অপেক্ষা করছি?’
‘আপনি এখানে?’
চোখের পলক পরছে না। তাকে এই সময় দেখতে পাবো আমার কল্পনায় ছিলো না।এনাজ চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
‘কোথায় হারালে?’
‘আপনার সাথে কোন কথা নেই।’
‘কেনো কেনো?’
‘দুই মাস শেষ হয়ে তিন মাস পরলো। আপনি একটা খোঁজও নিলেন না।’
‘কে বললো আমি খোঁজ নেইনি?’
‘খোঁজ নিলে তো একটা কল করতে পারতেন।’
‘তুমি তো করতে পারতে।’
‘আমি কি করে করি?’
‘তাহলে আমি তোমার অনুমতি ছাড়া কল কিভাবে করি?’
আমি গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম। উনি একগাল হেসে বললো,
‘তুমি কি আমার সাথে অভিমান করছো?’
‘না তো। আমি অভিমান করবো কেন? অভিমান করার কে আমি?’
নিজের কাজে নিজে অবাক হলাম। আমি তো সত্যি অভিমান করেছি। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না।
‘বাহ বাহ আমার মনমোহিণী তো কড়াকড়ি অভিমান করেছে।’
‘হুহ আসছে।’
মুখ ভেংচি দিয়ে বুকের কাছে দুই হাত গুঁজে সরে এলাম। খেয়াল হলো উনি আমায় মনমোহিণী বলে ডেকেছে। এই নামটা তো অচেনা নাম্বার থেকে ম্যাসেজে বলতো। তাহলে এটা নিশ্চয়ই উনি ছিলেন।
‘এই আপনি একটু আগে কি বললেন?’
‘যাক বাবা, আমি আবার কি বললাম?’
‘কি নামে ডেকেছেন?’
‘মনমোহিণী!’
‘তাহলে আপনি ছিলেন?’
চোখ দুটো গোল আলু করে বললাম। সে মুচকি হেসে বললো,
‘তোমাকে আমি বুদ্ধিমতি ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি আসলে মাথামোটা।’
‘এই কি বললেন?’
‘কিছু না! চলো কোথাও বসি।’
ধীর পায়ে পাশাপাশি হাঁটছি। কতদিন পর তাকে দেখলাম। অগোছালো চুল, তৈলাক্ত মুখশ্রী, দাড়িগুলো আগের তুলনায় অনেকটা বড়, চোখ দুটোতে ছটফটানি দৃষ্টি। এসবই জানান দিচ্ছে উনি আমার সাথে দেখা করার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে ছিলেন।
‘বাচ্চাটা আমাকে চিনলো কি করে?’
‘তোমার ছবি দেখিয়েছিলাম। সাথে তোমাকে দেখিয়ে দিছিলাম।’
হাঁটতে হাঁটতে কিছু সময় পরপর আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলো। যা দেখে আমি ঠোঁট চেপে হাসলাম। হঠাৎ কিছু মনে পরতেই উনি বললেন,
‘হেই দাঁড়াও।’
আমি দাড়িয়ে গেলাম। উনি পকেট থেকে দুটো সিল্ক চকলেট, এক মুঠ বকুল ফুল আর একটা লিপবাম বের করে আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘সরি,পকেটে চাপে পরে বকুল ফুলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।’
তার কথা আমার কর্ণকুহরে ঢুকেনি। আমি বকুল ফুল দেখে দিশেহারা। এই সাধারণ একটা ফুল যে আমার কতটা প্রিয় বলে বুঝাতে পারবো না। ফুলগুলো হাতে নিয়ে নাক টেনে ঘ্রাণ শুঁকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এগুলো কোথায় পেলেন?’
‘তোমাদের কলেজের ভেতরের গাছের থেকে।’
‘আপনি কুড়িয়েছেন?’
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। খুশি মনে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম।লিপবামটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি।আমার পছন্দের লিপবামটা।উনি নতুন কিনে এনেছেন।
‘পুরাতন লিপবামটা কিন্তু আমার কাছে এখনো আছে।’
আমি মুচকি হেসে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘এসব কিছুর সন্ধান নিশ্চয়ই তায়াং ভাইয়া দিয়েছে।’
‘এছাড়া আর কোথায় পাবো বলো?’
উনার চকলেট, ফুল, লিপবাম দেওয়ায় আমারও একটা জিনিসের কথা খেয়াল হলো। চকলেট, লিপবাম ব্যাগে রেখে একটা ছোট ব্যাগ বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। উনি কপালে প্রশ্নসূচক চিহ্ন একে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘এটা কি?’
‘খুলে দেখুন।’
উনি প্যাকেট খুলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।উনার যে টি-শার্ট আমি পুড়েছিলাম অবিকল ঐরকম একটা টি-শার্ট। আমি বললাম,
‘আমি কারো ঋণ রাখি না।’
‘তুমি জানতে আমি আসবো?’
‘না, অর্ডার করেছিলাম। আজকে এসেছে। তাই ব্যাগে ছিলো।আল্লাহর কি মর্জি দেখুন। আজকেই আপনি এলেন।’
‘ধন্যবাদ।’
উনি কথা বাড়ালো না। কিছু দূর যাওয়ার পর আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘এই তুমি একটু সুস্থির হয়ে দাঁড়াও তো।’
‘কেনো?’
‘তোমাকে মনভরে দেখবো।’
★
সাত দিন পরের কথা। ছাদে দাঁড়িয়ে এনাজকে একের পর এক কল করছি। কিন্তু অপরপাশ থেকে সুইচ অফ বলছে। রাগে, অভিমানে চোখ দুটো টলমল করছে। আগামীকাল পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আর উনার মোবাইল বন্ধ। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিছে। ছোট বোন নিঃশব্দে পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কল উঠাচ্ছে না?’
‘না মোবাইল বন্ধ বলছে।’
‘কেনো?’
‘জানি না।’
‘সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। নিচে চলো।’
আমি ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে মোবাইলে কল দেওয়া বন্ধ করলাম। ও সবকিছু জানে আমাদের বিষয়ে। আমি চুপচাপ নিচে নেমে এলাম। রাতেও কল করলাম। কিন্তু একই বিষয়। মোবাইল বন্ধ। দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। দুদিন আগেও সব ঠিক ছিলো। এখন এমন লাপাত্তা হয়ে গেলো কেন?জিদ করে রাতের খাবার না খেয়ে শুয়ে পরলাম।
পরদিন বিকাল…..
‘তোর হলো?’
আম্মু রুমে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলো। আমি তখনও ড্রেসিং টেবিলের সামনে ঠায় বসে আছি। আম্মু তা দেখে চেচিয়ে বললো,
‘তুই তো এখনো কিছু করিসনি।’
‘আম্মু আমি এখন বিয়ে করবো না।’
‘দেখতে আসলে কি বিয়ে হয়ে যায় নাকি।’
‘তাহলে দেখতে আসবে কেনো?’
‘শুনো বোকা মেয়ের কথা।’
‘উনারা এসে বসে রয়েছে। জলদী রেডি হো।’
‘ভালো লাগছে না।’
‘তোর ভালো লাগে কবে? পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসবি।’
‘আমি কোন মেকআপ করবো না। শুধু ড্রেস পাল্টে আসবো। কোন শাড়ি-টারি পরতে পারবো না।’
জর্জেটের একটা থ্রিপিস নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। দরজাটা দ্রিম করে বন্ধ করে ভেতরে ফুঁসতে লাগলাম। এই মুহুর্তে এনাজকে পেলে হামানদিস্তা দিয়ে পিষতাম।
মুখে একটু ক্রিম ঘষে বড় করে ঘোমটা টেনে সামনে গেলাম। ইচ্ছে করে সাজগোজ করিনি। আমি চাইছি না তারা আমায় পছন্দ করুক। পর্দা ভেদ করে ভেতরে ঢুকে সালাম দিলাম। সালামের উত্তর নিয়ে এক মহিলা খুশি মুখে সামনে এগিয়ে এসে আমাকে তার পাশে বসালো। মাথা হালকা উঠাতেই সেদিনের সেই লোকটাকে দেখতে পেলাম। মহিলা আমার গালে হাত দিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললো,
‘ছেলে তো খাঁটি সোনা পছন্দ করেছে। মা শা আল্লাহ! আমাদের ছেলের সাথে ভালো মানাবে। কি বলো?’
‘আমি তো সেদিন দেখে গিয়ে তোমাকে সবটা বলেছি। তুমি বিশ্বাস করতে চাওনি। এবার নিজ চোখে দেখে নাও।’
লোকটা বললো। মহিলা আমার বাম হাতের অনামিকা আঙুলে আংটি পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
‘রান্না পারো?’
‘জ্বি!’
‘মা শা আল্লাহ! মেয়ে কাজের আছে।’
সামনে আবছা অবয়ব চোখে এলো। মুখটাকে হাসি হাসি করে রেখেছে এক ছেলে। নিশ্চয়ই পাত্র হবে। আমার এখন হাত-পা ছুঁড়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। মহিলা আমার থুঁতনি উঁচু করে ছেলেটাকে দেখিয়ে বললো,
‘দেখ তো এনাম, তোর ভাবীকে ভাইয়ের সাথে কেমন মানাবে?’
‘সুপার আম্মু। ভাইয়ার সাথে জোস লাগবে।’
এর মানে এটা পাত্র নয়। পাত্রের ভাই। তাহলে পাত্র কই? চোখ বুলিয়ে কাউকে পেলাম না। পাত্রের মা আমার আব্বু-আম্মুকে বললো,
‘মেয়ে কিন্তু আমাদের অনেক পছন্দ হয়েছে। আমরা বেশি দেরী করতে চাই না। যত দ্রুত সম্ভব বিয়েটা দিতে চাই। ছেলে আমাদের পাগল করে ফেললো।’
আব্বু জিজ্ঞেস করলো,
‘ছেলে কোথায়?’
পাত্রের বাবা বললো,
‘ছেলে এসেছে। বাইরে বন্ধুর সাথে কথা বলছে। এখন আপনারা বলুন আমাদের বাসায় কবে যাচ্ছেন?’
এর মধ্যে দুটো ছেলে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। কন্ঠ পরিচিত মনে হওয়ায় মাথা উঠিয়ে তাকালাম।এনাজ ও তায়াং ভাইয়াকে দেখে মুখটা অলরেডি হা হয়ে গেছে। আরেকটু হা হলো যখন পাত্রের বাবা এনাজকে দেখিয়ে বললো,
‘এই তো আমাদের বড় ছেলে চলে এসেছে।’
আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তায়াং ভাইয়া মুখ টিপে হাসলো। এনাজ চোখ মারলো। এনাজের মা এনাজকে আমার পাশে বসালো। এখনো আমার কাছে মনে হচ্ছে সব স্বপ্ন। এনাজ কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
‘মুখ বন্ধ করো। মাছি তাদের ঘর ভেবে ঢুকে যাবে।’
এবার বিস্মিত ভাব কেটে গিয়ে মাথায় চিনচিন করে রাগ উঠে গেলো। কালকের থেকে আমি কেঁদে মরছি। আর উনারা সবাই মিলে এই পরিকল্পনা করেছে। এনাজ এক কান ধরে ইনোসেন্ট ফেস করে করুণ সুরে বললো,
‘সরি, তোমাকে এই সারপ্রাইজটা দিতে এমনটা করেছি। তুমি রাগ করো না প্লিজ।এবারের মতো মাফ করে দিও।’
#চলবে