#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই ?
#মম_সাহা
পর্বঃ তিন
ফুলোফুলো চোখ দুটি কিছুক্ষণের বিবর্তনে উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ। প্লাবন দূর হতে উচ্ছ্বাসিত মুখ খানা দেখে তৃপ্তির হাসি হাসে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
-‘আর খাবি তেঁতুল আচার?’
তিস্তা শেষ পর্যায়ের আচার টুকু মুখে পুরে নেয়। অমৃতের ন্যায় অতিরিক্ত স্বাদে চোখ দু’খানা বন্ধ হয়ে আসে। তিস্তার এমন মুখ ভঙ্গি দেখে চাপা হাসে প্লাবন। আচারের প্রতি তারও ভীষণ লোভ হচ্ছে তিস্তার খাওয়ার অভিনয় দেখে।
তিস্তা মুখের আচার টুকু শেষ করে আঙ্গুল গুলো চাটতে চাটতে বললো,
-‘নাহ্ মাস্টারমশাই, আর খাবো না।’
-‘তবে কী আমি আচারের বয়াম রেখে আসবো?’
তিস্তা মাস্টারমশাই এর কথা শুনে তৎক্ষনাৎ আচারের বয়ামটা ছিনিয়ে নেয়। প্লাবনের কাছ থেকে একটু আড়াল করে বলে,
-‘নাহ্, এই আচার আমি বাড়ি নিয়ে যাবো। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু যদি পরে আবার খেতে ইচ্ছে করে তখন আমি কী করবো? তাই এটা আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। যেদিন আমার খাওয়ার ইচ্ছে শেষ হয়ে যাবে সেদিন দিয়ে যাবো।’
-‘তোর ইচ্ছে শেষ হওয়ার আগে না আবার আমার আচার শেষ হয়ে যায় দেখিস।’
মাস্টারমশাই এর এমন কথায় তিস্তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
-‘আপনি কী চাচ্ছেন আমি এখন রাগ করে আচার না নিয়ে চলে যাই?’
প্লাবন হতভম্ব হয়ে যায় এহেন প্রশ্নে। ক্ষাণিকটা হোঁচট খায় মনে মনে। ব্যতিব্যস্ত স্বরে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তিস্তা বয়ামটা নিজের ব্যাগে রাখতে রাখতে বলে,
-‘আপনি এমনটা চাইলেও কিছু করার নেই। কারণ, আচারটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আপনাকে এর জন্য আমি পড়া শিখে দিবো। কেমন?’
প্লাবন এবার শব্দ করে হেসে দেয়। মেয়েটা এত বাচ্চা বাচ্চা কথা কেনো বলে? একটু আগেও এই ছোট্ট মেয়ে টা কেমন যেনো বড় হয়ে গিয়েছিল, ভীষণ অচেনা এক নারীতে রূপান্তরিত হয়েছিলো। কতটা ধৈর্য সহকারে সামলাতে হলো তাকে!
প্লাবন তিস্তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললো,
-‘তোর আপা জানে, তাই না? তুই তোর আপাকেই প্রথম বলেছিলি খারাপ স্পর্শের ব্যাপার টা?’
-‘হুম। আমি সবার আগে আপারেই বলছি। দুলাভাই নষ্ট পুরুষ। আমি আপারে অনেক বলেছি কিন্তু, কিন্তু আপা আমাকে চর লাগিয়েছে মাস্টারমশাই। অনেক জোরে মেরেছে।’
শুকনো চোখ গুলো কথার পরিপ্রেক্ষিতে জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। প্লাবনের ভীষণ অবাক লাগলো তিস্তার আপার ব্যবহারে। সে অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘তোর আপা আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি তোকে? আর কিছু বলে নি?’
-‘হ্যাঁ বলেছে তো, আপা কান্নাও করেছে। আপা বলেছে এ কথা বাড়ির কাউকে না বলার জন্য। তাই তো আপনারে বললাম মাস্টারমশাই। আপনি আর কাউকে বলবেন না কেমন? আপা কষ্ট পাবে। আপা বলেছে, এ কথা আমি কাউকে বললে তার সংসার ভেঙে যাবে। তখন গলায় দঁড়ি দেওয়া ছাড়া নাকি উপায় থাকবে না৷ দুলাভাই রে সে অনেক ভালোবাসে।’
কথা শেষ করে মন খারাপের বিষন্নতায় ডুব দেয় তিস্তা। প্লাবন হতাশার শ্বাস ফেলে বললো,
-‘এটা ভালোবাসা না রে, যে ভালোবাসা অন্ধ বানিয়ে দেয়,হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সেটা ভালোবাসা না। তোর আপা’র সংসার করার লোভ তার স্বামী’কে আরও এক ধাপ এই নোংরামির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। বাঙালী নারী জাত ভাবে সংসার বিহীন তারা কিছু না, তাই হাজারো নোংরামি সহ্য করেও সংসার রাখার জন্য মরিয়া হয়ে যায়। আচ্ছা একটা কাজ করবি তিস্তা?’
তিস্তা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। বিষন্ন স্বরে বলে,
-‘কী কাজ মাস্টারমশাই?’
-‘তোকে তোর দুলাভাই সবার আড়ালে স্পর্শ করেছে তাই না?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘তাহলে তাকে শাস্তিটা সবার আড়ালে তুই ই দিবি। পারবি না?’
প্লাবনের কথা তিস্তার বোধগম্য হয় না। সে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-‘কি শাস্তি দিবো? আর দুলাইভাই আমার বড়।’
প্লাবন কিছুটা রেগে যায়। ভরাট কণ্ঠে বলে,
-‘বড় বলে তুই শাস্তি দিতে চাস না আর সে তোকে নোংরা চোখে দেখুক সেটা তোর ভালো লাগবে?’
তিস্তা ডানে বামে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ তার ভালো লাগবে না। প্লাবন এবার আশ্বাসের স্বরে বললো,
-‘তোর আপা’র অন্ধত্ব তুই ঘুচাবি। আর দুলাভাই এর নোংরামিও তুই দূর করবি। পারবি না?’
তিস্তা’র হঠাৎ কী জেনো হলো। চোখ দু খানা চকচক করে উঠলো। ভীষণ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললো,
-‘পারবো মাস্টারমশাই।’
মেয়ে মানুষকে সৃষ্টিকর্তা আলাদা শক্তি দিয়ে হয়তো বানায়। তারা যতটা অবুঝই হোক নিজের নিরাপত্তা বেশ ভালো ভাবে বুঝে। তিস্তাও সেই স্বত্তার বাহিরে না।
হঠাৎ উঠোন থেকে চওড়া কণ্ঠের ডাক ভেসে এলো,
-‘মাস্টারমশাই, বাড়িত আছেন নি? মোড়ল সাহেব আইছে আপনার সাথ দেখা করার জইন্ন।’
প্লাবনের কপাল কুঁচকে যায়। মোড়ল সাহেব তার সাথে দেখা করতে আসছে কেন? হঠাৎ?
তিস্তাও অবাক দৃষ্টিতে মাস্টারমশাই এর দিকে তাকায়। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
-‘মোড়ল সাহেব আপনার সাথে দেখা করতে কেনো আসছে মাস্টারমশাই?’
প্লাবন মাথা নাড়িয়ে “জানিনা” বলে বড় টিনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্লাবনের মাও দুপুরে খেয়ে ভাত ঘুম দিয়ে ছিলো। কিন্তু মোড়লের নাম কানে যেতেই ভীষণ ঘুম যেনো কোথায় উবে গেলো। সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘর থেকে বাহিরে বেরিয়ে এলো।
তখন শরৎ এর নরম দুপুর। গ্রামে দুপুর বেলাটা থাকে বেশ নিস্তব্ধ। মোড়ল সাহেব’কে দেখে প্লাবন বেশ সম্মানের সাথে সালাম করে। বিনীত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
-‘আপনি এখানে যে? কোনো প্রয়োজন থাকলে আমাকে ডাকতে পারতেন।’
মোড়ল সাহেব তার সাথের চাকরটার কাছ থেকে হুঁকা পান করে। হুঁকার ধুয়ো আকাশে উড়িয়ে দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে,
-‘এই গেরামে তো অনেক মাস্টারই আছে। কিন্তু আমার মাইয়া কঙ্কণা’র তোমারেই লাগবো পড়ার জন্য। তুমি সময় কইরা গিয়া পড়াইয়ো। টাকা পয়সার ব্যাপার নিয়া ভাবতে হইবো না।’
প্লাবন তার মাধুর্যতা ময় কণ্ঠে আরও বিনীত ভাব ঢেলে বলে,
-‘শিক্ষকদের পড়ানোর বিনিময়ে যেটা দেওয়া হয় সেটাকে সম্মানী বলে, টাকা পয়সা না। আর আপনি তো জানেন দুপুরে আমার একটা শিক্ষার্থীদের দল আছে যাদের আমি পড়াই। সেটা ছুটি দিতে দিতে সন্ধ্যা নামে এরপর তো আর পড়ানো সম্ভব না। আপনি বরং কঙ্কণা’রে এসে পড়ে যেতে বইলেন।’
প্লাবনের কথা শুনে প্লাবনের মা হুঙ্কার দিয়ে বলে,
-‘কাকে কী বলছো,প্লাবন? মোড়াল সাহেব যেখানে এত বড় প্রস্তাব দিচ্ছে সেখানে তোমার না করা টা বেমানান।’
-‘এটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত বিষয় মা। আপনি কিছু বলবেন না আশা করি!’
প্লাবনের কথায় তার মা চুপ হয়ে গেলেও মোড়েলের সাথে থাকা তার চাকরটা চোখ রাঙিয়ে উঠে। ধমকের স্বরে বলে,
-‘আফনে ভূঁইয়া বাড়ির মাইয়ারে পড়াইতে পারবেন না? এত সাহস কই থেইকা আসে আপনার? গেরামে টিকতে পারবেন তো?’
মোড়ল সাহেব বিশাল এক ধমক দিলে লোকটাকে। শাসানোর ভঙ্গিতে বললেন,
-‘তোর এত সাহস কই থেইকা আসে? আমি তো কথা কইতাছি। মাস্টার গো লগে অভদ্রতা করবি না।’
মোড়লের ধমকে চাকরটা মাথা নত করে ফেললো। মোড়ল সাহেব নিজের বিদঘুটে আকৃতির হাসি দিয়ে সাধারণ কণ্ঠে বললো,
-‘আচ্ছা মাস্টার। তুমি যা কও তা’ই হইবো। তাহলে কঙ্কণা কাইল থেইকা তোমার এইখানে আইসাই পড়বো। ভালো থাইকো।’
প্লাবন ঘাঁড় নাড়িয়ে বললো,
-‘বসলেন না?’
-‘না মাস্টার। ম্যালা কাজ আছে। আজ তাহলে আসি?’
প্লাবন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। মোড়ল বের হতে নিয়েও একটু দাঁড়ালো। পড়ার ঘরটার দিকে তাকালো। ঘরের দরজা ঘেষে তখন তিস্তা দাড়ানো। মোড়ল তিস্তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে প্লাবনের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘এ তিস্তা নদী যে এখানে? কঙ্কণা এলে আবার দেখো নদীর জল বহুদূর না গড়ায়। একটা সাপ হলে আরেকটা নেউল।’
মোড়লের কথায় প্লাবন কিছুটা হেসে দেয়। হেসে চোখে ইশারা করে তেমন কিছু হবে না।
মোড়ল প্লাবনদের সদর দরজা পার হতেই তিস্তা দু’লাফে উঠোনে নেমে এলো। বিরক্ত মেশানো কণ্ঠে বললো,
-‘ঐ কঙ্কণা’রে পড়ানোর কী দরকার আপনার মাস্টারমশাই? ও খালি ঝগড়া করে। আমার একদম ভাল্লাগে না ওরে। টাকার গরমে যেনো ও শান্তি পায় না এমন ভাবখানা।’
প্লাবন তিস্তার কথায় কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্লাবনের মা মুখঝামটা দিয়ে বললো,
-‘হ্যাঁ, আমার ছেলের সুখ তো কারো সহ্য হয় না। স্বয়ং ওরই নিজের সুখ সহ্য হয় না। মোড়লের বাড়িতে গিয়া পড়াইলে কত টাকা পাইতো। নাহ্, হেয় তো আবার দরদী। এখন আবার এই উড়নচণ্ডী মেয়ে ঢং করতে আসছে। যা, বাড়িতে যা।’
প্লাবন অসহায় কণ্ঠে বললো,
-‘আহ্! মা! ওর সাথে কীভাবে কথা বলছো? যা তিস্তা পড়ার ঘরে যা।’
তিস্তা আর এক মুহূর্ত ব্যায় না করে ঘরে চলে গেলো। মাস্টারমশাই এর মা’টা কেমন যেনো। মহিলা বেশ পড়াশোনা জানলেও কেমন জেনো আচার আচরণ।
প্লাবন ছোট্ট শ্বাস ফেলে মা’কে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তার বাকি শিক্ষার্থী চলে আসলো। ব্যস্ত হয়ে গেলো সে দৈনন্দিন কাজে।
_______
বাড়ির উঠোনে হারিকেনের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। তিস্তা রান্নাঘরে মাঝ গুলো ভাজছে। মা পাশের বাড়িতে গিয়েছে, সে বাড়িতে ঝামেলা হচ্ছে বলে। যাওয়ার আগে তিস্তার ঘাঁড়ে মাছ ভাজার বিরাট দায়িত্ব দিয়ে গেছে।
বাড়িতে এখন সে, তার দাদী আর দুলাভাই আছে। আপাও মায়ের সাথে গিয়েছে।
তিস্তা গভীর মনযোগ তেলের ভিতর থাকা ফুটন্ত মাছ গুলো দেখছে। এটার মাঝেও ভীষণ আকর্ষণীয় কিছু খুঁজে পাচ্ছে বোধহয় সে। আসলে বয়ঃসন্ধির সময়টাই এমন। অসাধারণও বিরক্ত আসে আবার অতি সাধারণও আনন্দিত করে।
কিশোরী তিস্তা হঠাৎ অনুভব করলো তার পিঠে নোংরা হাতের ছোঁয়া। সে হাতটা জামার ভিতরে থাকা অতি গোপনীয় পিঠটা বাজে ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে।
তিস্তা চমকে পিছে তাকায়৷ বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
-‘দুলাভাই!’
পেটমোটা ভারী শরীর যুক্ত মোতালেব হালকা হাসে। হাতের ছোঁয়া আরও গভীর করে। যতটা গভীর করলে পিঠের অন্তর্বাসের কাপড়টা অব্দি ছোঁয়া যায়। বিশ্রী হেসে বলে,
-‘বেশ বড় হয়েছিস। এবার দুলাভাই এর খাতির যত্ন কর। চুড়ি,আলতা,আয়না কিনে দিবো।’
তিস্তা উঠতে নিলেও শক্ত হাতের চাপে উঠতে পারে না। দুলাভাই তবে মনুষ্যত্ব একবারে হারিয়ে ফেলেছে! তার দাম কী তিস্তাকে দিতে হবে?
#চলবে