মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্ব ২

0
495

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই ?
#মম_সাহা
পর্বঃ দুই

আকাশে মেঘ গুলো ক্ষাণিকটা তুলোর মতন লাগছে। শরৎ এর আকাশটা ভীষণ আদুরে হয়। দেখলেই মনে হয় ছুঁয়ে দিতে। এমন এক অদম্য ইচ্ছে নিয়ে সেই আকাশ পানে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তিস্তা সাথে হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের সরু পথ দিয়ে। তার সাথে আজ কেবল মাস্টারমশাই আছে। মাস্টারমশাই নিজের সাইকেলটা নিয়ে হাঁটছে গম্ভীরভাবে।

তিস্তা কতক্ষণ মনের মাঝে হাবিজাবি ভেবে হঠাৎ মাস্টারমশাই’কে প্রশ্ন করলো,
-‘আচ্ছা মাস্টারমশাই, আপনারে একটা কথা বললে রাখবেন?’

মাস্টারমশাই ক্ষানিকটা ভ্রু কুঁচকায়। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
-‘উল্টোপাল্টা চাইবি নাকি?’

-‘আপনার সবসময় মনে হয় আমি উল্টোপাল্টা চাই? থাক,লাগবে না।’

তিস্তার এহেন অভিমানে গোপনে হাসে মাস্টারমশাই। শরৎ এর কোমল বাতাসে ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে অভিমানী সপ্তদশী। মাস্টারমশাই কিছু বলে না, কারণ তিস্তা আবার নিজ থেকেই আসবে কথা বলার জন্য।

মিনিট পাঁচ পেরিয়ে যায় তিস্তা চুপ রয়। এখন যে পথটি দিয়ে হাঁটছে তার বা’পাশে একটা মরানদী আছে। মৃত নদী হলেও তার রূপের জেনো অন্ত নেই। তিস্তা মৃত নদীটির দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে,
-‘জানেন মাস্টারমশাই, এ গ্রামে অনেক আগে এক জমিদার বাস করতো, তার নাম ছিলো আনন্দমোহর। উনার সহধর্মিণীর এ নদীটা খুব পছন্দ ছিলো। উনার পছন্দকে আরও সৌন্দর্যময় করে তুলতে নদীটির পাড় চিনাপাথর দিয়ে বাঁধানো হয়। একটি বিশাল বসার জায়গা বানানো হয় সুন্দর করে। আনন্দমোহরে স্ত্রী’র নাম ছিলো মধুসখী,সেই নাম অনুসারে নদীটির নাম রাখা হয় মধুসখী। কিন্তু এই প্রিয় নদীই কাল হয়ে দাঁড়ায় মধূসখী’র। একদিন এ নদীতে ডুবেই সে মানবী মারা যায়। এরপর নাকি প্রায় কত যুগ নদীটি মৃত ছিলো। এর পানি শুখিয়ে চর জেগেছিলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন সবাই’কে অবাক করে নদীটিতে আবার পানি আসলো। নদীটি ভরে গেলো,তার রূপ আরও বেড়ে উঠলো।’

প্লাবন খুব মনযোগ দিয়ে সবটা শুনলো। সে এগুলো জানে। গত দু’বছর যাবত অনেকেই এ নদীটিকে জাদুময় নদী বলে আখ্যায়িত করে। অনেকে তো রাতে এখান দিয়ে আসে না। গ্রামীণ কিছু কুসংস্কার তো থেকেই যায়। তবে সে পুরোনো গল্প নতুন করে তিস্তার মুখ থেকে শুনতে ভালোই লাগছে। তাই সে নিরব শ্রোতা হয়ে সবটা শুনলো। এবার সে প্রশ্ন করলো,
-‘তাহলে তিস্তা, নদীটি আবার মৃত হলো কীভাবে?’

তিস্তা একটু খুশি হলো। মাস্টারমশাই তার কাছ থেকে কিছু জানবে,শিখবে সেটা যেনো বিশ্বজয় করার আনন্দ দিলো তাকে। সে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
-‘এ নদীটা আবার মৃত বলে ঘোষনা দেয়া হয় প্রায় সতেরো বছর আগে। আমি জন্মানোর পাঁচ দিনের মাথায় নাকি নদীটা মারা যায়। এর চর জেগে উঠে। আমি যখন মায়ের পেটে আসি তখনই নাকি নদীটা তার স্রোত হারিয়ে ফেলে,গতি কমিয়ে দেয়। জানেন মাস্টারমশাই আমার কী মনে হয়?’

মাস্টারমশাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-‘কী মনে হয়?’
-‘আমি জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে নদীটা মারা গেছে। বোধহয় আমি মারা গেলে নদীটা আবার বেঁচে উঠবে।’

প্লাবনের পা টা আপনা-আপনি থেমে যায়। কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছুতেই ক্ষানিকটা নড়ে উঠে সে। ধমক দিতে গিয়েও নিজেতে ধাতস্থ করে বলে,
-‘তাহলে এক কাজ কর, তুই বরং তাড়াতাড়ি মরে যা। তুই বেঁচে থেকে তো কারো কোনো কাজে আসছিস না বরং মরে গিয়ে কাজে লাগবি। এই মৃত নদীটা জীবিত হয়ে গেলে এখানে মাছ চাষ করা যাবে। তারপর কত মানুষ সেই মাছ বিক্রি করে তাদের উদরপূর্তি করতে পারবে। কি বলিস?’

তিস্তা মাথা নত করে কেবল ঘাঁড় কাত করে। যার অর্থ ‘ঠিক আছে’। প্লাবন অবাক হয়। এত ভদ্র মেয়ে তো তিস্তা না।

এদিকে সপ্তদশী তিস্তা’র মনে অভিমানের পাহাড়টা আরেকটু বড় হয়। মাস্টারমশাই’কে সে ঐ কথা টা বলেছিলো যেনো মাস্টারমশাই তাকে ধমক দেয়, ধমক দিয়ে বলে এসব কথা বলবি না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মাস্টারমশাই কিনা তাকে মরে যেতে বললো! মাস্টারমশাই কী বুঝে না? তিস্তার ভীষণ আদুরে লাগে মাস্টারমশাই এর বকা। অভিমান অধিক হওয়ায় চোখের কোণে উঁকি দেয় অশ্রুকণা। সে তাড়াতাড়ি বইয়ের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে ছুট লাগায়।

তিস্তার এহেন কান্ডে প্লাবন বেশ অবাক হয়। পিছন থেকে কয়েকবার ডাক দেয়। কিন্তু কে শুনে কার ডাক। প্লাবনের মনে সামান্য বিষন্নতা কড়া নাড়ে। কিন্তু মেয়েটাকে তখন আহ্লাদ দেখালে সে এসব কথা আবারও বলতো। আর প্লাবনের দেহের মাঝে ছোট্ট হৃদপিণ্ডটায় রক্তক্ষরণ হতো।

____

তিস্তা আজ স্কুল না গিয়ে ফিরে এসেছে। তখন ছুট লাগিয়ে স্কুলে গেট অব্দি গিয়েও স্কুল যায় নি। অন্য রাস্তা দিয়ে বাড়ি চলে এসেছে। হুটহাট মন খারাপ হয় আজকাল। মা বলেছে এ বয়সে ঐ একটু আধটু হয়।

তিস্তা মন খারাপ করে উঠোনের এক কোণে বসে আছে। তার মা তনয়া চুলোয় ভাত বসিয়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে আসে। আদুরে কন্ঠে বলে,
-‘কী হলো আজ তিস্তামনির? সে আজ দৌড়ঝাঁপ করছে না যে? আজ যে তোমার আপাই আসবে সে খেয়াল আছে?’

-‘আমার হুটহাট মন খারাপ করে আম্মা। আমার ভালো লাগে না কিছু।’

-‘এ বয়সে তো মন খারাপ করবোই। বিয়ার বয়স পাড় হইয়া যাইতাছে, অথচ তোমার মা বাপে তোমারে বিয়া দিতাছে না। কত কইরা বুঝাইলাম তাও বুঝে না।’

তিস্তার দাদীর এহেন কথায় তিস্তা ড্যাবড্যাব করে তাকায়। তার বিয়ে করার জন্য মন খারাপ হচ্ছে! ছিঃ এ তাহলে কেমন মন খারাপ!

তনয়া বেশ বিরক্তের স্বরে বলে,
-‘আম্মা,এসব আপনার ছেলে শুনলে কিন্তু আবার রাগারাগি করবে। আপনি ওর সামনে এগুলো বলবেন না দয়া করে।’

বৃদ্ধা মহিলা এবার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে নাতনির কাছে এসে বলে,
-‘হ, এহন আমার কথা তো তোমরা কেউ শুনবা না। সংসারে এহন হইলাম গিয়া আমি পুরাতন ভাঙা থালার মতন, যা কাজে আসে না অথচ ফালাতে পারো না মায়ায়। তাও তোমারে বলি বউ, মাইয়া মানুষের শরীর বাড়ার সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টির লোভ বাড়ে। তাই কাল বিলম্ব না কইরা মাইয়া শ্বশুড়বাড়িতে পাঠাই দেওয়া উচিত।’

তনয়া ক্ষানিক বিরক্ত হয় শাশুড়ির কথায়। এসব কুসংস্কার এখনো তার শাশুড়ি ধরে রেখেছে। মেয়েটার মাথায় এসব ঢুকলে আর পড়াশোনা করবে! এমনেতেই তো প্রচুর দুষ্টু।

তিস্তা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
-‘আম্মা, তোমার শাশুড়ির বিয়ে করার শখ জেগেছে। সেটা তো বলতে পারছে না তাই আমার নামে চালাচ্ছে। কি যুবতী? তাই না?’

তনয়া মেয়ের এমন বেসরম কথায় হেসে উঠে। বৃদ্ধ লতিকা ফোঁকলা দাঁতে একটু হেসে,লজ্জা রাঙা কণ্ঠে একটু শাসনের সুর ঢেলে বললো,
-‘দিনে দিনে গতর বাড়ে আর ইতরামি বাড়ে মাইয়ার।’

তিস্তা দাদীর গাল টেনে দেয়। ফিঁক করে হেসে উঠে তিনজনে। দাদী’কে সে বেশিরভাগ সময় যুবতী ডাকে। কারণ দাদী পছন্দ করে না তাকে কেউ বৃদ্ধ ভাবুক। তিস্তার ডাকে দাদী বেশ আনন্দিত হয়।

______

আজ দুপুর তিনটে বাজার আগেই তিস্তা হাজির পাঠশালায়। পড়নে তার নতুন লাল টুকটুকে গোল ফ্রকটা। তিস্তা’র বয়স সতেরো হলেও দেখতে বেশ বাচ্চাদের মতন ছোট।

প্লাবন সবে স্নান করে এসেছে। খেতে যাওয়ার জন্য রান্নাঘরে যেতেই তার টিনের চালের পড়ার ঘরটি চোখে পড়লো। লাল টুকটুকে ফ্রক পড়া এক কিশোরী মাথা নিচু করে বসে রইল। প্লাবন ক্ষানিকটা অবাক হলো। তিস্তা তো এত তাড়াতাড়ি পড়তে আসার মেয়ে না। প্লাবন নিজের খাবারের কথা ভুলে দ্রুত পায়ে পাঠশালার রুমটিতে চলে যায়। তিস্তার কাছাকাছি আসতে কান্নার শব্দে ভেসে এলো। প্লাবনের বুকটা ক্ষানিক মোচড় দিয়ে উঠলো।

সকালে মেয়েটা রাগ করে আর স্কুলও যায় নি। এখন এখানে কান্না করছে কেনো?সকালের রাগের জন্য কান্না করছে?

ক্ষানিকটা ইতস্ততা নিয়ে প্লাবন ভরাট তবে শান্ত কণ্ঠে ডাক দিলো,
-‘তিস্তা?’

তিস্তার কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। বরং সে কান্নার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। প্লাবন আবারও ডাক দিলো আদুরে কন্ঠে,
-‘তিস্তা,কী হলো তোর?’

তিস্তার তবুও নড়চড় নেই। প্লাবন এবার ইতস্ততা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তার ডান হাতটা তিস্তার বাহুতে রাখতেই তিস্তা ভয় পেয়ে ছিটকে দূরে সরে গেলো। ভীত কণ্ঠে বললো,
-‘আমি আর এ জামা পড়বো না। আমি আর ছুটোছুটি করবো না। আমি আর ওর সামনে যাবো না। নোংরা মানুষ। সবাই নোংরা।’

তিস্তার আচমকা বলা কথা গুলো প্লাবনের মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতে একটু সময় লাগে। কিন্তু বোধগম্য হতেই শরীরটা একটু কেঁপে উঠে। অনাকাঙ্খিত ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তিস্তা এসব কথা বলছে কেনো!

প্লাবন ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলে,
-‘কী হয়েছে তিস্তা? কে কী বলেছে তোকে? আমায় বল। কী হয়েছে?’

তিস্তার ততক্ষণে হেঁচকি উঠে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। সে মাস্টারমশাই এর দিকে তাকায়। চোখ গুলো লাল হয়ে ফুলে গেছে। মাস্টারমশাই’কে দেখে ভিতরের সব কান্না বের হয়ে আসে। অভিযোগের স্বরে বলে,
-‘সবাই খারাপ মাস্টারমশাই। অনেক খারাপ। জানেন আমার গাল, পেট, ঘাড় ধরেছে ও বাজে ভাবে। খুব খারাপ ওর হাত।’

প্লাবন আৎকে উঠে। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
-‘কে? কে ধরেছে তোর গাল?’

তিস্তা ফুপিয়ে কেঁদে দেয়। অস্ফুটস্বরে বলে,
-‘দু-দুলাভাই।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here