মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্ব ২৫

0
355

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ পঁচিশ

“কিগো,তিস্তা রানী’র যে বড্ড মন বেজার? পরীক্ষা কী অনেক খারাপ হলো?”

বিষাদিনী’র কথায় ধ্যান ভাঙে তিস্তা’র। মুচকি হেসে মাথা ডানে বামে ঘুরিয়ে বলে,
“নাহ্,পরীক্ষা তো মন খারাপ করার মতন হয় নি। পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে।”

“তবে যে আজ বড্ড চুপচাপ?”

“তেমন কিছু না। তোমরা আড্ডা দেও। আমি তো শুনছি। মাস্টারমশাই এলে কিন্তু আর আড্ডা দিতে পারবে না।”

তিস্তা’র কথায় সবাই আবার আড্ডাতে মনযোগী হলো। মেতে উঠলো নতুন উন্মাদনায়। তবে এটাকে আড্ডা বলা যায় না। বিষাদিনী কথার ছলে যা-ই বলে, সবটা থেকেই বাংলা’র ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি সম্পর্কে। কিছু না কিছু জানাই যায়।

সময়টা তখন পানসে,ক্লান্ত বিকেল। পাখিরা ফিরে এসেছে তার নীড়ে। সূর্য সারাদিন তার উত্তপ্ততা ছড়িয়ে এখন বাড়ি ফিরছে। চারপাশের আবহাওয়া টা থম মারা। যেন ঝড় হবে খুব।

তিস্তা’র মনেও চলছে উথাল-পাথাল ঝড়। বিবেকের তাড়নায় আর মনের পীড়ায় সে দিক ভ্রষ্ট। বিবেকের কথা শুনলে হৃদয়ের অভ্যন্তরে হবে র’ক্ত ক্ষরণ। আবার যদি হৃদয়ের কথা শুনে তবে বিবেকের কাছে হবে সবচেয়ে ঘৃণীয় মানুষ। কী করবে সে?

তিস্তা নিজের বই খাতা গুলো গুটিয়ে নিলো। উঠে দাঁড়ালো নিবিড় ভাবে। তিস্তার আকষ্মিক উঠে দাঁড়ানোতে আলোচনায় ভাঁটা পড়লো। কঙ্কণা অবাক কণ্ঠে বললো,
“কিরে, কোথায় যাচ্ছিস? মাস্টারমশাই পড়ানো শুরুই করলো না, আর তুই চলে যাচ্ছিস!”

তিস্তা উত্তর দিলো না। এর আগেই বাহিরের ঘর থেকে আশালতা বেগমের কণ্ঠ ভেসে এলো। সে কর্কশ গলায় বললো,
“আজ বোধহয় পড়াইবো না, বাবু। তারে একটু ঐ গ্রামের বাজারে পাঠিয়েছে। বিষাদিনী’র জন্য ভালো শাড়ি আনতে। কাল তো গ্রামে অনুষ্ঠান আছে, মধুসখী’র ঘাটে মেলা। আর তাছাড়া কয়দিন পর বউ হইবো,তখন তো কিনতেই হবে। তাই আগে আগে কিনে অভ্যাস করুক।”

আশালতা’র কথা থামলো। চুপ হয়ে গেলো আড্ডার আসর। নিজের মাঝে হাজার খানেক ভাবনা মাটিচাপা দিয়ে বিষাদিনী’র দিকে ধ্যান দিলো তিস্তা। মেয়েটা খুব সুন্দর। প্রাপ্তবয়স্ক আর খুব স্বাধীন চেতনার মেয়ে। এমন একটা মেয়েকে ফেরানো মাস্টারমশাই এর জীবনে সবচেয়ে বড় বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না।

তিস্তা দাঁড়ালো না আর। বের হয়ে গেলো বিনা বাক্যে। পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলো সবাই কিন্তু কোনো আশানুরূপ ফল পেলো না। তিস্তা সদর দরজা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরই একজনের মুখে দারুণ হাসির ঝিলিক দেখা দিলো।

_

প্রতি জৈষ্ঠ্যমাসে মধুসখী’র কোল ঘেষে দারুণ উৎসব উদযাপিত হয়। শোনা যায়, জমিদারের বিবাহ বার্ষিকী নাকি অনেক যুগ যাবত উদযাপিত হয়ে আসছে। জমিদার ভালোবাসা আর নিজের সম্পর্কের প্রতি ছিলেন খুব যত্নশীল আর শৌখিন। তিনিই সবসময় জৈষ্ঠ্য মাসের পঁচিশ তারিখ বড় করে একটি উৎসব উদযাপন করতেন। গ্রামের সব মানুষকে খাওয়াতেন, মেলা বসতো এখানে। সবাই ভরপুর আনন্দ করতো। তার স্ত্রী’র মুখের হাসিটা’ই ছিলো জমিদারের জন্য স্বর্গ। তাই এত আয়োজন। কালের গহব্বরে হারিয়ে গেছেন জমিদার ও তার শৌখিন সম্পর্ক। কিন্তু রয়ে গেছে সেই ধারাবাহিকতা।

তিস্তা মধুসখী’র সামনে দিয়ে হেঁটে আসছে। মন তার এখন আগের চেয়ে ভালো। কি সুন্দর রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হচ্ছে নদীর আশপাশ। কি সুন্দর লাগছে! সজীব মধুসখী’র সাথে সাজটা যেন দারুণ মানিয়েছে। আগে এ অনুষ্ঠান হলেও মধুসখী তখন ছিলো মৃ’ত। দারুণ অনুষ্ঠান হলেও এমন সজীবতা এতদিন দেখা যায় নি। ভাবনার মাঝেই তিস্তাকে কেউ ডেকে উঠলো,

“এই তিস্তা, না পড়ে কোথায় যাচ্ছিস? আমি চলে এসেছি তো।”

তিস্তার মুগ্ধতা কেটে যায়। বহুল পরিচিত কণ্ঠে ধ্যান ভাঙে। অতি পরিচিত ভাবে ছলাৎ করে উঠে হৃদপিণ্ডটা। তিস্তার চিত্ত জানে এ ডাকের মানুষটা কে। তিস্তা নিজেকে ধাতস্থ করে। কঠিন হতে হবে তাকে। অনেক কঠিন। যতটা কঠিন হলে প্রিয় মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিবে, ঠিক ততটা কঠিন।

তিস্তা’কে চুপ থাকতে দেখে প্লাবন এগিয়ে এলো। হতাশ কণ্ঠে বললো,
“ফিরে যাচ্ছিস যে? আমি চলে এসেছি তো। চল এবার।”

“নাহ্, যাবো না। আপনি তো নাকি আজ আর পড়াবেন না। নতুন হবু বউয়ের জন্য শখ করে শাড়ি কিনতে গিয়েছেন।”

তিস্তার কাঠ কাঠ জবাবে সামান্য হকচকিয়ে যায় প্লাবন। আশেপাশে মানুষজনের দৃষ্টি অনুসরণ করে, কণ্ঠ সামান্য খাদে নামিয়ে বললো,
“কে বলেছে পড়াবো না? তোদের তো এখন পরীক্ষা চলছে। এখন না পড়ালে কখন পড়াবো?”

তিস্তা উত্তর দেয় না। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। প্লাবন সামান্য নরম হয়। অসহায় কণ্ঠে বলে,
“এমন করছিস কেনো? আমি কী কোনো ভুল করেছি?”

প্রশ্নের পরিবর্তে কোনো উত্তর মিলে না। তিস্তা যেন কথা না বলার শপথ নিয়েছে। প্লাবণ কতক্ষন চুপ থেকে নিজের হাতে থাকা একটা প্যাকেট তিস্তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

“তোমার ভীষণ অভিমানের পানসে রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে যাক,স্রোতস্বিনী। আমরা আবারও উচ্ছ্বাসের সাথে উড়ে বেড়াবো, এই গ্রামের আনাচে-কানাচে। আর হ্যাঁ, আমি হবু বউয়ের জন্যই শাড়ি কিনতে গিয়েছিলাম। তুমিই তো আমার সবটার অধিকারীনি।”

তিস্তা থেমে যায়। কঠিন রাগের পাহাড় সামান্য গলে যায়। নিবিড় হয় রাগের তেজ। মাস্টারের আকুতি মাখা চাহুনির জন্য নিতে হয় যত্নের উপহার খানা। প্যাকেট টা হাতে নিয়েই গটগট পায়ে চলে যায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। এখানে আর থাকা যাবে না। যে প্রেমিকের জন্য গ্রীষ্মের কঠিন উত্তাপ সাজিয়ে রাখা,তাকে কোমল গলে যাওয়া প্রেম দেওয়া যাবে না। বিবেকের কাছে ছোট কখনোই সে হবে না।

_

“বাহ্ তিস্তা! ডুমুর রাঙের শাড়িটা তো তোমায় বেশ মানিয়েছে! কখন কিনেছো?”

বিষাদিনী’র প্রশ্নে সামান্য হোঁচট খায় তিস্তা। আমতা-আমতা করে বলে,
“কাল কিনেছি। আজকে মেলা উপলক্ষে আরকি কেনা হলো।”

বকুল শব্দ করে হেসে উঠলো। ঠাট্টার স্বরে বললো,
“মনে হচ্ছে বিবাহ বার্ষিকী টা জমিদারের না। তোর।”

আরেকদফা লজ্জা পেলো তিস্তা। কোনোরকমে লজ্জা পাশে রেখে বললো,
“জমিদারের মতন এমন পা’গ’ল প্রেমিক পেলে নাহয় এ কথা টা মানা যেতো।”

এবার তিস্তার কথায় সায় জানালো বিষাদিনী। মধুসখী’র ঘাটে চার কন্যা বেশ রমরমা আড্ডা দিচ্ছে। কথার প্রেক্ষিতে কথা বাড়ে।

বিষাদিনী হঠাৎ বলে উঠলো,
“জমিদার আসলেই পা’গ’ল প্রেমিক ছিলো। নাহয় নিজের কষ্ট এভাবে কমাতেন?”

তিস্তা, বকুল আর কঙ্কণা অবাক হয় বিষাদিনীর কথায়। অবাক কণ্ঠে বলে,
“নিজের কষ্ঠ কীভাবে কমাতেন?”

“আচ্ছা, সেটা পড়ে বলবো।আগে বলো, তোমাদের কী মনে হয়? জমিদার তার স্ত্রীকে কতটুকু ভালোবাসতেন?”

“আকাশের চেয়েও বেশি পরিমাণ। হিসেব করা সম্ভব না।

তিন কিশোরীর ঝটপট উত্তর। তাদের উত্তর শুনে বিষাদিনী বেশ উচ্চ স্বরে হেসে উঠে। প্রায় কতক্ষন হেসে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে বললো,
“যদি আমি বলি,জমিদারের বউ নিজে পড়ে গিয়ে মা’রা যায় নি। তাকে মে’রে ফেলা হয়েছে। তখন তোমাদের অনুভূতি কেমন হবে!”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here