#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা
পর্বঃ বিশ
মধুসখী এখন জলে পরিপূর্ণ। একটু আগে চাঁদ ছিলো না গগণে কিন্তু এখন যেনো ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের যেনো যৌবন উপচে পড়ছে। পরিবেশেও এখন একটা মুগ্ধতা কাজ করছে। এতদিন পর একটু দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণায় আচ্ছাদিত মানব মানবী যে আজ মুখোমুখি। এতদিন পর তৃষ্ণার সমাপ্তিতে প্রকৃতি মাঝেও যেনো আনন্দের ঢেউ।
মধুসখী’র ঘাটে বসে আছে তিস্তা। তার সাথেই কিছুটা দূরে বসে আছে মাস্টারমশাই। দু’জনই চুপচাপ।
কত আকুতি মিনতি করে অবশেষে তিস্তাকে এ ঘাট অব্দি এনেছে প্লাবন। আর নয় দূরত্ব। এত কাছে থেকেও সে দূরত্ব মানবে না।
তিস্তা হাঁটুর উপর মাথা রেখে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকায় নি মাস্টারমশাই এর দিকে। সে কঠিন হতে চাচ্ছে। যতটা কঠিন হলে মাস্টারমশাই এর থেকে মুখ ফেরানো যায়, ঠিক ততটা কঠিন।
মুখ নাহয় ফেরানো যায় কিন্তু হৃদয়? হৃদয় কী আদৌও ফেরানো সম্ভব? সম্ভব না বলেই তো এত রাতে এ মানুষটার সাথে চলে এসেছে এত দূর। হৃদয় তো চায় মানুষটার সান্নিধ্য। বোঁকা হৃদয় কী আর কাঠিন্যতা বোঝে?
নিরবতা ভাঙলো প্লাবন। ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠলো,
-‘তিস্তা?’
তিস্তার শরীরের ভিতর হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো। এইতো,তার ভিতর রাজ্যের প্রশান্তি। এতদিনের দহন যেনো এক নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। তিস্তা মনে মনে আওড়ালো “ভালোবাসা সুন্দর”।
তিস্তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে প্লাবন এগিয়ে এলো। তিস্তার হাতটা বিনা সংকোচে নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বেশ আদুরে স্বরে বললো,
-‘মান করেছিস নাকি রাগ?’
তিস্তার মন আহ্লাদ পেয়ে যায় কিন্তু তিস্তা তাদের আহ্লাদের মূল্য দেয় না। নিজের বা’হাতটা টান দিয়ে ছড়িয়ে নেয় মাস্টারমশাই’র হাত থেকে। কয়েকটা অমলিন শব্দ উচ্চারণ করে বলে,
-‘আমি নষ্ট মেয়ে মানুষ। পাপ লেগে যাবে।’
কয়েকটা শব্দ গুচ্ছ ক্ষতবিক্ষত করে প্লাবনকে। সবসময় কী ছুরি লাগে আঘাত করতে? বাক্যের আঘাত যে কী ভয়ঙ্কর। ছুরিও মাথা নত করবে নির্দ্বিধায়।
আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্লাবন করুণ স্বরে বললো,
-‘চাঁদের কী কলঙ্ক লাগে! যতই লোকে তারে কলঙ্কিনী বলে? তুই তো আমার চাঁদ।’
-‘আচ্ছা? তা এ আকাশে তো দুটি চাঁদ উঠে না, তবে মাস্টারমশাই এর হৃদয় মাঝে দুই চাঁদের আনাগোনা যে?’
আবার,আবার মেয়েটা তাকে ক্ষত-বিক্ষত করলো। বড্ড বড় হয়ে গেলো নাকি সে? আজকাল কথা বলতেও ভাবে না যে? নাকি হৃদয়ের কোমলতা জমে পাথর হয়ে গেছে?
নিজেকে ধাতস্থ করে প্লাবন। তিস্তার হাত’টা আবারও টেনে নিতে চায়। কিন্তু তিস্তা হাত’টা দ্বিগুণ শক্ত রেখে বললো,
-‘যখন এই হাতটার আপনাকে প্রয়োজন ছিলো,তখন তো ছিলেন না। তবে আজ কেনো? আজ তো তার কিছুই নেই। সব হারিয়েছে সে। তবে আজ কেনো তাকে ধরতে আসছেন? শূণ্যতা ধরে লাভ নেই। এর চেয়ে নতুনে যেমন মত্ত হয়েছেন,সেখানেই তেমন থাকুন।’
প্লাবনের এবার রাগ হলো। মেয়েটা তাকে কথা’ই বলতে দিচ্ছে না। একেক টা জবাব দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে।
প্লাবন এবার জোর করে আঁকড়ে ধরলো তিস্তার হাত। শক্ত কণ্ঠে বললো,
-‘চড় চিনিস? ভালো ব্যবহার করছি তাই ভালো লাগে না, তাই না? আমি কী ইচ্ছে করে হাতটা ছেড়ে ছিলাম? নিত্যান্তই বাধ্য হয়ে তোকে ছেড়ে দূরে যেতে হয়েছে। আবার তোর টানে ফিরে এসেছি তো আমি। আসি নি? শুধু তোর জন্যই তো আমার এ বেহাল দশা। তোর বিরহে প্রতি নিয়ত মরছিলাম। বুজেছিলি সেসব তুই? নিজের অভিমান, অভিযোগ আমার উপর ছেড়ে দে। কিন্তু একদম তিক্ততা দিবি না। মে’রে ফেলবো। একদম মে’রে ফেলবো। বেশি বড় হয়েছিস?’
-‘ম’রেই তো গেছি। আর কী মা’রবেন? মৃত আত্মা নিয়ে তবুও তো ছিলাম আপনার অপেক্ষায়। কিন্তু আপনি, আপনি আমায় আরও দারুণ ভাবে মেরে ফেললেন। মুখ’ই যদি ফিরিয়ে নেওয়ার ছিলো,তবে অপেক্ষা করতে কেনো বলেছিলেন?’
প্লাবন কাল বিলম্ব না করে জড়িয়ে ধরলো তিস্তাকে। মধুসখী সাক্ষী হলো দারুণ মুহূর্তের। নিরব চারপাশে হঠাৎ কান্নার শব্দ ভেসে এলো। তিস্তা কাঁদছে। এতদিনের অভিযোগ, অভিমান সব উজাড় করে দিয়ে বললো,
-‘কেনো শহুরে বউ নিয়ে এলেন এখানে? আমাকে মে’রে ফেলার জন্য তাই না? কেনো ছোট্ট কিশোরীর মনে এমন অনুভূতির সৃষ্টি করেছিলেন? শেষমেশ অনলে পুড়িয়ে মা’রার জন্য তাই না?’
তিস্তার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে প্লাবন উচ্চারণ করলো ভয়ঙ্কর সুখকর বাক্য,
-‘বিয়েটা হয় নি। তুই ছাড়া এই প্লাবনের সাথে আর কাউকে মানায় বল?’
তিস্তা যেনো ভুল কিছু শুনে ফেলেছে বোধ করলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘ওরা যে বললো,শহুরে বউ এসেছে। তবে?’
প্লাবন তিস্তার কেঁদে ঢোল হওয়া চোখ মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ওরা না বুঝেই তো লাফিয়েছে। আর,বাকিটা আমার মায়ের জন্য বোঝাতে পারি নি। বিয়েটা হবে হবে করেও শেষ মুহূর্তে হয় নি।’
-‘কেনো?’
-‘বিষাদিনী, মানে যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সে মেয়েটার জন্য। ও শেষ মুহূর্তে এসে বললো ও নাকি এখন বিয়েটা করবে না। আগে ও আমাদের গ্রামে আসবে তারপর এখানে এসে বিয়েটা করবে।’
তিস্তা প্রথম কথাটা অবাক হয়ে শুনলেও পরের কথাটাতে বিষন্নতা ভর করে। আজ হোক, কাল হোক,বিয়েটা তো হবেই।
আবারও অভিমান বাঁধে মানবী’র মনে। শক্ত কণ্ঠে বলে,
-‘ওহ্, তবে বিয়েটা একবারের জন্য বন্ধ হয় নি? বিয়েটা তবে শেষ পর্যন্ত হবে! আজ না হোক কাল,একদিন তো আপনার ঘরে বউ হয়ে ঐ মানুষটা আসবেই। তবে আর মায়া বাড়িয়ে কী লাভ!’
-‘বিয়েটা আর হবে না। একবার যেহেতু আমি তোর কাছ অব্দি এসেছি, বিয়েটা আর করছি না। তুই বিহীন আমি তো অসম্পূর্ণ।’
-‘কিন্তু আমিই যে এখন পঁচে গেছি। শুনেছেন তো। বড্ড দেরিতে এলেন যে।’
প্লাবনের ধৈর্যের সীমা আর বাঁধ মানলো না। মেয়েটাকে সত্যিই শাসন করা দরকার। তৎক্ষনাৎ চড় বসিয়ে দিলো তিস্তার গালে। রুক্ষ কণ্ঠে বললো,
-‘বেশি বুজতে শিখেছিস আজকাল? জিহ্বা টা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। অহেতুক কথা বলার জন্য এইটা থাকার প্রয়োজন নেই।’
তিস্তা এবার জড়িয়ে ধরলো মাস্টারমশাইকে। ভীষণ গভীর ভাবে আগলে নিলো প্রেম পায়রাকে। এইতো, মাস্টারমশাই তার। মাস্টারমশাই তো তার গায়ে কালী লেপন করে নি। তবে গ্রামের মানুষের কথায় কী আসে যায়?
_
বিষাদিনীও আজ চন্দ্র বিলাস করছে। জানালার লোহার মরচেপড়া শিকটা ধরে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে সাদাকালো ছবিটার দিকে। এইতো তার প্রাণের মানুষ। এইতো তার না হওয়া আপন মানুষ।
ছবিটাতে হাত বুলিয়ে যায় বিষাদিনী। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মুখভর্তি ঘন দাঁড়িওয়ালা সুপুরুষটির ভেতর কী যাদু আছে সে জানেনা। তবে,মানুষটির শূণ্যতা তাকে পোড়ায়। ভীষণ পোড়ায়। মানুষটি তো তার না। সৃষ্টিকর্তা যদি তার জন্য মানুষটাকে না-ই বানিয়েছিলেন তবে মানুষটার প্রতি মায়া জন্মাতে দিয়েছিলো কেনো?
সৃষ্টিকর্তার বুঝি দারুণ লাগে কাউকে পুড়তে দেখে?
বিষাদিনী খাতা নেয়। গোটা গোটা অক্ষরে লিখে,
“আপনি আমার ভীষন কাছে, সবটা হৃদয় জুড়ে,
ছুঁতে গেলে আপনি যেনো, আকাশ সমান দূরে।”
বরাবরের ন্যায় ছিঁড়ে ফেলে কাগজটা। ছুঁড়ে ফেলে শুকনো পাতার মাঝে। মানুষ জানবে না বিষাদিনীর আর্তনাদ। কেবল শুকনো পাতা গুলো জানবে, প্রেম বড় জ্বালাময়।
বিষাদিনী ছবি খানা জড়িয়ে ধরে বক্ষ মাঝে।
গভীর রাতে সবারই তো প্রিয় মানুষ সাথে আছে। শুধু তফাৎ একটায়। কারো সাথে কেবল স্মৃতি হয়ে, কারো কাছে বা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে।
_
তিস্তা আর প্লাবনের নিরবতার মাঝে হঠাৎ ঝোঁপ থেকে শব্দ হয়। ভয় পেয়ে যায় তিস্তা। কেউ তাদের দেখে ফেলবে না তো?
প্লাবনও ক্ষানিকটা চমকে চায়। কত গুলো পায়ের শব্দ হয়। তিস্তা ছিটকে যায় প্লাবন থেকে। এই চাঁদনী রাত কী আবার ভয়ঙ্কর অমাবস্যা আনবে তার জীবনে?
মানুষ গুলোর পায়ের শব্দ আরও নিকটে শোনা যাচ্ছে সাথে তরতর করে ঘামছে তিস্তা। নতুন কালরাত্রি যোগ হবে কী তার জীবনে?
#চলবে