মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্ব ১৮ +১৯

0
353

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ আঠারো

হাঁটে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ দ্বিগুণ মানুষ। “কন্যার সুখ” ভান্ডারের সামনে উপচে পড়া ভীড়। কারণ দোকানে বসে আছে সাদা রঙের থ্রি-পিস পড়া তিস্তা। হাতে তার মাধ্যমিকের ‘সাহিত্য কণিকা’ বই। বাংলা বলেই জানি যাকে। খুব মনযোগ দিয়ে পড়ছে বইটা। তার দোকানের সামনে যে অগণিত মানুষের ঢেউ, সেটা যেনো সে দেখেও দেখছে না।

মানুষ গুলো কী আর ভালো কাজে ভীড় জমিয়েছে? তারা তো কৌতূহল মিটানোর জন্য ভীড় জমিয়েছে। এদের দেখেও কী লাভ? ক্যাশ বাক্সে কী আর লক্ষী আসবে?

গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে তিস্তার লজ্জাহীন কাজের কথা। মানুষ তো অর্ধেকই আসছে কথা সত্যি কিনা সেটা যাচাই করে চক্ষু স্বার্থক করতে।

আর তো ভালো লাগে না। এত ভীড় করার কোনো মানে আছে? এগুলার কী খেয়ে কাজকর্ম নেই? নাকি তিস্তাকে এর আগে কখনো দেখে নি? আজব!

তিস্তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। ভীড়ের মাঝে তখন মানুষের কানাকানি চলছে। কেউবা বাজারের পন্যের মতন তিস্তাকে ক্রয় করা যায় কিনা সেই ছক কষতে ব্যস্ত।

হাতের বইটা শব্দ করে ক্যাশবাক্সের উপর রেখে উচ্চস্বরে বললো,
-‘কী সমস্যা আপনাদের? কী চাই এখানে? কিছু লাগলে নেন, নাহয় পথ ছাড়ুন।’

এবার যেনো মানুষ গুলো কথা বলার সুযোগ পেলো। বিশ্রী হেসে কয়েকজন বললো,
-‘এ দোকানে তোরেই খালি ভাল্লাগছে। তোরেই কিনতে চাই। ভরা বজারে, এ ব্যবসা করতে নামছোছ নাকি?’

তিস্তা ক্ষাণিকটা থমকে যায় কিন্তু দমে যায় না। সে তো তৈরী হয়েই এসেছে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। বাড়িতে যেভাবে ঘরের মানুষের সাথেই লড়ে আসলো, বাহিরে পারবে না?

দাদীর কুৎসিত কথা দাদীকেই ফিরিয়ে দিয়েছে। মাও আজ এই প্রথম দাদীর সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেছে। দাদী চুপ হয়েছে। এখন চুপ হওয়ার পালা এদের।

তিস্তা একটু আগের কথাটা একদম গায়ে মাখে নি ভাব করে বললো,
-‘ওমা! মানুষ বুঝি বিক্রি করা যায়? তবে নাহয় তোমার ঘরের মা, বোন,বউ,মেয়েকেই আগে বিক্রি করো।’

ভীষণ সমাগম চুপ হয়ে যায়। কিছু মানুষ তো তাজ্জব বনে যায় তিস্তার হাবভাব দেখে। এ মেয়েটার এখনো এত তেজ?

যে লোকটা তিস্তাকে খারাপ কথা বলেছে সে-ই আবার তেড়ে এসে বললো,
-‘এই, এই, তোর মতন আমার ঘরের মাইয়া,বউ বেহায়া নাকি? না,বাজারের মেয়েছেলে? নষ্ট মেয়ে মানুষ। আবার আমার বাড়ির মেয়েছেলের সাথে নিজের তুলনা দেস? তোর কাছ থেইকা কেউ কিছু কিনবো না। মাইয়া মানুষ হইয়া গঞ্জের হাঁটে বহস আবার এত কথা।’

রীতিমতো মানুষ আরও বেশি জড়ো হয়ে গেলো। তিস্তা কণ্ঠে তেজ রেখে বললো,
-‘চাচা,মানুষ কথাটা তো সবার জন্যই প্রযোজ্য। ছেলে মেয়ে সবাই মানুষ। কিন্তু আমাদের সমাজ মানুষ শব্দটি কেবল ছেলেদের জন্যই ব্যবহার করে। আর মানুষ শব্দটির আগে খুব সন্তর্পণে “মেয়ে” নামক শব্দটি যোগ করে মানুষ নামক জাত থেকে আলাদা করে দেয় নারী জাতটাকে। কেবল “মেয়ে” নামক বিশেষণটি যোগ করে নারীদের চরম দুর্বল জাত হিসেবে প্রকাশ করে।

যদি আলাদা করতেই হয় তবে,পুরুষ জাতদের মানুষ শব্দটির আগে “ছেলে” বিশেষণটি কেনো যোগ করা হয় না?

তবে,মানুষ কী শুধুই পুরুষরা? নারী কেবল এক অসহায় জাত হয়েই থাকবে? নারীরা কখনো ঝলমলে চকচকে “মানুষ” হতে পারবে না? নারীরা কেবল মেয়ে মানুষ হয়েই থাকবে? বিশেষণটির এমন সৎ ব্যবহার বুঝি আমাদের সমাজের চেয়ে ভালো কেউ করতেই পারবে না।

আজ মেয়ে বলেই আমি সবটা সহ্য করার পরও দোষীর কাঠগড়ায়। ঘরে খাবার নেই চাচা, আজ পরিবারের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে চেয়েছি মেয়ে হয়ে,সেটাই কী অপরাধ?

আমায় কিনবেন, চাচা? আপনার মেয়ের বয়সীই তো আমি। আমাকে এসব বলার আগে ওর কথা মাথায় এলো না? আমাদের মাঝে তো তফাত নেই।

নাকি আপনার ঘরের মেয়েরাই কেবল মেয়ে। আর,আমরা কোনো পণ্য?’

একদম চুপ পুরো জনসমুদ্রের ঢেউ। নিরব কথার বিস্ফোরণ যে সবার গহীনে কতটা স্পর্শ করেছে তা এ বিস্ফোরণ না দেখলে বুঝা’ই যেতো।

ভীড় ঠেলে নেপাল ঠাকুর তিস্তাদের দোকানের সামনে এলো। ভীষণ মমতাময় কণ্ঠে বললো,
-‘তিস্তা, আমারে আধা কেজি চিঁড়া দেও। সাথে এক খন্ড গুড়ও দিও।’

তিস্তার চোখে উপচে পড়া জল গুলো তিস্তা ঝড়তে দেয় নি। হাসিমুখে সে নেপাল ঠাকুরকে চিঁড়ে,গুড় দিলো। তার বিনিময়ে নেপাল ঠাকুর মূল্য পরিশোধ করলো।

আর কেউ দাঁড়ালো না দোকানের সামনে ভীড় করে। যে যার মতন নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালো। নেপাল ঠাকুর প্রাণ ভরে তিস্তাকে আশীর্বাদ করলো। এই তিস্তা কী কেবল তিস্তা?

এ তিস্তার মাঝে আছে তার চঞ্চল ভ্রমরী,সব বাবা-মায়ের কন্যা।

নেপাল ঠাকুর যেতেই তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে টুলটাতে বসে পড়লো। মনে পড়লো সকালের কথা। দাদী তাকে যখন বললো সে নোংরা মেয়ে ছেলের খাতায় যেনো নাম লেখায়,তখন তিস্তা হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় ক্ষ্যাপে গেলো।

চোখ গুলো ঘৃণায় লাল হয়ে গেলো। একদলা থুতু উঠোনের মাঝে ফেলে বলেছিলো,
-‘তোমার কথার ধরণে আমার ঘৃণা হচ্ছে দাদী। তুমিও তো মেয়ে। নিজের নাতনীকে এমন কথা বলতে বিবেকে বাঁধলো না?’

দাদীও দ্বিগুণ রেগে গেলো। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললো,
-‘তোর লগে কথা কইতে আবার বিবেক কিসের? ডুইবা মরতে পারোস নাই? নিলর্জ মেয়ে।’

এমন এক কথা দু কথায় দাদীর ভাষা শৈলী খারাপ হলো। অবশেষে দিক না পেয়ে তনয়া বেগম মেয়ের হয়ে কথা বলেন।

সকালের কথা ভাবতেই তিস্তার শরীরে আবার ঘিনঘিন ভাবটা জেগে উঠলো। কিছুক্ষণ মৌন থাকতেই মনে পড়লো আরও দরকারী একটা কথা। আজ তো মাস্টারমশাই এর বিয়ে। মানুষটা আর তার আছে তো?

___
‘বিয়েটা আমি করবো না, মা।’

কিছুক্ষণ পর যে ছেলের বিয়ে, সে ছেলের মুখে এমন কথা শুনেও আশ্চর্য হয় না আশালতা। মুখে আগের ন্যায় গাম্ভীর্যতা জড়িয়ে রেখেই বললো,
-‘এখানে তোমার অনুভূতির দাম আমি দিতে পারছি না।’
-‘কেনো,মা? আজ আমার চেয়েও আপনার জেদ বড় হলো?’

ছেলের প্রশ্নে ক্ষাণিকটা ব্যাথিত হলো আশালতা, কিন্তু প্রকাশ করলেন না বরং ক্ষীণ স্বরে বললেন,
-‘আমার জেদ না এটা। ধরতে পারো শেষ ইচ্ছে।’
-‘আপনার শেষ ইচ্ছে, আপনার ছেলের জীবনটা শেষ করতে পারে। তা জানেন তো?’

-‘কাউকে বাঁচাতে মাঝে মাঝে নিজে শেষ হলে ক্ষতি কী?’

মায়ের প্রশ্নে অবাক হলো প্লাবন। মা তো বেশ ছেলে ভক্ত। তবে আজ ছেলের শেষ হওয়াটাও মায়ের শরীরে লাগছে না?

ভাগ্য কী তবে, অন্য রকম খেলা খেলবে?

___

বিষাদিনী খুব যত্নে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিলো। এ বাড়িতে আজই তো তার শেষ দিন। এরপর সে চলবে সুখের ঠিকানায়। বিলাসিনী টা ভালো থাকতে পারবে তো?

অবশ্য বিলাসিনী খুব বুদ্ধিমান। সে নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিবে। সবাই কী আর বিষাদিনীর মতন বিষাদ প্রেমী হয়?

___

গতকাল বিকেল অব্দি বাজারে ছিলো তিস্তা। বেচাকেনা খারাপ হয় নি। অনেকেই তার থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছে।

সন্ধ্যের পর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি এসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।

এখন ভোর। চারপাশে সদ্য আলো ফুটেছে। তিস্তা তখন বেঘোর ঘুমে।

তনয়া বেগম বাহির থেকে ছুটে এলেন। তিস্তাকে ধাক্কা দিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
-‘তিস্তা,তাড়াতাড়ি উঠো। গ্রামে যে এক নতুন ঘটনা ঘটেছে।’

হঠাৎ ধাক্কায় ধড়ফড়িয়ে উঠে তিস্তা। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কের বোধগম্য হয় না মায়ের আচরণ। ভীত কণ্ঠে সে বললো,
-‘কী হয়েছে,আম্মা?’

তনয়া বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণের অশ্রু মুছলেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন,
-‘তোমার মাস্টারমশাই যে গ্রামে আসছে। সাথে তার নতুন বউ।’

তিস্তা কিছুটা সময় নেয় কথাটা বোঝার জন্য। কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি যেতেই বিদ্যুৎ খেলে যায় তার শরীরে। কেবল কানে আর মস্তিষ্কে একটা কথায় বাজছে, “মাস্টারমশাই গ্রামে ফিরেছে নতুন বউ নিয়ে।”

তিস্তা চুপ রয়। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,
-‘তবে কী সব,
ছিলো মিছে কলরব?’

#চলবে

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ উনিশ

-‘জানিস তিস্তা, বকুল ফুলের মতন ঘ্রাণ আসতেছিলো ঐ শহুরে বউ এর শরীর থেকে। এত দারুণ ঘ্রাণ আমি এর আগে কখনো,কোথাও পাই নি। কী সুন্দর তারে দেখতে। এমন মেয়ে পুরো গ্রামে খুঁজে পাবি না। এ জন্য ই বুঝি মাস্টারমশাই ভুলে গেলো গ্রামের তিস্তাকে?’

নিজের বান্ধবী বকুলের কথায় তিস্তার হৃদয় কোণে রক্তক্ষরণ হলো। সেই সকালে মাস্টারমশাই এসেছে কিন্তু তিস্তা ঘর থেকে বের হয় নি এ অব্দি। না গিয়েছে মাস্টারমশাই এর কাছে ছুটে। হাত পা সব যেনো বাঁধা পড়ছে অদৃশ্য শিকলে।

এখন তেজস্বী দুপুর পরিবেশে। মাস্টারমশাই এর খবর নিয়ে বকুলই এসেছে তিস্তার কাছে। গ্রামে তো যেনো উৎসব লেগেছে। সবার শখের মাস্টারমশাই এর শহুরে বউ এসেছে,সেটা কী কম আনন্দের?

তিস্তা কিয়ৎপরিমাণ সময় মৌন থেকে বিধ্বস্ত কণ্ঠে বললো,
-‘বউ বুঝি অনেক সুন্দর? তোর সাথে কথা বলেছে? গম্ভীর হবে শহরের মেয়ে,তাই না?’

-‘না,না। তার আচরণ যেনো মাখনের মতন। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। কোনো অহংকার নেই। আমার সাথেও কথা বলেছে।’

তিস্তা বকুলের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। তার বেহায়া মন যে বার বার ছুটে যেতে চাচ্ছে মাস্টারমশাই’র কাছে। কিন্তু নারীর শরীরের আত্মমর্যাদা যেতে দিচ্ছে না তিস্তার কিশোরী শরীরটাকে। নারীর যদি আত্মসম্মানই না থাকে,তবে সে পথের ধূলো হয়ে কেবল পদতলে গড়াগড়ি খাবে।

বকুল কিছুক্ষণ বান্ধবীকে বুঝিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। তাকেও তো আজ দেখতে আসবে ছেলের বাড়ির লোক। কারো প্রিয় মানুষ হারাচ্ছে,কারো বা স্বপ্ন। ব্যাথা তো কোনোটাতেই কম না। তবে,কাকে দেখাবে সে ব্যাথা? হারানো জিনিস কী আর ফেরানো যায়?

____

‘তিস্তা তো চরিত্র হারাইছে। গ্রামের লোক তো তার নাম কলঙ্কিনী রাখছে।’

পাশের বাড়ির চাচীর এমন কথা শুনে সামান্য থমকে গেলো প্লাবন।

আশালতা ব্যাগ থেকে জামাকাপড় গুছোচ্ছিলেন। কথাটা শুনে তিনি অবাক হলেন।অবাক নয়নে ছেলের দিকে তাকালেন।

প্লাবন কেবল ভ্রু কুঁচকালো। সেও হালকা ভাবে কথাটা শুনেছে। তবে কথাটা কতটা ঠিক? অবাক নয়নে মায়ের দিকে তাকায়। মাও তো শুনেছে একই কথা। তবে কী বড় কোনো বিপদ হয়েছে তিস্তার? আসছে পর থেকে এ অব্দি মেয়েটাকে দেখে নি। অন্যান্য বার দু একদিনের জন্য সদরে গেলেই মেয়েটা স্টেশনে অপেক্ষা করতো,তবে আজ কেনো ঘরের দ্বার অব্দি এলো না?

তবে কী মেয়েটা ভুলে গেছে অভ্যাস গুলো? নাকি বদলে গেছে?

প্লাবনকে চুপ থাকতে দেখে আশালতা জানার আগ্রহ প্রকাশ করার সুযোগ পেলো। হাতের জামাকাপড় আলনা’র মাঝে রেখে বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-‘আহা,তারপর মেয়েটার কী হলো!’

আশালতার প্রশ্নে চাচীও যেনো মজার কিছু বলার সুযোগ পেলো। তাই রসিয়ে রসিয়ে বললো,
-‘পাঁচদিন ধরে ওরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। ওর সাথে আরেকটা মেয়েও উধাও হয়েছিলো গ্রাম থেইক্যা। ঐ যে গ্রামের শেষ মাথায় বাড়িটা আছে না? তাদের বাড়ির মাইয়া। ওরে পরেরদিনই পরিত্যক্ত ক্ষেতের মাঝখানে পাইছিলো মরা অবস্থায়। কিন্তু তিস্তারে পাওয়া যায় নাই। পরে পাঁচদিন পর সোহাগ গো কাছারি বাড়ির বাগানে পাওয়া গেছিলো। কী অবস্থা আছিলো তখন মাইয়াটার। এর আগে ওর বাপের সাইকেলটা খাদে পইড়া পা ভাইঙা গেছিলো। মাইয়াটা তখন দোকানে বসা শুরু করছিলো। মাইয়া মানুষ হইলো গিয়া মিষ্টি,তাগোরে ঢাইকা রাখা লাগে। ভরা বজারে খোলা মিষ্টি দেখলে বেডাগো তো নজর যাইবো’ই। লোভ লাগবোই। এক হিসাবে নিজের ইচ্ছায় নষ্ট হইছে।’

-‘কেনো? মেয়ে হয়ে সংসারের হাল ধরতে চাওয়াটাই কী ভুল ছিলো, খালা? মেয়েটার বাবা অসুস্থ হওয়ার পর নিশ্চয় বাধ্য হয়েই বাজারে বসতে হয়েছিল মেয়েটাকে, তাই না? কেউ কী যেচে লোভের স্বীকার হতে চায় খালা?’

ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠে সামান্য ভড়কে গেলো মহিলাটা। এমা, এ যে মাস্টারমশাই এর নতুন বউ।

প্লাবন পুরো থম মেরে গেছে। তার ছোট্ট মানবীর উপর এত কিছু বয়ে গেছে? সে টেরও পায় নি? গত আড়াইটা বছর যে মেয়েটাকে আগলে রেখেছিলো,তার একমাসেই এত বিধ্বস্ত অবস্থা! মহিলার কথার ধাঁচে তো খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে গ্রামের মানুষের প্রতিক্রিয়া। মেয়েটা একটুও ভালো নেই তবে!

চাচী তখন ভড়কে যাওয়া কণ্ঠে আমতা-আমতা করে বিষাদিনী’র উদ্দেশ্যে বললো,
-‘আরে না,না নতুন বউ। তুমি আমারে ভুল বুজছো। কিন্তু তুমিই ভাইবা দেখো,মাইয়া হইয়া কী বেডা গো ভীড়ে যাওয়া উচিত ছিলো?’

বিষাদিনী তার সদ্য ধুয়ে আসা মুখটা মুছতে মুছতে বললো,
-‘মানলাম, সে বাজারে বসাতেই তার সাথে এমন হয়েছে। আপনাদের ভাষায় তার বাজারে বসা কাজ টা অনুচিত ছিলো। আচ্ছা, সে যদি বাজারে না বসতো তবে তার ঘরের রেশন কী আপনারা দিতেন?’

যে উদ্যম ইচ্ছে নিয়ে কথা শুরু করেছিলো মহিলা, সে উদ্যমতা আর নেই চাচীর ভেতরে। শহরে মেয়ের সাথে কথা বলে পারবে না। আজকালকার মেয়েছেলে তর্ক করতে পারলেই যেনো জিতে যায়। এরা কী আর ভালো মন্দ বুঝে!

প্লাবন উঠে দাঁড়ালো। নাহ্,এখন এখানে বসে থাকাটা বোকামি। এমনেতেই অনেক কিছু বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে। এখন যতটুকু আছে তা-ই আগলে ধরতে হবে।

প্লাবনকে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে, পিলে চমকে উঠে আশলতার। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে,
-‘কই যাও আব্বা? কই যাও?’

ভুল সময়ে, মায়ের এমন অবুঝ প্রশ্ন শুনে অবাক হয় প্লাবন। সাথে মাথায় ভোঁতা রাগে অনুভূতি গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মা-ই তো তাকে কত নাটক করে ঐ শহরে আটকে রেখেছিলো। নাহয় এত বড় ক্ষতি আদৌও হতো! ছোট্টো মেয়েটার উপর দিয়ে এত ঝড় বইতো?

প্লাবন মায়ের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো। আশলতার ক্ষাণিকটা মনোক্ষুণ্ণ হলো। ছেলেটা তার এমন ছিলো না। যেদিন থেকে তিস্তা নামক মেয়েটার সাথে দেখা, সেদিন থেকেই ছেলেটা বদলে যায়। তাই তো মেয়েটাকে দু’চোখে সহ্য হয় না তার।

বিষাদিনী আশালতার মনোভাব বুঝে। শীতল কণ্ঠে, স্বান্তনার স্বরে বলে,
-‘ফুপিমণি, এত উত্তেজিত হচ্ছেন যে? প্লাবন দা কী ছোট্ট মানুষ? সে যা করবে বুঝেশুনেই করবে।’

আশালতার ভয় হয়। ছেলেটা যা তিস্তা ভক্ত,নষ্ট মেয়েকেই না আবার দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলে। ভয়ে মায়ের প্রাণ আতঙ্কিত হয়। আকুতি ভরা কণ্ঠে, সামনের মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তুমি আমার ছেলেটাকে একটু বেঁধে রেখো,মা।’

-‘আপনার ছেলে কী বাঁধন মানবে,ফুপিমণি? আর না, আমি কারো জীবনে শিকল হয়ে থাকি। একটু ধৈর্য্য ধরুন। ভালো কিছু হবে।’

আশালতা খাটের এক কোণে বসে পড়ে। বিষাদিনী মেয়েটা এত ছন্নছাড়া কেনো? একজন নারী’ই তো পারে একজন পুরুষকে বাঁধতে। তবে,মেয়েটার এত অনীহা কেনো বাঁধনে?

বিষাদিনী তার জন্য বরাদ্দ করা রুমটাই চলে গেলো। জানালার রঙ উঠে যাওয়া লোহার শিকে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকে। জানালার বাহিরের জায়গাটায় একটু গাছপালা বেশি। শুকনো পাতা জানালার বরাবর পুকুরটাতে ভাসছে। পুকুরের পানি গুলো ভীষণ চকচক করছে মধ্যাহ্নের সূর্যের তাপে। বিষাদিনী বেশ আকর্ষণ অনুভব করে সেই দৃশ্য দেখে। আজকাল তার বিষন্নতা বোধ হয় না। তার আজকাল ভবঘুরে হতে ইচ্ছে হয়। বাঁধন তো আর সবার জন্য না। বিষাদিনীর মনে ভাবনার উদয় হয়। মূর্ছে যাওয়া হৃদয়টা ছন্দ পাতে, “কেউ কেউ উড়ে গেলে,কেউ কেউ মুক্তি পায়।”

পরক্ষণেই মনে হলো, বাহ্ দারুণ তো! মোটা কালির দোয়াত নিয়ে সাদা চকচকে কাগজে লিখে ফেলে ছন্দখানা। সাথে মিশিয়ে দেয় বিষাদ। বিষাদিনী হয়ে,বিষাদ লেপন করবে না, তা কী হয়? ছন্দখানা জ্বলজ্বল করছে। দারুণ হাতের লেখা দিয়ে বিষাদিনী লিখে ফেলে ব্যাথাময় কয়েকটা শব্দ,

“শিকল আমি নাহি হলাম,না-ই বা কাটলাম তার ডানা,
আমি পাখি রঙহীন বলে, রঙিন পাখির কী উড়তে মানা!”

কবিতাটার দু লাইন লিখে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঝড়া পাতার মাঝখানে। কেউ জানবে না,সে যে মানুষকে উড়তে দিতে চায়। কেউ না জানুক, শক্ত খোলশের আড়ালে কোমলতা। জেনে গেলেই তো জ্বালিয়ে যাবে।

_

আজ আকাশে চাঁদ নেই। ভীষণ আঁধার চারপাশে। সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি তিস্তা। মাস্টারমশাই দেখা করতে এসেছিলো কিন্তু সে বের হয় নি। মাস্টারমশাই তো তার মানুষ না এখন। মাস্টারমশাই হলো পর মানুষ। পর মানুষের প্রতি মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? শূণ্য’ই যার ফলাফল।

হঠাৎ জানালার পাশে খুব ধীরে শব্দ হলো। তিস্তা সামান্য চমকে গেলো। সে উবুড় হয়ে শুয়েছিলো এতক্ষণ। তার পায়ের দিকে দক্ষিণ বরাবর জানলা দিয়ে শব্দটা হলো। তিস্তা সামান্য ভয় পেয়ে গেলো। চমকে উঠে জানলার দিকে তাকাতেই দেখলো বাক্সবন্দি সুখ।

একটা দারুণ রাজকীয় বয়ামে ভরা জোনাকি পোঁকা। তিস্তার কলিজাটা সামান্য ছলাৎ করে উঠে। পুরোনো সুখ নতুন করে,নতুন রূপে তার জানালায়!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here