ভয়_আছে_পথ_হারাবার পর্ব 22

0
1104

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২২,,

তিলো কয়েক মূহুর্তের জন্য ঘোরের মাঝে চলে গেলো অরিকের কথায়। অরিক ওকে ডাকছে। তিলোর সেদিকে খেয়াল নেই। অরিক ওর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে জোরে ডাকলো। তিলো হঠাৎই হুসে ফিরে কেবল বললো,
‘আমি…। আমি এখন ফোনটা রাখছি।’

বলেই অরিককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। অরিক ওর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সে বিষয়ে কোনো ধারণা করতে পারলোনা। ওর ভেতর অস্থিরতা বেড়ে চলেছে।
তিলো ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। অরিকের ওর প্রতি আচরণগুলো ভিন্ন, এটা তিলো আন্দাজ করতে পারলেও ভাবতে পারেনি কখনো অরিক সরাসরি স্বীকার করে নেবে সেটা। তিলো তো নিজের পরিবার এবং বন্ধুদের বাইরে শুধু ফাহাদকেই ভালোবেসেছিলো। অরিক ওকে কেন ভালোবাসতে যাবে? ও তো তিলোকে সহ্যই করতে পারতো না একসময়। তিলোর ভাবনার মাঝেই ওর ফোনে টুন করে একটা একটা শব্দ হলো। তিলো ফোনটা তুলে দেখে অরিক ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ছোট্ট একটা লাইন কেবল,
‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে?’

তিলোর অজান্তেই ওর ঠোঁটের কোণা সামান্য উঁচু হয়ে উঠলো। কেউ এর আগে ওকে কখনো এভাবে কথা বলেনি। হয়তো সে রবি ঠাকুরের এই লাইনটুকু দ্বারা অরিকের চাটুকারিতায় সামান্য গলে গেলো। অরিককে হারিয়ে ফেলাটা কি তার জীবনে ভুল বলে গণ্য হবে নাকি ওকে আঁকড়ে ধরাটা? তিলো নিজের উভয়সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। তিলোর নিজের কি কোনো অনুভূতি নেই অরিকের প্রতি? তিলো সেটা জানে না। ফাহাদকে হারিয়ে ফেলার পর ওর নিজেকে হৃদয়হীনা বলে মনে হয়। কারো সাথেই আর সে নিজের হৃদয়ের আদান-প্রদান ঘটাতে পারেনি। হয়তো অনুভব করতেই ভুলে গিয়েছে এধরনের অনুভূতি। রেজাকে ও পরিবারের থেকে ঠিক করা বিধায়ই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে মন থেকে। জীবন তো থেমে থাকে না। কারো না কারো সাথে ওকে মানিয়ে চলতেই হতো। সে রেজাকে একমুহূর্তের জন্যও অনুভব করার চেষ্টা করেনি। ভালোবাসার অনুভূতি তো উন্মাত্ত উগ্র অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার মতো। যেখানে শুকনো পাতার খসখসে আওয়াজটাও মনে হয় সুর তুলছে। অরিক সত্যি কিছু ওর প্রতি অনুভব না করলে কিভাবে এই বেপরোয়া শব্দটাকে লাগামহীনভাবে ব্যবহার করলো একজন অপরিচিতের সামনে। অরিক নিশ্চিতভাবেই একজন দ্বায়িত্ববান ছেলে। সে কোনো কথার মানে না বুঝে বলবে না। অরিককে রেজার মতো একজন অপরিচিত ধরেই কি সব নতুন করে গুছিয়ে নেওয়া যায়না?

অরিক তিলোর থেকে ম্যাসেজটার উত্তর আশা করছে না ঠিকই। তবে ওর তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগছে তিলো কিছু বলুক সে সম্পর্কে আর ও শুনুক। অরিকের তিলোর প্রতি অনুভূতিটা বুঝে উঠতে সময় লেগেছে। ভালোবাসা আর ভালো লাগার মধ্যে পার্থক্য হয়তো এটাই যে, অরিক কোনোভাবেই বলতে পারে না কোথা থেকে ঠিক ও তিলোকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। শুধু জানে ও বাসে। খুব বেশিই হয়তো। কেন বাসে কি কারণে বাসে ও ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ। যদি হয়ে থাকে এটা হঠাৎ তবে হঠাৎই। যদি এর সূত্রপাত আরো অনেক আগে হয়ে থাকে তবে অনেক আগে থেকেই। আগে কোনোভাবে হয়তো না। অরিকের ক্ষেত্রে এটা হঠাৎ। ভার্সিটিতে দেখার পর থেকে। ধীরে ধীরে ওর আচরণ, অনুভূতি বদলেছে ওর অজান্তেই। তবে তিলোর বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে আমূল পরিবর্তন এসে গিয়েছিলো রাতারাতি। সবটা বুঝতেও সময় লেগেছে ঠিকই। তবে কেবল এক সপ্তাহের মাঝেই ওর কাছে তিলো নামটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অরিকের তিলোকে ভালোবাসার কথা না। তবে হয়ে গিয়েছে এটা। কেবলই হয়ে গিয়েছে। তিলোর বিয়ে হয়ে যাবে শুনে নিজের ভেতরের যন্ত্রণাটার নাম ও খুব তাড়াতাড়ি দিতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে, এটা একটা অনুভূতি যাকে সকলে বলে থাকে ভালোবাসা। একটা উশৃংখল শব্দ! যেরকমটা ও আগে কখনো কারো প্রতি অনুভব করেনি।

যখনই বুঝতে পেরেছে, আসলে কি রকম অনুভূত হয় একজন ভালোবাসার মানুষকে হারাতে, অরিক তিলোর ফাহাদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার সময়কার অনুভূতিটাও অনুভব করলো যেটা ও সেই সময় একদম হেসে অতিরঞ্জিত একটা বিষয় মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিলো। অরিক বুঝতে পারলো, তিলো ওর থেকে আরো কঠিন হৃদয়ের একজন মানুষ। কারণ সে সেই সময়টা কাটিয়ে উঠে এসেছে। অরিক বুঝতে পারলো তার দূর্বলতা। সে কখনো পারবেনা সেটা। বিষয়টা লজ্জাজনক হলেও অরিক সেই লজ্জায় লজ্জিত হতে রাজি। ও সরাসরি রেজা সাহেবকে গিয়ে বলে এসেছে। দ্বিধায় ছিলো লোকটা বিয়েটা ভাঙবে কিনা? কারণ ও বিয়ে ভাঙতে বলেনি। শুধু নিজের অনুভূতি জানিয়েছিলো। ভেবেছিলো হয়তো এরপর ওর পালা তিলোর জায়গায় নিজেকে দেখার জন্য। কিন্তু সেটা হয়নি। রেজা সাহেব অরিকের অনুভূতিকে সম্মান করে। ভালোবাসলে আচরণগুলোও হয়ে ওঠে ঠিক সেই শব্দটার মতোই পরোয়াহীন এবং উন্মাদনায় পরিপূর্ণ। বেখেয়ালি।

তিলো সেরাতে ঘুমাতে পারেনি। কেবলই বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছে। কি বললো তখন অরিক! কথাটা বারবার মস্তিষ্কের মাঝে ছোটাছুটি করেই চলেছে। সত্যিই সে এটা বলেছে! ওর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। তিলো বুঝতে পারছে, ও ফেঁসে গিয়েছে। এখনো চলেছে। কিন্তু নিজেকে থামাতেও পারছে না। নিজেকে একবার হ্যাংলা মনে হচ্ছে তো একবার মনে হচ্ছে, এটা শুধু কারো প্রতি সম্মান বা নিজের প্রতি একটা সম্মান। যে তাকে সম্মান করবে, তাকে মেনে নেওয়াটাও তো পরোক্ষভাবে নিজেকে সম্মান করা।

আনিস সাহেব নাসীরা পারভীনের রাগ ভাঙাতে নানা উপায় বের করছেন। নিজে থেকে কথা বলছেন। তবুও তার রাগ যেন পড়ছেই না। এমন না যে তিনি অরিককে অপছন্দ করেন। ছেলে হিসাবে অরিক ভালোই। তার নামে কোনো বদনাম নেই। বরং ছোট থেকে পড়াশোনায় সে ভালো। বড় হয়ে আলাদা হোস্টেলে থেকেও কোনো বাজে অভ্যাস গড়েনি। চরিত্রের দিক থেকেও প্রশংসনীয়। দেখতেও খারাপ না। তিলোর তুলনায় একটু বেশিই। কেবল চোখজোড়া একটু ছোট। চশমা পড়ায় আরো মনে হয়। বিয়ের বাজারে পাত্রীপক্ষের প্রথমেই পছন্দ হয়ে যেতে পারে। নাসীরা পারভীনেরও তাকে খারাপ লাগে না। কিন্তু রেজার মতো অতো ভালো চাকরি সে করে না। ওই পেশার একটা ছেলেকে তার মেয়ে ইতিমধ্যে প্রত্যাশা করে। সেখানে কলেজের প্রফেসর অরিকের বিষয়ে নাসীরা পারভীনের মনটা খুঁতখুঁত করছে। সাথে ফাহমিদা বেগমের বিষয়টা তো আছেই।

পরদিন তিলো কিছু না ভেবেই সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। আজ ভার্সিটি যাবে না সে। সকালে ডাইনিং এ খাবার গোছানোই পেয়েছে। নাসীরা পারভীন রেগে আছেন বিধায় রান্না করে রেখে চলে গিয়েছেন নিজের রুমে। কাউকে গুছিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছেন না।
তিলো একবার তুষারের রুমের দরজা ঠেলে উঁকি মেরে দেখলো আনিস সাহেব তুষারের সাথে ঘুমিয়েছেন রাতে। তিলো ঠোঁট টিপে হেসে দিলো। ওর মা রাতে ওনাকে ঘরে ঢুকতে দেননি। তিলো নাসীরা পারভীনের এই কাজটায় বেশ মজা পায়। এবার দেখতে পায়নি ও কি হয়েছে। তবে প্রতিবার দেখে রুমের দরজার বাইরে আনিস সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন আর নাসীরা পারভীন ওনার বালিশ কম্বল ছুঁড়ে ওনার উপর ফেলছেন। ওনি সেগুলো হাতে ধরে সামলাতে ব্যস্ত আর এদিকে মুখ থেকে নাসীরা পারভীনকে নাসু নাসু ডেকে মাঝে মাঝে ক্ষমা চান তো মাঝে মাঝে তার ভুলটা বোঝাতে থাকেন। তিলোর অদ্ভুত লাগে এটা ভেবে যে, ওনারা এতোবছর পরও কম বয়সী নতুন দম্পতির মতো ঠোকাঠুকি ধরনের ঝগড়া বাঁধান। তবে নাসীরা পারভীন কোনোদিনও ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যাননি। ওনার কথা হচ্ছে, এটা ওনার স্বামীর বাড়ি মানে ওনার বাড়ি। ঝগড়া করে চলে যাবেন কেন? চলে যাবেন, আবার ঝগড়া মিটে গেলে মাথা নিচু করে ঢুকতে বিব্রতবোধ হবে না? তাঁর কি আত্মসম্মান নেই? গেলে আনিস সাহেব যেতে পারেন। আনিস সাহেব যেতেনও। নিজের বাবার বাড়ি চলে যেতেন। ঝগড়া মিটে গেলে নিজেই আবার ফিরে আসতেন। নাসীরা পারভীন কখনো আসতে বলতেন না।

তিলো পুরান কথাগুলো চিন্তা করতে করতেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে এসে রিকশা থামালো। ও একদমই নিশ্চিত নয় যে অরিক আদৌও বাড়িতে আছে কিনা? খুব ভোরে ফিরোজকে বলে ও অরিকের ঠিকানা যোগাড় করেছে। ফিরোজ কলেজের পিয়নকে দুশো টাকা দিতেই সে অরিকের ঠিকানাটা ফাইল ঘেঁটে বের করে দিয়েছে। তিলো আর কাউকে জিজ্ঞাসা করতে সংকোচবোধে ভুগছিলো। ওরা কি ভাববে? তিলো সম্পূর্ণ আন্দাজের উপর এসেছে। ফাহমিদা বেগম গতকাল বলছিলেন অরিক আরো দুদিন বাড়িতে থাকবে। তাহলে ও নিশ্চয়ই ছুটি নিয়েছে ভার্সিটি থেকে। যদি ছুটি বাতিল না করে থাকে তাহলে এখন বাড়িতে থাকার একটা সম্ভাবনা আছে।

তিলো ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানের থেকে জেনে নিলো অরিক তিনতলায় থাকে। তিলো একবার চিন্তা করলো সিঁড়ি বেয়ে উঠবে। পরক্ষণে লিফট ফাঁকা দেখে উঠে পড়লো। তবে লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই একটা যুবক দৌড়ে এসে উঠলো লিফটে। পরনে ট্রাউজার আর একটা ধূসর বর্ণের হাফ হাতার গেঞ্জি। পায়ে সু। ঘেমে একাকার। হয়তো সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলো। এখন ফিরছে! তিলোর এখন মনে হচ্ছে, হয়তো সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে। লিফটের দরজা বন্ধ হলো। তিলো স্থির হয়ে নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে ফোনে মুখ গুঁজে ফেলেছে। তিলো স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। আগে কখনো এমন বদ্ধ পরিবেশে একা অপ্রস্তুত অবস্থায় সে পড়েনি। ছেলেটা মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে ওকে। তিলো সেদিকে খেয়াল না করার চেষ্টা করছে। অহেতুক হাত উঠিয়ে ঠিক হয়ে থাকা মাথার কাপড়টা আরো টেনে দিলো। পিনে আটকে আছে। তারপরও করলো। ছেলেটা হঠাৎ ফোন থেকে মুখ তুলে বলে উঠলো,
-এক্সকিউজ মি, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি নতুন এসেছেন? না মানে আগে আপনাকে দেখিনি?

তিলো উত্তর দেওয়ার আগেই লিফটের দরজা খুলে গেলো। ও আর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা। ও বেরিয়ে যেতেই ছেলেটা পেছন থেকে বলে উঠলো,
-আসলে বাড়িটা আমাদের। তাই আপনার পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম।

আর কিছু বলার আগে আবারও দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। বাড়িটা ওদের তো কি হয়েছে? সেধে কথা বলা লাগবে তাই তে? নাকি ওকে চোর ছ্যাচড় কিছু মনে করে জানতে চাইলো?

যাই ভাবুক তাতে ওর কি? তিলো তিনটা দরজার মধ্যে কোনটায় কলিং বেল বাজাবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছে। এখানে যে তিনটা ফ্ল্যাট হবে সেটা ওর মাথায়ও আসেনি। এ বি সি, কোন দরজায় বেল বাজাবে ও। দারোয়ানটাও আধা কথা বলে। তিলো আবার নিচে নেমে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলো। এবার সিঁড়ি বেয়েই নামলো এবং উঠলো। ওর মনে হচ্ছে, তখন লিফট ব্যবহার করে লাভটা কি হলো ওর? হাঁপিয়ে গিয়েছে উঠে এসে। সি ফ্ল্যাটের দরজায় বেল বাজিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।
দরজা খুললো না। তিলোর রাগ হলো। ও এবার পরপর কয়েকটা বাজালো তুষারের মতো অভদ্রতার সাথে। ভেতর থেকে কারো গলা শোনা গেলো। অরিক বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দরজার সামনে তিলোকে দাঁড়িয়ে থাকাতে দেখে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। চোখের ঘুম নিমেষে উধাও৷

#চলবে

অনেকে বোনাস পর্বের জন্য বলেন। সেটা ইনশাআল্লাহ একদিন দেবো। এই সপ্তাহের অ্যাসাইনমেন্টটা জমা দিয়ে তারপর একদিন। আর ইনশাআল্লাহ নিয়মিত ছোট বড় পর্ব করে গল্প দিতে পারবো যদি সময় করে উঠতে পারি এবং হঠাৎ করে ডিপ্রেশনে না পড়ি।
#মেঘের_পাহাড় গল্পটার কথা যারা বলছেন, ওই গল্পটা এটা শেষ হওয়ার পর লম্বা ছুটি কাটিয়ে নতুন করে শুরু করবো আবার।

ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here