ভয়_আছে_পথ_হারাবার পর্ব 18

0
1194

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

১৮,,

-দোস্ত সত্যিই তুই রাজি হয়ে গেলি?

ভার্সিটির মাঠে একটা বড় গাছের ছায়ায় সকলে বসে আড্ডা দিতে শুরু করেছে। আজকের সবচেয়ে বড় বিষয় তিলোর বিয়ে। কারো যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা। হঠাৎ করে এমনটা হবে ওরা কেউ ভাবতে পারেনি। মিরা অবিশ্বাসের কন্ঠে কথাটা বললো। সম্বন্ধ আসতে পারে, তাই বলে ও কাউকে একবারও না বলে একেবারে রাজি হয়ে কথাটা বললো! হজম হচ্ছে না কথাটা। বিশেষ করে অনির। অনি ছেলের বয়স শুনে নাক শিটকাচ্ছে। সাথে যখন শুনেছে টাক, অনির তো হার্টফেইল করার উপক্রম।
অবিশ্বাসের সুর গলায় স্পষ্ট রেখে অনিমা বললো,

-তিল, রাজি হয়ে গেলি? লোকটা আসলে লোকটাই। নাতি নাতনির মুখ দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা, কে জানে? লোকগুলো আসলে বিরক্তিকর।

তিলো ওর কথায় তেমন পাত্তা না দিয়ে বললো,
-তবে মানুষ ভালো।

-এক দেড় ঘন্টা কথা বলে কিভাবে বুঝলি? মানুষ কয়েক বছর সংসার করেও বুঝতে পারে না।

-কয়েক বছর সংসার করে তো আর বিয়ে করা সম্ভব নয়। আগের দিনগুলোতে তো কেউ কাউকে না দেখেই বিয়ে করতো। জানিস, অরিক ভাইয়ার নানা নানীর কিভাবে বিয়ে হয়েছে? অরিক ভাইয়ার নানার বাড়ির লোক একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখে পছন্দ করেছিলো। তবে বিয়ের দিন তারা পাত্রী বদলে একটা কৃষ্ণ বর্ণের বোবা একই সাথে কানে কালা মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিচ্ছিলো। এদিকে পাশের গ্রামের অরিক ভাইয়ার নানীর বর ওই দিনই বিয়ে করতে আসার সময় নৌকা ডুবে মারা যায়। অরিক ভাইয়ার নানাকে ঠকানো হয়েছে বলে বিয়ে না করে চলে আসে। এদিকে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় তার নানীকে কতো কথা শুনতে হচ্ছিলো! অরিক ভাইয়ার নানীর বাবার ক্ষমতা ছিলো অনেক। এখন মেয়ের বিয়ে দিতে পাত্র খোঁজ শুরু। যে করে হোক সেই রাতেই মেয়ের বিয়ে দেবেন। এদিকে তাকে অলক্ষী বলে কেউ বিয়ে করতে রাজি হলোনা। অরিক ভাইয়ার নানা বরযাত্রী নিয়ে সেই গ্রাম ধরে যাওয়ার সময় একপ্রকার তুলে নিয়ে গিয়ে তার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। তারা কি অসুখী হয়েছে? এখনো বেঁচে আছেন তারা। দুজন দুজনকে ছাড়া একপাও চলে না। কথা হলো, দেখা সাক্ষাৎ বিষয় না। সে যদি ইচ্ছা করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে তো তুমি হাজার খুঁজলেও পাবে কিভাবে তার আসল রূপের খোঁজ। গোয়েন্দা লাগাতে হবে তো তাহলে।

তিলোর গল্প শুনতে শুনতে আহান রিয়ার কোলে মাথা রেখে শুতে নিতেই রিয়া ওর চুল ধরে টেনে তুললো। আহান ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে ওর সমস্যা জিজ্ঞাসা করলে রিয়া চোখ বড় করে তাকিয়ে ওকে সতর্ক করলো। বিষয়টা কেউ খেয়াল না করলেও তৌকির করেছে। আহানের কানে ফিসফিস করে বললো,
-বিয়ে হতে না হতে বউয়ের শাসনে বিড়াল হয়ে গেলি!

কথাটা বলে তৌকির দাঁত বের করে হাসছে। আহান মুখে রাগের ভঙ্গিমা করে চুপ করে বসে থাকলো।

অনি বিরক্ত তিলোর প্রতি। অমন বয়স্ক একএকটা লোককে ও বিয়ে করবে মানতেই পারছে না। ওদের তর্কবির্তকের মাঝখানে অরিক এসে উপস্থিত হলো। এখন ক্লাস টাইম নয় তাই ওদের ঘাবড়ে যাওয়ারও কোনো কারণ নেই। অরিক তিলোর পেছনে দাঁড়ানো বিধায় ও খেয়াল করেনি।অনি ওর মুখোমুখি বসেছে আর সে এখন অরিকের মুখোমুখি। অরিকের দিকে চোখ পড়তেই অনি নিজের ওড়না টেনে পুরো মুখ ঢেকে ফেললো। আগেরদিনের ঘটনার পর ও অরিকের সামনে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে। নিজের ভুল এবং হ্যাংলামি বুঝতে পেরে লজ্জাও পাচ্ছে। পুরো ঘোমটা টেনে বিড়বিড় করলো, এই কাজী মারুফ এখানে কেন রে ভাই? গালির ভান্ডার কি ফাঁকা হয়নি?

তিলো ভ্রু কুঁচকে অনিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-তোর আবার কি হলো? কোনো অপরাধ করে পুলিশের থেকে লুকাচ্ছিস নাকি?

অনি কিছু বলার আগেই অরিক তিলোর নাম ধরে ডাকলো। তিলো মাথা ঘুরিয়ে ওকে দেখে বললো, ‘জ্বি।’

অরিক বলতে চায় তবে পরিবেশটা ওর কাছে উপযুক্ত মনে হলোনা। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে বললো,
-ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করে যাবে।

তিলো নিজের ভেতরকার জড়তা নিয়েই বললো,
-ঠিক আছে।

অরিক আরো কিছু সময় দাঁড়িয়ে ফিরে আসলো। তিলোর বন্ধুরা নির্বাক ছিলো এতক্ষণ। অরিক ফিরে যাওয়ার পর ফিরোজ বললো,
-তোর ভাই ডাকলো কেন তোকে?

তিলো কাঁধ নাড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
-আমি কি জানি। কিছু বলবে হয়তো। যাই হোক,
তিলো অনিকেতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-তোর যাওয়ার কি খবর?

-আরো কিছুদিন লাগবে।
অনিকেত মলিন কন্ঠে বললো।

তৌকির বললো,
-তা ভাই চলেই যখন যাবি আর নতুন করে পড়াশোনা শুরু করবি তো এখানে পড়ছিস কেন? একবারে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে পড়াশোনা শুরু কর। আমি হলে তো এই কয়দিন শুধু চিল করতাম।

অনিকেত মন খারাপ করে বললো,
-যেতে কি আর ইচ্ছা করছে। দিই ডাকছে। বাবাও যেতে জোর করছে।

ওদের আড্ডার পরিবেশটা মূহুর্তে গম্ভীর হয়ে উঠলো। কিছু সময় পর অনি আবারও অধৈর্য্য ভঙ্গিতে ডেকে উঠলো, ‘তিইইল।’

-হ্যাঁ বল।

-তুই সত্যি রাজি হয়ে গেলি?

-আরে জ্বালা। এই মেয়ে তো সব কথার এক কথা বারবার বলে যাচ্ছে।

অনি কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বললো,
-এভাবে বললি তুই!! আর তুই কেবল চাকরি দেখে বিয়ে করছিস না?

-নাহ্। আমি বলেছি, তিনি লোক ভালো। এখন চাকরিটা একটা এডভান্টেজ। ‘এ’ ক্যাটাগরির অ্যাম্বাসেডর হবেন একজন যদি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে।

অনি বিরক্ত ভঙ্গিমায় বললো,
-‘এ’ ক্যাটাগরি না ‘জি’ ক্যাটাগরি, কোনো বিষয় না৷ বিষয় হলো লোকটা বুড়ো এবং টাক৷ আর সে খাটো।

তৌকির ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,
-অ্যাম্বাসেডর তো তিন ক্যাটাগরি জানি আমি। এ, বি আর সি। এখন জেড ক্যাটাগরি কবে আবিষ্কার হলো। নিশ্চয়ই এটা অনির বরের পদ। এলিয়েন বিয়ে করবে তো সে আবার।

অনি খানিকটা রেগে তৌকিরের পিঠে নিজের ব্যাগটা দিয়ে বারি মারলো। তৌকির খুব বেশি ব্যথা না পেলেও সেখানে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললো,
-সত্যি কথা তো! সবার গায়ে লাগে।

অরিক টিচার্স ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুব ভালো করে নিজের চেহারা পরখ করছে। চাপ দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নিজেকে দেখছে। ছোটবেলায় ওকে একটা সাদা বড় বল মনে হতো। এখন একদমই মেদহীন বলিষ্ঠ একটা শরীরের অধিকারী সে। সেই শ্বেত ভাল্লুকের গায়ের রং খানিকটা চেপে গিয়েছে এখন, আরো ভালো লাগে। ছোট থাকতে রোদে দৌড়াদৌড়ি করলেই ওর গাল নাক পুরো লাল হয়ে যেতো। ওকে কিছু বিচ্ছু ছেলে ইঁদুরের লাল শিশু বলেও ডাকতো। এখন অতোটা হয়না। সময়ের সাথে কাজের ব্যস্ততায় গায়ের রং একটু চেপে গিয়েছে।
অরিক নিজের চেহারার পরিবর্তন খুঁজছে। যা আসলে ও খুঁজছে, তা পেলোনা। আজকে কি তিলোকে অন্য দিনের তুলনায় বেশি ভালো লাগছিলো? অরিক চিন্তা করছে। গ্রামের বাড়িতে খালার বিয়ের সময় গিয়ে অনেক কথা শুনেছে ও। দূর বনে নাকি একটা ফুল ফোটে। যার উদ্দেশ্যে ফোটে তার নাকি বিয়ে হয়। একে নাকি বিয়ের ফুল বলে। অরিক কখনোই সেগুলো বিশ্বাস করে না। ও আরো শুনেছে, বিয়ের সময় নাকি চেহারা খোলে। তিলো কি সুন্দর ছিলো আজকে দেখতে? আদৌও চেহারা সুন্দর হয় নাকি মানুষ এটা বিশ্বাস করে বিধায় চোখে ভ্রমের সৃষ্টি হয়? অরিক দেখছে নিজের চেহারা আরো ভালো হয়েছে নাকি। ওর কি এখনো বিয়ের সময় হয়নি?
নিজের পাগলামিতে নিজেই লজ্জা পেলো অরিক। ভাগ্য ভালো যে ওর এটুকু অন্তত বোধ ছিলো যে কারো সামনে এই কাজ ও করেনি।

ক্লাস শেষে তিলো অরিকের সাথে দেখা করতে আসলো। অরিককে খুঁজতে খুঁজতে একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে পেলো। তিলো অনুমতি নিয়ে ঢুকে দেখলো অরিক একা একা বসে স্টুডেন্টদের থিসিস দেখছে। তিলো আশেপাশে তাকিয়ে ফাঁকা দেখে কিছুটা সংকোচ নিয়েই ওর সামনে দাঁড়ালো। অরিক বেশ কিছু সময় ওকে পাত্তা দিলো না। তিলোর বিরক্ত লাগছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। অবশেষে না পেরে বললো,
-প্রফেসর, কিছু বলবেন বলেছিলেন।

অরিক চশমার ফাঁকা থেকে ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
-হুম বলবো। তাড়া আছে তোমার?

-হুম। না মানে আসলে হ্যাঁ। কিছুটা।

-বুড়োর সাথে ডেটে যাবে?

অরিকের কথাটায় তিলোর বেশ রাগ হলো। কিছু বলতে গিয়েও বললো না। এই প্রতিষ্ঠানে তাদের সম্পর্ক চাচাতো ভাই বোনের নয়৷ বরং শিক্ষক ছাত্রীর। তিলো নিজেকে সামলে শান্ত কন্ঠে বললো,
-নাহ্। বাড়ি ফিরতে হবে।

-কাল রাতে ফোন ধরোনি কেন?

-ওহ! তখন আসলে ব্যস্ত ছিলাম। আর তারপর …

-তারপর?

তিলো ডান হাতটা তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিমা করে চোখ বুজে আবার খুলে বললো,
-আসলে এরপর অলসতায় আর কথা বলতে ইচ্ছা করেনি।

তিলোর উত্তরটায় অরিক কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাই ভুলে গিয়েছে। অলসতায় তার ফোন ব্যাক করতে ইচ্ছা হয়নি। অরিক সেদিকে আর না গিয়ে বললো,
-শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে?

-এই কথাগুলো বলতে আমাকে দেখা করতে বলেছেন? সত্যি? আমি তো কতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভেবে বসে আছি।

অরিক কন্ঠে গাম্ভীর্য এনে বললো,
-ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছো কেন? বিয়ের সময় বিয়ে হবে। তাই বলে মাঝে মাঝেই ভার্সিটি থেকে উধাও হয়ে যাও কেন?

-সরি। আসলে কালকে মামা আসতে দেননি।

-অযুহাত বন্ধ করো। এখন যাও৷ আর ক্লাস ফাঁকি দিও না।

তিলো মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বের হয়ে আসার সময় অরিক হঠাৎই কোমল কন্ঠে ওকে ডেকে ওঠে,
-তিল…

অরিকের কন্ঠের এই কমনীয়তার সাথে তিলো একদমই পরিচিত না৷ হঠাৎ এমন ডাকটা ওর কান থেকে মস্তিষ্কে ঢুকে এক অন্য ধরনের অনুভূতির সন্ধান দিলো ওকে। তিলো না চাইতেও মৃদু কেঁপে উঠলো। নিজের অজান্তেই তেমনি মৃদু কোমল সুরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘জ্বি, বলুন।’

অরিক ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি কি রাজি এই বিয়েতে?

অরিকের চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত। তিলো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তর দিলে যেন সে চোখে অসহায়ত্ব এবং মনকষ্ট ভেসে উঠবে। অরিকের দৃষ্টি ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। তিলো যান্ত্রিক কন্ঠে উত্তর দিলো,
-হ্যাঁ। আমি নিজেই রাজি।

অরিক কয়েক মূহুর্ত নির্জীব চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ‘ওহ’ বলে আবার নিজের কাজে মন দিলো। তিলো এবার অনুমতির অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো ক্লাসরুম থেকে। বেরিয়ে এসে তিলো নিজেই এক গোলকধাঁধায় যেন আটকে গিয়েছে। তিলো অবুঝ নয়। তবে অবিশ্বাসী। অরিকের ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া আচরণ ওর অজানা নয়। অরিকের বর্তমানে ওর সাথে কথা বলার ধরণ। সবকিছুই ওকে ভাবতে বাধ্য করায়, ওর প্রতি অরিকের বিশেষ অনুভূতি রয়েছে। তিলো এটা আজ থেকে নয় বরং ভার্সিটিতে অরিকের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকেই অনুভব করে। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না। অরিককে এড়িয়ে চলে ও। ও বিশ্বাস করতে পারে না, যে ছেলে ছোট থেকেই নিজের মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে ওকে অপছন্দ করতো সে ওর প্রতি কিছু অনুভব করে। তিলো নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেও কোনো সদুত্তর পেলোনা।

শুক্রবারে অরিকদের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা প্রায় সকলেই ভিড় করেছে। সকল আতিথেয়তা শেষে হঠাৎ অরিক সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো ……

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here