ভ্রমর (পর্ব – ৩)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
মধ্যরাত। হালকা বাতাসে গাছের পাতাগুলো তিরতির করে নড়ছে। জমিদার বাড়িতে হালকা নীলাভ আলো, শুধু ঘরগুলো অন্ধকার। হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল স্নিগ্ধার। চোখ খুলে অন্ধকারের কোলে নিজেকে আবিষ্কার করে আরও ঘাবড়ে গেল সে। বুকের ধকধক শব্দ এখনো শোনা যাচ্ছে। কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে স্নিগ্ধার। সে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল। তাওহিদার পাশে শুয়েছে সে; তার ওপাশে মনি। টেবিলে পানিভর্তি গ্লাস। সেটায় এক প্রকার হামলে পড়ল স্নিগ্ধা। এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে ফেলল; যদিও তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করা সুন্নত। কিন্তু এই মহূর্তে তার ভাবনা একপ্রকার বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে। স্নিগ্ধা কয়েক মিনিট তব্দা খেয়ে বসে থেকে মা তাওহিদার দিকে তাকিয়ে থাকল। তাওহিদার মায়াবী মুখ দেখে দুঃস্বপ্নের সব ঘটনা খেই হারিয়ে ফেলল। আলো নিভিয়ে আবারও শুয়ে পড়ল সে। চোখ বন্ধ করল। হুটহাট চোখের পাতায় ভাসতে থাকল নানান রঙের, নানান বর্ণের ঘটনা। চোখজোড়া খুলে ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাল স্নিগ্ধা। এবার ঘটনাগুলো খোলা চোখেও এসে ভর করতে দু’বার ভাবল না।
স্নিগ্ধার বাবা সিকিন্দার। তিনি আগে এই গ্রামেই থাকতেন, এই জমিদার বাড়িতেই। শরিফ পড়োশোনায় কোনো আপোষ করেন না বলে সিকিন্দারকে পাঠিয়েছিলেন বিদেশে পড়াশোনার জন্য। মাস্টার্স কমপ্লিট করে যখন সিকিন্দারের ফেরার কথা চলছিল, তখন শফিক ছেলের বিয়ের কথা ভেবে এক মেয়েকে পছন্দ করেন। সেই মেয়েটা অন্য কেউ নয়—তাওহিদা। কিন্তু দেশে ফিরে সিকিন্দার জানিয়ে দেন, গ্রামের মেয়েকে তিনি বিয়ে করবেন না। মুখে তা বললেও তখন তার শক্তি ছিল না শফিকের বজ্রকণ্ঠ ছাপিয়ে কথা বলার। অনেক চেষ্টার পর বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ে বলতে তাদের মাঝে একপ্রকার ধরাবাঁধা নিয়ম; যে নিয়ম তাদের দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা ঢালতে পারেনি। শুধু শারীরিক স্পর্শে একে অপরের কাছে থাকলেও, মনের দিক থেকে যোজন দূরে ছিল সিকিন্দার ও তাওহিদা। শরিফের আবদারে বছর গড়াতেই স্নিগ্ধার জন্ম হয়। তারপর থেকে শহরে সিকিন্দারের আনাগোনা বাড়ে। মাঝে মাঝে এমনও হতো যে দুই মাস পরে বাড়ি ফিরছেন তিনি। শহরে তার নিজস্ব এক প্রতিষ্ঠান আছে বলে কেউই তেমন কিছু মনে করত না। এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যায়। সিকিন্দারকে কখনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না বলে পরবর্তীতে তিনি আরও দেরিতে বাড়ি ফিরতেন। তাওহিদার জন্য ভালোবাসা না থাকলেও স্নিগ্ধার জন্যে সিকিন্দারের ভালোবাসা টইটুম্বুর। সম্ভবত স্নিগ্ধাকে দেখার জন্যই তিনি বাড়ি ফিরতেন। এভাবে বাবাকে পেয়ে, না পেয়ে স্নিগ্ধার বড় হয়ে ওঠা। বাবার প্রতি তার অভিযোগ বাড়লেও সিকিন্দারকে অভিযোগ করা হয় না। তবুও ভালোই ছিল সবাই। কিন্তু ভালো সময় সবসময় থাকে না। খারাপ সময় আসে, আসতেই হয়। এ হলো জীবনের নিয়ম। জমিদার বাড়িরও খারাপ সময় এলো। যা স্নিগ্ধা ভুলতে চাইলেও পারে না। অনেকবার ভুলতে গিয়ে সেই ঘটনার অতলে হারিয়ে গেছে সে। যেমনটি নামাজে বসলে ঘোরের মাঝে হারিয়ে যায়—ঠিক তেমন।
সেবার স্নিগ্ধার চৌদ্দতম জন্মদিন। তার জন্মদিনে জমিদার বাড়িকে জাঁকজমক করে সাজানো হয়েছিল। সিকিন্দারের বিয়ের পর ওই প্রথম এত আলোকসজ্জা জমিদার বাড়িতে। কিন্তু সেই আলো নিভিয়ে গেছিল দ্রুত—যখন শফিক জানতে পেরেছিলেন, তার বড় ছেলে সিকিন্দার শহরে আরেকটা বিয়ে করেছে। সারা বাড়িতে হৈচৈ, চেঁচামেচি শুরু হয়। তাওহিদার মুখ চেয়ে আর নিজের সন্মানের জন্য প্রতিবাদ করেন শফিক। কিন্তু সেদিন শফিকের বজ্রকণ্ঠ ছাপিয়ে সিকিন্দারের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল—মেনে নিতে পারেনি কেউ। কথায় কথায় সিকিন্দারকে ত্যাজ্যপুত্র করেন শফিক। তাওহিদা সব দেখেও চুপ করে থাকেন। একদম চুপ! কারো প্রতি তার কোনো অভিযোগ ছিল না, আজও নেই।
চৌদ্দতম জন্মদিনে মায়ের থেকে, একটা পরিবারের থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল স্নিগ্ধাকে। সিকিন্দার নিজের সাথে মেয়েকেও নিয়ে বেরিয়ে গেছিলেন সেদিন। তাওহিদা আটকাননি, শুধু তাকিয়ে ছিলেন। সেদিন থেকে বাবার সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ছাপিয়ে রাগ এসে ভর করেছিল স্নিগ্ধার ছোট্ট মনে। তারপর থেকে বাধ্য হয়েই বাবাকে ঘিরে আশা, স্বপ্ন লালন করতে হয়েছে স্নিগ্ধাকে। সিকিন্দার কখনো স্নিগ্ধাকে ঠিকমতো বাইরে বেরোতে দিতেন না। এমন নয় যে তিনি স্নিগ্ধাকে ভালোবাসেন না; প্রচণ্ড ভালোবাসেন। আর তাই মেয়েকে নিয়ে ছোট ছোট ভয়ে ডুবে থাকেন রোজ। তার ভয়ে স্নিগ্ধার অনেক ইচ্ছেই আজ অপূর্ণ রয়ে গেছে। যেগুলো স্নিগ্ধাকে পোড়ায়। সিকিন্দার ভালোবাসলেও তার দ্বিতীয় স্ত্রী কখনো ভালোভাবে নেননি স্নিগ্ধাকে। কত কাজ করে যে সিকিন্দারের কাছে স্নিগ্ধাকে খারাপ করতে চেয়েছেন তিনি! নেহাত সিকিন্দার মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন! নিত্য রুটিন ছিল তার দ্বিতীয় স্ত্রী’র অপনাম। স্নিগ্ধার কাছে যোগ্য জবাব থাকলেও কখনো দেয়নি। স্নিগ্ধাও ঠিক তাওহিদার মতো; সবকিছু মেনে নিতে পারে, মানিয়ে নিতে পারে। অপমানের জবাবে অপমান—ভুল উত্তর। অপমানের জবাবে চুপ থাকা—মোক্ষম উত্তর। রাসূলও এ নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। তাই সে বরাবর চুপ থেকেছে। এতটুকু অভিযোগ করেনি।
স্নিগ্ধার এ বাড়িতে আসার ঝোঁক ছিল প্রথম থেকেই। মাঝে মাঝে তাওহিদার সাথে যোগাযোগ হতো—ওটুকুতে আর সাধ মেটে? বয়স বাড়ার সাথে সাথে মা’কে চোখ ভরে দেখার তৃষ্ণা বেড়ে চলেছিল। কিন্তু সিকিন্দারকে মানিয়ে নিতে গিয়ে প্রায় ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তারপর স্নিগ্ধা আসতে পেরেছে এই বাড়িতে। তাই তাকে নিয়ে সবার এত হৈ-হুল্লোড়। বাবার কাছে বদ্ধ পরিবেশে ফিরে যাওয়াও দুঃস্বপ্নের। আসার সময় সিকিন্দারের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দিয়েছেন, স্নিগ্ধা যেন আর না ফেরে। নিজেও আর ফিরতে চায় না সে। বরং বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পথ খুঁজে চলেছে সদ্য বিশে পা দেওয়া মেয়েটি।
‘স্নিগ্ধা…’
তাওহিদার অস্পষ্ট করুণ ডাক শুনতে পেল স্নিগ্ধা। একটু চমকালো। তাওহিদা এখনো জেগে আছেন? মায়ের দিকে ফিরে ছোট্ট উত্তর দিল, ‘হুম।’
‘ঘুম আসছে না?’
‘উঁহু!’
‘চোখ বন্ধ কর। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’
চোখ বন্ধ করল স্নিগ্ধা। তাওহিদা পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। চোখের কার্ণিশ থেকে অশ্রু মুছে তাওহিদাকে জড়িয়ে ধরল স্নিগ্ধা। না, এই পরিবার আর মা’কে ছেড়ে সে কোত্থাও যাবে না। গেলে এভাবে পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে কে?
__________
অদূরের চেনা বাঁশির সুরে ঘুম ভাঙল স্নিগ্ধার। সকালের সূর্য এসে তার চোখে-মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। মিরমির করে চোখ খুলল সে। তাওহিদা ততক্ষণে উঠে পড়েছেন। স্নিগ্ধার চোখ খোলার ভঙি দেখে হেসে কপালে চুমু দিয়ে বাইরে গেলেন। স্নিগ্ধা চুপচাপ জননীর আদর উপভোগ করে বিছানায় পড়ে রইল। বিনিদ্র রাতগুলো এখন ‘ঘুম’ ঠিকানাকে পেয়ে গেছে। তাই রাতে যত মন খারাপ ছিল, সেগুলো তাওহিদার আদরে মন ভালোর ঔষধ হয়ে ফুরফুরে রেখেছে স্নিগ্ধাকে।
মিন্টুর বাঁশির সুরটা আজ বেশ জোরালোভাবে শোনা যাচ্ছে। তার বাঁশির সুরে কী যেন এক বেদনা! আচ্ছা ছেলেটির কীসের এত কষ্ট? কিছুক্ষণের মধ্যে উঠে পড়ল স্নিগ্ধা। হাত-মুখ ধুয়ে মনিকে ডাকল সে। হাজার ডাকাডাকির পরেও মনিকে ওঠাতে ব্যর্থ হয়ে একাই বেরিয়ে পড়ল। উদ্দেশ্য সেই বটগাছ!
বটগাছের শিকড়ে আজও মিন্টুর দখল। হাত বাঁশিতে, চোখ বন্ধ। ছেলেটির চোখের পাপড়ি খুব ঘন। একদম মেয়েদের মতো। অথচ এ বেমানান পাপড়িগুলো মিন্টুকে স্নিগ্ধার মনে মানিয়ে দিচ্ছে। বিস্ময়ে আরও ভালো করে তাকাল স্নিগ্ধা। কপালের কোণে একটা পোড়া দাগ। মাথায় গামছা বাঁধা থাকলেও কিছুটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গরম কিছু দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে পুড়িয়ে দেওয়া ক্ষত। প্রথমে মন খারাপ হলেও পরে সে বুঝতে পারল, মিন্টুর পোড়া দাগ আর মেয়েলি চোখের পাপড়ির ব্যাপারটা স্নিগ্ধাকে বেশি টানছে। কী অদ্ভুত!
স্নিগ্ধার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ না শুনলেও কেমন করে জানি মিন্টু বুঝল স্নিগ্ধার আগমন। তার শরীরে খুব হালকা, মিষ্টি একটা ঘ্রাণ থাকে। হয়তো সেই ঘ্রাণ নাকে এসেছে। কিন্তু ঘ্রাণটা প্রথমদিনের থেকে আরও মিইয়ে যাওয়া—কীভাবে নাকে এলো?
চোখ খুলল মিন্টু। স্নিগ্ধার দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফেলল সামনের নৌকা বাঁধা পুকুরটাতে, ‘আপনি এখানে?’
স্নিগ্ধা পাশের শিকড়ে বসতেই মিন্টু চট করে উঠে দাঁড়াল। বেশ জোরেই হাসল স্নিগ্ধা, ‘উঠে পড়লে যে? বসো।’
‘না না, আপনিই বসুন।’
‘এসব কী আপনি টাপনি লাগিয়ে রেখেছ? তুমি আমার বড় হবে।’
কিছু বলল না মিন্টু। স্নিগ্ধা আবারও বলল, ‘তুমি কী তোমার ছোটদের আপনি করে সম্বোধন করো?’
এবারও চুপ মিন্টু। তার মুখে শুধু ভাবনার খেলা চলছে। ভাবনাগুলো প্রকাশের পথ হারিয়ে ফেলেছে হয়তো। তাই বদ্ধ হয়ে মিন্টুর মুখেই ছুটোছুটি করছে।
নিজেও শিকড় থেকে উঠে দাঁড়াল স্নিগ্ধা। মিন্টুর দিকে তাকাতেই সে আরও একটি নজরকাড়া জিনিস দেখতে পেল। মিন্টুর চোখের মণির কাছে একটা তিল। কেন যেন এই বেমানান ব্যাপারটাও স্নিগ্ধার ভালো লাগল। আসলে যে মানুষটিকে ভালো লাগে, তার হাজার বেমানান জিনিসও ভালো লাগে। স্নিগ্ধার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এক’ই।
সকালের হালকা গরম রোদ—স্নিগ্ধাকে এই গাছের ছায়ায় আটকে রেখেছে। ছোটবেলায় এই গাছ আর পুকুরটা প্রচণ্ড পছন্দের ছিল তার। পুকুরটাতে আগে বড় বড় শাপলা ফুটত। সেই শাপলাগুলো তুলে গয়না বানিয়ে সাজতো ম্নিগ্ধা। কখনো জীবনানন্দের বনলতা সেন সাজার চেষ্টা, কখনো বা বেদের মেয়ে জোসনা! কত সুন্দর ছিল শৈশবের সেসব দিন! আড়ালে চোখের কোণে অশ্রুর খেলা চলতে থাকে স্নিগ্ধার।
স্নিগ্ধার চোখের ঝকঝকে অশ্রুবিন্দু দেখতে পেল মিন্টু। মন ভালো, হাশি-খুশি মেয়েদের চোখে অশ্রু সর্বদাই বেমানান। মিন্টুর ইচ্ছে করল জিজ্ঞাসা করতে, কেন স্নিগ্ধার মন খারাপ। কিন্তু ভেতর থেকে কে যেন বাঁধা দিয়ে ফেলল। যার চোখের অশ্রু কারণ জিজ্ঞাসা করার পথ নেই, যার চোখের অশ্রু মুছে দেওয়ার অধিকার নেই; তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে নিজেকে বোকা বোকা মনে হয়। তাই মিন্টু বাঁশিটা কোমরে গুজে পুকুরের দিকে যেতে লাগল। স্নিগ্ধা তৎক্ষনাৎ কনিষ্ঠ আঙুলে অশ্রু মুছে এগিয়ে গেল মিন্টুর দিকে। মিন্টু পুকুরের ধারে বাঁধা নৌকায় উঠল।
স্নিগ্ধা হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘আমিও উঠব।’
মিন্টু ভ্রু কুঁচকে জবাব দিল, ‘পড়ে যাবেন।’
‘আবারও আপনি?’ নৌকায় উঠল স্নিগ্ধা।
মিন্টু বৈঠা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকল। নৌকায় মিন্টুর সোজাসুজি আরেক পাশে বসে চারিদিকে চোখ বুলালো স্নিগ্ধা। নৌকার মাঝে কীসের যেন দুইটা বস্তা।
মাঠে একগাদা গরু চরছে। মাঝে বটগাছ, সবুজের সমারোহ, রোদে হালকা গরম পরিবেশ মিলিয়ে গ্রামের অনন্য চিত্র!
মিন্টুকে বৈঠা হাতে বসে থাকতে দেখে স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করল, ‘নৌকা চালাতে পারো না?’
মিন্টু গাম্ভীর্য ধরে রেখে উত্তর দিল, ‘পারি।’
‘তাহলে চালাও।’
‘আপনি বড়িতে যান।’
‘কেন?’ মুখ মলিন করল স্নিগ্ধা, ‘আমার সঙ্গ ভালো লাগছে না?’
‘আমি পুকুরে খাবার দেবো। তাছাড়া গ্রামের কেউ যদি দেখে, এই সকাল বেলায় আপনি বাড়ির কাজের লোকের সাথে নৌকায় আছেন, তবে খারাপ ভাববে।’
‘কী?’ জিজ্ঞাসা করেই খিলখিল করে হেসে ফেলল স্নিগ্ধা। মলিনতা, শৈশব ভেবে চোখে আসা অশ্রু সবকিছু বিলীন হয়ে গেল তার হাসির দমকে।
স্নিগ্ধার হাসির মূর্ছনায় মিন্টুর দিশেহারা অবস্থা। অস্থির চোখে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল সে।
স্নিগ্ধা হাসি থামিয়ে বলল, ‘গ্রামের লোক কী ভাববে, না ভাববে তার আগেই তুমি ভেবে বসে আছ? এটা ঠিক না। এবার নৌকা চালাও। দেখি মাঝি হতে পারো কি না।’
স্নিগ্ধার মুখে অসম্ভব মায়া, যা এড়িয়ে যাওয়া ভয়ঙ্কর কষ্টসাধ্য। মিন্টুও এড়িয়ে যেতে পারল না। সব ভাবনা ফেলে নৌকা চালাতে শুরু করল সে।
পানি ছোঁয়ার চেষ্টায় মশগুল স্নিগ্ধা। হাত ভিজিয়ে পুকুরের পানি পুকুরেই ছেটাচ্ছে সে। কিছু পানির ছটা এসে পড়ছে স্নিগ্ধার ধবধবে মুখে। মিন্টু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে খোলা চুলের উচ্ছ্বাসিত মেয়েটিকে।
পুকুরের মাঝে এসে বস্তা থেকে মাছের খাবার বের করে পুকুরে ছেটাতে থাকল মিন্টু। স্নিগ্ধার চোখ তখন ঘর্মাক্ত মিন্টুর মুখে।
স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করল, ‘অন্যের বাড়িতেও কাজ করো তুমি?’
মিন্টু নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেই উত্তর দিল, ‘না তো। কেন?’
‘এই পুকুরে খাবার দিচ্ছ যে?’
‘পুকুরটা দাদামশাই কিনেছেন। আপনি নাকি এই জায়গাটা খুব পছন্দ করতেন। তাই দাদামশাই বটগাছ, তার আশেপাশের জমি আর এই পুকুরটা কিনে নিয়েছেন।’
স্তব্ধ হয়ে থাকল স্নিগ্ধা। সবার থেকে দূরে থাকার পরেও সবাই তাকে কত ভালোবেসেছে, তার পছন্দের কত প্রাধান্য দিয়েছে—ভাবতে গেলেও অবাক হতে হয়। ভালোবাসার কী অসীম শক্তি! কাছে না থাকলেও কাছে থাকার মতো করে অন্যরা ভালোবাসতে পারে, আগলে নিতে পারে। আচ্ছা, এভাবে কী মিন্টুকেও সে দূর থেকে ভালোবাসতে পারবে? কীসব ভাবনা! যখন কাছে থেকে ভালোবাসার সুযোগ থাকে, তখন দূরত্বের ভাবনা কেন?
(চলবে)