ভ্রমর (পর্ব – ২)

0
1384

ভ্রমর (পর্ব – ২)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে বটগাছের পাতা নৃত্য করছে, আর বাঁশির সুরে নৃত্য করে চলেছে স্নিগ্ধার মন। ভেজা শরীর মাঝে মাঝে ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠছে। মনি যখন পৌঁছাল তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। ঠকঠক করে কাঁপছে বেচারি। স্নিগ্ধা মুখে আঙুল রেখে চুপ থাকতে বলল। তখন’ই হঠাৎ বাঁশির সুর বন্ধ হয়ে গেল। স্নিগ্ধা পেছনে তাকিয়ে দেখল, ছেলেটি তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সরাসরি ছেলেটির চোখে তাকিয়ে আবিভূত হয়ে গেল স্নিগ্ধা। অসম্ভব সুন্দর চোখ। ছেলেদের এমন সুন্দর চোখ সে এর আগে দেখেনি। অথবা এটাও হতে পারে যে সরাসরি কারো চোখের দিকে তাকানোই হয়নি।
মিন্টুর অপলক চাহনিতে স্নিগ্ধা কেমন বেকুব বনে গেল। মনে হচ্ছে মিন্টুর বাঁশির সুর এভাবে শুনে বড় অপরাধ করে ফেলেছে সে। সবকিছু নিশ্চুপ, শুনশান।
মনি নীরবতা ভেঙে বলে উঠল, ‘মিন্টু ভাইয়া, তোমার বাঁশির সুরে জাদু আছে মেনে নিলাম। এই দেখ-না, আমার বোনটি কীভাবে ছুটে এসেছে।’

মিন্টু স্নিগ্ধার দিকে তাকাল। কয়েকদিন ধরে জমিদার বাড়িতে এই মেয়ের নাম জপে চলেছে সবাই। যা বুঝা গেছে, স্নিগ্ধা সবার আদরের দুলালি। সেই মেয়ে বৃষ্টিতে কাঁপতে কাঁপতে এভাবে বাঁশির সুর শুনছে জানলে, জমিদার শফিক নিশ্চিত মিন্টুকে বাড়িতে বসিয়ে রাখবেন স্নিগ্ধাকে বাঁশির সুর শোনানোর জন্য!
স্নিগ্ধার আপাদমস্তক দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মিন্টু। স্নিগ্ধা ততক্ষণে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। মিন্টু যেভাবে তাকিয়ে আছে—হওয়ার’ই কথা। এমন চাহনির শিকার সে যে প্রথম এমন নয়। এর আগেও কত ছেলে এভাবে তাকিয়ে দেখেছে কিন্তু কখনো লজ্জা লাগেনি, অস্বস্তিও হয়নি। অথচ এই শুকনো, শ্যামলা ছেলেটির চাহনি কেমন অসহ্য হয়ে উঠছে স্নিগ্ধার কাছে। এত পরে সে টের পেল, মনির মতোই ঠাণ্ডায় কাঁপছে নিজেও। বাড়িতে এই ভেজা শরীরে দেখে ফেললে এলাহী কাণ্ড হয়ে যাবে।
মিন্টু স্নিগ্ধাকে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘বাড়িতে যান আপনারা। দাদামশাই আপনাদের এভাবে দেখলে আমাকেই বকবেন।’
‘হুম।’ বলে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো স্নিগ্ধা।

বটগাছের নিচ থেকে ফিরতে ফিরতে ঠাণ্ডায় জমে গেল দু’জন। এক হাত অপর হাতে ঘষতে ঘষতে বাড়িতে ঢুকল স্নিগ্ধা আর মনি। লুকিয়ে নিজেদের ঘরে পৌঁছে কাপড়-চোপড় পাল্টে আবার দুই মাথা এক করে ফেলল। অতঃপর এক কাথায় ঢুকে থাকল দু’জন।
মনি বালিশে মুখ ডুবিয়ে দিল। বলল, ‘জ্বর এলে আর রক্ষা থাকবে না।’
নিঃশব্দে হাসল স্নিগ্ধা, ‘আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভিজে যদি জ্বর না আসে, তাহলে সেই ভেজা আবার কী এমন ভেজা?’
‘তাই বলে বাঁশির সুরে মগ্ন হয়ে ভিজতে হবে?’ বলে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো মনি।
‘ছেলেটি খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারে।’
‘তাই?’
মনির কথার ধাঁচে চট করে মাথা ঘোরালো স্নিগ্ধা। মনির মুখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক চকমক করছে। স্নিগ্ধাও হেসে ফেলল, ‘এভাবে কেন বলছ?’
‘না এমনিই।’ ঢং করে বলল মনি।
স্নিগ্ধা আর কোনো উত্তর দিল না। সে চায় না মনির সামনে বেকায়দায় পড়তে।

সন্ধ্যার দিকে ঘুম ভাঙল স্নিগ্ধার। চোখ রগড়ে জানালা পানে তাকাল সে। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে টেকা দায়। কিন্তু মনি বেশ আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। এক মহূর্ত চুপ করে থেকে বুঝার চেষ্টা করল জ্বর এসেছে কি না। না, জ্বর আসেনি। মনির কপালে হাত রেখেও জ্বরের কোনো নাম নিশানা পাওয়া গেল না। আনন্দিত হয়ে গুনগুন করতে করতে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পাশে গেল স্নিগ্ধা। দেখল, মিন্টু মাঠ থেকে ত্রিশটার মতো গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছে। এই সব গরুগুলো শফিকের, আর গরুগুলোর খেয়াল রাখার জন্যেই মিন্টুকে রাখা হয়েছে।
মিন্টু গরুগুলো নিয়ে আসতে আসতে কী মনে করে উপর ঘরের জানালার দিকে তাকাল। দেখতে পেল স্নিগ্ধাকে। চোখ বুলিয়ে দিল হালকা ভেজা চুলে আর স্নিগ্ধার আবেগী চোখে। স্নিগ্ধা মিন্টুর দিকেই তাকিয়ে আছে! তা দেখে চট করে মাথা নামিয়ে ফেলল মিন্টু। পরবর্তীতে আর একবারও ওপরে তাকালো না। মিন্টুর কাণ্ড দেখে ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল স্নিগ্ধা। যতক্ষণ দেখা যায় খিটখিটে ছেলেটিকে, ততক্ষণ তাকিয়ে থাকল। গ্রিলের ফাঁকে ফাঁকে হাত রেখে চোখ বন্ধ করল।

‘লাভ নেই, লাভ নেই!’ মনির ঘুম মাখানো গম্ভীর স্বর কানে আসতেই চমকে চোখ খুলল স্নিগ্ধা। থতমত খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে দাঁড়িয়ে থাকল। মনি আবারও বলে উঠল, ‘ও মেয়েদের থেকে দূরে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। আমার সাথেও ঠিকমতো কথা বলে না।’
স্নিগ্ধা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে মনির পাশে বসল। দেখল মনি ঘুমের ঘোরে এসব বলছে কি না। হঠাৎ মনি যন্ত্রের মতো চোখ খুলল।
স্নিগ্ধা বুকে থুতু দিয়ে বলল, ‘এভাবে কেউ চোখ খোলে?’
মনি আবারও তার মিষ্টি হাসিটা দিল।
স্নিগ্ধা কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, ওই মিন্টু থাকে কোথায়?’
‘ওর প্রতি তোমার এত আগ্রহ কেন বলো তো?’ উঠে বসল মনি, ‘কী ব্যাপার?’
‘তেমন কিছু না। একটা মানুষের ব্যাপারে জানতে চাওয়া তো স্বাভাবিক তাই না?’
মিটিমিটি করে হাসল মনি। মনির হাসিতে অপ্রস্তুত হয়ে গেল স্নিগ্ধা। চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল সে। বিছানা ছেড়ে, গুছিয়ে দাঁড়াল। এখন এ ঘর থেকে বেরোতে পারলেই বাঁচে এমন অবস্থা! ছেলেটির সম্পর্কে স্নিগ্ধা কেন জানতে চাইছে; তা সে নিজেই জানে না। কিন্তু এটা সত্যি যে, ছেলেটির সম্পর্কে কিছু জানার আগ্রহ সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে বেড়ে যাচ্ছে।

স্নিগ্ধার ভাবুক, সুক্ষ্ম মলিন মুখ দেখে মনির মায়া হলো। সে গড়গড় করে বলতে লাগল, ‘তখন এক বুড়ির কুঁড়েঘরে গিয়েছিলে না? ওই বুড়ির’ই ছেলে মিন্টু ভাই। বাবা মারা গেছে সেই কবে! দাদুই ওকে বড় করেছে। ওদের সব খরচ দাদু দেয়, নাতির মতোই আদর করে। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়েছেও আবার।’ উল্লাস কমিয়ে একটু থামল সে। পরে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘মিন্টু ভাইকে যদি ভালো লেগে থাকে তবে… কথাটা ভুলে যাও।’
খুব জোরে হেসে ফেলল স্নিগ্ধা। তার হাসি’ই অনেক কিছুর উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। মনি ঠোঁট উলটে বলে উঠল, ‘আমি বুঝলাম না, ওই হ্যাংলাটাকে কী দেখে ভালো লাগল তোমার?’
__________

স্নিগ্ধা মেয়েটিকে সুবিধার মনে হচ্ছে না মিন্টুর। তখন কেমন করে যেন তাকিয়ে ছিল। চাহনিটা এত স্নিগ্ধ আর আবেগি যে বলার নয়! ওভাবে কেন তাকিয়ে ছিল কে জানে! মিন্টু দ্বিতীয়বার আর ওই চোখে তাকানোর সাহস পায়নি। যতক্ষণ সে বাড়িতে ঢোকেনি, ততক্ষণ যে স্নিগ্ধা তাকে দেখে চলেছিল তা অনুমান করেছে মিন্টু। কেমন একটা ভীতি কাজ করছিল। সমানভাবে বাড়ছিল বুকের ধুকপুকানি। এ অনুভূতি কেন হয়েছিল তা সে জানে না। হয়তো কোনো শহরের আধুনিক মেয়ে তাকে এভাবে দেখছে বলেই এমন হচ্ছে। চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
একা একা অন্ধকার কুঁড়েঘরে এমন সব অদ্ভুত কথা ভেবে চলেছে মিন্টু। তার জীবন মা, জমিদার বাড়ি, সেই বাড়ির গরু এবং বাঁশির করুণ সুর নিয়েই সীমাবদ্ধ। করুণ সুরে বাঁশি বাজানোর কোনো কারণ নেই, কিন্তু তবুও সে বাজায়—ভালো লাগে এই আর কী! এসব ছাড়া এই প্রথম নিজের লাগামহীন ভাবনা কোনো মেয়েকে নিয়ে ভেবে চলেছে। তেইশ বছরের জীবনে এই প্রথম এমন হলো। কী সাংঘাতিক!

‘মিন্টু, শরিফ বাবাজানের থাইকা আমার ঔষধের টাকাটা যে নিয়ে আইতে কইছিলাম। আনছিস?’
জিভে কামড় দিল মিন্টু! তহমিনা কথাটা না বললে আর মনেই পড়ত না। সে বলে উঠল, ‘নিয়ে আসব মা। তুমি চিন্তা করো না।’
‘নিয়া আইব না, এখন’ই যাইয়া লইয়া আয়।’

আজ হঠাৎ জমিদার বাড়িতে যেতে অস্বস্তি হচ্ছে মিন্টুর। এই প্রথম অস্বস্তি হচ্ছে দেখে নিজের উপর’ই বিরক্ত সে। বারবার মনে হচ্ছে স্নিগ্ধার সামনে না পড়লেই ভালো। স্নিগ্ধার সাথে দেখা না হলে মসজিদে বিশ টাকা দান করে দেওয়ার নিয়্যত করল মিন্টু। চারপাশ দেখে সোজা শরিফের ঘরে গিয়ে দরজায় আওয়াজ করল। শরিফ সাড়া দিলেন না। মিন্টু দরজায় একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। সে মাথা বাড়িয়ে দেখল শরিফ ঘরে নেই। বাইরে কিছুক্ষণ পায়চারি করে দেখল নিচে একজনও নেই। কারো নাগাল না পেয়ে সদর দরজার দিকে পা বাড়াল মিন্টু; তখন’ই উপর থেকে সবার হাততালি ভেসে এলো। মিন্টু পিছু ফিরে তাকাল। শব্দটা স্নিগ্ধার ঘর থেকে আসছে সন্দেহ নেই। তারমানে সবাই ওই ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওদিকে যাবে কি না এই দ্বন্দ্বে এক স্থানেই মিনিট পাঁচেকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হলো মিন্টুকে। খালি হাতে ফিরলে মায়ের জুতার মার না খেতে হয় সেই ভয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। স্নিগ্ধার ঘরের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, লুকিয়ে মাথা বাড়িয়ে দিল।
সারা ঘরে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে—সবার মধ্যমনি স্নিগ্ধা। ঘর থেকে আসা ছিন্ন ছিন্ন কথায় বুঝা গেল, স্নিগ্ধা চমৎকার সুন্দর গান গায়। স্নিগ্ধাকে গান গাইতে বলা হচ্ছে কিন্তু স্নিগ্ধা বারবার ‘না’ বলছে। এমন সময় স্নিগ্ধার চোখে পড়ল মিন্টুর ঝাঁকড়া চুল। মিন্টু চট করে মাথা লুকিয়ে ফেলল। স্নিগ্ধা দেখতে পায়নি এমন ভঙিমা করে সবার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত গান গাইতে রাজি হলো।
মিন্টুর কানে আসতে লাগল তখন স্নিগ্ধার স্নিগ্ধ, মিষ্টি কণ্ঠ, ‘বংশী বাজায় কে রে সখি, বংশী বাজায় কে…’
আহা! আল্লাহ্ যেন পৃথিবীর সব মিষ্টতা স্নিগ্ধার সুরে ঢেলে দিয়েছেন!

গানটা শেষ হতেই মিন্টু নিচে নামতে শুরু করল। একটা একটা করে সিঁড়িগুলোতে পা রাখছে আর গুনছে সে। ছোটবেলা থেকে এ বাড়িতে তার চলাচল হলেও কখনো সিঁড়ির ধাপ গোনা হয়নি। আজ খুব গুনতে ইচ্ছে করছে। কেন তা কে জানে!
পনেরোটা সিঁড়ি পেরোতেই স্নিগ্ধার দুষ্টু, মিষ্টি কণ্ঠ কানে এসে বাজলো, ‘লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গান শুনছিলে?’
হকচকিয়ে পিছু ফিরে নিচে তাকিয়ে থাকল মিন্টু। তার বুকটা ধুকধুক করছে—চুরি করে গান শোনার জন্য না কি স্নিগ্ধার উপস্থিতি; সে তা ঠাওর করতে পারল না।
স্নিগ্ধা ঠোঁট কামড়ে হাসল, ‘আমার দিকে তাকাও।’
মিন্টু তাকাল না। স্নিগ্ধা এক’ই কথা পুনরায় বলল। কিন্তু মিন্টু নিচেই তাকিয়ে থাকল। না, মিন্টু আর স্নিগ্ধার ওই দুই চোখে তাকাবে না। একবার তাকিয়ে যে অদ্ভুত সব কাণ্ড হচ্ছে; দ্বিতীয়বার তাকে ভস্মীভূত হয়ে যেতে হবে। চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইল মিন্টু। আল্লাহ্ প্রথমবার সাহায্য না করলেও এবার করলেন।
শরিফ বের হলেন ঘর থেকে। মিন্টুকে দেখে বললেন, ‘কী ব্যাপার মিন্টু? এই সময় তো তোমাকে আসতে দেখা যায় না।’
‘দাদামশাই, মা পাঠাল। মায়ের প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধ শেষ।’ স্নিগ্ধার সামনে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে মিন্টুর।
শরিফ স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে গর্বে বুক ফুলিয়ে বললেন, ‘তোদের ভাষা শিখিয়েছি ওকে। শুধু ওর মাকেই শেখাতে পারলাম না।’ শেষ কথাটা বলে হাসলেন তিনি।

শরিফ নিচে নামলে মিন্টুও তাড়াহুড়ো করে নামতে শুরু করল। আড়চোখে একবার স্নিগ্ধার দিকে তাকাতেই দেখল, স্নিগ্ধা তাকে ইশারায় দাঁড়াতে বলছে। ব্যাপারটা বুঝতেই আরও দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে চলে গেল মিন্টু।
স্নিগ্ধা ফিক করে হেসে বিড়বিড় করল, ‘কাল দেখাচ্ছি তোমায়!’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here