ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
শেষ_পর্ব ৩য় অংশ
#সুলতানা_সিমা
দিশার কেবিন থেকে ডক্টর বের হতেই মিহান,দিহান,শাওন একসাথে এগিয়ে এসে বলে,ডক্টর দিশার কি অবস্থা?
_পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে আপনারা যেতে পারেন। দিহান মিহান যাওয়ার আগেই শাওন দৌড়ে গিয়ে কেবিনে ঢুকে। সাথে মিহান আর দিহান থেমে গেলো। শাওন কেবিনে ঢুকে দেখলো দিশা বসে আছে। শাওনকে দেখে দিশা চোখ নামিয়ে নেয়। শাওন চট করে দিশাকে জড়িয়ে ধরে। এভাবে জড়িয়ে ধরায় দিশা ৪৪০ ভোল্টের শকড খেলো। শাওন তাকে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরেছে? দিশার ঘাড়ে তরল কিছু পরলো। ফ্যাসফ্যাসে কান্নার নিঃশ্বাস শুনা যাচ্ছে। শাওন কি কাঁদছে? দিশা চট করে শাওনকে জড়িয়ে ধরলো। ইচ্ছে করছে শাওনকে কলিজায় ঢুকিয়ে রাখতে। এতো নেশা কেন এই মানুষটার প্রতি তাঁর? শাওন দিশাকে ছেড়ে দিশার দুগাল ধরে বলল, ”
_ঠিক আছিস এখন?” দিশা কিঞ্চিৎ ভাবে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। শাওন বলে,”
_কি হয়েছিলো?” দিশা কিছু বলেনা। শাওন আবার দিশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”
_জানিস এতোক্ষণ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। কতো ভয় পেয়ে ছিলাম।” দিশা কান্নাভেজা চোখে মৃদু হেসে উঠে। এতো সুখ লাগছে কেন তাঁর? স্বামীর ভালোবাসা পাচ্ছে বলে?”
কিছু মেডিসিন নিয়ে দিশাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। বাসায় আসার পরেই অরিন দিহানকে সব বলে দেয়। দিহান সব শুনে রাগে একটা চেয়ার তুলে আছাড় মেরে ফেলে। চেয়ারটা ছিটকে গিয়ে দূরে পরে। অরিন কেঁপে ওঠে। দিহানের রাগান্বিত চেহারা দেখে ভয়ে কেঁদে দেয়৷ দিহান চট করে অরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে,”
_এই বউপাখি কাঁদছো কেন? তোমাকে কিছু বলবো না,ভয় পেয়না। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই বউপাখি। দোষ ওর। সাজা ওকেই পেতে হবে। ও তোমাকে ছুঁয়েছে বউপাখি।” শেষ কথাটা বলতে দিহানের গলা ধরে আসে। শাওন এসে রুমে ঢুকতেই চট করে একজন আরেকজনকে ছেড়ে দিলো। শাওনও একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। চলে যেতে লাগে তখন দিহান পিছন থেকে ডাক দেয়,
_কি রে চলে যাচ্ছিস কেন? আয়।” শাওন আসে। অরিনের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,” দিশার নাকে কেমনে আঘাত পেয়েছিলো অরিন?”
দিহান বলে,”তোকে বলেছিলাম না মিহান অরিনকে ভালোবাসে?
_হুম। তো?
দিহান একে একে শাওনকে সব বলে দিলো। সব কিছু শুনে শাওন রাগান্বিত হয়ে বলে,”
_কি ভাবে কি ও নিজেকে? প্রথমে দিশার বিয়ে আটকিয়ে ওকে লোকসমাজে কথা শুনালো। আজ দিশাকে মারলো, কি শত্রুতা ওর দিশার সাথে? আমি তো ওকে মেরেই দিবো।”
_কিহ? মিহান দিশার বিয়ে ভেঙেছে?
_হ্যাঁ মিহানই ওই লোক যে ফারাজের পরিবারে ফোন দিয়ে ওর নামে বদনাম করতো।”
দিহান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “ওর কলিজা বড় হয়ে গেছে ওর কলিজা হাতে নিতে হবে।”
শাওন বলে,”ওর কলিজা তো হাতে নিবো আমি। আজ ওকে আমি খুন করেই ফেলবো।”
বলেই শাওন রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পা বাড়ায়। দিহান শাওনকে আটকিয়ে বলে,
_তুই দিশার খেয়াল রাখ। ব্যাপারটা আমি দেখছি।”শাওন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
_ওকে আমার এক্ষুনি মেরে দিতে ইচ্ছে করছে দিহান।
_তুই বাসায় থাক আমি আসছি। দিশা আর অরিনের খেয়াল রাখবি। বউপাখি নিজের খেয়াল রেখো।”
বলেই দিহান বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। অরিন শাওন আটকাতে চাইলেও আটকে না৷ কোনো এক অদ্ভুত কারণে মিহানকে মারতে চেয়েও মারতে পারেনা সে। তাই এখন গ্যাংয়ের সাথে হাত মিলাবে। যে তাঁর বউয়ের গায়ে হাত দিয়েছে সে তাঁকে বাঁচতে দিবেনা। একটু রাস্তা এসে দিহান দেখে লুপা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে দিহানের মাথায় বুদ্ধি খেলে। লুপাকে মিহান কতটা পাগলের মতো ভালোবাসে তা সবাই জানে। লুপার গায়ের একটা ফুলের টুকাও মিহান সয্য করতে পারেনা। লুপাকে কয়েকদিন মিহানের চোখের আড়ালে রাখলেই তো মিহান এমনিই মারা যাবে। দিহান লুপার সামনে গাড়ি থামায়। লুপা দিহানকে দেখে বলল,”
_আরে ভাইয়া তুমি? তুমি এ রাস্তা দিয়ে কই যাচ্ছো?
_যাচ্ছিলাম এদিকে একটা কাজে। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
_কলেজ থেকে একটু শপিংয়ে যাবো ভাবছিলাম। রিকশা পাইনি তাই হাঁটছিলাম। কিন্তু এখন হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।
দিহানের কপাল কুঁচকে আসে। কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বলে,”
_তুই হেঁটে যাবি কেন। নীল তোকে নিতে আসেনা?
_আসলে ভাইয়া ও চাকরি খুঁজছে। আজ একটা ইন্টারভিউ দিতে গেছে।
_অহ আচ্ছা। আয় আমার সাথে আয়। আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।” লুপা গাড়িতে উঠে বসে। গাড়িতে উঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই লুপা ঘুমিয়ে যায়। দিহানের মস্তিষ্কে আরেকটা বুদ্ধি খেলে। চট করে লুপার ব্যাগ থেকে ফোন বের করে মিহানকে মেসেজ দিলো। বালির হাট বলে একটা জায়গা আছে একদম নির্জন জায়গা। দিহান ওই জায়গায় আসার জন্য মেসেজ দেয়। লিখে,” ভাইয়া আমি খুব বিপদে আছি। এক্ষনি বালির হাটে চলে আসো।” দিহান মেসেজটা সেন্ড করেই বালির হাটের দিকে গাড়ি ঘুরায়। বেশ অনেকক্ষণ পরে উদ্দেশ্য জায়গায় পৌঁছে যায় দিহান। দিহান আসার আগেই মিহান চলে এসেছে। লুপা গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। দিহান গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে তাকায়। জায়গাটা একদম নির্জন চারিদিকে শুধু বালির পাহাড়। বালি ছাড়া কিছুই দেখার নেই। দিহান একটু এগিয়ে এসে দেখে মিহান কল দিয়ে দিয়ে পাগলের মতো চারদিকে লুপাকে খুঁজছে। দিহান গিয়ে একটা জায়গায় বসলো। একদিকে তাঁর হাতে ফোন বাজছে, অন্যদিকে মিহান পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে।
চারদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ মিহান দাঁড়িয়ে যায়। এখানে কোথাও ফোন বাজছে। মিহান রিংটোন ফলো করে এসে দেখে লুপার ফোন হাতে নিয়ে দিহান বসে আছে। মিহান এসে ছু মেরে ফোন নিয়ে ফোন উল্টে পাল্টে দেখে বলল,”তুই মেসেজ দিছিলি?”দিহান বাঁকা হাসে। মিহান বলে”
_ লুপার ফোন তোর কাছে কেন?
_আমার কাছে লুপার ফোন থাকা কি অবাকের বিষয়?
_দেখ দিহান কথা প্যাচাবি না। লুপা কই?
_ভাই তোর মতো কথা প্যাচানোর ক্ষমতা নাই। তাই সোজা কথায় আসি। মানছি অরিনের সাথে তোর রিলেশন ছিলো। তাই বলে তুই এখনো ওকে জ্বালাবি? তুই জানিস তুই ওকে ছুঁয়েছিস এটা শুনে আমার দম আটকে আসছে। দেখলে কি হতো? আমি ভেবেছিলাম তোকে বুঝিয়ে বলবো। তুই ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দিবো। কিন্তু তুই তো ক্ষমার যোগ্যই নয়। আমি আর পারবো না মিহান। আমার যে এখন তোকে মারতেই হবে। কারণ তুই শুধু আমার বউয়ের উপর থেমে নেই। তোর বাড়াবাড়িটা দিশার সাথেও হচ্ছে। কি মনে করেছিলি? দিশার বিয়ে ভাঙলে আমি কানাডা যেতে পারবো না। তুই আরো সুযোগ পাবি? উঁহু। সুযোগ পাবিনা। কারণ সুযোগ পাওয়ার জন্য তুই বেঁচেই থাকবি না।”
মিহান হো হো করে হেসে উঠে। তারপর বলে,
_তুই আমাকে মারবি আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো? এখানে ডেকে এনে সুযোগ তো তুই আমাকে করে দিয়েছিস দিহান। যে কাজটা এতোদিন করতে পারিনি সেটা আজ করেই ছাড়বো। তোকে আজ মেরেই দিবো। তোর বাঁচার অধিকার নেই। তুই আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিস।”
দিহান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”
_আমি তোর ভালোবাসা কেড়ে নেইনি। তুই ছুঁড়ে ফেলেছিস আমি খুঁড়িয়ে নিয়েছি।”
মিহান চেঁচিয়ে বলল,
_তুই ছুঁড়ে ফেলা ভালোবাসা কেন খুঁড়িয়ে নিবি দিহান? যে ভালোবাসা ছুঁড়ে ফেলবে সে আবার খুঁড়িয়ে নিবে এটাই ভালোবাসার নিয়ম।
দিহান মিহানের থেকে আরো জোরে গলা উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,”
_আর সেই ভালোবাসার জন্য বোনের গায়ে হাত তুলা কোন নিয়মে পড়ে রে?
_দেখ আমি ওকে জেনে বুঝে মারিনি। আমার হুশ ছিলো না।
_কেন হুশ থাকবে? এটা তো তোর বোন,নয় এটা আমার বোন। অন্যের বোনের বেলায় হুশ থাকার কথাই তো নয়।
_দেখ নিজের বোন অন্যের বোন বলে কোনো কথা নেই, বোন বোনই হয়। ঝগড়া আমাদের মধ্যে। মাঝখানে ওদের টানবি না।
_তাহলে তুই কেন টানলি? তুই কেন আমার সাথে খেলতে গিয়ে দিশার বিয়ে ভেঙে দিছিলি। কেন ওকে লোক সমাজে কথা শুনিয়েছিলি? নিজের বোন হলে এমনটা করতি?
মিহান আর কিছু বলল না। এই কাজ করার পরে তাঁর মনে হচ্ছে সে সত্যিই ভুল করেছে। দিহান বলল,”
_গাড়ির দিকে তাকা।”
মিহান তাকিয়ে দেখলো লুপা গাড়িতে ঘুমিয়ে আছে। সাথে সাথেই মিহানের কলিজা লাফিয়ে উঠলো। মিহান গাড়ির দিকে দৌড় দেয় দিহান ধরে ফেলে। মিহান বলে ”
_ছাড় আমায়। তুই ওকে এখানে এনেছিস কেন?”
_কারণ বোনের গায়ের আঘাত ভাইকে ঠিক কতটা কষ্ট দেয় সেটা তোকে বুঝানো দরকার।
_দেখ তুই আমার বোনের গায়ে হাত তুলবি না। ঝগড়া আমার সাথে। মারামারি করতে হলে আমার সাথে কর।
_তাহলে তুই কেন আমার বোনের গায়ে হাত তুলেছিস। তুই কেন আমার সাথে মারামারি না করে আমার বোনকে টেনেছিস?
_সেটার জন্য ক্ষমা চাইতে হয় আমি ক্ষমা চাইবো। তুই আমার বোনের গায়ে ফুলে টুকাও দিবি না।
দিহান কিছু না বলে গাড়ির দিকে যেতে লাগে। মিহান দিহানের কলার ধরে বলে, ”
_দিহান তুই আমার বোনকে ছুঁবিও না।” দিহান মিহানের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বলে,”
_তোর সাথে খেলতে হলে তোর স্টাইলে খেলতে হবে।” মিহান আবার দিহানের হাত ধরে আটকিয়ে বলল,”
_ দিহান তুই বললে আমি দিশার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো। তুই আমার বোনকে আঘাত করবি না।
_এখন তো আমি ওকে আঘাত করবোই। কারণ আমি জেনে গেছি তোকে শাস্তি দেওয়ার জন্য লুপাকে আঘাত করাই যথেষ্ট।
_দিহান প্লিজ দোহাই লাগে তুই ওকে আঘাত করবি না। দোষ আমার। আমাকে মেরে দে।
_ হ্যাঁ। তোকে মেরে আমি আসামী হই তারপর আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাক। আর আমার অনুপস্থিতিতে তুই আমার বউপাখিকে জোর করে তোর খাঁচায় বন্দি করে নে, আমার বোনকে মেরে নে,তাইতো?
দিহান মিহানকে ছাড়িয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ায়। মিহান চট করে দিহানের পায়ে ধরে ফেলে। তারপর অনুরোধের গলায় বলে,”
_দে আমাকে কাগজ দে, আমি সুইসাইড লেটার লিখবো, কেউ তোকে আসামী বানাবে না। প্রয়োজনে আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুরকে খাইয়ে দে। নয়তো এই বালিতে জ্যান্ত পুতে দে। খোদার কসম, হাশরের মাঠেও আল্লাহর কাছে তোকে খুনী বলবো না। তোর কোনো সাজা হবে না তুই আমায় মেরে দে। তবুও আমার বোনকে মারিস না প্লিজ৷ তোর দুটি পায়ে ধরি আমার বোনকে আঘাত করার আগে আমার কলিজা তোর হাতে নিয়ে নে। ওর কষ্ট দেখার ক্ষমতা আল্লাহ আমায় দেয়নি রে।”
দিহান মিহানকে ছাড়িয়ে এসে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। মিহান দৌড়ে এসে গাড়িতে ধরতে চায় কিন্তু সে ছুঁতেই পারেনি তার আগেই দিহানের গাড়ি চলে যায়। মিহান দৌড়ে গিয়ে তাঁর গাড়িতে উঠে। মিহান ফুল স্পিডে গাড়ী চালাচ্ছে কিন্তু দিহানের গাড়ির ধারে কাছেই যেতে পারছে না। দিহান যেন লুপার কোনো ক্ষতি না করে সে জন্য মিহান কত কি মানত করছে। নফল নামাজও মানছে। তাঁর জীবন চলে যাক তবুও তাঁর বোনের যেন কোনো ক্ষতি হয়না। ভয়ে তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। রাস্তায় সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে ঘোলাটে লাগছে। একটা জায়গায় এসে মিহানের গাড়ি ট্রাকের সাথে বিকট শব্দে ধাক্কা খেয়ে উল্টে গিয়ে দূরে ছিটকে পড়ে। ট্রাকের ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে যায়। মিহান গাড়ির নিচে থেকে ড্রাইভারে যাওয়া দেখে কোনো রকম ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,”
_আমার বোনকে বাঁচান প্লিজ।” আশেপাশের লোকজন দৌড়ে এসে মিহানকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে। রক্তে পুরো শরীর লাল হয়ে আছে। মিহান তখনও ঠোঁট নাড়িয়ে বলছে,”
_আমার বোন,,,,, আমার বোন,,,।” পুরো কথাটা সে মুখ দিয়ে বের করতে পারছে না। তাঁর দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে ফেলে মিহান।
শামু শ্রাবণ ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো। ভিড় দেখে গাড়ি থেকে নেমে আসে দুজন। রক্তাক্ত কাউকে দেখে শামুর মাথা ঘুরে উঠে। রক্ত মাখা মুখটা শ্রাবনের চেনা চেনা লাগছে। শ্রাবণ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের উপরের রক্ত মুছতেই শামু ও শ্রাবণ এক সাথে উচ্চারণ করলো,”মিহান।” শ্রাবণ তারাতাড়ি তাঁর হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। শামু নীলকে ফোন দিয়ে আগে খবরটা জানায়। তারপর ইশিকে কল দিয়ে তাদের বাসায় জানানো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই লুপা, নীল ও তাঁর মা চলে আসে। তাঁর কিছুক্ষণের মধ্যেই মিহানের পরিবারের সবাই চলে আসে।
লুপা এসেছে থেকে শূন্য চোখে মিহানের কেবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ভাইয়ের এক্সিডেন্টের খবর শুনে তাঁর ভিতরের লুপা মারা গেছে। শান্তি চৌধুরী কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে গেছেন। সায়রা চৌধুরীর কান্না তো থামানোই যাচ্ছে না। ইশি খবরটা পেয়ে একবার জ্ঞান হারিয়ে ছিলো। আসার রাস্তায় একবার। এখনে এসে আবার। সবাই কাঁদছে শুধু লুপা পাথর হয়ে গেছে। অনুভূতি হীন মানুষের মতো শুধু চেয়ে আছে কেবিনের দিকে। দিহান নিজেকে দোষারোপ করছে। মিহানকে কেন সে আগে বলেনি সে লুপাকে আঘাত করবে বলে মিহানকে ভয় দেখাচ্ছিলো আর কিছুই না। তাঁরও তো হাত কাঁপে মিহানকে মারতে। সেখানে সে নির্দোষ লুপাকে কিভাবে মারবে?
২৪ ঘন্টা পেরিয়ে যায় মিহানের জ্ঞান ফিরে না। কেউ হসপিটাল থেকে যেতে চাইছে না। সবাই শ্রাবণের পরিচিত বলে থাকতে পারছে৷ নয়তো পেশেন্টের সাথে এতো মানুষ এলাউ না। মিহানকে icu ঢুকাচ্ছে দেখে লুপা অনেক জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে,”ভাইয়ায়ায়ায়ায়া”।” সবাই লুপার দিকে ছুঁটে আসে। লুপা কেঁদে কেঁদে ডাকে,”ভাইয়ায়ায়া,,,এই ভাইয়া।” বলে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে বসে লুপা। কেউ তাঁর কান্না থামাতে পারছে না। দিহান লুপার মাথায় হাত দিয়ে বলে,”
_কাঁদিস না। ভালো হয়ে যাবে ও।”
লুপা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”
_ওরা আমার ভাইয়াকে ওখানে কেন নিয়ে গেছে। আমার ভাইয়াকে ওখান থেকে এনে দাও তোমরা। আমার ভাইয়াকে ওরা কষ্ট দিবে। তোমরা নিয়ে আসো ওখান থেকে।” লুপা দিশার কোমর জড়িয়ে বলে,”
_ও আপু। আপু গো। তুমি ভাইয়াকে অভিশাপ দিয়েছো তাইনা? তুমি কেন অভিশাপ দিয়েছো? তোমায় মেরেছে বলে? আর কখনো মারবে না আপু। তুমি ভাইয়াকে নিয়ে আসো ওখান থেকে। ওরা আমার আমার ভাইকে মেরে দিবে। আমার ভাইকে নিয়ে আসো না আপু যাও।”
লুপার কান্নায় সবাই কেঁদে যাচ্ছে। সায়রা চৌধুরীর কান্নার গতি আরো বেড়ে যায়। সুমনা চৌধুরী উনাকে বুকে জড়িয়ে রাখেন। হাসান চৌধুরী নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছেন। যুবক ছেলের এমন অবস্থা দেখে কোন বাপ না কেঁদে থাকবে? অরিন আজ প্রথম মিহানের জন্য দোয়া করছে। শুধুমাত্র লুপার কান্না দেখে। অরিনের কোনো ভাই নেই। সে জানেনা ভাইয়ের ভালোবাসা কেমন। শুধু দেখেছে। একটা ভাই একটা বোনকে কতটা ভালোবাসতে পারে,একটা বোন একটা ভাইয়ের জন্য কতটা কাঁদতে পারে। আর কারো জন্য হোক বা না হোক লুপার জন্য হলেও যেন মিহান সুস্থ হয়ে উঠে, এটাই চায় অরিন। লুপার কান্না থামছেই না। কারো স্বান্তনা দেওয়ার ক্ষমতাও নাই। নীল লুপাকে বুকের সাথে চেপে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল, “আর কাঁদিস না৷ মিহান কষ্ট পাবে।” ভাইয়ের কষ্ট হবে শুনে লুপা চুপ হয়ে যায়। শ্রাবণকে দেখে লুপা লাফ দিয়ে উঠে দৌড়ে শ্রাবণের সামনে দাঁড়ায়। হাত জোর করে শ্রাবণকে বলে,
_ও ভাইয়া, আমাকে একবার আমার ভাইয়ের কাছে যেতে দাওনা। একবার ওখানে ঢুকতে দাও।
_কিন্তু,,,,।
“শ্রাবণ আর কিছু বলার আগেই লুপা বলে,”
_আল্লাহর দোহাই লাগে একবার আমার ভাইকে দেখতে দিন। আমি দেখেই চলে আসবো।
_কান্নাকাটি করতে পারবা না কথাও বলতে পারবা না, শুধু দেখেই চলে আসবা।” লুপা দুহাতে দ্রুত চোখ মুছে নিয়ে বলে,”কাঁদবো না। দেখুন আমি কাঁদছি না।” শ্রাবণ ঢুকতে দেয়। সাথে নীলও যায়। লুপা মিহানের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে নীলকে বলে,”ওরা আমার ভাইয়ের শরীরে এতো কিছু লাগাইছে কেন? আমার ভাই কি কষ্ট পায়না?” নীল নিঃশব্দে কেঁদে চোখের পানি মুছে। লুপা মিহানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”ভাইয়া উঠো। আমায় চকলেট এনে দিবে না? আমি কিন্তু রাগ করবো। না উঠলে আব্বুকে বলে দিবো তুমি স্মোক করো। দেখবে আব্বু তোমায় মারবে। [কিছুক্ষণ থেমে] আচ্ছা আমি আর কখনো তোমায় বলবো না আব্বুকে বলে দিবো। কাউকে এটা বলবো না স্মোক করো। ওঠো না এবার। আর কতো ঘুমাবে? আমায় ঘুম পাড়াবে না? রাত হয়েছে যে। প্রতিরাতের মতো মেসেজ দিয়ে বলবে না “ধানিলংকা ঘুমিয়ে যা রাত হয়েছে। গুড নাইট।” উঠবে না তো? ঠিক আছে আমি এখনে বসে থাকবো।”
বলে লুপা মেঝেতে বসে পড়ে। লুপার পাগলামো দেখে নীলের দম আটকে আসছে। চোখ মুছে লুপাকে বলে,”লুপা চল।” লুপা চেঁচিয়ে উঠে বলে,”আমি যাবো না।” নীল বলে,”আস্তে মিহান কষ্ট পাবে তো।” লুপা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। নীল বলে,”চল।”
_না আমি যাবো না। আমি কথা বলবো না। আমি চুপ করে বসে থাকবো। আমি চলে গেলে ওরা আমার ভাইকে মেরে ফেলবে।” নীল অনেক চেষ্টা করেও লুপাকে বের করতে পারেনা। শ্রাবণও চেষ্টা করে পারলো না। নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় জ্ঞান হারায় লুপা। তখন তাকে কোলে করে বের করা হয়।
এক সপ্তাহ চলে যায় মিহানের জ্ঞান ফিরে না। ডক্টর জানায় মিহান কোমায় চলে গেছে। লুপার অবস্থা একদম পাগলের মতো হয়ে যায়। হঠাৎ মূর্তি ন্যায় বসে থাকে। হঠাৎ ভাইয়া বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। এক মিনিটের জন্যেও হসপিটাল থেকে তাকে নেওয়া যায়না। ডক্টর মিহানের কেবিনে ঢুকলে লুপা পাগলের মতো চেঁচিয়ে বলে,”ওরা আমার ভাইকে মারতে যাচ্ছে। ওরা আমার ভাইকে মেরে দিবে। আরে কেউ তো আমার ভাইকে বাঁচাও।” একদিন একটা বাচ্চার হাতে চকলেট দেখে লুপা মিহানের কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”
_ভাইয়া, ওই দেখো ওরা চকলেট খাচ্ছে। তুমি আমাকে চকলেট এনে দিবে না? একবার উঠো না ভাইয়া। একবার আমায় কোলে নিয়ে তারপর আবার ঘুমিয়ে যেও।”
যতদিন যায় লুপার পাগলামো বাড়তে থাকে। এখন লুপা সব সময় গুনগুন করে ভাইয়া ভাইয়া বলে কাঁদতে থাকে। রাত ঘনিয়ে এলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে একা একা কথা বলে। প্রতিদিন শুধু একটাই কথা বলে, ”
_ওরা বলে আমার ভাই নাকি বাঁচবে না? ওরা এমন কেন? আমার ভাই না বাঁচলে আমি কাকে ভাই ডাকবো? কাকে বলবো, ভাইয়া আমায় কোলে নিয়ে হাঁটো। কে প্রতিদিন বাইরে গেলে পকেট ভরে আমার জন্য আইসক্রিম চকলেট নিয়ে আসবে? আচ্ছা ওদের কি ভাই নাই? ওরা কি জানেনা ভাই ছাড়া বোন অচল?
প্রতিদিন মিহানের পাশে বসে একা একা কথা বলে,
_ভাইয়া জানো। আমার না খুব মন খারাপ। আকাশ থেকে এক ঝাঁক পরী নেমে আসে না। পরীর মতো আমারও ডানা গজায় না। আমার পরীদের দেশে যাওয়া হয়না। আমার মনটাও ভালো হয়না ভাইয়া। তুমি কি উঠবে না?
চলবে,,,।
সরি রাতে ঘুমিয়ে গেছিলাম। শেষ অংশ বিকালে অথবা সন্ধ্যায় আসবে।