ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_৪০
#সুলতানা_সিমা
আকাশের সাথে রং বদলানো আর গিরগিটির রং বদলানোর মাঝে একটা মিল আছে। দুটোই কখন কোন রং ধারণ করে তা বুঝাই যায় না। ক্ষানিক আগে নীল শাড়ি জড়ানো আকাশটা এখন কালো হয়ে গেছে৷ ইটের ভাটার কালো ধোঁয়ার মতো কালো মেঘেরা উড়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে৷ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুরুম গুরুম করে আকাশ ডেকে জানান দিচ্ছে সবাই নিজের গৃহে ফিরে যাও আকাশ এবার কাঁদবে, তাঁর কান্নায় ভিজিয়ে দিবে আকাশে ঢাকা ভূবন। সাথে আছে তীব্র বাতাস। শান্তি নীড়ের দ্বিতীয় তলার ডান পাশের একটা রুমে বসে আছে অরিন আর দিহান। রুমের জানালাটা খুলা। জানালার পর্দা ঠেলে বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে অরিনের গা। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লেগে শীতল হয়ে যাচ্ছে অরিনের হাত পা। তবুও তাঁর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। একটু পর পর পানি খেয়ে গলা ভেজাচ্ছে। তাঁর এই অদ্ভুত আচরণে বিরক্ত হয়ে দিহান বলল,”
_উফ বউপাখি! কি হয়েছে বলো তো? এতো পানি খাচ্ছো কেন? একটু পরে ভাত খাবে। পানি খেয়ে পেট ভরে রাখলে খাবে কেমনে? আর কি এমন কথা, যে বলতে গিয়ে বার বার থেমে যাচ্ছো?
অরিন আরেক গ্লাস পানি খেয়ে শুকিয়ে যাওয়া গলাটা ভিজালো। হাত পা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে তাঁর। ভয়ে কলিজাটা লাফাতে লাফাতে যেন পাজর ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হঠাৎ করেই দিহানকে অনেক ভয় লাগছে। যা আগে লাগতো না। মনে হচ্ছে এই ঘর ভয়ংকর জঙ্গল। দিহান একটা সিংহ আর অরিন একটা বিড়াল। অরিন কিছু বললেই দিহান তাকে থাবা মেরে ধরে খেয়ে ফেলবে। অরিনকে এখনো চুপ থাকতে দেখে দিহান উঠতে চাইলো। অরিন দিহানের একটা হাত ধরে আবার বসিয়ে দেয়। তারপর বলে,
_আপনি আমায় বিশ্বাস করবেন তো? ভুল বুঝবেন নাতো আমায়?
_কি এমন কথা বলো তো? যে এতো ভয় পাচ্ছো? যা বলার নির্ভয়ে বলো? কোনো ভয় নেই।
অরিন দু কয়েক শুকনো ঢোক গিলে বলল,”
_আ আসলে। আমি,,,,,,,, আমি,,, আ আ আমি মিহান ভাইয়ার এক্স গার্লফ্রেন্ড।
_হা হা হা আচ্ছা। তারপর?
_আমি সিরিয়াস দিহান। উনার সাথে আমার রিলেশন ছিলো। উনার সাথে ব্রেক আপ হওয়ার পরেই আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।
দিহান বিরক্তি নিয়ে বসা থেকে উঠে। খাটের উপর থেকে ল্যাপটপ আর কিছু কাগজ গুছাতে গুছাতে বলল,”
_শুনো? তোমার আরো রেষ্ট দরকার। রেষ্ট নাও। এই লুপা ও না তোমাকে দিয়ে শুধু শুধু এই তিনটা দিন অন্যের খাটনি কাটালো। এখন তো দেখছি তোমার মাথা চলে গেছে ওর সিঙ্গেল মাদার ফ্রেন্ডকে সঙ্গ দিয়ে।
_লুপা আপু মিথ্যে বলেছে। আমি মিহান ভাইয়ার সাথে ছিলাম।
কথাটা শুনে দিহানের হাত থেমে গেলো। তারপর জোরপূর্বক হেসে বলল,
_দে দে দেখো বউপাখি। মমমমজা করাটা একদম ভালো লাগে না। এভাবে মজা করবা না।
অরিন বসা থেকে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলল,”
_আমি মজা করছি না দিহান। আপনার কসম।
অরিনের কথাটা শুনে দিহানের হাতের ল্যাপটপটা পড়ে গেলো। বিস্মিত হয়ে বলল,” মানে?
অরিন কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর একে একে সব বলতে লাগলো। মিহানের সাথে দেখা হওয়া সম্পর্ক হওয়া জিহানের বিয়েতে ওই অন্ধকার ঘরে অরিনকে হেঁচকা টানে নিয়ে যাওয়া। অরিনকে তিনদিন বন্দি করে রাখা সব বলে দিলো। অরিন পুরোটা কথা মাথা নিচু রেখে বলল। কথা শেষ করে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো দিহান চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো অগ্নি রূপ ধারণ করেছে। তবুও চোখ চিকচিক করছে। যে চোখে রাগ সে চোখে কষ্টের পানি। অরিন ভীত গলায় বলল,”আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ। আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি। আপনাকে আগে কিচ্ছু জানাইনি।”
দিহান হাতে মুঠোবদ্ধ করে ধরলো। এতো বড় সত্যি কিনা অরিন তাঁর থেকে লুকিয়ে রেখেছিলো? একবারও বলার প্রয়োজন মনে করেনি? তারমানে এতো ভালোবাসা পেয়েও অরিন তাকে ঠকিয়েছে? দিহানের ইচ্ছে করছে আশ পাশের যা আছে সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। ইচ্ছে করছে অরিনকে সজোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলতে,”আমার থেকে এতো বড় সত্যি কেন লুকালি তুই?” বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা অনুভব করছে। চোখ দুটো ভিষণ জ্বলছে। তার পাখি কিনা তারই ভাইয়ের পাক্তন? আর এটা সে আজ জানলো? অরিন আর কিছু বলতে যাবে দিহান হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলো। অরিন ক্ষীণ করে বলল,”সরি।” দিহান কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো মিহান আর নীল বসে বসে কি নিয়ে যেন আলাপ করছে। মিহানকে দেখে দিহানের রাগ আরো বেড়ে গেলো। দিহান রক্তিম চোখে মিহানের দিকে তাকালো। দিহানের চোখ দেখেই মিহান যেন কিছু আঁচ করে ফেললো। তাঁর চেহারার রং বধলে গেলো। জোর পূর্বক হেসে দিহানকে বলল,”কি ভাই? এভাবে তাকাচ্ছিস কেন?” দিহান ওভাবেই তাকিয়ে রইলো৷ ততক্ষণে অরিন নিচে নেমে আসে। অরিনকে দেখে উদ্বীগ্ন লাগছে। মিহান আঁচ করে নিলো কিছু তো একটা হয়েছে। অরিনকে দেখে দিহান সদর দরজার দিকে পা বাড়ায়। অরিন দিহানের পিছে দৌড় দেয়। ততক্ষণে দিহান দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। অরিন বেরিয়ে আসতে আসতে দিহান গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
___________________________________
একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে দিশা আর ফারাজ। অর্ধেক শপিং করে হঠাৎই ফারাজ দিশাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে চলে আসলো৷ দিশা ফারাজের হাবভাব কিছুই বুঝতে পারছে না। দিশাকে নিয়ে আসার সময় কত বকবক করলো। শপিং করার সময়ও বকবক করতে করতে দিশার কান ঝালাপালা করে দিছে। অথচ এখন একদম গম্ভীরমুখে বসে আছে। দিশার যতদূর মনে পড়ছে ফারাজের ফোনে একটা কল এসেছিলো। ওই কল আসার পর থেকেই ফারাজ চুপ। ওয়েটার তাদের কফি দিয়ে গেলে দিশা মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো। ফারাজ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। দিশা বলতে চাইলো কফি এসেছে কিন্তু তাঁর নার্ভাসনেস বলতে দিচ্ছে না। দিশা নিজের মতো কফি খেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে ফারাজ বলল,”
_দিশা একটা প্রশ্ন ছিলো।
দিশা চোখ তুলে উপরে তাকিয়ে বলল,”
_জ্বি বলুন।
_ আচ্ছা, তুমি কি শাওনকে ভালোবাসতে?
দিশার বুকটা ধুক করে উঠলো। এটা কি বলছে ফারাফ? ও কিভাবে জানলো দিশা শাওনকে ভালোবাসে? তাহলে কি ইশি বলে দিয়েছে? দুলা দুলা ডেকে ফারাজের সাথে কথা বলে বলে এসব বলে দিয়েছে? বাসায় গিয়ে আচ্ছামতো ধুলাই দিবে। ফারাজ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। দিশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। ফারাজ আবার বলে,
_তুমি কি তোমার আব্বুকে কখনো বলেছিলে শাওন ছাড়া তোমাকে অন্য কারো সাথে বিয়ে না দিতে?
_জ্বি বলেছিলাম। আসলে আমি আর শাওন,,,,,,,,[একটু থেমে] আচ্ছা বাদ দিন না।
দিশার জবাব গুলো বার বার হ্যাঁ পেয়ে ফারাজ নিশ্চিত হয়ে গেলো ফারাজকে ফোনের ওই ব্যক্তিটা যা বলেছে সব সত্যি বলেছে। ফারাজ বলল,
_বাদ দিতে চাইলেই কি বাদ দেওয়া যায় দিশা?” ফারাজের গলা গম্ভীর শুনাচ্ছে। দিশা বলল,
_চাইলে অনেককিছু করা যায়। আমিও করবো।” ফারাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তারপর হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে বসে বলল,”
_দেখো দিশা। বিয়ে এমন একটা জিনিস যে প্রেম নামক সম্পর্কের মতো সহজে ভেঙে দেওয়া যায়না। প্রেম এমন একটা জিনিস যেখানে মনের গভীর মিল থাকলেও সহজে ভেঙে দেওয়া যায়। জাস্ট ব্রেকআপ বললেই চলে। কিন্তু বিয়ে এমন একটা জিনিস যেখানে মনের নূন্যতম মিল না থাকলেও সহজে ভেঙে দেওয়া যায়না। ভাঙতে হলেও আইনের কাছে যেতে হয়। তাই আমি মনে করি যে বিয়েটা ভেবে চিন্তে করা উচিত। এখন তোমার বাবা মায়ের চাপে পড়ে তুমি আমাকে বিয়ে করছো। পরে তুমি কি পারবে আমাকে ভালোবাসতে, সারাজীবন আমার সাথে থাকতে? পারবে কি শাওনকে ভুলে যেতে, বলো? না তুমি সুখে থাকবে না আমি থাকবো। না শাওন থাকবে।
ফারাজের কথাগুলো যেন দিশার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কথার আগাগোড়া কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না সে। শুধু অবাক হয়ে ফারাজের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছুই মাথায় ঢুকছে না তাঁর। দিশা বলল, ”
_এসব কি বলছেন?
_জানি তোমার খারাপ লাগছে। আমি তোমাকে খারাপ বলছি না দিশা। মানুষের মন হচ্ছে অন্ধকার ঘর। যার ভেতরের খবর বলা যায়না৷ কখন কোন রং ধারণ করবে সেটাও আন্দাজ করা যায়না। আমি অনেক দেখেছি দিশা, বিয়ের পরেও মানুষ তার পাক্তনের কাছে চলে যায়। অথবা পাক্তনকে মনে করে করে স্বামীর সংসারে মন বসাতে পারে না। এতে সংসারে অশান্তি হয়।
দিশার মুখটা কালো হয়ে গেলো। ফারাজ কি বলছে এতোক্ষণে বুঝলো সে। কিন্তু এসব হঠাৎ কেন বলছে সে? কে বলেছে এসব? ইশি বলল,
_আপনাকে কে বলেছে শাওন ভাইয়ের সাথে রিলেশন ছিলো?
_বলেছে কেউ একজন। আর যে বলেছে সে তোমারই কেউ।
_কে? ইশি?
_উঁহু। আছে একজন। আমি তোমাকে নাম বলতে পারবো না দিশা। কথাটা তোমার মুখে শুনলে ভালো লাগতো। আমাদের পরিচয় হয়েছে থেকে যতবার কথা হয়েছে আমি জিজ্ঞেস করেছি তোমায়,কাউকে ভালোবাসো কিনা? বিয়েটা চাপে পড়ে করছো কিনা। তুমি বার বার উত্তরে না বলেছো। একজনের সাথে ৮ বছরের সম্পর্ক থাকার পরেও কথাটা কেমনে লুকালা তুমি?
_হোয়াট? ৮ বছর?
ফারাজ তাচ্ছিল্য হাসলো। তারপর বলল, ”
_ তুমি আগে বলতে পারতে দিশা। তোমাদের ভালোবাসার কথাটা। বিশ্বাস করো আমি তোমাদের মাঝখানে আসতাম না।
_আরে আপনি এসব কি বলছেন? শাওন ভাইয়ের সাথে এতো গভীর সম্পর্ক নেই যতটা এখানে বলা হয়েছে। আপনি আমার কথাগুলা শুনুন প্লিজ।
_শুনা তো হয়ে গেলো সব। আর কি শুনাতে চাও?
_সেটাই যেটা আপনি শুনেন নি। দেখুন আমি জানিনা আপনাকে কে কি বলেছে। এটাও জানিনা আপনি কেন সব বিশ্বাস করে নিচ্ছেন। শাওন ভাইকে শুধু একা আমিই পছন্দ করতাম। ওয়ান সাইট লাভ। আর কিছুই না। এটা আমি কেন আপনাকে বলতাম বলুন? এটা বললেই বা কি না বললেই বা কি। পছন্দ তো যে-কোনো কিছুই হয়। এটা তো অন্যকিছু ছিলো না তাইনা?
_দিশা আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু তোমার নিজের কেউ কেন মিথ্যে বলবে? আমি তোমাকে শুধু এটুকু বলবো, বিশ্বাস সবাইকে করা যায়। শুধু বলা যায়না কাকে বিশ্বাস করছি, যে মিথ্যে বলছে তাকে নাকি যে সত্যি বলছে তাকে। যদি এমন কিছু থেকেও থাকে তাহলে আমাকে বলতে পারো দিশা। আমি তোমাকে হেল্প করবো।
_এমন কিছুই নেই।”
দিশার মনটা কালো হয়ে গেলো। কে তাঁর নিজের মানুষ যে তাঁর নামে এতো মিথ্যে কথা রটালো? নিজের মানুষগুলা এমন হয় কেন? কেন তাঁদের সব সময় আপনজনদের বদনাম করতে হয়? হ্যাঁ সে শাওনকে ভালোবাসে। কিন্তু তাদের তো ৮ বছরের সম্পর্ক না। দিশা হঠাৎ বোধ করলো শাওনকে খুব মিস করছে সে। আসার আগে শুনে এসেছে শাওনরা আজ চলে যাবে। আচ্ছা শাওন কি চলে গেছে? এমন কেন শাওন? কেন বুঝেনা তাঁর জন্য পাগল এই দিশা? চোখে পানি আর ধরে রাখতে পারলো না দিশা। এতোক্ষণে রাগে কান্না পাচ্ছিলো এখন কষ্টে কান্না চলে এসেছে। দিশার চোখে পানি দেখেই ফারাজ অস্থির হয়ে বলল,”
_হেই। কাঁদছো কেন? আমি তোমাকে অবিশ্বাস করিনি। আমি বিশ্বাস করেছি। আমি শুধু বলেছি এমন কিছু থাকলে আমাকে বলবে আমি হেল্প করবো। আচ্ছা আচ্ছা সরি। আর হবে না কান্না থামাও। দেখো আমি কান ধরছি।
দিশা চোখ মুছে বলল,
_ইটস ওকে। আমি উঠছি।
_আরেকটু বসো।
_আমার কাজ আছে।
_ওকে৷ আমি তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি আসো।
_নো থ্যাংকস।” বলেই বড় বড় পা ফেলে দিশা বেরিয়ে আসলো রেস্টুরেন্ট থেকে। ফারাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসে ভাবতে লাগলো এতো আপন কেউ কি করে নিজের মানুষের বদনাম করে?
____________________________
খাটের উপর বসে আছে অরিন। তাঁর ঘরটা এতো নিস্তব্ধ হয়ে আছে মনে হচ্ছে এটা একটা কবর। আর অরিন হচ্ছে এই কবরের লাশ। যে দিকে তাকাচ্ছে শুধু দিহানকে চোখে ভাসছে। এইতো দিহান ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরনি করছে। এইতো টাওয়েল কোমরে পেছিয়ে ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে চিল্লিয়ে বলছে,বউপাখি আমার জামা দাও। সব চোখের সামনে সত্যি সত্যি ভাসছে অরিনের। মনে হচ্ছে এই বুঝি দিহান এসে অরিনকে জড়িয়ে ধরে বলবে,”বউপাখি ভালোবাসি খুব বেশি। এই বুঝি দিহান খাটে শুয়ে অরিনকে বুকে নিয়ে বলবে,”বউপাখি ঘুমিয়ে যাও তোমার শরীর খারাপ করবে।” কই গেলো দিহান? সে কি জানেনা তাঁর বউপাখিকে সে ঘুম না পাড়িয়ে দিলে ঘুমায় না। রাগের মাথায় কি ভুলে গেছে তাঁর বউপাখি সে না খেলে কিছুই মুখে নেয়না।
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই। দিহানের বাবা চাচা সবাই বাসায় এসে গেছে। এখনো দিহান বাসায় আসেনি। বাসার সবাই এতোক্ষণে জেনে গেছে অরিন আর দিহানের মাঝে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। আর সেই ঝগড়ার রেশ ধরে দিহান রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। কি নিয়ে ঝগড়া এটা কেউ জানেনা। সবাই অরিনকে বার বার জিজ্ঞেস করছে কি নিয়ে তাদের মাঝে ঝগড়া হয়েছে। অরিন কাউকে কিছু বলতে পারছে না। কি বলবে সে? যে কথাটা শুনে দিহান রেগে গেছে সে কথাটা বাসার সবাই জানলে তো তাকে বাসা থেকে বের করে দিবে। সুযোগে পেয়ে শান্তি চৌধুরী দিলারা চৌধুরী অরিনকে অনেক কথা শুনিয়ে দিলেন। অরিন শুধু কান ভরে শুনলো কিছুই বলল না দিহানকে বার বার ফোন দিয়ে যাচ্ছে দিহান ফোন ধরছেই না। নীল, শাওন,জিহান অনেকবার খুঁজতে বের হতে চাইছিলো। কিন্তু মিহান বাঁধ সেধে বলল,”দিহান ছোট বাচ্চা নয় যে তাকে খুঁজে আনতে হবে। চলে আসবে চিন্তা করো না।” অরিনের তখন ইচ্ছে করছিলো মিহানের বুকে ছুরি চালিয়ে দিতে। এতো বাজে হয় কি করে মানুষ? এই বাজে লোকটার সাথে কিনা তাঁর সম্পর্ক ছিলো?
অরিন দিহানকে আবার কল দিলো। এবার দিহান ফোন ধরেছে৷ অরিন কাঁদতে কাঁদতে বলল,”
_ক্ক ক্ক কই আ আপনি? প্লিজ চলে আসুন। আপনার দুটো পায়ে ধরি প্লিজ বাসায় আসুন। আপনাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি এভাবে থাকলে মরে যাবো। আমি আর পারছি না।
দিহান কিছু না বলে ফোন রেখে দিলো। অরিন সাথে সাথে ফোন দিলো ফোন বন্ধ। আবার ফোন দিলো আবারও বন্ধ। অরিন ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিহান যে জায়গাটায় শুয় সেখানটা খামচে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অরিন। বালিশে বেডশিটে দিহানের গায়ের গন্ধ লেগে আছে। সেই গন্ধ অরিনের কষ্টটা আরো দ্বিগুন করে দিচ্ছে। কান্নাগুলো উথলে উথলে পড়ছে।
রাত দুইটা। অরিন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছে। তাহাজ্জুদ পড়লে নাকি আল্লাহ দোয়া কবুল করেন। অরিন দিহানকে চায়। তাঁর স্বামীকে তাঁর ঘরে চায়। দিহানের আগুন রাগটা যেন পানি হয় এটাই চায়। নামাজ শেষ করে মুনাজাত শুরু করলো তখনই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। অরিন মুনাজাত শেষ করে দৌড়ে দরজা খুলতে এসে থেমে যায়৷ মনের মধ্যে প্রশ্ন উঠলো,যদি মিহান হয়? তাছাড়া একবারই নক করেছে আর করেনি। ভুল ওতো শুনতে পারে। দিহান হলে তো একবার নক করবে না। অরিন খাটের দিকে ঘুরতেই আবার নক করলো। অরিন তৎক্ষণাৎ বলল,”
_ক্ক ক্ক কে?” কোনো উত্তর দিলো না। অরিন দিহানের চারদিকে তাকিয়ে কিছুই পেলো না। আলমারি খুলে ক্রিকেট ব্যাট বের করলো৷ এর মধ্যে আবার কড়া নাড়ে। অরিন ব্যাট হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুললো। দরজা খুলে অরিন ব্যাট তুলে সামনে তাকালো দিহান দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে অরিনের হাত নেমে যায়। দিহানের মুখটা কতো শুকনো লাগছে৷ তাঁর চোখ দুটো রক্তলাল। চুল একদম এলোমেলো হয়ে আছে। নিশ্চয়ই চুল টেনে কান্না করেছে। এভাবে না কাঁদলে তো তাঁর মন হালকা হয় না। অরিনের বুকটা হু হু করে উঠলো। হাতের ব্যাটটা ফেলে দিয়ে দিহানের পা ধরতে যাবে দিহান চট করে অরিনকে ধরে ফেলে। অরিন ডুকরে কেঁদে উঠলো। দিহান অরিনের চোখ মুছে দিতে দিতে ভাঙা গলায় বলল, ”
_বউপাখি কেঁদো না প্লিজ। এসে গেছি তো আমি। আর যাবো না তোমায় ফেলে। কোত্থাও যাবো না। জানো [বুক দেখিয়ে] এখানে খুব ব্যথা করেছে আমার৷ তোমাকে ছাড়া থাকতে চাইলেও থাকতে পারিনা বউপাখি। দম বন্ধ হয়ে আসে। কান্না থামাও প্লিজ।
অরিন কান্না থামায় না। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখ ফোলে গেছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গাল দুটো লাল হয়ে আছে সাথে নাকের ডগাটাও। দিহান আবারও বলল,”
_খুব কষ্ট দিয়েছি তোমায় তাইনা? বিশ্বাস করো আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো খুব বেশি। তাই বেরিয়ে গেছিলাম। তুমি আমাকে আগে কেন বলো নি বলো? আমি তো তোমার কাছে কিছুই লুকাইনা।”
অরিন এখনো কাঁদছে। কান্না থামাতে পারছে না সে। দিহান পকেট থেকে কয়েকটা চকলেট বের করলো। অরিনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতের মুঠো ভরে চকলেট নিয়ে অরিনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,”
_সরি বউপাখি। এবার তো কান্না থামাও। তোমার কান্না দেখে কষ্ট হচ্ছে খুব। সরি তো বউপাখি। মনে পড়ে তুমি তোমার খাতায় লিখেছিলে,”আমার একটা তুমি চাই যে আমার রাগ ভাঙাতে মুঠো ভরে চকলেট নিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে সরি বলবে।, বলছি তো বউপাখি। সরি। প্লিজ কান্না থামাও।
অরিন কান্না থামিয়ে চোখ মুছে নিলো। দিহান দাঁড়ালো। অরিন দিহানকে জড়িয়ে ধরে আবারও কেঁদে উঠলো৷ দিহান বলল,”আবার কাঁদছো কেন?
_আমি এতো ভালোবাসার যোগ্য নয় দিহান। আমায় কেন এতো ভালোবাসেন বলেন? এখনো কিভাবে এতো ভালোবাসছেন?
_এইটুকু ভুলে যদি ভালোবাসা কমে যায় তাহলে কেমন ভালোবাসলাম শুনি?
_আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ। আমি আপনাকে ঠকিয়েছি সত্যি ঠকিয়েছি আপনাকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন উনার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। উপরওয়ালার কসম করে বলছি বিশ্বাস করুন।
_আমাকে বিশ্বাস করাতে তোমার কসম করতে হবে না বউপাখি। আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি। অন্ধের মতো বিশ্বাস করি। কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার বিশ্বাস করো। রাগ হচ্ছিলো খুব। কেউ কেন আমার বউপাখিকে ছুঁবে। কেন আমার বউপাখিকে বন্দি করবে? ও তোমায় কষ্ট দিয়েছে। তোমায় কাঁদিয়েছে। আমি ওকে মেরে দিবো বউপাখি। ওকে জানে মেরে দিবো। হোক সে আমার ভাই। তবুও আমি তাঁর খুনি হবো।
চলবে,,,,,,,।