ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_৩৯

0
1394

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_৩৯
#সুলতানা_সিমা

কখনো কখনো মুক্তিও আমাদের নিষ্কৃতি দেয়না। মাঝে মাঝে মুক্তিটাও নতুন করে বন্দি করার জন্য আসে। একঘন্টা আগে পাক্তনের থেকে মুক্তি পেয়ে এখন এসে স্বামীর বাড়িতে নতুন করে বন্দি হলো অরিন। শান্তি নীড়ের সবাই তাকে প্রশ্নের শিকলে বন্দি করে রেখেছে। সবারই একটা প্রশ্ন, এইতিন দিন কই ছিলো সে? অরিন পারছে না কারো প্রশ্নের জবাব দিতে আর না পারছে মুখ তুলে উপরে তাকাতে। মিহান যখন তাকে মুক্তি দেয় তখন বলে দিয়েছে কাউকে কিছু বললে বলতে পারো তবে বলার পরে স্বামীর মৃত্যু দেখার জন্য প্রস্তুত থেকো। অরিন কি করে বলবে এখন সে কই ছিলো? স্বামীর ক্ষতি কি করে চাইবে সে? চোখ বাঁকা করে একবার মিহানের দিকে তাকালো। মিহান শান্তি চৌধুরীর পাশে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মতো তাঁরও চোখে প্রশ্নের ঝুলি ঝুলিয়ে রেখেছে। কে বলবে এই ছেলেটাই সবকিছুর পেছনে আছে। এতো নিখুঁত রিয়েকশন মানুষ কেমনে নিতে পারে? শান্তি চৌধুরী বার বার জিজ্ঞেস করছেন অরিন কই ছিলো। অরিন মুখ খুলছেই না। সুমনা চৌধুরী অরিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ”

_কি হলো বউমা আম্মার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছো না কেন? বলো কই ছিলে এই তিনদিন?

অরিন এবারও তাঁর ওষ্ঠযুগল নাড়ালো না। জহুরা বেগম অরিনের সামনে এসে তাঁর গাল ছুঁয়ে মোলায়েম গলায় বললেন,”

_কই আছিলি রে মা? কছ না কেন? উনা গো জবাব দে।

অরিন কোনো জবাব দিলো না। শান্তি চৌধুরী খুব কড়া ভাবে কিছু বলতে যাবেন তাঁর আগেই সিঁড়ির দিক থেকে দিহানের আর্তনাদ ভেসে এলো।

_আহহহহহহহ।

তৎক্ষণাৎ উপস্থিত সবার চোখ সিঁড়ির দিকে যায়। দিহান দৌড়ে আসতে গিয়ে সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। শাওন ইশি দিশা নীল দৌড়ে গেলো দিহানকে তুলতে। তাঁর আগেই দিহান উঠে আবার দৌড়ে দিলো। অরিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তৃষ্ণার্ত চোখে অরিনের দিকে তাকালো। অরিনকে দেখার তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছিলো সে। তিন দিন নয় যে তিন হাজার বছর কাটিয়েছে তাঁর পাখিটাকে না দেখে। অরিনের চোখ মুখ একদম শুকিয়ে আছে।দিহান অরিনের দু গাল হাতের বেড়িতে নিয়ে মুখটা তুলে অস্থির স্বরে বলল,”

_তু তু তুমি ঠিক আছো বউপাখি? সুস্থ আছো তো তুমি? তুমি ভালো আছো তো?”

স্বামীকে দেখে চোখের পানিটা আর আটকে রাখতে পারলো না অরিন। দিহান কত এলোমেলো হয়ে আছে। যেন কত যুগ ধরে নিজের খেয়াল রাখেনা। অরিন ডুকরে কেঁদে উঠলো। দিহান চট করে অরিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আদর মাখা গলায় বলল,”

_কিচ্ছু হবেনা তোমার। আমি আছি তো। কিচ্ছু হবে না। কাঁদবে না, একদম কাঁদবে না।”

দিহানের পাথর হয়ে যাওয়া চোখ গলে জল বেরিয়ে এলো। অরিনের ছোঁয়া যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে তাঁর সর্বাঙ্গ। শান্তি চৌধুরী থেকে শুরু করে দিলারা চৌধুরী শায়লা চৌধুরী সবাই দিহানের কাজে রেগে আছেন। দিহান কোথায় অরিনকে প্রশ্ন করবে অরিন কই ছিলো, তা না করে সে উথলানো প্রেম দেখাচ্ছে? শান্তি চৌধুরী উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করলেন, “দিহান।” উনার কথায় দিহান অরিনকে ছাড়েনি দেখে উনি দিহানের কাঁধে ধরে টান দিয়ে অরিনের থেকে ছাড়িয়ে আনলেন। তারপর তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,”

_আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছি ও এই তিনদিন কই ছিলো ও কোনো জবাব দিচ্ছে না কেন?” দিহান চেঁচিয়ে বলল,”

_তোমাদের প্রশ্ন করার সময় চলে যাচ্ছে তাইনা? ও তো ফিরে এসেছে পরে জিজ্ঞেস করলে কি হবে? ওর চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছো না তোমরা, ও যেখানেই ছিলো ভালো ছিলো না।”

শান্তি চৌধুরী অবাক চোখে দিহানের দিকে তাকালেন। দিহান উনার সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছে? তাও এই অরিনের জন্য? অরিনের প্রতি রাগটা আরো তীব্র হয়ে গেলো উনার। তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া দিহানের থেকে সরিয়ে অরিনের উপর নিক্ষেপ করলেন।
দিলারা চৌধুরী দিহানকে বললেন,”

_ভালো ছিলো নাকি ছিলো না সেটা পরে দেখবো। আগে ওকে প্রশ্ন কর ও কই ছিলো এই তিনদিন?

_যেখানেই থাকুক। যেখান থেকেই আসুক। ওর এখন রেষ্ট দরকার। তোমাদের প্রশ্নের উত্তর পরে দিবে।

দিহানের কথা শুনে শান্তি চৌধুরী চড়া গলায় বললেন, ”

_পরে দিবে? এটা কোনো তামশা খানা নয় যে এখানে যা খুশি তা চলবে৷ ওর তিনদিন বাইরে থাকায় আমাদের কতো পেরেশান হতে হয়েছে। টিভি, খবরের কাগজ সব জায়গায় খোঁজ লাগিয়েছি। এতে কি আমাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট হয়নি? লোকে এটা পর্যন্ত বলেছে যে, খোঁজে দেখো হয়তো কোনো ছেলের সাথেই আছে। চারদিকে শুধু কানাকানি ছিলো শান্তি নীড়ের বউ পাওয়া যাচ্ছে না। আর তুই এখন ব্যাপারটা একদম স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছিস?

_হ্যাঁ নিচ্ছি। কারণ ও যেখানেই ছিলো কোনো খারাপ জায়গায় ছিলো না এটা আমার বিশ্বাস।

_ঠিক আছে তাহলে ওকে জিজ্ঞেস কর এই তিনদিন ও কই ছিলো?

দিহান এবার চেঁচিয়ে বলে উঠলো,”

_জাহান্নামে ছিলো। এবার চুপ করো। আর একটাও প্রশ্ন কেউ করবে না ওকে।

_তুই আমার সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছিস?

শান্তি চৌধুরীর চোখ দুটো চিকচিক করছে। উনার চোখে এতো সহজে পানি আসেনা। দিহান মাথা নিচু করে ফেললো। না চাইতেই সে উনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। সে-ই বা কি করতো? অরিনকে দেখে উনারা কি বুঝতে পারছেন না অরিন ভালো নেই? ওকে অসুস্থ লাগছে? শান্তি চৌধুরী চুপ হয়ে গেলেন।জিহানের বাবা রাগি চোখে অরিনের দিকে তাকালেন। উনি এখন দিহানকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলবেন এটা নিশ্চিত। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে লুপার কলিজা ভয়ে কেঁপে উঠে। এতোক্ষণে সে যা বুঝেছে সেটা হলো অরিনের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর থাকা সত্বেও সে লুকাচ্ছে। আর সেটা এমনি নয় কোনো বড়সড় কারণেই লুকাচ্ছে। যেটা হোক সেটা পড়ে দেখা যাবে আপাতত অরিনকে বাঁচাতে হবে, কিন্তু কিভাবে বাঁচাবে সে। জিহানের বাবা দুবার প্রশ্ন করেই দিয়েছেন অরিন কই ছিলো। দিহান উনাকে থামতে বলছে কিন্তু উনি দিহানকে ধমক দিয়ে উঠলেন। লুপা চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা দম নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করলো। যা হবার হবে সে এই রিক্স নিবেই।

_ভাবি আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে ছিলো। আর আমিই ভাবিকে পাঠিয়েছিলাম।

লুপার কথাটা শুনে যেন সবাই আকাশ থেকে পরলো। কয়েক জোড়া বিস্মিত চোখ লুপার দিকে তাকালো। মিহান বলল,”এসব কি বলছিস তুই?

_হ্যাঁ ভাইয়া। আসলে আমার ফ্রেন্ড। সিঙ্গেল মাদার। তিনদিন আগে ওর ডেলিভারি ডেট ছিলো। ওর পাশে থাকার মতো কেউ নেই। তাই আমি ভাবিকে পাঠিয়েছিলাম।

লুপার কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো। দিহানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। অরিন আর মিহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারণ কেউ না জানলেও ওরা জানে লুপা মিথ্যে বলছে। কিন্তু কেন? দিহান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

_ তুই এরকম মেয়ের জন্য অরিনকে বাইরে পাঠিয়েছিস? তাও এই অবস্থায়?

লুপা মাথা নিচু করে ছোট করে বলল,”সরি ভাইয়া।” মিহান বলল,”

_আচ্ছা তোর কথা আমরা কেন বিশ্বাস করবো? তুই যে সত্যি বলছিস তাঁর প্রোফ কি?

_আমার কথা বিশ্বাস করবে কারণ আমি এই বাড়ির মেয়ে। আর আমার কথার প্রোফ আমি নিজেই।

_তাহলে তুই এতোদিন বললি না কেন?

_আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম ভাইয়া। তাই বলিনি।”

দিহান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”

_তোর সাহস কি করে হলো আমার অনুমতি ছাড়া ওকে বাইরে পাঠানোর? তাও অন্যের কাজ করার জন্য?

_সরি ভাইয়া।

_সরি মাই ফুট। এতোদিন মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিলো আমার। আর তুই কিনা সব জেনেও বসে বসে দেখে যাচ্ছিলি। আমি তোর ভাই নাকি শত্রু?

সুমনা চৌধুরী বললেন,”আমার ছেলের কষ্ট না হয় বাদই দিলাম। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ কতটা চিন্তায় ছিলো। সব জায়গায় নিউজ দেওয়া হচ্ছিলো অরিন নিখোঁজ। তখনও তুই চুপ ছিলি? তখনও তোর ভয় কাটছিলো না। তখনো বলার প্রয়োজন মনে করছিলি না যে অরিন আছে। আমাদের না হয় না-ই বললি। আম্মাকে তো বলতে পারতি।

পরিস্থিতি ভালো নয়। সবার চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সবাই লুপার উপর ক্ষেপে গেছে। মিহান জানে লুপা মিথ্যে বলছে কিন্তু এই মূহুর্তে লুপাকে বাঁচাতে হবে। নয়তো সবাই লুপাকে বকাঝকা করবে। তাঁর বোনকে কেউ বকলে তাঁর কলিজায় লাগে। মিহান সবাইকে বলল,”

_আচ্ছা সবাই থামো। যা হওয়ার তো হয়ে গেছে। অরিনের রেস্ট দরকার। ওকে উপরে যেতে দাও। আর ও সুস্থ ছিলো সুস্থ ভাবে ফিরে এসেছে এটাই তো অনেক। আপাতত বিষয়টা বাদ দাও। দিহান যা তো ওকে নিয়ে উপরে যা।

দিহান কোনো কথা না বারিয়ে অরিনকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। লুপাও চলে গেলো উপরে। মিহান বাইরে বেরিয়ে এলো। বাগানে এসে দোলনায় একটা লাত্তি দিলো। তাঁর মাথার রগ টগবগ করছে। লুপার জায়গায় অন্যকেউ হলে এতোক্ষণে খুন করে দিতো। কত প্ল্যান করে রাখছিলো যে অরিন বাসায় আসবে তারপর সবাই অরিনকে বাসা থেকে বের করে দিবে। একটুর জন্য আর প্ল্যান সাকসেস হচ্ছিলো। বের করে দিতো অরিনকে,কিন্তু লুপা কিনা মূহুর্তেই সব বদলে দিলো। লুপাকে কিছু বলতেও পারবে না অযথা কান্নাকাটি করবে। ওর চোখের পানি মিহানের সয্য হয়না। তাঁর বোনের কাছে সাত খুন মাফ। তাঁর বোন যদি তাঁর সব প্রিয় জিনিস গুলোও তছনছ করে দেয় তবুও সে আরেকটা প্রিয় জিনিস খুঁজে এনে বোনের হাতে দিয়ে বলবে,নে এটাও ভাঙ তবুও তুই মনটা খারাপ করিস না। দোলনায় বসে বসে মিহান অন্য প্ল্যান করতে লাগলো।

অরিনকে খাটে বসিয়ে দিহান গ্লাসে পানি এনে অরিনকে খাওয়ালো। তারপর অরিনের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,”বউপাখি। তুমি ঠিক ছিলে তো ওখানে?” অরিনের ভেতর ফেটে কান্না আসে। কান্নাগুলো সব উথলে উথলে ওঠছে। এতো ভালো কেন বাসে দিহান? একবারও কেন জিজ্ঞেস করেনা সে কই ছিলো? এতো গভীর বিশ্বাস কেউ কাউকে কি করে করতে পারে? আর এই মানুষটাকেই কিনা তাঁর অন্ধকার জীবনের কথা জানানো হয়নি? দিহান আবার বলল,”

_তোমাকে খুব মিস করেছি বউপাখি। জানো আমার মনে হয়েছিলো তুমি আমার উপর অভিমান করে কোথাও লুকিয়ে গেছো। খুব বেশি কষ্ট হয়েছিলো আমার।”[অরিনকে জড়িয়ে ধরে]” আর কখনো আমায় না জানিয়ে কোথাও যাবেনা বলো? নয়তো ফিরে এসে আমায় আর পাবেনা। আমি মরেই যাবো।
_চুপ করুন প্লিজ।” দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদলো। ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পাওয়ার সুখের কান্না। বেশ কিচ্ছুক্ষণ পরে অরিন দিহানকে ছেড়ে বলল,”

_আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই দিহান। আমি আর পারছিনা না বলে থাকতে।” দিহান অরিনের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল,”

_আপাতত কিছু শুনতে চাইনা। তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।
_কিন্তু,,,।” অরিন আর কিছু বলার আগেই দিশা প্লেটে ভাত নিয়ে ঘরে ঢুকলো। দিহান অরিন একটু সরে বসলো। দিহান দিশাকে বলল,”তুই এখন এটা নিয়ে এসেছিস কেন?
_আম্মু পাঠিয়েছে। ভাবি শুনো। ভাইয়া না খেয়েই আছে। ওকে খাইয়ে দিও তুমিও খেয়ে নিও।” বলেই দিশা চলে যায়। অরিন দিহানের দিকে ব্যথিত চোখে তাকিয়ে বলে,”আপনি না খেয়ে ছিলেন?
_তুমি কই আছো কেমন আছো এটা না জেনে কি করে খেতাম?
“অরিন মাথা নিচু করে ফেললো। দিহান প্লেট হাতে নিয়ে অরিনের হাতে দিয়ে বলল,” খাইয়ে দাও।

অরিন চোখ মুছে হাত ধুয়ে এসে দিহানকে খাইয়ে দিলো। দিহানের জোরাজোরিতে নিজেও দু’তিন লোকমা খেলো। খাওয়া শেষে দিহান অরিনকে নিয়ে শুইয়ে পড়ে। নিজের বুকে অরিনের মাথা রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে সেও ঘুমিয়ে যায়।

_________________

পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে যখন সূর্যকে তাঁর আড়াল করতে যায়, তখন আকাশের রং বদলে যায়। সূর্যের সাথে মেঘেরাও রং বদলায়। তাঁদের সাথে রং বদলায় পৃথিবীও। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সৌন্দর্যের মায়াজাল। সে জালে আটকে যায় হাজারো বিকেল প্রেমী। লাল হলুদ ধরণীতে দাঁড়িয়ে সূর্যের লুকিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে। লুপাও ঠিক তাই। তাঁর কাছে সকাল আর বিকেলের ভূবন অনেক প্রিয়। সূর্যের উঁকি দেওয়া সকালটা যত সুন্দর ঠিক তত সুন্দর সূর্যের লুকানোর বিকেলের দৃশ্য। নরম নরম দক্ষিণা বাতাস এসে গায়ে লাগতেই কেঁপে উঠে সে। বাতাসের সাথে ভেসে এলো মাতাল করা ঘ্রাণ। লুপা এই ঘ্রাণের সাথে পরিচিত। বামে তাকিয়ে দেখলো নীল দাঁড়িয়ে আছে। এক পলকে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। লুপা ছাদ থেকে নেমে যেতে পা বাড়ালো। নীল দৌড়ে এসে লুপার হাত ধরে বলল,”

_চলে যাচ্ছিস কেন? আমাকে দেখে? আমার থেকে দূরে দূরে থাকার কারণটা কি বলতো?” লুপা নীলের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,”সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। হাত ছাড়ো।
_লুপা আমার কথাটা শুন। আমি আর কি করবো বল। আব্বুর পায়ে পড়েও মানাতে পারিনি। আম্মু তো আমার সাথে আছে। তোর পরিবারের সবাই তো আছে। তাহলে আর কি চাই বল?
_কিছু চাইনা। হাত ছাড়ো।
_তুই আমার উপর রাগ করে আছিস?

লুপা কিছু বলল না। নীল লুপাকে জড়িয়ে ধরে মৃদুস্বরে বলল,”এভাবে থাকিস না বাবুই। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।” লুপা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সেও নীলকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,”

_দাদুমনি মানেনি। কেউ মানবে না। ভাইয়া যতই বলুক একা আমাদের বিয়ে দিবে। সেটা ভাইয়া পারবে না। কারণ ভাইয়া জানে দাদুমনির না এর উপর কারো হ্যাঁ হয়না। আম্মু আমায় নিষেধ করেছে তোমার সামনে না আসতে। তাঁর মতো ভুলটা যেন না করি অনেক করে বুঝিয়ে বলেছে।
_তুই চিন্তা করিস না। আমি আবার আব্বুর কাছে যাবো। যে করেই হোক আব্বুকে নিয়ে আসবো। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।
_হুম।
নীল হাতের বাঁধন শক্ত করে বলল,”
_খুব শীঘ্রই তোকে বউ বানাবো দেখিস।” লুপা কিছু বলল না শুধু মৃদু হাসলো। নীল বলল,”
_প্রতিদিন বিকালে ছাদে এসে বসে থাকিস কেন?
_কারণ বিকালটা অনেক সুন্দর হয় তাই।
_উপভোগ করতে পারলে প্রতিটি মূহুর্তই সুন্দর।
_তাই?
_হুম।
_আচ্ছা অরিন ভাবি কি সত্যিই তোর বান্ধবীর কাছে ছিলো?
লুপা চট করে নীলের বুক থেকে মাথা তুললো। নীলের জিজ্ঞাসুক চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ রইলো। নীল বলল, “কি হয়েছে?
_মাগরিবের আজান দিবে আমি যাচ্ছি।” বলেই লুপা চলে আসে। নীল দাঁড়াতে বললেও দাঁড়ালো না। কারণ সে জানে কিছুক্ষণ পর আবার নীল একই প্রশ্ন করবে। তখন কি উত্তর দিবে? মিথ্যে হ্যাঁ?

_______________

খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে শাওন। তাঁর মনটা অস্থির হয়ে আছে। দিশার জন্য মনটা কেমন যেন করছে। আজ অরিন ফিরে এসেছে। অরিনের ফিরে আসায় কোনো আনন্দ হচ্ছে না তাঁর। মনটা দিশাতেই আটকে আছে। আজ সারাটা দিন থেকে দিশা তাঁর মাথায় ঘুরঘুর করছে। কিছুতেই দিশার কথা মাথা থেকে সরাতে পারছে না। কেন জানি দিশার জন্য খুব খারাপ লাগছে তাঁর। সকালে যখন অরিনকে খুঁজতে বের হবে তখন ইশি তাকে ডেকে ইশির রুমে নেয়। তারপর বলে,”

_শাওন ভাইয়া। আমি তোকে কয়েকটা কথা বলবো। যতক্ষণ না আমার কথা শেষ হবে তুই কিছু বলবি না। দিশা এই বিয়েটা কেন করছে জানিস? যেন তোকে ভুলতে পারে। জানিস ভাইয়া, দিশা তোকে কতটা ভালোবাসে? ঠিক ততটাই যতটা ভালোবাসলে ভালোবাসার জন্য হাসতে হাসতে মরা যায়। তুই জানিস না ভাইয়া সেদিন তোর কথাগুলো দিশাকে ঠিক কতটা আঘাত করেছিলো। দিশা তো শুধু তোকে ভালোবেসেছিলো আর কিছুই না। এটা অনেক বড় অপরাধ হয়ে গেছিলো তাইনা? তুই তো পারতি ভাইয়া সুন্দর ভাবে বুঝাতে। তা না করে তুই কি করলি? ওকে নির্লজ্জ বেহায়ার উপাধি দিলি? কখনো কাউকে এক তরফা ভালোবেসেছিস ভাইয়া? বাসিস নি? বাসলে বুঝতি এ ভালোবাসা কতটা বিষাদময়। এ ভালোবাসা কতটা নির্লজ্জ আর বেহায়া বানিয়ে দেয়। আমি তোকে এগুলা বলতাম না ভাইয়া কিন্তু আমার বলতেই হচ্ছে। দিশাকে স্বান্তনা দিতে তুই রোজ রোজ দিশার কাছে যাচ্ছিস। দিশার পাশে বসছিস এতে দিশার মনের অবস্থা কি হচ্ছে তুই খোঁজ নিচ্ছিস? দিশা তোর প্রতি আরো দূর্বল হচ্ছে। যখনি তুই ওর সামনে থেকে চলে আসিস ও কান্নায় ভেঙে পড়ে। তোকে ভুলতে গিয়ে নতুন করে ভালোবাসার কান্না। রোজ রোজ তোর জন্য ওর কান্না দেখতে ভালো লাগেনা ভাইয়া। তুই জানিস না ও প্রতি রাতে তোর জন্য কত কাঁদে। তুই যদি ওকে দূরে থাকতে বলছিস তাহলে তুই নিজেই কেন দূরে থাকছিস না? ও নিজেকে গুছাতে চাইছে গুছাতে দে ভাইয়া৷ ওর সাথে এতো মিশে ওকে এলোমেলো করে দিস না।”

ইশির কথাগুলা শুনে কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারেনি শাওন। কিছু না বলে বেরিয়ে গেছিলো বাসা থেকে। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত দিশা তাঁর মস্তিষ্ক জুড়ে আছে। শত ব্যস্ততা থাকার পরেও দিশার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। সত্যিই তো দিশাকে দূরে থাকতে বলে সে কেন বার বার দিশার পাশে যাচ্ছে? কি এমন কারণ যে নিজে না চাইতেই চলে যাচ্ছে? আচ্ছা তাঁর কি শান্তি নীড় থেকে চলে যাওয়া উচিত? হ্যাঁ চলে যেতেই হবে। এখানে থাকলে তাঁর এই অস্থিরতা কমবে না। না পারবে দিশার থেকে দূরে থাকতে। শায়লা চৌধুরী এসে ডেকে গেলেন খাওয়ার জন্য। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও শাওন খেতে গেলো। টেবিলে বসে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো দিশা আর দিহান নেই। শাওন বলল,”

_দিহান কই খাবেনা?” লারা শান্তি চৌধুরীকে সার্ভ করে দিতে দিতে বলল,”দিশা আপু উনাদের খাবার নিয়ে উনাদের রুমে গেছেন। উনারা ঘুমে আছেন আপু জাগাতে নিষেধ করছে।” শাওন কিছু বলল না। দিহান এই কয়দিন ঠিকমতো ঘুমায়নি ওর ঘুমের প্রয়োজন। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে দিশা এসে টেবিলে বসলো। ইশি লারাকে বলল,”ভাবি তুমিও বসো না।” লারা মৃদু হেসে বলল,”তুমি খাও আমি মায়ের সাথে খাবো।” দিলারা চৌধুরী মুচকি হাসলেন। লারার প্রতিটি জিনিস উনাকে মুগ্ধ করে। ছেলের বউ নিয়ে উনার অনেক গর্ব হয়। এতো মিষ্টি আর ভালো মেয়ে কি আজকাল পাওয়া যায়? কত ভালোবাসে সবাইকে। আর অরিন? অরিন তো একদম তাবিজ করে নিয়েছে দিহানকে। এসেছে থেকে বাসায় একটা না আরেকটা লেগে আছে। হানিফ চৌধুরী মুখে ভাত পুড়ে দিশাকে বললেন, ”

_ফারাজের পরিবার কাল শপিংয়ে যাবে। ওরা আমায় বলল তোকে যেনো তাদের সাথে দেই। কাল ফারাজ গাড়ি নিয়ে আসবে তুই চলে যাবি।”

উনার কথা শুনে শাওনের চোখ জোড়া চট করে দিশার দিকে চলে গেলো। এতোক্ষণ তাকায়নি সে। কিন্তু ফারাজের সাথে দিশা যাবে শুনে বুকটা চিনচিন করতে লাগলো। দিশা প্লেটে চোখ রেখেই বলল,”ঠিক আছে আব্বু।” দিশার ঠিক আছে কথাটা শাওনের ভালো লাগলো না। তাঁর মন যেন অন্যটা শুনতে চেয়েছিলো। হঠাৎ শাওন বোধ করলো তাঁর অস্থিরতা আগের থেকে আরো বেড়ে গেছে। কোনো রকম দু লোকমা খেয়ে প্লেট রেখে উঠে গেলো সে। গলা দিয়ে খাবার নামছেই না। এ কি হচ্ছে তাঁর সাথে? কেন এমন লাগছে তাঁর? কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে।

চলবে,,,,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here