ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_৩৮
#সুলতানা_সিমা
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি এলো৷ সেই রাত পেরিয়ে সকাল। এখনো মিহান আসেনি৷ বসে থাকতে থাকতে অরিনের একবার ঘুম লেগে গেছিলো। ফজরের আজান শুনে ঘুম ভেঙে যায়। মনটা ছটছট করছে দিহানের জন্য। কিন্তু যাবে কি করে সে? এই ঘর থেকে পালানোর কোনো রাস্তা নেই। ইচ্ছে করছে চোখের সামনে ভনভন করে উড়া মশার মতো উড়ে চলে যেতে দিহানের কাছে। চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে গেছে। ভেতরটা খুব কাঁদছে কিন্তু চোখ দিয়ে জল বের হচ্ছেনা। যেন ফুরিয়ে গেছে সব জল। কান্না যেমন মন হালকা করে তেমনি বুকটাও ভারি করে৷ তাইতো অতিরিক্ত কাঁদলে আর কাঁদা যায়না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে চোখ বন্ধ করলো অরিন। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তবুও নিতে হচ্ছে কারণ সে বাঁচতে চায়। তাঁর স্বামীর বুকে আবার ফিরে যেতে চায়। দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে চাইলো। মিহান এসেছে। হাতে খাবারের প্যাকেট। সাথে এক বোতল পানি৷ অরিন তড়িঘড়ি করে উঠে এসে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো,”
_উ উ উনি কেমন আছেন? আ আ আপনি উনার কাছেই গিয়েছিলেন তো? উনি ভালো আছেন তো?”
মিহান চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। তারপর একটা দম ছেড়ে খাটে বসে হাতের খাবারের প্যাকেট আর বোতল খাটে রাখতে রাখতে বললো,”
_এরকম কবুতর মার্কা প্রেম দেখলে না আমার খুব জ্বলে। এক কাজ কর এখানে সেন্ডুইচ,আর বার্গার আছে যেটা খাওয়ার খেয়ে নাও। আমি একটু বাইরে যাবো।
অরিন অনুরোধের গলায় বলল, ”
_বলেন না উনি কেমন আছেন?”
মিহান ছোট করে জবাব দিলো,”
_ হুম ভালো।”
অরিন হাত জোর করে মিনতির স্বরে বলল, ”
_আমাকে উনার কাছে নিয়ে চলুন না প্লিজ।
_তোমাকে তো নিয়ে যাওয়া যাবেনা।
_প্লিজ নিয়ে চলুন। উনি খুব কষ্টে আছেন আমি জানি।
“মিহান কিছু বলল না। অরিন চেঁচিয়ে, ” কেন এই পাগলামি করছেন? আমাকে আমার স্বামীর কাছে দিয়ে আসুন।
_তা তো দেওয়া যাবেনা। দেখো, তোমাকে আমি কিডন্যাপ করার চিন্তাও করিনি। কিন্তু দিহান তোমাকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে শুনে আমার মাথা ঠিক থাকলো না। এখানে তুমি আমার চোখের সামনে আছো অরিন। তোমার কসমে আমি আটকে তাকলেও একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে থাকায় আমি তোমার সামনে না গেলেও রোজ একবার দেখা হয় আমাদের। কিন্তু কানাডা চলে গেলে তোমায় আমি আর দেখতে পারবো না। কারণ আমি থাকি অন্টারিওতে আর ও তোমায় নিয়ে উঠবে নুনাভাট। দুই শহরের দূরত্ব জানো? অনেক দূর। তখন আমি রোজ রোজ তোমায় দেখতে পারবো না। এখন তো ছুঁই বা না ছুঁই কথা বলি বা না বলি প্রতিদিন একবার হলে তো তোমায় দেখতি পারি। কিন্তু ওখানে গেলে তো আর দেখাই হবেনা। তোমাকে দেখাটা এখন আমার অভ্যাস হয়ে গেছে অরিন। না দেখলে ভালো লাগবে না। তবে একটা লাভ হয়েছে সেটা কি জানো? তোমাকে আমি তিনদিন বন্ধি করে রাখবো। তিনদিন পরে ছেড়ে দিবো। তিনদিন পর বাড়িতে গেলে নিশ্চয়ই তোমাকে সবাই জিজ্ঞেস করবে তুমি কই ছিলে। তুমি কিছু বলতে পারবে না কারণ যদি কিছু বলো তোমার স্বামীর ক্ষতি হবে৷ তখন নিশ্চয়ই তোমার স্বামী থেকে শুরু করে সবাই তোমায় খারাপ ভাব্বে। আর তারপর,,,,,,? দিহান তোমায় ছুঁড়ে ফেলে দিবে আমি খুঁড়িয়ে নিবো।”
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো মিহান। হাসতে হাসতে আবার কেঁদে দিলো৷ অরিনের ঘা জ্বলে উঠলো মিহানের কথায়। সে চেঁচিয়ে বলল, ”
_পাগল হয়ে গেছেন আপনি। নিজের ভাইয়ের সাথে শত্রুতা করছেন? এতোই যখন আমায় ভালোবাসেন তাহলে নিজের ফুপিকে কেন মানাতে পারেন নি? কেন উনারা রোজ রোজ এসে আমার বাবা মাকে কথা শুনাতো? কেন পারেন নি আমার চলে যাওয়ার কারণ খোঁজতে? খুব ভালোবাসেন তো তাহলে কেন পারেন নি আমার বাবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে আপনি আমায় বিয়ে করবেন? আচ্ছা বলুন তো, কখনো কি আমার বাবা মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে এসে বলেছিলেন আপনি আমায় ভালোবাসেন, আপনি আমায় বিয়ে করতে চান? বলুন বলেছিলেন? বলেন নি। না কখনো নিজের ফুপিকে মানাতে চেষ্টা করেছিলেন। আমি না বুঝে উঠতে পারছি না। আপনি আমাকে ভালোবাসেন নাকি ঘৃনা করেন।
মিহান অরিনের খুব সামনে এসে দাঁড়ালো তারপর বলল,”কি বললে? ফুপি তোমার বাবা মাকে কথা শুনাতো? কেন?
_কারণ আপনি আমাকে ভালোবাসতেন তাই। আপনার ফুপি চাইতো আপনার বাড়ির বউ যেন আমি না হই।
_তুমি বললে আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম? প্রমাণ কি? তোমার মুখের কথা? যে মুখ দিয়ে আমায় মিথ্যে ভালোবাসি বলেছিলে সেই মুখের কথা? উঁহু! নেভার। আমার ফুপি যদি এমনটা চাইতো তাহলে এতোদিন তুমি দিহানের সাথে ঘর করতে পারতে না। আচ্ছা খেয়ে নাও।
_প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন।”
মিহান কথার জবাব না দিয়ে চলে গেলো। অরিন পেছন থেকে দু-তিন বার চেঁচিয়ে বলল নিয়ে যেতে। মিহান এসবে পাত্তাই দিলো না।
_________________________________
দুপুরের দিকে দিহানকে নিয়ে শাওন,নীল,জিহান,মিহান বাসায় আসলো। বাসার প্রতিটি মানুষ চিন্তায় ভেঙে পড়েছে। দিলারা চৌধুরী থেকে শুরু করে শায়লা চৌধুরী পর্যন্ত সবাই চিন্তিত অরিনকে নিয়ে। হঠাৎ এটা কি ঘটে গেলো? অরিন কই হারিয়ে গেলো কারো মাথায় ঢুকছে না। জহুরা বেগম তো কাঁদতে কাঁদতে বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। দিহান আসতেই সবাই এসে ড্রয়িংরুমে জড়ো হলো। দিহান কপাল চেপে ধরে সোফায় বসলো। নীল পুলিশকে ফোন দিলো। বরাবরের মতো এবারও পুলিশ জানালো কোনো খোঁজ পায়নি তারা। দিহান জিহানকে বলল,”
_পেপারে,টিভিতে নিউজ দাও। যে খোঁজ দিতে পারবে তাকে অনেক টাকা পুরষ্কৃত করা হবে বলে দাও।”
কথাটা বলেই দিহান সামনে তাকিয়ে দেখলো ইশি আর লারা দিহান উঠে ওদের দিকে তেড়ে গেলো মারার জন্য। নীল আর জিহান দিহানকে সামনে থেকে আটকায় শাওন কোমর জড়িয়ে ধরে। দিহান চেঁচিয়ে বলে, “ছাড় আমায়। ওরা থাকতে ও হারিয়ে গেলো কিভাবে? ওরা যদি ওর খেয়াল রাখতেই পারবে না তাহলে সাথে গেলো কেন?”
সবাই দিহানকে টেনে নিয়ে উপরে যায়। সুমনা চৌধুরী ছেলের পাগলামি দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দিছেন। দিশা কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়ে। শান্তি চৌধুরীর মাথা ঘুরছে। ইশি আর লুপা উনাকে নিয়ে উপরে যান। আস্তে আস্তে সবাই উপরে চলে যায়। শাওন দিশার সামনে বসলো। দিশার মাথায় হাত রেখে বলল,”কাঁদিস না রে সব ঠিক হয়ে যাবে।” দিশা এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কোনো এক অদ্ভুত কারণে দিশার কান্না শাওনের সয্য হয়না। শাওন দিশার চোখ মুছে দিয়ে দিশাকে জড়িয়ে ধরলো। নিজের বুকে দিশার মাথা চেপে ধরে বলল, “শান্ত হ প্লিজ। তোর কান্না দেখলে খুব কষ্ট হয় রে।” দিশা দু’হাতে শাওনকে জড়িয়ে ধরে বলল,”ভাইয়ার কষ্টটা আমার সয্য হচ্ছে না শাওন ভাই। ভাবি কই হারিয়ে গেলো বলো তো।
_ফিরে আসবে কান্না থামা।” দিশা কান্না থামালো না। কিছুক্ষণ কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কান্না থামিয়ে দিলো। কিন্তু শরীরের ঝাকুনিটা রয়ে গেলো। দিশার শরীরের ঝাঁকুনি শাওনের বুকে লেগে হৃদয়ের সাগরে ঢেউ তুলে যাচ্ছে। আর সেই ঢেউয়ের তালে তালে হারিয়ে যাচ্ছে শাওনের যৌবন মন। হঠাৎ শাওন বোধ করলো তাঁর খুব শান্তি লাগছে। এক মূহুর্তের জন্য যেন তাঁর সব কষ্ট পাড়ি জমিয়েছে দূর আকাশে। যেখানে হাত বাড়ালেও ছোঁয়া যাবেনা। প্রতিটি পুরুষ নারীর ছোঁয়ায় কয়েক মূহুর্তের জন্য কষ্ট ভুলে যায়। কথাটা শাওনের কাছে সত্যি মনে হচ্ছে। আচ্ছা সত্যি কি নারীর ছোঁয়ায় পুরুষ কষ্ট ভুলে যায় নাকি বিশেষ কোনো নারীর ছোঁয়ায়? কিছুক্ষণ পরে দিশা শাওনের বুক থেকে মাথা তুলে করুন চোখে শাওনের দিকে তাকালো। দিশার এই চোখ দুটোর ভাষা আজ শাওন বুঝতে পারছে। দিশা যেন বলছে আমায় কেন ভালোবাসো না শাওন ভাই? হঠাৎ শাওনের বুকটা আবার যন্ত্রণায় ভরে গেলো। সে বোধ করলো দিশা যদি তাঁর বুকে মাথা রাখে আবারও সেই সুখ পাবে। চট করে উঠে দাঁড়ালো দিশা। তারপর শাওনকে সরি বলে চলে গেলো উপরে। শাওন বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো।
___________________
অতিরিক্ত কষ্ট মানুষকে পাথর বানিয়ে দেয়। দিহানও পাথর হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে আজ তিনদিন হয়ে গেলো অরিনের খোঁজ নেই। পুলিশও কিছু করতে পারছে না। টিভিতে পর্যন্ত নিউজ দেওয়া হয়েছে সবকিছুরই ফলাফল শূন্য। দিহানের বাবা মা এমনকি শান্তি নীড়ের সবাই চিন্তিত। হঠাৎ করে অরিন কই হারিয়ে গেলো? এমন কোনো জায়গা নেই দিহান খোঁজ লাগায় নি। কোথাও খোঁজে পায়নি তাঁর বউপাখিকে। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় দিহান কেমন যেন হয়ে যায়। পাগলের মতো ছুটে চলা,মেয়েদের মতো চিৎকার করে কান্না করা সব কিছু হঠাৎ করে থেমে গেলো। শূন্য দৃষ্টিতে অন্ধকার রুমে বসে থাকলো ঘন্টার পর ঘন্টা৷ তিনটা দিন যেন তিন তিনটা যুগ। দিহানের প্রতিটি মূহুর্ত কাটছে অরিনকে ভেবে। যখন গলা শুকিয়ে যাচ্ছে একটু পানি খাচ্ছে তবুও কিছু মুখে তুলছে না। তার যে গলা দিয়ে খাবার নামবে না। দুপুর দুইটা বাজে। সকাল থেকে এই পর্যন্ত দিশা দুবার এসেছে খাওয়াতে কিন্তু দিহান নড়লোই না। সুমনা চৌধুরী ছেলের চিন্তা অরিনের চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে গেছেন। জহুরা বেগমও অসুস্থ।
নীল আর শাওন এক প্লেট ভাত নিয়ে দিহানের রুমে ঢুকলো। একটু আগে শান্তি চৌধুরী অনেক চেষ্টা করে গেলেন দিহান খেলোই না। নীল ভাত মেখে দিহানকে বলল,”দিহান হা কর।” দিহান নড়লো না। যেভাবে ছিলো ওইভাবেই থাকলো। শাওন দিহানকে বলল,”দিহান সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস? কিছু তো মুখে নে৷ তোর অবস্থা কেমন হয়েছে দেখ? এভাবে না খেয়ে থাকলে তো মরে যাবি।” দিহান আগের মতোই থাকলো। নীল আবার খাওয়াতে চাইলে দিহান নীলের হাত সরিয়ে দিয়ে দূর্বল গলায় বলল,”খিদে নাই তোরা খেয়ে নে।
_এসব কি বলছিস তুই? দিহান তিনদিন হয়ে গেছে পানি ছাড়া কিচ্ছু খাচ্ছিস না তুই। খেয়ে নে প্লিজ।” নীলের কথায় কোনো ভাবান্তর হলোনা দিহানের। ক্ষানিক পরে বসা থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেলো। দরজার সামনে দাঁড়ানো সুমনা চৌধুরী আর হানিফ চৌধুরী চোখের পানি বাদ মানলো না। সুমনা চৌধুরী কাপড়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠেন। হানিফ চৌধুরী বারান্দায় গেলেন। গিয়ে দিহানের কাঁধে হাত দিয়ে ডাক দিলেন,”দিহান।” বাবার ডাকে দিহান পিছন ফিরে তাকালো। তাঁর চোখ মুখ শুকনো। সিল্কি চুলগুলা কেমন যেন খুশকো হয়ে আছে। মাত্র তিনদিনে দিহানের চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। হানিফ চৌধুরীর বুকটা ধুক করে উঠলো। দিহানের দু বাহুতে ধরে বললেন,”
_তোর মা কিছু খাচ্ছে না তুই খাচ্ছিস না বলে। অল্প তো খেয়ে নে বাবা।” দিহান তাঁর বাবার দুটো হাত এক করে তাঁর দুহাতের মুঠোয় নিলো। তারপর ধরা গলায় বলল,”
_তুমি না আমাকে গিফট পছন্দ করো বাবা। আজ একটা গিফট চাইবো দিবে?” হানিফ চৌধুরী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। দিহান বলল, “অরিনকে আমায় গিফট দিবে বাবা? দিবে প্লিজ?” হানিফ চৌধুরী মাথা নিচু করে দিলেন। দিহান আবার বলল, “ওকে! আম্মু তো আমায় সারপ্রাইজ দিতে পছন্দ করে, তাইনা? তাহলে আম্মুকে একবার বলো না অরিনকে এনে আমায় সারপ্রাইজ দিতে। প্লিজ বাবা।” হানিফ চৌধুরীর আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হলো না। ছেলের থেকে হাত ছাড়িয়ে তিনি দ্রুত পা ফেলে বারান্দা ত্যাগ করলেন। দিহান হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো। মিনিট খানেক পরে দিয়া দৌড়ে আসলো। এসে দিহানের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,”
_ভাইয়া ভাবি এসেছে।
চলবে,,,,,,।
রিচেইক করার সময় নেই। সময় নিয়ে লিখিনি তাই জানিনা কি লিখছি❤