ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_৩৭

0
1217

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_৩৭
#সুলতানা_সিমা

[তাড়াহুড়ো করে না পড়ার জন্য এতো তাড়াতাড়ি দিলাম। মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।]

তিনদিন চলে যায় অরিনের মিহানের সাথে কোনো কথা হয়নি। অরিনের বাবা খালেদ মিয়া উনার ফোনটা উনার সাথে সাথে রাখেন। একদিন খালেদ মিয়া ভুলে উনার ফোনটা রেখে কাজে চলে যান। সুযোগ পেয়ে অরিন উনার ফোনটা এনে মিহানকে ফোন দেয়। মিহান সাথে সাথেই ব্যাক করে। মিহান জানতে চায় অরিন কেন এই তিনদিন ফোন দেয়নি। অরিন বলে,”আসলে ফোন বাবার কাছে তাকে তো তাই দিতে পারিনা।
_আগে তো ঘরেই থাকতো। এখন উনার কাছে কেন? ” অরিন কিছু বলল না। মনসুর সাহেব যা বলে গেলেন সে বিষয়টা মিহানকে জানালো না। মিহান খুব রগচটা। পড়ে দেখা যাবে সে তাঁর ফুপির সাথে ঝগড়া করছে। অরিন কথা ঘুরাতে বলল,” আচ্ছা কেমন আছেন?
_ভালো থাকার কথা নাকি? তিনদিন হলো ফোন দাও না।
_সরি। একটা কথা বলবো?
_বলো।
_ ধরেন আপনার কাছে আমাকে বিয়ে দিতে আমার পরিবার রাজি হলো না। তখন আপনি কি ভাবে উনাদের রাজি করাবেন?” মিহান কোনো উত্তর দিলো না শুধু হাসলো। অরিন অবাক হয়ে বলল,”আশ্চর্য। হাসছেন কেন?
_হাসবো না? আমার মতো হাই ফ্যামিলির ছেলে তোমার বাবা মা রিজেক্ট করবে? আমার যা কিছু আছে সব দেখে তোমার বাবা আমাকে কোলে নিয়ে নাচবে,আর তুমি বলছো রাজি হবেনা? “মিহানের কথাটা শুনে অরিনের খুব খারাপ লাগে। গরিবরা কি বড়লোক দেখলে কোলে নিয়ে নাচে? অরিন মিহানকে বলল,”আমার বাবা আমাকে টাকা দেখে বিয়ে দিবেনা। আমার বাবা টাকার লোভী নয়।
_আরে তুমি কথাটা নেগেটিভভাবে নিচ্ছ কেন? আমি তো এমনি বললাম।” অরিন আর কিছু বলল না। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলো। সেদিন অরিনের মা দেখে ফেলেন অরিন যে কথা বলছিলো। উনি অরিনকে অনেক বকাঝকা করেন। তারপর আরো তিনদিন চলে যায় তাদের কথা হয়না। চারদিন পর মিহান থাকতে না পেরে রাতের বেলা অরিনদের বাড়ি চলে আসে। তাদের বাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে অরিন কখন ঘর থেকে বের হবে। ঘর থেকে বের হচ্ছে না দেখে মিহান একটু দূর গিয়ে অরিনদের চালে ডিল মারে। ডিলটা গিয়ে পরে সেলিনা বেগমের চালে। উনি গালাগালি করে চিল্লিয়ে ঘর থেকে বের হন। সেদিন আর মিহানের সাথে অরিনের দেখা হয়না। অরিনদের বাড়ি থেকে লুকিয়ে বের হতে দেখে ফেলেন মামুনুল হক। উনি গিয়ে মনসুর সাহেবকে বলে দেন। মনসুর সাহেব নিজের চোখে দেখেননি তাই বিষয়টা শায়লা বেগমকে জানালেন না। পরেরদিন মিহান আবার আসে অরিনদের বাড়ি। অপেক্ষা করতে করতে এক সময় অরিন ঘর থেকে বের হয়। মিহান ফিসফিসিয়ে ডাক দেয় অরিনকে। অরিন কেঁপে ওঠে। মিহানকে রাতের বেলা তাদের বাড়ি দেখে ভয়ে তার কলিজা লাফাতে লাগে। মিহানের সাথে কখনোই রাতের বেলা দেখা করা হয়নি তাঁর। ওই জঙ্গলের দেখা করা ছাড়া আর সব দেখা করাই তাদের দিন দুপুরে পুকুরের এপাড় ওপাড়ে সীমাবদ্ধ। মিহান আরেকটা ডাক দেয়। অরিন ভয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকে যায়। মিহানের রাগ হয়। এই মেয়ের এতো ভীতু স্বভাব তাঁর পছন্দ নয়। রাগে মিহান অরিনদের ঘরে চলে যায়। খালেদ মিয়া আর জহুরা বেগম খেতে বসছিলেন। মিহানকে দেখে দুজনের চোখ কপালে উঠে যায়। অরিন প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো মিহানকে দেখে তাঁর হাত থেকে প্লেট পড়ে যায়। থরথর করে হাঁটু কাঁপতে থাকে৷ খালেদ মিয়া গম্ভীর গলায় মিহানকে বললেন,”কোনো দরকার?” মিহান আমতা আমতা করে বলল,”আব,,,মানে,,,,আ আমি পা পানি খাবো।” জহুরা বেগম পানির গ্লাস এগিয়ে দেন। মিহান আঁড়চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পানিটা খেয়ে শেষ করে। তারপর চলে আসে। যেহেতু অরিনের বাবা মাকে দেখা দিয়ে দিয়েছে তাই সেদিন চোরের মতো বের হয়নি সে। গেটের বাইরে পা রাখতেই মনসুর সাহেবের সম্মুখীন হয় মিহান। উনি মনে হয় হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। উনাকে দেখে মিহান কেঁপে উঠে। চোরের মতো বের না হলেও চোরি করতে গিয়ে ধরা পরার মতো ভয় পায়। মিহানকে দেখে উনি জিজ্ঞেস করলেন,”কই গেছিলা তুমি?” মিহান একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। প্রথম বারের প্রশ্নে উত্তর দেয়না। উনি দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করেন,”কই গেছিলা?”
_এ এ এদিকে যাচ্ছিলাম। পা পানি খেতে এই বাড়িতে গেছি।” মনসুর সাহেব কথা বাড়ান নি। বাড়িতে গিয়ে শায়লা বেগমকে মামুনুল হক সাহেবের বলা কথা ও নিজের দেখা বিষয়টা বলে দিলেন।

পরেরদিন শায়লা বেগম অরিনদের বাড়ি যান। জহুরা বেগম শায়লা বেগমকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বলেন,”আরে ভাবি আপনে? আপনে কেন কষ্ট কইরা আইতে গেলেন। কোন কাজ থাকলে খবর পাটাইয়া দিতেন আমি যাইতাম।” শায়লা বেগম গম্ভীরমুখে বললেন,”খালেদ ভাই বাড়িতে আছে?”
_জ্বে ভাবি আছেন তো। আহেন ঘরে বহেন আইয়া।” শায়লা বেগম ঘরের ভিতর যান। জহুরা বেগম পুকুর পাড় থেকে খালেদ মিয়াকে ডেকে আনেন। উনি জাল ফেলে মাছ ধরছিলেন। উনি আসার পরে শায়লা বেগম কোনো ভণিতা ছাড়াই বললেন,”শাওনের বাবাকে কয়েকদিন আগে পাঠিয়ে দিছিলাম একটা কথা বলতে, উনি বলে গেছিলেন?” জহুরা বেগম ও খালেদ মিয়া একে অপরের দিকে তাকান। দুজনের মুখটা ছোট হয়ে যায়। কাল রাতে মিহান এসেছিলো এটা কি উনি জেনে গেছেন? শায়লা বেগম বললেন,”

_আমি অরিনকে দোষারোপ করবো না। কারণ ওর বয়সটা হচ্ছে ভুল করার, আবেগের বয়স।
ওর কাছে এখন পৃথিবীর সবকিছু সুন্দর লাগবে। ও এখন যেটা করছে সেটাও ওর কাছে সুন্দর লাগছে।তোমাদের মেয়েরও বয়স কম আমাদের ছেলেরও বয়স কম বলা যায়। তাই আমি বলবো ওরা ভুল করে ফেলছে। তবে তাদের সাথে যেন আমরা ভুল না করি। দেখেন খালেদ ভাই রাগ করবেন না। আমি অরিনকে মিহানের জন্য মেনে নিলেও আমার ভাই মেনে নিবেনা। আমার পরিবার মেনে নিবেনা। আমার মা চান ভালো পরিবারের ভালো মেয়ে গুলা উনার নাত বউ বানাতে। এমন পরিবারে উনারা কখনো আসবেন না। আপনাদের আমি নিজের মানুষ ভাবি। তাই আমি চাইনা আপনাদের সাথে আমার মনমালিন্যতা হোক। আপনাদের কাছে হাত জোড় করে বলছি। আপনারা অরিনকে মিহানের থেকে সরিয়ে আনুন। ওকে দিয়ে মিহানের সুন্দর ভবিষ্যতটা নষ্ট করে দিবেন না।” জহুরা বেগম আর খালেদ মিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। শায়লা বেগমের কথায় মনে হচ্ছে অরিনকে উনারা মিহানের পিছে লাগিয়ে দিছেন। সেদিন শায়লা বেগম কথাটা বলে চলে যাওয়ার পরে খালেদ সাহেব অরিনকে মারধর করেন। রাগারাগি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। যখন বাড়ি ফিরে আসেন তখন ব্যাগ ভরে বাজার নিয়ে আসেন। অরিনকে জানিয়ে দেন কাল তাকে দেখতে আসবে। অরিন রান্নাঘরে গিয়ে দেখে জহুরা বেগম মাছ কাটতেছেন। অরিন উনাকে বলে,”বাবাকে একটু বুঝাও না মা প্লিজ। আমি বিয়ে করবো না মা। আমি আর উনার সাথে যোগাযোগ রাখবো না তবুও তোমরা আমার বিয়ে দিয় না এখন।
উনি মাছ কাটতে কাটতে জবাব দেন,”
_তোর বাপ যেইডা কইছে হেইডা হুন। তোর লাইগা ভালা অইবো।
_তোমরা শুধু চাচা আর চাচির কথায় এমন করছো। উনি খারাপ নয় মা। উনি অনেক ভালো।
জহুরা বেগম ঝাঁজালো গলায় বললেন,”
_এইসব আমারে কতাছস কেন? তোর বাপেরে ক।” অরিন চোখ মুছতে মুছতে ঘরে চলে যায়। সারা সন্ধ্যা ঘরে বসে কান্না করে কেউ তার ঘরে একটা উঁকিও দেয়না। রাতে খাওয়ার সময় জহুরা উনাকে ডাক দেন।

খেতে বসে অরিন তাঁর বাবাকে বলে,”বাবা আমি বিয়ে করবো না।” অরিনের বাবা কর্কশ গলায় বললেন, ”
_কেন? কেন বিয়ে করবি না? ওই পোলার লাইগা? আমারে প্রত্তেকদিন [প্রতিদিন] অপমান করাইতে চাস? তোর লাইগা আমি সরমে ডাক্তার বাড়ি কামে যাইনা। মাটিত থাইকা চাঁন্দ ছুঁইবার চাস কেন? গরিবের ঘরে জন্ম নিছস মাটিত চউখ [চোখ] রাইক্কা চলতে শিখ।”
অরিন চেঁচিয়ে বলে, ”
_তোমরা আমাকে মাটিতে রাখো কেন? গরিব হও কেন তোমরা? গরিব তো আমায় জন্ম দিলা কেন? আমি বিয়ে করবো না। এতে যা খুশি করার করো।” বলেই অরিন প্লেটে পানি ঢেলে উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। খালেদ মিয়া ও ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে উঠে যান। গোয়াল ঘরে গিয়ে দড়ি হাতে নেন। সেলিনা বেগম বাড়িতে ছিলেন না। উনার ঘরের পাশে একটা আম গাছ ছিলো। ওই গাছে দড়ি বাঁধেন। জহুরা বেগম এটা দেখে কান্নাকাটি করে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তবুও খালেদ মিয়াকে আটকানো যায়না। উনি জহুরাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে গলায় দড়ি লাগাতে যান। অরিন দৌড়ে এসে খালেদ মিয়ার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বলে,”আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা। আমায় ক্ষমা করে দাও। আমায় এতিম বানাইও না গো বাবা। আমি বিয়ে করবো। আমি আর কোনোদিন তোমার অবাধ্য হবো না। তুমি এমনটা কইরো না বাবা। প্লিজ তুমি এমনটা কইরো না।”

পরেরদিন অরিনকে দেখতে আসে। ছেলে অরিনকে আগেই পছন্দ করছিলো তাই ওইদিনই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে যায়। মনসুর সাহেব ওখানে উপস্থিত ছিলেন উনি সপ্তাহের ভিতর ডেট ফেলেন। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরের দিন অরিন আলাদিন চাচার ফোন নিয়ে মিহানকে কল দেয়। দেখা করবে বলে পুকুর পাড়ে ডাকে। মিহান আসে লাল রংয়ের একটা শাড়ি চুড়ি খোঁপা আলতা নিয়ে। অরিনকে বলে,”আজ তুমি না ডাকলেও আমি আসতাম। জানো আমাদের জন্য এই দিনটা কতটা স্পেশাল? আজকের এই দিনে আমাদের ভালোবাসা শুরু হয়েছিলো।” অরিনের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। মিহানের হাসিটা সাথে সাথে উড়ে যায়। অবাক হয়ে বলে,”কাঁদছো কেন?”অরিন কিছু বলেনা। মাথা নিচু করে কেঁদেই যায়। মিহান হাত বাড়ায় অরিনের চোখ মুছে দিতে, কিন্তু আবার হাত ফিরিয়ে আনে। তাদের সম্পর্কের মাঝে এখনো হাত ধরাটাও হয়নি। আর এতোটা কাছে দাঁড়ানো তো হয়-ই নি। মিহান ব্যথিত গলায় বলল,”কি হইছে অরিন? কাঁদো কেন বলো প্লিজ।
অরিন চোখ মুছে শুকনো এক ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করে বলে,”
_আমাকে ভুলে যান প্লিজ। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।
_ফা ফা ফাজলামো করছো? দে দেখো এসব একদম ভা ভালো লাগে না।
_আমি সত্যি বলছি আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিশ্বাস না হলে আপনার ফুপাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। প্লিজ আপনি আমাকে ভুলে যান।”মিহানের হাত থেকে অরিনের জন্য আনা জিনিসগুলা পড়ে যায়। তাঁর চোখ দুটো ভিজে আসে। ঠোঁট দুটো অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে থাকে। কান্নায় তাঁর বুকটা ফেটে যাচ্ছে। অরিনকে বলতে চাচ্ছে প্লিজ বলো এগুলা মিথ্যা। কিন্তু গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। অরিন দুহাত জোর করে বলল,”আমায় ক্ষমা করে দিবেন। ” তারপর অরিন চোখটা মুছে চলে যায়। মিহান ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তাঁর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে। অরিন এটা কি বললো? অরিনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? অরিন অন্যকারো হয়ে যাবে? মিহানের নিঃশ্বাস যেন এই মাত্র বন্ধ হয়ে যাবে। শ্বাস ফেলতে পারছে না। উঠে দাঁড়িয়ে আবার ধপ করে পড়ে যায়। তাঁর পায়ে কোনো শক্তি নেই। সেদিন চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারেনি মিহান। সে পাথর হয়ে গেছিলো।

পরের দিন মিহান অরিনদের পুকুর পাড়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে অরিনের অপেক্ষা করতে লাগে। সারাদিন অরিন পুকুরে আসেনা মিহানও বাড়ি যায়না। সন্ধ্যায় অরিন পুকুরে এলে মিহান দৌড়ে অরিনের সামনে আসে। এসে বলে, “অরিন আমি পারছি না তোমায় ভুলে যেতে। পারবো ও না। প্লিজ তুমি চলে আসো আমার সাথে। চল আমরা পালিয়ে যাই।”
_আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আপনি চলে যান প্লিজ। ভুলে যান আমাকে।” বলেই অরিন দ্রুত পায়ে ঘরে চলে যায়। তবে মিহান থামেনা। প্রতিদিন এসে একটাই আবদার করতে থাকে। একদিন অরিন ভেবেই নিলো যা হবার হবে সে মিহানের সাথে পালিয়ে যাবে। মিহানকে এতো কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। মনে মনে অপেক্ষা করতে লাগলো মিহান আবার আসলে সে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ওইদিনই মনসুর সাহেব অরিনদের বাড়িতে আবার আসেন। এসে খালেদ সাহেবকে বলেন,”মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছো খালেদ ভাই। তবুও মেয়ে আমাদের ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখে কেমনে? তুমি তোমার মেয়েকে সাবধান করতে পারো না? নাকি ইচ্ছা করে মেয়েকে এই ছেলের সাথে লাগিয়ে দিছো? আমার শাশুড়ী যখন শুনবেন এসব, তখন যদি প্রশ্ন করেন আমরা থাকতে উনার নাতি এই ভুল করে কেমনে, তখন কি উত্তর দিবো? খালেদ ভাই মাইয়ারে সাবধান কর। নয়তো খারাপ হবে।”

সেদিন মনসুর সাহেব কথাগুলা বলে যাওয়ার পরে খালেদ মিয়া পুনরায় গলায় ফাস দিতে যান। কি করবেন বা তিনি? মেয়ের জন্য যদি বার বার অপমানিত হতে তাহলে তো মরে যাওয়াই ভালো।মেয়ে না বুঝলে কত বুঝাবেন? সেদিন অনেক ঝামেলা হয়। অরিন জহুরা বেগম উনাকে অনেক কষ্টে থামান। সেলিনা বেগম সব শুনে নেন। খালেদ সাহেবকে জহুরাকে অনেক কথা শুনান। অরিন নিজের সিদ্ধান্ত বদলে নেয়। তারপর মিহান যখন বিকালে আসে অরিন পুকুর পাড়ে যায়। গিয়েই মিহানকে বলে,”আপনি আর কোনোদিন আসবে না এখানে আমার কসম লাগে।” মিহান করুন চোখে তাকিয়ে অস্পষ্ট ঠোঁটে উচ্চারণ করে,”অরিন।” অরিন কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে বলে,”প্লিজ চলে যান আপনি। কাল আমার বিয়ে। আপনি আর আসবেন না এখানে।
_হ্যাঁ আসবো না। তুমি আমার সাথে চলো তোমায় নিয়ে আমি অনেক দূর চলে যাবো। এখানে আর আসবো না।
_আমি এসব করতে পারবো না। আমার বাবাকে আমি ছোট করতে পারবো না।
_তোমার বাবা মেনে নিবে একদিন দেইখো।
_বাবা মানবে না। বাবা চায় আমি আপনায় ভুলে যাই।
_ফুপিও চায় আমি তোমাকে ভুলে যাই তাই বলে কি আমি তোমাকে ভুলে যাচ্ছি? বড়রা এমনটাই চায়। প্লিজ চলো আমরা পালিয়ে যাই।
_আমার বাবা মরে যাবে। আমি আমার বাবার মরা মুখ দেখতে পারবো না।” মিহান রেগে যায়। রাগে চেঁচিয়ে বলে,”কিসের এতো অহংকার তোমার বাবার? পরের বাড়ি কাজ করে খায় তবুও অহংকার করে। আমার মতো ছেলে তোমার মতো মেয়েকে ভালোবাসে বিয়ে করতে চায় এটা তোমার বাবার কপাল। নয়তো কে আসবে তোমাদের এমন বাড়িতে? যদি তোমার গায়ের রং আরেকটু ফর্সা হতো না, তাহলে অহংকারে তোমার বাবার জমিনেই পা পড়তো না। আর তুমিও বা কেমন মেয়ে? বিদেশ থেকে ছেলে এসেছে শুনেই লোভ সামলাতে পারছো না। নেচে বিয়ে করতে যাচ্ছো? এরকম বেদেশি দশটা ছেলে কিনার সামর্থ্য আছে আমার। তোমার বাবাকে বলে দিও তাঁর মতো ছোট জাতের ছেলে নই আমি।” অরিন কঠিন গলায় বলল, “ব্যস। বুঝে গেছি আমি। বাবা ঠিকই বলেছে আমি চাঁদ ছুঁতে চাচ্ছি। আপনি চলে যান। আমি আমার ছোট জাতের বাবাকে নিয়েই ভালো থাকবো।
_হ্যাঁ থেকো ভালো। আজ থেকে তুমি তোমার মতো আমি আমার মতো থাকবো। না তোমাকে আমি চিনি না আমাকে তুমি চিনো। আর হ্যাঁ, ক্ষমা চেয়েছো না? করে দিলাম ক্ষমা। আসবো না আর এখানে। নিজের মতো ভালো থেকো। ” বলেই মিহান চলে যেতে লাগে। থেমে আবার পিছন ফিরে আসে। তারপর বলে,”একটা সত্যি কথা কি জানো? আমার মতো ছেলের তোমার মতো মেয়ে যায়না। তুমি আমার যোগ্যই না। সেটা জেনেও তোমায় ভালোবেসেছি। এটাই আমার সব থেকে বড় ভুল। আগে যদি বুঝতাম আজ এতোটা কষ্ট হতো না। তোমার মতো লোভী থার্ডক্লাশ মেয়ে আমার দরকার নাই।”

মিহান সেদিন চলে যায়। একবারের জন্যেও পিছন ফিরে তাকায় না। রাগের মাথা কি বলে দিয়েছে সে নিজেই জানেনা। তাঁর বলা প্রতিটি কঠিন কথা যে অরিনের কলিজায় বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধেছে সেটা সে আন্দাজই করতে পারিনি। তারপরের দিন অরিনের গায়ে লাল বেনারসি জড়ানো হয় সেই রাতেই বেনারসি খোলে সাদা শাড়ি জড়িয়ে দেওয়া হয়৷ তার কিছুদিন পরে তাঁর বাবার মৃত্যু। সবকিছু অরিনের জীবনটা বদলে দেয়। মাঝে চলে যায় এক বছর। এই এক বছর অরিন নামে মাত্র বেঁচে ছিলো। একদিকে মিহানের সাথে বিচ্ছেদ মিহানের কঠিন কথা অন্যদিকে স্বামীর মৃত্যুর জন্য অলক্ষী নারী হিসাবে চিহ্নিত হওয়া অন্যদিকে বাবার মৃত্যু। এতোকিছু কিভাবে সয্য করেছে সেটা শুধুমাত্র উপরওয়ালা আর মাথার নিচের বালিশ জানে।

এই একটা বছর অরিন মনে মনে অপেক্ষা করে মিহান হয়তো একবার আসবে এসে বলবে তুমি ছোট জাতের নয়। ভালোবাসায় জাত দিয়ে কি হবে। হয়তো একদিন মিহান এসে বলবে,”তুমি অযোগ্য নও অরিন তুমি আমার যোগ্য। কিন্তু মিহান আর আসেনি। অরিন হয়তো জানেইনা তার কসমে আটকে ছিলো মিহান। আর মিহানও হয়তো জানতোই না তাঁর অপেক্ষায় একটা বছর পথ চেয়ে ছিলো অরিন। ধীরে ধীরে অরিনের মন থেকে মিহান নামক শব্দটা মুছতে লাগে। মিহানের তীক্ষ্ণ কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মনটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে অরিন কলেজে ভর্তি হয়। তারপর যায় তাঁর মামাদের দেশ ইন্ডিয়ায়৷ তারপর এক দূর্ঘটনায় দিহানের সাথে তাঁর বিয়ে হয়৷ যখন প্রথম জানতে পারে এটা মিহানের ভাই। তখন নিজের এমন পোড়া কপালের নিয়তি দেখে খুব কেঁদেছিলো সে।

তাঁর মনে দিহানের জন্য অদ্ভুত এক ফিলিংস হতো। চাইলেও দূরে থাকতে পারতো না। হয়তো দিহানের সাথে তাঁর পবিত্র বন্ধন ছিলো বলে, নয়তো দিহান তাঁর স্বামী ছিলো বলে এমন হতো। না চাইতেই দিহানকে নিয়ে ভাবতে লাগে অরিন। স্বামীকে নিয়ে ভাবা যদি পাপ হয় তাহলে সে এই পাপটা না চাইতেই করে ফেলেছে। যেদিন জহুরা বেগম দিহানের আর অরিনের বিয়ের কথা শুনে অসুস্থ হয়ে গেলেন সেদিন অরিনের মনে হলো, মিহানের ভাইয়ের সাথে অরিনের বিয়ে হয়েছে এটা জানার পর যদি জহুরা বেগম অসুস্থ হয়ে যান, তাহলে মিহানের পাক্তন প্রেমিকা অরিন এটা জানলে দিহান কতটা কষ্ট পাবে? অরিন দিহানকে সব বলে দিতে চায়। একদিন না একদিন দিহান সব জানবে তাঁর থেকে ভালো সে বলে দিক। সম্পর্ক গভীরে যাওয়ার আগে এসব জানানো উচিত। অরিন দিহানের সাথে সেলাই ঘরে বসে কথা বলছিলো। জহুরা বেগম শোবার ঘরে বসে ছিলেন। অরিনের কথাগুলা স্পষ্ট শুনা যাচ্ছিলো। যখন অরিন বলল,”আপনাকে আমার অতীত নিয়ে কিছু বলতে চাই। তখনই জহুরা বেগম দৌড়ে সেলাই ঘরে গিয়ে অরিনের মুখ ধরে ফেলেন। অরিন ফোন কেটে দেয়। জহুরা বেগম বলেন,”এইডা কি করতাছস? তুই জামাইরে এইডা কইবি না। ওই পোলা জামাইয়ের চাচতো ভাই। এইডা হুনার পরে জামাই কষ্ট পাইবো।
_কিন্তু মা উনি তো এইটা শুনার অধিকার রাখেন।
_কিছু কথা স্বামীরে হুনাইতে নাই। স্বামীর মন ভালা রাখনের লাইগা। কষ্ট না দেওয়ার লাইগা। তুই এইডা হুনাতি যদি মিহান পোলা না হইয়া অন্য পোলা হইতো৷ এখন এইডা হুনলে তো জামাই ওই পোলারে দেখলেই তর সাথে সম্পর্কের কথা মনে পইড়া যাইবো। জামাই তখন কষ্ট পাইবো। তুই এইডা কইবি না। আমার কসম লাগে।” মায়ের কসমে সেদিন অরিন থেমে যায়। আর দিহানকে বলা হয়নি মিহানের কথা। শান্তি নীড়ে এসে যখন মিহানের সাথে দেখা হয় মিহান অরিনের সাথে এমন আচরণ করে যেন মিহানের সাথে অরিনের আগে পরিচয়-ই ছিলো না। মিহানের স্বাভাবিক আচরণ অরিনকে স্বস্তি দেয়। দিহানকে সবটা উজাড় করে ভালোবেসে ফেলছে এখন পুরনো কিছু মনে রাখতে চায়না সে। স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষ নিয়ে ভাবতে চায়না সে।

[বর্তমান]

ঘড়ির কাঁটায় রাত ৪টা বাজে। দিহান এখনো অরিনকে খুঁজে যাচ্ছে। পাগলের মতো হয়ে গেছে সে। খোঁজা বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরার কথাটা বলতে সাহস হচ্ছে না কারো। শাওন নীল জিহান দিহানের কান্না দেখে নিজেরা কাঁদছে। কিন্তু মিহানের মজা লাগছে। এটাই তো চাইতো সে। দিহান কাঁদুক। দিহানকে তো হাত দিয়ে মারতে পারবে না সে। তাঁর হাত কাঁপে। তাই এভাবেই মারবে। তিলে তিলে শেষ করে দিবে। এই যে দিহান পর পর চারবার জ্ঞান হারালো। মিহানের খুব মজা লেগেছে। দিহানকে খুব হিংসা হয়। এতো বড় কপাল কেন হবে দিহানের? কেন দিহান এতো সুখী জীবনের অধিকারী? দিহান রাস্তার আইলেনের উপর হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগলো। মিহান,জিহান,নীল শাওন দৌড়ে আসে দিহানের পাশে। দিহান শাওনের কোমর জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলল, “আমাকে তুই মেরে দে শাওন প্লিজ। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রে। ও কি জানেনা আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারিনা? ও কেন আসছে না আমার সামনে? কেন লুকিয়ে আছে বল? আমার বউপাখির কিছু হয়ে গেলে আমি মরে যাবো শাওন।” কাঁদতে কাঁদতে দিহান ক্লান্ত হয়ে যায়। জিহান দিহানের মাথা বুকে জড়িয়ে রাখে। নীল পুলিশকে ফোন দিয়ে জানে কোনো খোঁজ পাইছে কিনা। ওরা জানায় পায়নি। কিছুক্ষণ শান্ত থেকে দিহান আবার কেঁদে উঠে। দু’হাতে চুল টেনে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। মিহান বলে,”এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না দিহান। দেখবি অরিন ফিরে আসবে। তুই কিছু খা দিহান। সেই সকাল থেকে না খেয়ে আছিস।
দিহান কেঁদে কেঁদে বলে,”
_আমি এখন কই থাকতাম মিহান, বলবি? আমার বউপাখির সাথে আমি এখন কানাডা থাকতাম। কতো সুন্দর একটা মূহুর্ত থাকতো আমাদের। কতো কতো খুশি আমাদের ঘিরে থাকতো। আর এখন কিনা আমার পাখিটা,,,,,”দিহান আর কিছু বলতে পারেনা কান্নার বেগ বেড়ে যায়। যার জন্য ভিতর থেকে তাঁর কথা আসছে না। হঠাৎ একটা ট্রাক আসছে দেখে দিহান উন্মাদের মতো বলে,”আ আ আমি এই ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যাবো। আমি আর পারছি না।”দিহান রাস্তার মাঝখানে চলে যায়। নীল শাওন জিহান দিহানকে জাপটে ধরে তারাতাড়ি সরিয়ে আনে। ওরা সরে আসতেই ট্রাক ওদের দাঁড়িয়ে থাকা জায়গার উপর দিয়ে যায়। এক সেকেন্ড দেরি হলে জিহান দিহান নীল শাওম চার জনই পিশে যেতো। মিহান যে দিহানকে আটকাতে যায়নি এটা কেউ খেয়ালই করলো না। জিহান দিহানকে আইলেনের উপর বসিয়ে কান্নাজড়িত গলায় বলল,”পাগলামি করিস না ভাই। তোর কিছু হলে আমরা থাকবো কেমনে? এসব দেখলে দাদুমনি তো মরে যাবে রে।
_আমি আর পারছি না ভাইয়া। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ও কেমন আছে সুস্থ আছে নাকি কোনো বিপদে আছে। কিছু খেয়েছে নাকি না খেয়েই আছে। কি অবস্থায় আছে আমি কিচ্ছু জানিনা। যতক্ষণ না ওর খুঁজ পাবো আমি শান্তি পাবো না ভাইয়া। ওকে খুঁজে না পেলে আমি মরেই যাবো।” নীল বলল,”
_তোর কিছু হলে অরিন ফিরে এসে তোকে না পেলে কতটা কষ্ট পাবে ভাব। মাত্র তো একটা দিন হলো। আমরা আরো খুঁজবো। দেখবি অরিনকে আমরা পেয়ে যাবো।
দিহান অবাক হয়ে বলে,”একটা দিন? আমার কাছে তো একটা বছর মনে হচ্ছে।” বলতে বলতে আবারও কেঁদে উঠে দিহান।” তারপর কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে বলে,” আল্লাহহহহহহহ! আমার বউপাখির কাছে আমায় নিয়ে যাও আল্লাহ। নয়তো তোমার কাছে নিয়ে যাও। আমি যে আর পারছি না ওকে ছাড়া।

চলবে,,,,,।

কাল যারা অরিনের উপর রেগে ছিলেন তাঁদের কাছে একটা প্রশ্ন,আজও কি রেগে আছেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here