ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_৩৬
#সুলতানা_সিমা
দেয়ালের এক কোণা ঘেঁষে গুটিশুটি মেরে বসে আছে অরিন। তার সামনে রাখা আছে লাল রঙের একটি শাড়ি। শাড়ির উপরে একটা আলতা। দু ডজন লাল চুড়ি। লাল গোলাপের একটা খোঁপা ও এক জোড়া পায়েল। এই জিনিসগুলোর সাথে অরিন খুব পরিচিত। কোনো এক দিন এগুলা তাঁর জন্যই কেনা হয়েছিলো৷ ভাগ্যের পরিহাসে এগুলা পড়া হয়নি তাঁর। কোনো একদিন খুব করে আফসোস হতো এই জিনিস গুলা পড়তে পারেনি বলে। কিন্তু এখন তাঁর আফসোস হয়না। তাঁর স্বামীর কাছে পৃথিবীর সব কিছুই তুচ্ছ মনে হয়। সে এখন ভালোবাসে তাঁর স্বামীকে। তাঁর সর্বাঙ্গ জোড়ে তাঁর স্বামীর বসবাস। দিহানের কথা খুব মনে পড়ছে তাঁর। অরিন মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তাঁর সামনের দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকা মানুষটা অরিনের কান্নায় পাত্তা দিলো না। এক পা ভাঁজ করে এক পা আধ ভাঙা করে বসে আছে। আধ ভাঙা পায়ের উপর একটা হাত রাখা যে হাতে আছে জ্বলন্ত সিগারেট। সেই সিগারেটের ধোঁয়া নেচে নেচে দলা বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটু পর পর আবার সিগারেট ফুঁকে মুখ ভরে ধোঁয়া উড়াচ্ছে। সেই ধোঁয়া ঢেকে দিচ্ছে তার মুখ। অরিন কেঁদে কেঁদে মিনতির স্বরে বলল,”প্লিজ আমাকে যেতে দিন। উনি হয়তো চিন্তা করছেন।
মানুষটি অরিনকে গম্ভীর গলায় বলল,”
_বললে না যে। মনে আছে কি তোমার এই জিনিসগুলার কথা?
অরিন চেঁচিয়ে বলল “_না মনে নেই। এসব তুচ্ছ বিষয় মনে রাখিনা আমি। ছেড়ে দেন আমায়।
_তুচ্ছ?
_হ্যাঁ তুচ্ছ। আমি এখন অন্যকারো স্ত্রী। এসব মনে নিয়ে চলা যেমন আমার জন্য অপরাধের তেমনি পাপও।
_পাপ? তুমি পাপ বুঝো? তাহলে আমার মন ভাঙলে কেন? আরে একটা মানুষের মন ভাঙার থেকে বড় পাপ কি হতে পারে? আর কি বললা? তুমি অন্যকারো স্ত্রী? তুমি শুধু আমার স্ত্রী।
_স্ত্রী? কিসের স্ত্রী? আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়নি। না হওয়ার কথা ছিলো। দরজা খুলে দিন আমায়। আমি আমার স্বামীর কাছে যাবো।
_কোথাও যাবেনা তুমি। আর ওই দিহানের কাছে তো আর জীবনেই যাবেনা।
_প্লিজ আমায় যেতে দিন। উনি আমায় খুঁজে না পেলে খুব কষ্ট পাবেন। আপনি বললে আপনার পায়ে ধরবো তবুও প্লিজ আমায় যেতে দিন। উনি খুব কষ্ট পাবে।
_বাহ৷ ওর কষ্ট লাগবে বলে তুমিও কষ্ট পাবে? কষ্ট কাকে বলে বুঝো তুমি? ভালোবাসার মানুষটিকে দেখা করতে ডেকে নিয়ে বিয়ের কথা জানানোকে কষ্ট বলে৷ যে কষ্টটা তুমি আমাকে দিয়েছিলে।
_আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। আপনি বলেছিলেন আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তবুও কেন আমার পিছু নিলেন? দিহান আমার স্বামী। আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি। প্লিজ আপনি আমার স্বামীর থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিবেন না। দোহাই লাগে আল্লাহর।
_চুপ একদম চুপ। বার বার স্বামী স্বামী করবা না। তোমার স্বামী শুধু আমি।
_কেন পাগলামো করছেন? আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়নি।
_হয়ে যেতো। হয়ে যেতো যদি তুমি ঠিক থাকতে। তুমি কেন মাঝখান থেকে সম্পর্ক ভেঙে দিছিলে? আর কাল তুমি দিহানকে কি বললে? দিহান তোমার প্রথম ভালোবাসা? তাহলে আমি কি ছিলাম?
_আপনি আমার অতীত ছিলেন। যা আমি অনেক আগেই ভুলে গেছি। এখন আমার সব জোড়ে শুধু এবং শুধুই আমার স্বামী আছে।
_ভুলে যাও ওকে। আবার ফিরে আসো আমার হয়ে। আমি তোমার বাচ্চার ক্ষতি করবো না প্রমিজ। ও আমার পরিচয়ে বড় হবে। আমরা অনেক দূর চলে যাবো দিহান আমাদের খুঁজে পাবেনা।
_চুপ করুন প্লিজ। আমার স্বামীকে কষ্ট দেওয়ার কথা মাথাতেই আনবেন না। বিশ্বাস করুন উনার প্রতি আমার যতটা টান আছে উনার প্রতি যতটা আকৃষ্ট হই,উনাকে নিয়ে মনে যতটা ফিলিংস হয় ততটা আপনাকে দিয়ে হতো না। উনাকে এক মিনিট না দেখলে আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে। কিন্তু আপনাকে এক মাস না দেখলেও আমার খারাপ লাগতো না। কেন জানেন? কারণ আপনি আমার প্রেমিক ছিলেন। আর উনি আমার স্বামী। মেয়েরা সব ছেড়ে দিতে পারে। নিজের বাবা মাও ছেড়ে দেয়। এক পেট থেকে আসা ভাই বোনও ছেড়ে দেয়। শুধু স্বামী ছাড়তে পারেনা। আমিও পারবো না। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি উনাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচবো।”
অরিন কথাটা বলে শেষ করতেই তার সামনে বসে থাকা মানুষটি উঠে এসে তাঁর মুখ চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই ফোন বেজে উঠল। অরিনের মুখ ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো নীল ফোনের স্ক্রিনে দিহান লেখা। অরিনের মুখটা আবার চেপে ধরে ফোনটা রিসিভ করলো। ফোনের ওপাশ থেকে দিহানের অস্থির গলা ভেসে এলো,”মিহান কই তুই? অরিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সব জায়গায় খুঁজেছি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা। প্লিজ ভাই আমায় হেল্প কর। আমি মরে যাবো ওকে না পেলে। তুইও খুঁজনা ওকে প্লিজ।”
_আচ্ছা রাখ তুই। আমি আসছি। টেনশন করবি না। হয়তো কোথাও আছে চলে আসবে।” মিহান ফোন কেটে দেয়। অরিনের মুখ ছেড়ে দিলে অরিন জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে। মিহান হো হো করে হেসে উঠে। দেয়ালে তার হাসির বারি লেগে ভয়ংকর প্রতিধ্বনি তুলছে। মনে হচ্ছে কোনো পিশাচ হাসছে। মিহান হাসি থামিয়ে বলে,”
_তোমার হাসবেন্ড তো তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেলো। বউ নাই।” বলেই আবারও হাসে মিহান। তারপর বলে,”জানো তোমার স্বামী তোমাকে আজ কি সারপ্রাইজ দিতো?” অরিন কেঁদে কেঁদে হাত জোড় করে বলে,”
_প্লিজ উনার কাছে আমাকে নিয়ে চলুন।
_আহহা আগে আমার কথা শুনো না। ও তোমায় কি সারপ্রাইজ দিতো জানো? আমিই বলে দেই। ও আজ রাত আটটার ফ্লাইটে তোমায় নিয়ে কানাডা চলে যেতো। কতো সুন্দর করে আমার সাথে সারপ্রাইজ প্ল্যানিং করলো। তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় প্লেনে তুলবে। তারপর তোমাকে কানাডা নিয়ে তুরি মেরে চোখ খুলতে বলবে।”
“অরিন হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। মিহান অরিনের চোখ মুছতে আসলে অরিন দুপা পিছিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে,”ছুবেন না আমায়। ওইদিন ওই অন্ধকার ঘরে ওটা আপনি ছিলেন তাইনা? তাহলে আমি যখন আপনায় প্রশ্ন করছিলাম ওটা আপনি ছিলেন কিনা কেন মিথ্যে বলছিলেন যে ওটা আপনি ছিলেন না।
_তো কি বলতাম ওটা আমি ছিলাম? যেন পরে তুমি আমার সাথে স্বাভাবিক ভাবে চলাটা বন্ধ করে দাও।
_তাহলে এতোদিন আপনি শুধু আমার সামনে ভালো অমানুষীর নাটক করেছিলেন? যেন আমি স্বাভাবিক থাকি? ভুলে যাবেন না আমি আপনার ভাইয়ের বিয়ে করা স্ত্রী। আমাকে ছুঁয়ার অধিকার আপনার নেই। কোন সাহসে ছুঁয়েছিলেন আমাকে?
_আমি কি করতাম অরিন? তোমাকে দেখলে আমার মাথা নষ্ট হয়ে যায়। পুরনো সেই তোমাকে ফিল করি।[একটু থেমে] জানো, তোমার পাশে কাউকে আমার সয্য হয়না। আমি সবাইকে তোমার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছি কাউকে তোমার রাস্তায় আসতে দেইনি। কোনো পুরুষের হাতের ছোঁয়া তোমার গায়ে লাগতে দেইনি। কিন্তু এই দিহান। এই দিহান তোমাকে ছুঁয়ে ফেললো৷ ওর অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে ফেলল। সবার মতো করে ওকে আমি তোমার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে পারিনি অরিন। সত্যি পারিনি। ওকে মারতে গেলে আমার হাত কাঁপে। কলিজা মুচড় দিয়ে উঠে।
” অরিন অবাক হয়ে বলল,”
_স স স সবার মতো বলতে। ক্ক ক্ক কি বুঝাচ্ছেন আপনি? তা তা তারমানে আ আ আমার জীবনে যারা আসতে চেয়েছিলো তাদের আ আ আপনি মেরেছেন?
মিহান তার আগের জায়গায় বসে। কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,”
_আজ তোমায় সব বলবো অরিন সব। সেদিন তুমি যখন আমায় বলেছিলে তোমায় ভুলে যেতে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি এতোটাই কষ্ট পেয়েছিলাম যে কথা বলতে পারিনি। বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু ভেজা চোখে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর যখন তোমাকে ভুলতে না পেরে বার বার তোমার কাছে গেলাম, তুমি আমায় বার বার বললে তোমায় ভুলে যেতে। তবুও আমি তোমার কাছেই যেতাম। এক সময় তুমি তোমার নিজের কসম দিয়ে বললে তোমার সামনে আর না যেতে। সেদিন আমি অনেক কষ্টে নিজেকে দমাই। কিন্তু আমি মেনে নিতে পারিনি অরিন। তুমি অন্যকারো হও এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। রাগ ও ক্ষোভে আমি তোমার স্বামীকে মেরে দিয়েছিলাম। ওকে মারতে দেখে ফেলেছিলো তোমাদের বাড়ির আলাদিন চাচা আর শাওনদের বাড়িতে যে কাজ করতো মামুনুল হক চাচা উনি। আমি মামুনুল হককে টাকা দেখিয়ে আমার পক্ষে নিয়ে আসি কিন্তু আলাদিন বলে সে সবাইকে বলে দিবে তাই ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেই। তারপর আমি চলে যাই কানাডা। ওখানে যাওয়ার চারমাস পরে মামুনুল হক চাচা জানায় দিহান নাকি শাওনের সাথে তোমাদের বাড়ি গেছিলো। তোমার দাদী নাকি অসুস্থ ছিলেন। আমি উনাকে বললাম তোমাদের বাড়ি যেতে। তোমাকে একবার দেখে আসতে। আর দাদী সত্যি অসুস্থ নাকি এটাও দেখতে। উনি যান। কিন্তু তুমি উনাকে দেখে ফেলো। আর চিৎকার চেঁচামেচি করো পরে উনি পালিয়ে যান। তার দুদিন পর চাচা জানায় খাবার টেবিলে বসে নাকি সে শুনেছে তোমার বিয়ের আলাপ চলছে বাবুল নামে কোনো লোকের ছেলের সাথে। খবরটা পেয়ে আমি সাথে সাথে বাংলাদেশে চলে আসি। জিহান ভাইকে বলে আসি আমার বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি কদিন থেকে আসবো। দেশে এসেই বাবুলের ছেলেকে আমি মেরে দেই। তারপর উঠি শাওনদের পুরাতন বাড়ি। ভাবলাম একটু রেষ্ট নিবো তারপর তোমার সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবো তুমি না বুঝলে তোমার মাকে বুঝাবো। আমি ওই বাড়িতে যেদিন উঠলাম ওইদিনই আমার বাড়ির লোকজন ওখানে ঘুরতে যায়। ভাবলাম কোনো রকম লুকিয়ে বেঁচে যাবো। কিন্তু আমার কলিজা আমার আদরের বোনটা না দেখে ভাঙা জায়গায় পা রাখতে যাচ্ছে দেখে লুকিয়ে তাকতে পারিনি। নিজের অজান্তেই ওকে বাঁচাতে হাত এগিয়ে গেছিলো। ওখানে কিছুটা বিপদ মুখি হই আমি। ভাগ্যিস মামুনুল হক চাচা আমায় একটা চাদর দিয়েছিলেন ঠান্ডার জন্য, তাই মুখ ঢাকতে পারছিলাম। সেদিন আমি ঢাকায় এসে অন্য বাসায় উঠি। তারপর একদিন মামুনুল হক চাচা জানায় তোমাকে দিহানের সাথে কিচেনে দেখেছে। তাও খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি আবার তমালপুর যাই। কিন্তু দিহানকে শুধু মাথায় বারি দেওয়া ছাড়া ওকে মারার দুঃসাহস আমার হয়নি। পরেরদিন দিহানরা চলে আসে ঢাকায়। দাদুমনি অসুস্থ হয়ে যান। আমিও আর লুকিয়ে থাকতে পারিনি সবাই ভাবে আমি দাদুমনিকে দেখতে কানাডা থেকে এসেছি। তারপর দাদুমনির পিছনে কিছুদিন চলে যায়। দাদুমনি কিছুটা সুস্থ হয় তখনই মামুনুল হক চাচা জানায় তোমার বিয়ে হবে ইমন নামে একটা ছেলের সাথে। বন্ধুদের বাসায় যাবো বলে তমালপুর আবার যাই তারপর ইমনকেও আমার শিকার হতে হয়৷
মিহানের সব কথাগুলা শুনে অরিনের শরীর কাঁপতে লাগে। এসব কি শুনছে সে? মিহান তাঁর স্বামী থেকে শুরু করে সবাইকে মেরেছে? এতো গুলা মানুষের প্রাণ মিহান নিয়েছে? অরিন হঠাৎ কাঁপা গলায় বলল, ”
_মা মা মা মামুনুল হক চাচাকে মেরেছেন কেন?
_কারণ আমার রাগ হচ্ছিলো ওর উপর। ও থাকা কালীন অবস্থায় তোমার আর দিহানের বিয়ে হলো কি করে? তাও ও আমাকে কিচ্ছু জানায় নি। নীলদের বাড়ি থেকে আমাকে এসে শুনতে হয়েছিলো তুমি মিসেস দিহান। জানো আমি দিহানকেও মারতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। আমার কলিজা কাঁপে। কানাডায় মাফিয়াদের ওর পিছু লাগিয়ে দিছিলাম। ওরাও পারেনি। শালা কপাল নিয়ে জন্মেছে।” বলেই মিহান বসায় থেকেই পায়ের কাছের একটা টুলে লাত্তি দিলো। টুলটা কিছু দূর গিয়ে ছিটকে পড়ে। অরিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চেঁচিয়ে বলল,”
_আপনি তাহলে সে যে আমার স্বামীকে খুন করতে চায়? কি ভেবেছেন আপনি, রক্ষা পেয়ে যাবেন? আমি আপনার নামে মামলা করবো। আমার স্বামীর গায়ে একটা ফুলের টুকা দিলে আপনাকে খুন করে ফেলবো? আমার স্বামীর থেকে আমাকে আলাদা করতে আসবেন না নয়তো মেরে দিবো আপনাকে।
মিহান বসা থেকে উঠে অরিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,”
_তুমি কাকে খুন করবে বলো তো? আমাকে নাকি দাদুমনি কে?
অরিন অবাক হয়ে তাকায়। মিহান বাঁকা হেসে বলে,”
_দাদুমনিও তো চায় তুমি দিহানের থেকে আলাদা হয়ে যাও। কারণ দাদুমনি জানে তুমি তার তিন তিনটা নাতির জীবন নিয়ে খেলছো। বেচারা শাওনও নাকি তোমাকে ভালোবাসে। আর কদিন আগে আমার ডাইরিটাও পরে নিল। জেনে গেলো আমাদের অতীতের কথা। সেই অতীত যে অতীতে তুমি শুধু মিহানের ছিলে। তাই দাদুমনি এখন শুধু চায় তার প্রাণের নাতি দিহানের সাথে তোমার মতো ধোকাবাজ মেয়ে না থাকুক। বাই দ্যা ওয়ে এবার আমি যাই? তোমার স্বামীর সাথে থেকে তোমাকে খুঁজতে হবে তো।” বলেই শয়তানি হাসলো মিহান। অরিনকে কিছু বলতে না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অরিন দৌড়ে আসে মিহানের সাথে বের হওয়ার জন্য কিন্তু মিহান তাঁর আগেই দরজা বন্ধ করে দেয়। অরিন দরজার খুলতে টান দেয়। মিহানকে ডাকাডাকি করে। কিন্তু দরজা আর খোলা হয়না। অরিন নিজের চুল টেনে কাঁদতে লাগে। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো। তার ভাগ্যে এতো দূর্দশা কেন? কেন সে সুখী হতে পারেনা। অরিনের মনে পড়ছে পুরনো দিনগুলার কথা। যে দিনে সে শুধু মিহানের ছিলো।
[অতীত]
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে অরিনের সাথে মিহানের প্রথম পরিচয় হয়েছিলো৷ তখন অরিন মাত্র ক্লাস নাইনে পড়তো। অরিনের বাবা ডাক্তার বাড়িতে কাজ করতেন। একদিন অরিন একটা দরকারে তাঁর বাবার কাছে গিয়েছিলো। উনি গাছের আগাছা কেটে পরিষ্কার করছিলেন। অরিন উনার সাথে কথা বলছিলো হঠাৎ চোখ যায় শাওনের বেলকনিতে একটা ছেলে বসে বসে বই পড়ছে৷ অরিন চোখ নামিয়ে নিয়ে আবার তাকায়। দ্বিতীয়বার তাকানোর সময় দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়৷ সাথে সাথে ছেলেটা কপাল কুঁচকে ফেলে। তারপর বই নিয়ে রুমে চলে যায়। অরিন ছেলেটার কান্ডে হয়। সে তাকালো বলে চলে যাচ্ছে? বাবার সাথে কথা বলা শেষ হলে চলে আসে অরিন। আসার সময় একবার শাওনের বেলকনির দিকে তাকায়৷ কিন্তু তার দৃষ্টিতে ছেলেটা আবার পড়লো না। পরেরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে শাওনের সাথে দেখা হয়। শাওন পরিচয় করিয়ে দেয় ছেলেটা শাওনের মামাতো ভাই মিহান। ওই দিন অরিন আর মিহানের কোনো কথা হয়নি। এর পর থেকে স্কুলে আসা যাওয়ার সময় প্রতিদিন শাওনের সাথে দেখা হতো, সাথে থাকতো মিহানও। একদিন অরিন টিপ পরে স্কুলে যায়। ওইদিন মিহান অরিনের সাথে প্রথম কথা বলে,”মুসলিম মেয়ে হয়ে টিপ পড়েন? এগুলা ঠিক মানায় না। ইবরাহীম আঃ এর জামানায় কাদের টিপ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিলো শুনেন নি?” অরিন সেদিন লজ্জা পায়। সে মেয়ে হয়েও বিষয়টা খেয়াল রাখেনি? সেদিনের পর থেকে মিহানের সাথে অরিনের টুকটাক কথা হতো। এক সময় মিহান একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। শাওন মিহানের সাথে তাকতো না বলে অরিন দাঁড়াতে চাইতো না। কিন্তু মিহান কথার শিকলে আটকে দিতো। এভাবেই চলতে থাকে দিন। একসময় মিহান অরিনকে জানিয়ে দেয় তাঁর মনের কথা। অরিন ফিরিয়ে দেয়। পর পর চারবার মিহান ভালোবাসার হাত বাড়ায় কিন্তু অরিন বার বারই ফিরিয়ে দেয়৷ তাঁর মনে হয় মিহানের মতো এত সুন্দর ছেলে তাকে কেন ভালোবাসবে। এটা শুধুই টাইমপাস ছাড়া কিছুই না। কিন্তু ধীরে ধীরে অরিনের মনে মিহানের জন্য ভালো লাগা তৈরি হয় তাই এক সময় অরিন মিহানকে মেনে নেয়।
খুব ভালো ভাবে চলতে থাকে তাদের সম্পর্ক। নিজের বাবার ফোন দিয়ে মিহানের সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলা মাঝে মাঝে মিহান তমালপুর এলে পুকুরের এপাড়ের গাছের আড়ালে একজন ওই পাড়ের গাছের আড়ালে একজন দাঁড়িয়ে ইশারায় কথা হতো এটাই ছিলো তাদের দেখা করা। সবকিছু ভালোই চলছিলো কিন্তু হঠাৎ একদিন,,,,,,,,।
অরিন চারদিকে তাকিয়ে মাথায় ওড়না টানতে টানতে জঙ্গলার দিকে যাচ্ছে। এই জায়গাটা গ্রামের একটা মাথায় পড়েছে। গাছগাছালি বেশি হওয়ায় একটু জঙ্গল টাইপ হয়ে আছে। সবাই এটাকে জঙ্গলা ডাকে। মানুষের চলাফেরা নাই বললেই চলে। অরিনকে এভাবে যেতে দেখে ফেলেন মনসুর সাহেব। খুব সাবধানে উনিও অরিনের পিছু নেন। অরিন জঙ্গলার ভিতর এসে মিহানের সামনে দাঁড়িয়ে জোরে একটা শ্বাস ছাড়লো। মনসুর সাহেব মিহান দেখে চোখ কচলে আবার তাকান।
অরিন মিহানকে বলল,”বলেন এখানে কেন ডাকছেন? পুকুর পাড়েই তো ভালো।
_শুনো প্রেম করি আমরা। সারাজীবন কি পুকুর পাড়েই চোখাচোখি করবো? সামনাসামনি দু’একটা কথা বললে কি হয়?
_যখন কারো হাতে ধরা পড়বেন তখন বুঝবেন কি হয়। বলেন কি বলবেন।
_আমি ভাবছি আমার আব্বু আম্মুকে তোমার কথা বলে দিবো তুমি কিন্তু রাগ করবা না।
_উনারা আমার মতো কালিকে দেখলে লেজ তুলে দৌড়াবে।
_আমার আব্বু আম্মুর লেজ নেই।
অরিন ফিক করে হেসে উঠে। অরিনের সেদিন এসএসসির লাষ্ট এক্সাম ছিলো। মিহান বলল,”
_এক্সাম ভালো হইছে?
_জ্বি অনেক ভালো।” সেদিন কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায় দুজন।
দুদিন পরে মনসুর সাহেব অরিনের বাড়িতে যান অরিনের বাবা আর মাকে ডেকে আনেন। মায়ের সাথে অরিনও আসে মনসুর সাহেব বলেন, “অরিন মা তুমি একটু অন্যঘরে যাও।” অরিন বেড়িয়ে আসে। কিন্তু সেলাই ঘরে এসে বেড়ার মধ্যে কান লাগিয়ে বসে থাকে। মনসুর সাহেব অরিনের বাবাকে বলেন,”খালেদ ভাই অরিনরে বিয়ে দিবানা না?
_কি যে কন ভাইজান? মাইয়ার কি বিয়ার বয়স অইছে? সবে তো এসএসসি দিলো। আরেকটু বড় ওউক তাইলে ভাবুন নে।
_বেশি বয়স হলে কিন্তু বিয়ে দিতে ঝামেলা হবে।
_না ভাইজান অইবো না। আমার মাইয়া গায়ের রং দিয়া একটু চাপা। কিন্তু আমার মাইয়ার মতো মায়াবী চেহারা এই দশ গেরামে খুঁইজা পাইবেন না।
_তারপরও খালেদ ভাই যত তাড়াতাড়ি পার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও। ওই যে সেদিন বললে না মেলায় দেখে অরিনকে পছন্দ করছে বলছে বিয়ের পরও পড়াবে তাঁর কাছে বিয়ে দিয়ে দাও।
_না না ভাইজান আমি আমার মাইয়ারে এহন বিয়ে দিমুনা।” বললেন জহুরা। মনসুর সাহেব বুঝে গেলেন এসবে কাজ হবেনা না সোজা কথায় বলতে হবে। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে বললেন,”আমার শালার ছেলে মিহান তাকে তো তোমরা চিনো? ওই ছেলের সাথে মনে হয় অরিনের কোনো সম্পর্ক আছে। বিয়ে যখন দিবে না তাহলে মেয়েকে সাবধান করে দাও। ছেলের থেকে দূরে থাকতে বলবে। তোমাদের মেয়ে এই ছেলের সাথে দেখা করতে জঙ্গলার ভিতর গেছিলো। শায়লা বলেছে তোমাদের বুঝিয়ে বলতে তাই বলে গেলাম।” বলেই উনি চলে যান। উনার কথা গুলা শুনে অরিনের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। উনি জানলেন কেমনে অরিম জঙ্গলায় গেছিলো? শুকনো এক ঢোক গিলে ঘরে আসলো অরিন। ঘরে এসে দেখলো তার বাবা মা দুজনের মুখটা বিষন্ন। জহুরা বেগম উঠে এসে অরিনকে বললেন,”কি রে তোর লগে ওই পোলার কি সম্পর্ক? মানুষ ঘরে আইসা বিচার দেয় কেন? ” অরিন মাথা নিচু করে ফেলে। অরিনের বাবা কান্নাজড়িত গলায় বললেন,”পরের বাড়ি কাম কইরা তোরে পালি। ঘরে বসে পরের মুখে কথা শুননের লাগি না।”
চলবে,,,,,,,,।