ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_২৯

0
1103

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_২৯
#সুলতানা_সিমা

স্বামী বিদেশ বলে পরকিয়া করবে? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে আদৌ এই বাচ্চাটা দিহানের কিনা? এই মেয়ে তো একটা,,,,,, দিলারা চৌধুরী কথা শেষ করার আগেই মিহান হাত বাড়িয়ে দিলারাকে থামিয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,”অনেক বলে দিয়েছো। এবার মুখে লাগাম দাও বড়মা। এসব কি বলছো তুমি? এটা বলার জন্য রাত তিনটায় আমায় ছাদে নিয়ে এসেছো?
_তুই বিশ্বাস করছিস না মিহান আমি নিজের চোখে দেখেছি।
_বড়মা প্লিজ থামো। আমাকে বলেছো বলেছো অন্যকাউকে বলবে না। চোখে যা দেখলে তা নিয়ে মন গড়া মন্তব্য করে নিলে? চোখের দেখা সবসময় সত্যি হয়না। সব দৃশ্যের পেছনেও আরেকটা দৃশ্য থাকে যা কারো চোখে পড়ে না। জড়িয়ে ধরলেই সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে মূর্খের মতো এটা ভাবা বন্ধ করো বড়মা। শাওন অরিনকে বোনের চোখে দেখে আর অরিনও শাওনকে ভাইয়ের চোখে দেখে৷ ওরা ভাই বোন হিসাবে জড়িয়ে ধরতেই পারে। এখানে পরকিয়ার কি দেখলে তুমি? পরকিয়া কাকে বলে বুঝো?” কথাটা বলে মিহান চলে যেতে পা বাড়ায়। সিঁড়ির সামনে গিয়ে আবার ফিরে আসে। দূরের এক লাইটের কিঞ্চিৎ আলোতে দেখা যাচ্ছে দিলারা চৌধুরী মুখে এক সমুদ্র বিরক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মিহান বলল,”দাদুমনির পরে এই পরিবারে তোমার স্থান তাই তোমাকে একটা কথা সবসময় মাথায় রাখতে হবে। যে কথা মুখ দিয়ে বের হলে ঝগড়া সৃষ্টি হয় সেটা সব সময় পেটে চেপে রাখা উত্তম।” বলেই মিহান চলে যায়। দিলারা চৌধুরী হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকেন৷ ভেবেছিলেন মিহানকে বললে মিহান বিশ্বাস করবে অথচ সে বিশ্বাসই করেনি। উনি তো ভুল দেখেননি নিজের চোখে দেখেছেন শাওন আর অরিনকে। এটাও শুনেছেন শাওন বলেছে অরিনকে সাথে নিয়ে যাবে। মিহান কে না বলে যদি শান্তি চৌধুরীকে বলতেন তাহলে হয়তো কাজে আসতো। নিজের প্রতি রাগ হলো উনার। পর পর দুবার ভুল করলেন তিনি। গায়ের চাদর ঠিক করতে করতে নিচের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। আজ নয়তো কাল ঠিকই সবার সামনে প্রমাণ করে দিবেন শাওন অরিনের মাঝে কিছু একটা আছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে হানিফ চৌধুরী অরিনের রুমে উঁকি দিলেন। অরিন ঘুমিয়ে আছে। বালিশে তাঁর মাথা নেই। হানিফ চৌধুরী ঘরে ঢুকলেন। এক হাতে অরিনের মাথা তুলে অন্যহাতে বালিশ এনে অরিনের মাথা বালিশে রাখলেন। কম্বলটা কোমর পর্যন্ত টেনে দিয়ে অরিনের মাথায় হাত বুলালেন। আজকাল অরিনের মুখটা দেখলে উনার কলিজা জুড়িয়ে যায়। প্রথমে ভাবতেন দিহানের মতো ছেলের সাথে এই শ্যামবর্ণ গরিব ঘরে এতিম মেয়ে যায়না। কিন্তু উনার মনে হয় অরিনের থেকে ভালো মেয়ে দিহানের জন্য হতে পারেনা। এতো শান্তশিষ্ট মেয়ে কি আজকাল পাওয়া যায়? অরিনের প্রতি খুব মায়া জমেছে উনার মনে। অরিনের মুখটা এতো মায়াভরা যে উনি অরিনকে দিশা আর দিয়ার মতো না ভেবে থাকতে পারেন না। উনার এখন মনে হয়না উনার দুটো মেয়ে সব সময় মনে হয় উনার তিনটা মেয়ে। আর এই তিনটি মেয়ের মধ্যে একটা মেয়ে উনার সব থেকে বড় স্বপ্নটা পূরণ করতে চলছে। দাদা হওয়ার স্বপ্নটা মনে এসে বাসা বেঁধেছিলো যখন দিহানের বয়স বিশ বছর হয় তখন থেকেই। বন্ধুদের নাতি নাতনি দেখলে মনে মনে ভাবতেন কবে ছেলে বড় হবে কবে বিয়ে দিবেন আর কবে তিনি দাদা হবেন। অবশেষে তিনি দাদা হতে চলছেন। আর এই স্বপ্নটা পূরণ করতে চলছে অরিন। এই কারণেই হয়তো অরিনের প্রতি এতো দূর্বলতা বেড়েছে উনার। এই একটা কারণ উনাকে অরিনের মায়াজাল আটকে ফেলেছে। এখন চাইলেও উনি অরিনের দিকে বিরক্তি চোখে তাকাতে পারেন না। অরিন উনার দিকে তাকালে মনে হয় যেন উনারা নাতি/নাতনি উনার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো সুখ কেন দাদা হওয়ার স্বপ্নে? ঘুমন্ত অরিনের কপালে চুমু এঁকে মুচকি হাসতে হাসতে রুম ত্যাগ করলেন হানিফ চৌধুরী। রুম থেকে বেরিয়ে সুমনা চৌধুরীর সম্মুখীন হন। উনিও অরিনকে দেখতে এসেছিলেন। হানিফ চৌধুরী সুমনাকে ভেতরে যেতে দিলেন না অরিনের ঘুম ভেঙে যাবে বলে। সুমনা চৌধুরী স্বামীর কান্ডে হেসে উঠেন। হাসতে হাসতে পা বাড়ান কিচেনের দিকে।

সকালের নাস্তা রেডি করে সবাইকে টেবিলে ডাকেন সুমনা। সায়রা চৌধুরী সবাইকে ডাক দিলে একে একে সবাই নিচে নেমে আসে শুধু লুপা আর অরিন বাদে। সুমনা জানালেন অরিন ঘুমুচ্ছে পরে খাবে। মিহান খেয়াল করলো ইশি মাথায় ফুলের মুকুট পরে আছে। এটা সে কাল কিনে দিয়েছিলো। ইশির কান্ডে হাসি পেলো তাঁর কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই শাওন বলল,”কিরে ইশি এটা রাতে খুলে ঘুমিয়েছিলি,নাকি মাথায় নিয়েই ঘুমিয়েছিলি?” ইশি আড়চোখে একবার মিহানের দিকে তাকায়। মিহান তাঁর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু একটা ভাবছে। ইশি চট করে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শাওনকে বলল,”আমার জিনিস আমি মাথায় রাখবো নাকি পায়ে রাখবো সেটা আমার ব্যাপার। তাতে তোর কি?
_আমার কিছু না। যেভাবে মাথায় নিয়ে হাটছিস মনে হচ্ছে কেউ নিয়ে নিবে। কেউ নিবেনা খুলে ফেল নয়তো দেখবি লোকে তোকে পাগলের গুষ্ঠি বলবে?” শাওনের কথা শেষ হতেই দিশা তেজি গলায় বলল,”ওই তুই গুষ্ঠি তুলে কথা বললি কেন?” মিহান তাঁর গজ দাঁতের হাসি দিয়ে বলল,হ্যাঁ ভাই বল তুই গুষ্ঠি তুলে কথা বললি কেন?
ইশি চোখ বড় বড় করে বলল,”
_মিহান ভাই তুই হাসছিস?” মিহান আঙুলে ঠোঁট চেপে না সূচক মাথা নাড়ালো। শাওন বলল,”হাসবে না? তোরা আবালদের নিয়ে সবাই হাসবে।” শাওনের কথা শেষ হতেই দিশা গ্লাস ভর্তি পানি শাওনের উপর ছুঁড়ে মারলো। শাওন চেঁচিয়ে বলল,”মেজো মামী নানুমনি আমি ওকে মেরে দিবো কিন্তু।” শাওন কথা শেষ হতে না হতেই আরেক গ্লাস পানি ছুঁড়ে মারলো। শাওন উঠে এসে দিশাকে চেপে ধরে সসের বোতল নিয়ে দিশার মুখে সস ঢেলে দিতে লাগলো। দিশা চিল্লিয়ে সবাইকে ডাকে কেউ এসে শাওনকে আটকায় না। মিহান আর নীল হেসে লুটিয়ে পড়ছে। শান্তি চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে বসে আছেন। সুমনা চৌধুরী আর সায়রা চৌধুরী হাসছেন। কিন্তু দিলারার মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বসে আছেন। উনার এসব মোটেও ভালো লাগছে না। এতো বড় বড় ছেলে মেয়ে গা ঘষাঘষি ঝগড়া কেন করবে?

শাওন দিশার মুখে মাথায় ইচ্ছে মতো সস লাগিয়ে দিয়ে যেতে লাগে এরই মাঝে দিশা শাওনের টিশার্ট খামচে ধরে মুখ মুছতে লাগে। শাওন টিশার্ট টেনে ছাড়াতে পারেনা। গলা উঁচিয়ে বলে,”নানুমনি তোমার নাতনিকে বলো আমার টিশার্ট নষ্ট করলে আমি ওকে দিয়ে ধোয়াবো।” দিশা শাওনকে ধাক্কা দিয়ে বলে যা সর এখান থেকে। টিশার্টে এতো ঘামের গন্ধ। ওয়াক ছিঃ।
_থাকুক আমার ঘামের গন্ধ তাতে তোর কি?” নীল বলল,”ওর সবকিছু ভাই। তোর সাথে তো লেপ্টে ওকেই থাকতে হয় তাইনা?” দিশা একটা পাউরুটি নিয়ে নীলের উপর ছুঁড়ে মারলো। নীল আবার ওটা দিশার উপর ছুঁড়ে মারলো। ইশি মাথার মুকুটটা খুলে টেবিলে রেখে বলল,”নে ভাই খুলে দিয়েছি এবার থাম তোরা।” দিশা ইশিকে ধমক দিয়ে বলল,
_তুই চুপ থাক।
_তোরা চুপ থাক।” চেঁচিয়ে ধমক দিয়ে বললেন শান্তি চৌধুরী। উনার ধমকে সবাই চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু তাঁরা মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে। শাওন গরম চোখে দিশার দিকে তাকাতে তাকাতে এসে নিজের চেয়ারে বসলো। দিশা ভেংচি কেটে চুল ঠিক করতে লাগলো। শান্তি চৌধুরী বললেন,”আর একটা কথা যদি কেউ বলবি তাহলে ছেঁড়া জুতো দিয়ে তোদের পিটাবো।” দিশা বলল,”কাল দারোয়ানের জুতা ছিঁড়ে গেছে ওটা এনে এই আহাম্মককে পিটাও।” শাওন বলল, “ওটা দিয়ে তোকে পেটানো উচিত। মুটকি কোথাকার।” শান্তি চৌধুরী হুংকার দিয়ে উচ্চারণ করলেন,”আবার?” দুজন চুপ হয়ে যায়। শান্তি চৌধুরী বলেন, “ওই রুহান যা তো লুপাকে আর অরিনকে ডেকে নিয়ে আয়।” নীল চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”আমি যাচ্ছি।” মিহান গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো। হঠাৎ এভাবে গলা খাঁকারির মানে কেউ বুঝলো না। নীল চলে গেলো উপরে। এতোক্ষণ উঠে আসার সুযোগ খুঁজছিলো সে।

লুপা রুমের মধ্যে পায়চারি করছে। কাল রাতের ঘটনার পরে নীলের সামনে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না তাঁর। রাতের ঘটনার পর থেকে নীলকে নিয়ে নিজের অজান্তেই ভেবে যাচ্ছে সে। এভাবে ভাবতে থাকলে নীলকে ভুলবে কেমনে? যতটা অভিমান জমেছিলো সেটাও কেন জানি বেহায়ার রূপ নিচ্ছে। মন চাচ্ছে নীলকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলুক আমি তোমাকে ভালোবাসি নীল ভাই খুব বেশি ভালোবাসি। ইচ্ছে করছে নীলের কলার খামচে ধরে বলুক “আমায় নিয়ে আরেকবার ডুব দিবে তোমার অতল সাগরে? ভেসে যাবে আবার আমায় নিয়ে বহুদূরে? যতদূর গেলে তুমি আমি ছাড়া কেউ থাকবে না? শুধু তুমি আমি আর এক সমুদ্র সুখ থাকবে।”

লুপার নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। কেন সে নীলকে নিয়ে এতো ভাবছে? কেন মনে নীলকে নিয়ে এতো এতো অনুভূতি জেগে উঠছে? কেন নীলের উপর রাগ করতে পারছে না সে? কেন নীলকে এতো ভালোবাসে সে? এতো কেন এর উত্তর নেই তাঁর কাছে। নীলের ভালোবাসার স্পর্শ পেয়ে তাঁর কালো জগত নীলময় হয়ে গেছে। দরজার বাইরে থেকে কেউ নক করছে। লুপা বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল,”ওই কে রে?” দরজার ওপাশ থেকে সাড়া নেই। লুপা এক রাশ বিরক্তি নিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সাথে সাথে নীল এসে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। লুপা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। চোখের পলকে এটা কি হয়ে গেলো? নীল লুপার সামনে দাঁড়াতেই লুপা চোখ নামিয়ে নেয়। রাতের কথাটা মনে পড়ছে তাঁর। নীল গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,”কি হয়েছে তোর? সবাই ডাকছে যাচ্ছিস না কেন?” লুপা বাজখাঁই গলায় বলল,”আমার ইচ্ছে তাই।
_তোর ইচ্ছেতেই সব হবে নাকি?
লুপা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,”
_তোমাকে কেন কৈফিয়ত দিবো? যাও এখান থেকে।
_তুই আয়।
_আমি যাবো না।
_কেন যাবিনা? আর তুই অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিস কেন?
_এটাও আমার ইচ্ছে।
_ইচ্ছে নাকি নিজেকে কন্ট্রোল করছিস?” নীলের কথায় লুপা চোখ বড় করে আবার ছোট ছোট করে তাকালো। নীল দুষ্টুমির সাথে হাসলো। তারপর লুপার হাত ধরে বলল,”
_আয়।” লুপা ঝাড়া দিয়ে নীলের হাত ছাড়িয়ে দেয়। নীল গম্ভীর গলায় বলে,”
_রাতের মতো ত্যাড়ামি করছিস?
_হ্যাঁ করছি। তো কি করবে?
_তুই করতে বলছিস? আই মিন রাতে ত্যাড়ামির পর যেটা করছিলাম ওইটা? ওকে ডান।” লুপা চট দু পা পিছিয়ে যায়। কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে দুহাত গলা টিপার মতো চেপে ধরে ফ্লোরে লাত্তি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। লুপার কান্ডে নীল হেসে উঠে। তাঁর অবুঝপাখিটা আজও অবুঝ রয়ে গেছে। টেবিলে এসে লুপা যে চেয়ারটায় বসলো নীল তাঁর ঠিক সোজা চেয়ারে বসলো। নাস্তা করে করে সবাই প্ল্যান করতে লাগলো আজ জিহান আসার পরে তারা কি কি করবে। নীল পা বারিয়ে লুপার পা খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ একটা পায়ে তাঁর পা পরলো। নীল খোঁচা দিলো। দিশা উপরে চোখ তুলে শাওনের দিকে তাকালো। শাওন ভদ্র ছেলের মতো চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। দিশার পায়ে আরেকটা খোঁচা পরতেই দিশা আবারও শাওনের দিকে তাকালো শাওন এখনো আগের মতো খাচ্ছে। নীল মুখ দিয়ে শি শি শি করে যাচ্ছে। লুপা তাকাচ্ছে না। দিশা ব্যাপারটা খেয়াল করে সাবধানে টেবিলের নিচে তাকালো। নীল তাঁর পা দিয়ে দিশার পা চেপে রাখছে। দিশা দাঁতে দাঁত চেপে অন্য পা এনে জোরে একটা পারা দিলো। নীল “ওমা গোউউউউ” বলে লাফিয়ে উঠলো। টেবিলের সবাই জিজ্ঞাসুক চোখে নীলের দিকে তাকায়। নীল জোরপূর্বক হেসে বলল,”জিহ্বায় কামড় পড়ছে।” সবাই নিজের মতো খেতে লাগে। নীল লুপার দিকে তাকিয়ে শি শি করলো। দিশা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”ভাই নীল এদিকে তাকা। হাত পা গুটিয়ে শান্ত হয়ে খা। দেখবি পা থেকে জিহ্বা কিছুতেই কামড় খাবিনা।” নীল শুকনো এক ঢোক গিলল। কাকে ভেবে কার পা ছুঁয়েছে বুঝতে পেরে কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে ফেললো সে।
_________________________________

জিহান বাসায় এসেছে দু’ঘন্টা হলো। সবার সাথে কথা বলে উপরে চলে গেছে রেষ্ট নিতে। দিলারা কিচেনে ঢুকে রান্না করছেন। কত ধরনের রান্না করছেন অথচ উনার মুখে বিরক্তির চাপ নেই। আজ কতো খুশি উনি। খুশিতে তিনি আত্মহারা হয়ে আছেন। অরিন উনাকে এতো খুশি হতে দেখেনি, এতো হাসতেও কখনো দেখেনি৷ সব সময় গোমড়ামুখে বসে থাকতেন। অথচ আজ উনার মুখে হাসি লেগেই আছে৷ দেখে মনে হচ্ছে উনি পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ। মা মনে হয় এমনই হয়। তাঁর সন্তান কাছে এলে তাঁর সব খারাপ লাগা দূর হয়ে যায়। অরিনের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। জহুরা বেগমের কথা মনে পরছে। কে জানে উনি কেমন আছেন। কিচেন থেকে চলে এলো অরিন। রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো দিহান মেসেজ সিন করেছে কিনা। না করেনি,কিন্তু একটিভ আছে। অরিন কল দিলো দিহানের ফোন ওয়েটিং বিজি দেখাচ্ছে। অরিনের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসলো। এতো অবহেলা কেন করছে দিহান? কি হয়েছে তাঁর? কি করেছে অরিন? হাঁটুতে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। তাঁর শান্তি লাগছে না। উঠে বারান্দায় গেলো, সেখানেও শান্তি লাগছে না। রুমে এসে দিহানকে ফোনের পরে ফোন দিলো এখন ফোন যাচ্ছে কিন্তু দিহান ফোন তুলছে না। অরিন একের পর এক ফোন দিতেই থাকলো কিন্তু দিহান ফোন তুলছে না। স্বামীর অবহেলায় বুকটা পুড়ে যাচ্ছে তাঁর। স্বামীর অবহেলার থেকে কঠোর অবহেলা আর হতে পারেনা।

একঘন্টা ধরে অরিন ফোন দিচ্ছে অথচ দিহান ফোন তুলছেনা। যেখানে দিহান অরিনের সাথে কথা না বলে একদিন থাকতে পারেনা সেখানে আজ তিন হলো তাঁদের কথা হয়না। দিহান কিভাবে থাকছে তাঁর বউপাখির সাথে কথা না বলে? তাহলে কি দিহান বদলে গেলো? আচ্ছা কেন বদলে গেলো? সে কালো বলে? এমন নয়তো দিহান ওখানে কোনো সুন্দরী মেয়েকে ভালোবেসে ফেলছে? আচ্ছা দিহানের কোনো ক্ষতি হয়নি তো? ক্ষতি হলে বাসার অন্যদের সাথে কথা বলে কেমনে? দিহান কি এটা মিথ্যে বলেছিলো যে তাকে কেউ ফলো করে? এমন তো নয় এই বিয়ে থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত যা যা হয়েছে সব দিহানের প্ল্যান অনুযায়ী?” ভাবতেই অরিনের মাথাটা ভনভন করে উঠলো। মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে তাঁর। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। দুহাতে মাথা চেপে রেখে বসে থাকলো। দিহানের এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন তাকে শেষ করে দিচ্ছে। সারাটাদিন চলে যায় দিহান ফোন ধরেনা মেসেজ সিন করেনা। হিসাবের খাতায় আরেকটা দিন উঠে গেলো দিহানের সাথে কথা হয়নি৷ আজ অনেকবার সুমনা চৌধুরীকে বলতে গেছিলো দিহান তাঁর সাথে কথা বলছে না। কিন্তু বলতে পারলো না। দিহানের একটা ছবি বের করে বুকে চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। ছবিতে অসংখ্য চুমু দিলো। ছবির উপর মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল,”
_কেন আমার সাথে কথা বলছেন না দিহান? কেন এতো কষ্ট দিচ্ছেন বলুন? আমি কি করেছি যার জন্য এই কঠিন শাস্তি দিচ্ছেন? দেখেন না সবাই কতো হাসি খুশিতে আছে অথচ আমি থাকতে পারছি না। আমার বুকটা পুড়ে যাচ্ছে দিহান। [দুহাতে পেট ধরে] দেখেন আপনার বাচ্চাটাও কাঁদছে। আপনার জন্য কাঁদছে। প্লিজ একটাবার কথা বলুন প্লিজ।” কাঁদতে কাঁদতে অরিনের হেঁচকি উঠে যায়। সে ক্লান্ত হয়ে কান্না থামিয়ে দেয়। কিন্তু চোখের পানিটা থেমে যায়না। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই থাকে।

জানালা খুলার বিকট শব্দে অরিনের ঘুম ভেঙে যায়। লাফ দিয়ে উঠে বসে সে। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে দেখলো রাত ১০টা বাজে। তাহলে কি সে এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো? খাট থেকে নেমে জানালায় বাইরে উঁকি দেয়। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা এমনকি বাতাসও নেই। তাহলে এতো শব্দ করে জানালা খুললো কিভাবে? অরিন কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। জানালা বন্ধ করে সাথে সাথে আবার খুললো। জানালার বাইরে একটা সুতোয় চিরকুট ঝুলে আছে। সুতোটা ছাদ থেকে এসেছে। অরিন চিরকুটটা হাতে নিয়ে জানালা বন্ধ করে দেয়। খাটে বসে এসে চিরকুটটা খুলে পড়তে লাগলো,”

“ভাবি তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। দিহানকে নিয়ে। কথাটা আজ রাতে না বললে হয়তো আর বলার সুযোগ পাবো না। পেছনের গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো আছে সুযোগ বুঝে বেরিয়ে যেও। কেউ যেন ঠের না পায়।”

অরিন চিরকুটটা পরে অবাক হলো। কে লিখলো এটা? নাম দেওয়া নেই কেনো? আর দিহানকে নিয়েই বা কি কথা থাকতে পারে? বারান্দায় গিয়ে পিছনের গেটে উঁকি দিলো। হ্যাঁ সাদা রঙের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অরিন ফোন হাতে নিয়ে দিহানকে কল দিলো। বুকটা আবারও মুচড়ে উঠলো এখনো ওয়েটিং। দিহান কি নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে? দুগাল গড়িয়ে জল পরলো৷ চোখটা মুছে বাইরে বের হলো সে। কে বাসায় নেই সেটা দেখতে হবে। যে বাসায় নেই সে এই চিরকুট দিয়েছে। পা এগুচ্ছেনা তাঁর। আজ সারাদিন পেটে কিছুই পড়েনি। বাচ্চাটা যেন চিৎকার করে বলছে আম্মু কিছু খাও প্লিজ আমার খুব খিদে লাগছে। কিন্তু বাচ্চা কি জানে তাঁর মায়ের গলা দিয়ে খাবার নামছে না? অরিন প্রতিটি রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো কে কে বাসায় নেই। তিনজন মানুষ বাসায় নেই। মিহান,নীল,জিহান। অরিন নিশ্চিত হতে পারলো না কে হতে পারে। একবার মিহান ভাবছে তো একবার নীল আর একবার জিহান। কিন্তু জিহান তো তাঁর সাথে কথাই বলেনি আর সে তো অরিনকে ভাবি ডাকবে না? অরিন মনের ভীর লাগা প্রশ্ন থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে খুঁজতে লাগলো। এতো ভেবে কি লাভ? যে হয় তো হবেই। অরিন দিয়ার রুমে গিলো দিয়া টিভি দেখছিলো। সে দিয়ার পাশে বসে বললো,”দিয়া তুমি নীল ভাইয়া আর মিহান ভাইয়াকে দেখেছো?
_না গো ভাবি দেখিনি।
_অহ।” অরিন চলে আসে দিয়ার রুম থেকে। দিশাকে ছলেবলে জিজ্ঞেস করে জিহান কই দিশা বলল সেও খুঁজছে পাচ্ছে না। অরিন ডিনারের টেবিলে গেলো না। এখন তাঁর গলা দিয়ে খাবার নামবে না। বার বার চিরকুট হাতে নিয়ে পড়ছে। যতবার দিহানের নাম পড়ছে ততবার অজানা ভয় তাঁর আত্মা কেঁপে উঠছে। কি হতে পারে দিহানের বিষয়ে কথা যা অরিন জানেনা?

রাত ১১:৩০ সবাই খেয়েদেয়ে নিজের রুমে চলে গেছে। অরিন বাসার পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। গেটের সামনে এসে দেখলো গাড়িতে ড্রাইভারও আছে। অরিন গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট হলো। গাড়ির ছোট গ্লাসে ভেসে উঠলো ড্রাইভারের বাঁকা ঠোঁটের অদ্ভুত হাসি।

চলবে,,,,,,,।

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here