ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_২৮

0
1099

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_২৮
#সুলতানা_সিমা

জিহানের বিয়ে উপলক্ষে শাওন আজ তাঁর ভালোবাসার মানুষটির স্বামীর বাড়ি এসেছে। তাঁর নানু বাড়ি শান্তি নীড় এসেছে সে। সাথে তাঁর মাও আছেন। শান্তি নীড়ের গেটের ভেতর পা রাখতেই তাঁর বুকটা মুচড়ে উঠলো। এই বাড়িতে তাঁর ভালোবাসার মানুষটি বসবাস করে। যাকে আজও ভুলতে পারেনি সে। কত চেষ্টা করেছে ভুলে যেতে কিন্তু একদম ভুলে যেতে পারছেনা। বরং ভুলে যেতে যত চেষ্টা করছে ততই মনে পড়ছে অরিনের কথা।

কলিং বেল বাজাতেই অরিন এসে দরজা খুলে দিলো। অরিনকে দেখে শাওনের বুক ফেটে কান্না আসে। কাল দিহান ফোন দিয়ে জানিয়েছে সে বাবা হবে। কত খুশি ছিলো দিহানের কণ্ঠে সেটা মাপা যাবেনা। তাঁর ভালোবাসা অন্যকারো সন্তানের মা হবে। এটা ভাবলেই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কি হতো যদি অরিন তাঁর সন্তানের মা হতো? ভাগ্য কেন এতো নির্মম হয়? কেন ভাগ্যে কারো নাম না থাকলে সে অন্যকারো হয়ে যায়? ভালবাসার জোরের থেকে ভাগ্যের জোর বেশি। এই কথাটা মানেনা শাওনের মন। শাওনের গলা ব্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে গলা কেউ টিপছে শুধু হায়াতের জোরে দমটা বের হচ্ছেনা। অরিন শাওনকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে,”শাওন ভাইয়া আপনারা?” শাওন ম্লান হেসে ছোট করে হুম বলল। অরিন শায়লা চৌধুরীকে সালাম করলো। উনি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ভেতরে চলে যান। অরিনের মন খারাপ হয়ে যায়। শাওনও ভিতরে গেলো।

রুহান দিয়ার চিল্লাচিল্লিতে সবাই নিচে নেমে আসে। দিশা,ইশি,নীল,মিহান শপিংয়ে চলে গেছে। শাওন সবার সাথে কথা বলে উপরে যায় ফ্রেশ হতে। একটুপরে সন্ধ্যা নেমে আসে। শপিং শেষে দিশারাও চলে আসে বাসায়। দুদিন থেকে অরিন কোনো কাজ না করলেও সন্ধ্যার চা টা সে বানায়। চা বানিয়ে সবার জন্য নিয়ে গেলো। সবাইকে চা দিয়ে শেষে শাওনের রুমে গেলো সে। শাওন খাটে বসে মাথা নিচু করে চুল মুঠি ধরে ছিলো। অরিন অনুমতি না নিয়ে রুমে ঢুকে। শাওনের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়,”ভাইয়া।” শাওন মাথা তুলে অরিনের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ সে এভাবেই তাকিয়ে থাকে। অরিনকে দেখার একটা তৃষ্ণা হয়েছিলো তাঁর। হঠাৎ মনে হলো অরিন এখন কারো সুতোয় বাঁধা তাও তাঁর ভাইয়ের সুতোয়। শাওন চোখ নামিয়ে নেয়। অরিন চা রেখে শাওনের পাশে বসে বলে,”কেমন আছেন ভাইয়া?
_হুম ভালোই। তোমার কি অবস্থা?
_হুম।” অরিন কিছুক্ষণ মাথানিচু করে চুপ থাকে। তারপর বলে,”মাকে সাথে নিয়ে আসলেন না ভাইয়া।” শাওনের বুকটা ধুক করে উঠলো। সে জহুরাকে সাথে আনতে চেয়েছিলো কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো জহুরা বেগম এখন এই বাড়ির আত্মীয়। উনি দাওয়াত ছাড়া বিয়েতে আসবেন কেন? গরিব হলেও তো উনার আত্মসম্মান বলে কিছু আছে। এই বাড়িতে বিয়ে হবে অথচ উনাকে কেউ দাওয়াত দেইনি। শাওন চায়নি উনি ছোট হন। কিন্তু অরিন এমন প্রশ্ন করবে জানলে সাথে নিয়ে আসতো সে।

অরিনের ফ্যাসফ্যাসে কান্নার শব্দ শুনে শাওন অরিনের দিকে তাকালো৷ অরিনের কান্না দেখে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো তাঁর। বলল,”অরিন কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?” অরিন চোখটা মুছে বলল,”কিছু না ভাইয়া। ভেবেছিলাম মা তোমাদের সাথে আসবে। কতদিন হলো মাকে দেখিনা। যেতে চাইলেও কেউ যেতে দেয়না। এবার আপনারা যাওয়ার সময় উনাকে বলে আপনাদের সাথে নিয়ে যাবেন প্লিজ। এক সপ্তাহ থেকেই চলে আসবো। আসলে মাকে ছাড়া কখনো কোথাও এতোদিন থাকিনি তো,,,,,,।” আর কিছু বলতে পারলো না অরিন। আবার তাঁর কান্না চলে এসেছে। শাওন বলল, “কেঁদো না অরিন। আমি নিয়ে যাবো তোমাকে সাথে করে।” দিলারা চৌধুরী মাত্র রুমে ঢুকেছিলেন। শাওনের কথা শুনে উনার পা থেমে যায়। উনি দ্রুত সরে দরজার আড়ালে দাঁড়ান। অরিন কেঁদে কেঁদে হাসছে। কি যেন একটা বলছে কিন্তু দিলারা চৌধুরী শুনতে পারছেন না। তবে উনার মনে হচ্ছে অরিন শাওনকে বলছে,” সত্যি বলছেন আমাকে নিয়ে যাবেন?” শাওন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই অরিন শাওনকে জড়িয়ে ধরে। দিলারা চৌধুরী ৪৪০ ভোল্টের শকড খেলেন। এটা কি দেখছেন তিনি, অরিন পরকিয়া করে? দিলারা চৌধুরী আশে পাশে তাকিয়ে দেখলেন কাউকে দেখা যায় কিনা। স্বাক্ষী হিসাবে দৃশ্যটা কাউকে দেখানো খুব প্রয়োজন কাউকে দেখতে না পেয়ে শান্তি চৌধুরীর রুমের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।

অরিন এভাবে জড়িয়ে ধরায় শাওনের দম আটকে আসছে। যদিও জানে অরিন তাকে ভাই মনে করে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে তবুও তো এটা সত্যি সে অরিনকে ভালোবাসে। শাওন দু কয়েক ঢোক গিলে নিজেকে সামলে বলল,”অ অ অরিন চা ঠা ঠা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।” অরিন শাওনকে ছেড়ে দেয়। চায়ের কাপ শাওনের হাতে তুলে দিতে দিতে বলে,”উপরওয়ালা আমাকে ভাই দেয়নি তো কি হয়েছে? আপনি তো আছেন।”শাওন ম্লান হেসে চায়ে চুমুক দিলো। অরিনের ফোন বেজে উঠতেই সে উঠে রুমে চলে গেলো।

এদিকে দিলারা চৌধুরী শান্তি চৌধুরীকে না পেয়ে ফোন নিয়ে আসলেন। কিন্তু এসে দেখলেন অরিন নাই চলে গেছে। উনার নিজের উপর খুব রাগ হলো। কোনো স্বাক্ষী বা প্রমাণ ছাড়া এটা কাউকে বলে ওতো লাভ নেই। শান্তি চৌধুরীকে না খুঁজে আগে কেন ফোন নিয়ে আসলেন না? তখন তো এসে অরিনকে পেতেন। আর একটা ছবিও তুলতে পারতেন। নিজেকে নিজে বকতে বকতে চলে গেলেন তিনি।

_______________________________________

গতকাল ছিলো পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের আড্ডায় ঝাঁকে ঝাঁকে রাস্তায় নেমেছিলো বসন্ত প্রেমিরা। বাইরে দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিলো কেউ বুঝি বাড়িতে থাকেনি সবাই বাইরে চলে এসেছে। তবে চারদিকে এতো আড্ডা থাকার পরেও শান্তি নীড়ের কোনো ছেলে মেয়ে কাল বসন্তের আড্ডা জমাতে বাইরে বেরয়নি। তাঁরা সবাই শপিংয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলো। সবাই বলতে মিহান,দিশা,ইশি ও নীল। লুপা রুহান আর দিয়া যায়নি। তিনজনেরই একটা কথা, তাদের মন ভালো নেই। দিশারা সবাই ভেবে রেখেছিলো সন্ধ্যায় একটু বসন্ত মেলায় যাবে। কিন্তু বাসায় ফিরে সবাই টায়ার্ড হয়ে যায় তাই আর যাওয়া হয়নি। আজ তাঁরা যাবে। রাত আটটার দিকে ইশি আর দিশা গিয়ে মিহানের কাছে বায়না ধরে সে বাইরে ঘুরতে যাবে কেন জানি মিহান এক কথাতেই রাজি হয়ে যায়। মিহান নীল ও শাওনকে জোর করে সাথে নেয়। সবার জোরাজোরিতে লুপাও সাথে যায়। সবাই বের হওয়ার আগে লুপা অরিনকে বলে,”ভাবি তুমিও আমাদের সাথে চলো না।” অরিন শান্তি চৌধুরীর দিকে তাকায়। শায়লা চৌধুরী লুপাকে বলেন, “তোরা ঘরের মেয়ে ও ঘরের বউ। সংসারের কাজ ফেলে ঘরের বউদের ঘুরাঘুরি মানায় না। তোরা যা।” শায়লা চৌধুরীর লুপা কথা বাড়ালো না।

৮:৩০ দিকে শাওন নীল বের হলো। তারপর বের হলো লুপা। হলুদ রংয়ের শাড়ী চুড়ি পরা ইশি দিশাও বাসা থেকে বের হলো। তাঁদের সাথে মিহানও আছে। মিহান কালো রংয়ের একটা পাঞ্জাবী পড়েছে। পাঞ্জাবীর হাত ফোল্ড করে কনুই পর্যন্ত তুলে রাখা। তাঁর ফর্সা গায়ে কালো পাঞ্জাবী। সিক্সপ্যাক বডি হওয়ায় আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে৷ সাথে তাঁর পাগল করার মতো গজ দাঁতের হাসি তো আছেই। শাওন সাদা টিশার্ট পরে একটা কালো লেদার জ্যাকেট পরেছে। নীল সবুজ রঙের একটি টিশার্ট তার উপরে বাদামী রঙের একটি লেদার জ্যাকেট পরেছে। লুপা বেগুনি রঙের স্কার্ট পরেছে। সে সবার থেকে আলাদা হয়ে হাঁটছে। কারো সাথে মিশছে না। মিহান দিশা ইশি সবার আগে আগে হাঁটছে তারপর শাওন ও নীল সবার শেষে হচ্ছে লুপা। ইশি গাঁধা ফুলের ছোট একটা মালা মাথায় বাঁধলো। হলুদ শাড়ীতে তাকে অনেক সুন্দর লাগছে। এভাবে মাথায় ফুল বাঁধায় একদম পরী পরী মনে হচ্ছে। ইশি মিহানের দিকে একবার তাকালো তাঁর দিকে তাকাচ্ছে কিনা দেখতে, কিন্তু মিহান তাঁর দিকে তাকাচ্ছেই না। ইশির রাগ হলো। একবার তাকালে কি এমন হয়ে যাবে? সে কি সুন্দরী নয়? মানুষ কী চাচাতো বোনের উপর ক্রাশ খায়না? এই ছেলেটা এতো নিরামিষ কেন? নিজের মনে চলা প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারল মিহানের উপর। কনুই দিয়ে মিহানের পেটে গুতো দিয়ে ডাক দিলো,”মিহান ভাই।
মিহান ভাবলেশহীন থেকে জবাব দেয়”
_হা।
_দেখ তো আমায় কেমন লাগছে?” মিহান একবার তাকিয়ে বলল,”
_ভালোই।
_অহ।” ইশির মুখটা কালো হয়ে যায়। মিহান সব সময় ছোট ছোট শব্দে তাঁর সাথে কথা বলে। এমন কেন সে? কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা মুখ গোমড়া করলে বেশি সুন্দর লাগে ইশিকেও তা লাগছে। দিশার খুব হিংসা হলো। দিশা হিংসা করে বলল,”এই মাথায় এটা কি লাগিয়েছিস? কি বিশ্রী লাগছে খুলতো।” ইশি এমনিতেই রেগে ছিলো দিশা এটা বলতেই মাথা থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। সাথে সাথেই দিশা ওটা হাতে তুলে নেয়। ইশি এটা দেখে কিন্তু কিছু বলেনা। তাঁর খুব রাগ হচ্ছে। যাকে দেখানোর জন্য পরলো তার কাছে কিনা শুধু ভালোই লাগছে। সুন্দর লাগছে বললে ওতো কিছুটা শান্তি পেতো সে। মিহান ইশির দিকে তাকিয়ে মাথায় ফুল নাই দেখে বলল,”কিরে ওটা খুলে দিলি কেন? সুন্দর লাগছিলো তো।” ইশি প্রফুল্ল হয়ে বলে,”সত্যি?
_হুম। সত্যি সুন্দর লাগছিলো।”
ইশি খুব খুশি হয়। সে তৎক্ষণাৎ দিশাকে বলল,”ওই ওটা দে।
_দিবো মানে এটা কি তোর?
_ দিশা ফাজলামো করিস না দে।
_দেখ তুই ফেলে দিয়েছিস আমি খুঁড়ে নিয়েছি। হিসাব বরাবর এটা এখন আমার।” ইশি মালাটায় ধরে টান দেয় দিশা ছাড়েনা। টানাটানির এক পর্যায়ে মালা ছিঁড়ে যায়। দুএকটা ফুল মলে গেছে। দুজনের ঝগড়া দেখে মিহান ইশিকে বলে,”ওই ইশি ছাড় তো মেলায় গিয়ে তোকে কিনে দিবো।”মিহানের কথায় ইশি থেমে গেলো। কিন্তু চোখে দিয়ে দিশাকে গিলে খায়৷ দিশা এসবে পাত্তা না দিয়ে তাঁর বত্রিশপাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে পিছন ঘুরে হেঁটে শাওনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শাওন দাঁড়িয়ে যায়, কিন্তু নীল দাঁড়ায় না সে হাঁটতে থাকে। শাওন ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি?”
_আমার মাথায় এটা বেঁধে দিবে প্লিজ? আমি ইশিকে বলেছিলাম ও বাঁধতে পারেনা।
_দেখে তো মনে হয়েছে তুই ইশির সাথে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করেছিস।
_ওই তো মাথায় বেঁধে দেয়না বলে ঝগড়া করেছিলাম।
_আচ্ছা দে।” দিশা শাওনের হাতে দিলো। শাওন দিশার মাথায় ফুল বাঁধতে লাগে। নীল ইশিকে বলে,”পিছন তাকিয়ে দেখ।” ইশি পিছন তাকিয়ে দেখলো শাওন দিশার মাথায় ফুল বেঁধে দিচ্ছে। ইশি বলল “যাক তাহলে ওরা ঝগড়া ছাড়াও ভালো ভাবে চলতে পারে।” ইশির কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই টাস করে একটা শব্দ আসলো। ইশি দিশা মিহান লুপা তৎক্ষণাৎ পিছন ঘুরে তাকায়। শাওন হাত উল্টে পিঠে দিয়ে বিস্ময়কর চোখে দিশার দিকে তাকিয়ে আছে। দিশাও কোমরে হাত দিয়ে লাগি লুকে তাকিয়ে আছে। শাওন ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,”ওই মারলি কেন?
_তুই এটা ছিঁড়লি কেন?
_ওটা তো আগে থেকেই ছেঁড়া ছিলো।
_একদিকে ছেঁড়া ছিলো তুই তো তিন ভাগ করে দিয়েছিস।
_তুই এতো ঠুনকো সুতার মালা কিনিস কেন? টান দিলেই ছিঁড়ে যায়।
_তুই ওটা ইচ্ছে করে ছিঁড়েছিস।
_ছিঁড়েছি বেশ করেছি।
_আমিও মেরেছি বেশ করেছি। বাদর একটা।
_আমি বাদর? তুই কী? জানিস এই শাড়ীতে তোকে কেমন লাগছে? কামলা বেডি ছিনস? কামলা বেডি লাগতাছে।
_আর তোকে কোন রাজপুত্র লাগছে রে? স্পেশালি আজ একদম কালা কুত্তা লাগছে। বাদরের মতো চেহারা নিয়ে অন্যের রূপ বিচার করতে আসে। হুহ্।” মিহান ওদের ঝগড়া দেখে বলল,”ওই তোরা থাক আমরা যাচ্ছি।” দিশা বলল,”এই ডাফারের সাথে আমি থাকবো? ইম্পসিবল। নিয়ে যা এই ইডিয়টকে।
_তোর মতো শাকচুন্নির সাথে কে থাকতে চায় রে? সুযোগ পেলেই সৎ ব্যবহার করিস। মুটকি একটা।” কথাটা বলেই শাওন চলে গেলো। দিশা চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো। এটা কি বলে গেলো শাওন? সেদিন গাড়ির ঘটনাটা ইঙ্গিত করেনি তো? লজ্জায় দিশার মাথা কাটা যাচ্ছে। শাওন গিয়ে মিহানের পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো। দিশা আস্তে আস্তে হাঁটছে কেন জানি লজ্জায় তাঁর শাওনের সামনে যেতে সাহস হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে মেলায় পৌঁছে যায় সবাই। ইশি দিশা অনেক আনন্দ করছে দুজনই অনেককিছু কেনাকাটা করল। কিন্তু লুপার মাঝে কোনো আনন্দ নেই। না সে কিছু কেনাকাটা করছে। চুপচাপ একটা দোকানের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকল। মিহান দুটো আইসক্রিম কিনে লুপা পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গলা খাঁকারি দিতেই লুপা চমকে উঠে। মিহান অবাক হয়। এতো এতো মানুষের ভীরে হইচইপূর্ণ পরিবেশে লুপা সাধারণ গলা খাঁকারিতে চমকে উঠলো, সে কি অন্যমনস্ক ছিলো? লুপা মিহানের হাতে আইসক্রিম দেখে অন্যদিনের মতো লাফিয়ে উঠলো না। শুধু একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মিহান লুপাকে বলল,”কি রে ধানিলংকা আইসক্রিম খাবিনা?” লুপা শুধু না সূচক মাথা নাড়ালো। মিহান একটা বেঞ্চে বসে লুপাকে পাশে বসালো তারপর বলল,”তোর কি হয়েছে?
_কিছু না ভাইয়া।” লুপার গলাটা অন্যরকম লাগছে। মিহান বলল ”
_এভাবে মন খারাপ করে আছিস কেন?
_আমার ভালো লাগছে না আমি বাসায় চলে যাবো।
_মন খারাপ?
_এমনিই। মাথা ব্যথা করছে।
_খুব বেশি?
_হুম।” মিহান আইসক্রিম দুটো লুপার হাতে দিয়ে লুপাকে নিয়ে ইশির আর দিশার কাছে গিয়ে বলল,”শুন আমি চলে যাচ্ছি ওকে নিয়ে। তোরা পরে যাস।” ইশি বলল,
_কেন কি হয়েছে ওর?
_তেমন কিছু হয়নি। ওর মাথা ব্যথা করছে।
_তাহলে ও চলে যাক তুই কেন যাবি?
_রাতের বেলা ওকে আমি একা ছাড়বো?” শাওন বলল,”নীলের ও তো ভালো লাগছে না বলছে। তাহলে নীল লুপাকে নিয়ে বাসায় চলে যাক আমরা একটু পরে যাই।” নীলের নাম উঠতেই লুপা বলল,”
_আমি একা যেতো পারবো।
_মিহান বলল,”একা কেন যাবি আমি যাবো তো।
_ইশি অনুরোধের স্বরে বলল,”তুই যাবি না ভাইয়া প্লিজ। নীল তো চলে যাবে ও নীলের সাথে চলে যাক। সমস্যা কি?
মিহান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,”
_ঠিক আছে তাহলে তুই নীলের সাথে চলে যা লুপা।
_না ভাইয়া থাক আমি তোমাদের সাথেই যাবো।
_মাথা ব্যথার মাঝে এখানে থাকবি? পরে অসুস্থ হলে আব্বু আমায় বেঁধে পিটাবে। তুই যা। ওই নীল ওকে নিয়ে তারাতাড়ি যা তো।”

বাধ্য হয়ে লুপাকে নীলের সাথে যেতে হলো। লুপা সাথে যাচ্ছে দেখে নীলের মনে লাড্ডু ফুটলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে মেলার গেট ফেরিয়ে চলে আসে তাঁরা। লুপা মুখটা বিষন্ন করে রাখছে। আর ওর এই বিষন্ন মুখটা দেখে নীলের কলিজা বার বার মুচড় দিয়ে উঠছে। ততবারই মনে পড়ছে তার পরিবারের করা অন্যায়গুলা তাঁর করা অন্যায়গুলো। লুপার সাথে এতো এতো অন্যায় হয়েছে যে নীলের ক্ষমা চাইতেও লজ্জা লাগে। চুপচাপ রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলছে দুজন৷ দুজনেরই মুখে কোনো রা নেই। কিছু জায়গা হেঁটে এসে নীল লুপাকে বলল,”রিকশা নিবো?” লুপা কিছু বলল না। সে তাঁর মতো হেঁটে গেলো। নীল লুপার হাত ধরে দাঁড় করায়। লুপা নড়েনা। অন্যদিনের মতো হাত ছাড়াতে ছটফট করেনা। লুপার এই নিরব থাকাটা নীলকে খুব পুড়ায়। নীল লুপার দুগাল ধরে ধরা গলায় বলল,”সরি তো বাবুই। মাফ করে দে প্লিজ। আমি জানতাম না লুপা তুই এসব আম্মুর জন্য করছিস।”
লুপা নীলের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। নীলের কথা শুনে সে একটুও অবাক হলো না। কাল তাঁর ফুপি ফোন করে বলেছেন নীল নাকি সব জেনে গেছে তাই সে বাসা থেকে রাগ করে বেরিয়ে গেছে। লুপা জিজ্ঞেস করেছিলো নীল কেমনে জানলো। উত্তরে তিনি বলেছেন “জানিনা৷”

নীল আবার বলল,”আমি কি করতাম বল? তুই তো আমায় বাধ্য করেছিলি তোকে ভুল বুঝতে। হ্যাঁ আমি যা করেছি সীমাহীন করে ফেলেছি। কিন্তু কি করতাম বল? আমার যে সয্য হতো না তোকে অন্য কারো সাথে দেখলে। দে না ক্ষমা করে বাবুই প্লিজ। নে না একবার বুকে টেনে। আমি কার কাছে যাবো বল? আম্মু বুঝেনা আব্বু বুঝেনা দাদী বুঝেনা ফুপি বুঝেনা এখন তুই বুঝিস না। কেউ কি আমাকে বুঝবিনা? সবাই কষ্ট দিবি? একটু কথা বলনা। প্লিজ বাবু।” নীলের গলা ভেজা শুনাচ্ছে। লুপা চোখ তুলে উপরে তাকালো৷ নীলের চোখে পানি,সে কাঁদছে। লুপা ভেতরটা হু হু করে উঠলো। নীলের চোখের পানি এতো কষ্ট দিচ্ছে কেন তাকে? ইচ্ছে করছে নীলকে বুকে চেপে শক্ত করে ধরে বলতে, আমি আছি। কেউ তোমায় কষ্ট দিবেনা আর। নীলের চোখের পানিটা বুকটা পুড়িয়ে দিলো,কিন্তু অভিমানের ভারি পাথরটা বুক থেকে নামলো না৷ খুব অভিমান জমেছে নীলের প্রতি৷ কেমন ভালোবাসা নীল তাকে বাসলো যে তাঁর চোখের পানিটা দেখে বুঝতে পারলো না সে নীলকে পাগলের মতো চায়। এতটা ঘৃণা তো লুপা চায়নি যে এতো এতো মানুষের সামনে তাকে অপমান করবে? ভালোবাসার মানুষকে কি অপমান করা যায়? কখনো কেন নীল তাকে প্রশ্ন করেনি, লুপা আমি ছুঁয়ে দিলে তোর চোখে ভিজে আসে কেন? কখনো কেন জানতে চায়নি, লুপা তুই কেন আমার দেওয়া ধিক্কার গুলা হজম করে নিস। নীল কেন তাঁর বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার কারণে লুপাকে দোষারোপ করবে? এতোই কি চেয়েছিলো সে মেয়েটাকে? লুপার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো৷ নীল লুপার কপালে কপাল ঠেকে ক্ষীণ করে বলল,”সরি বললাম তো বাবুই। আর কত রাগ করে থাকবি বল? তুই আম্মুর কথা ভাবলি অথচ একবার ভাবলি না আমি কিভাবে থাকবো তোকে ছাড়া।
_ভালোই তো ছিলে।”কান্নাজড়িত গলায় বলল লুপা। নীল লুপার মুখের দিকে জিজ্ঞাসুক চোখে তাকাল। লুপা বলল,”খুব কষ্ট পেয়েছো তাইনা? বিয়েটা ভেঙে গেছিলো বলে। হ্যাঁ কষ্টই তো পেয়েছো৷ না পেলে কি আমাকে দোষারোপ করতে?
_ওটা তো রাগ ছিলো বাবুই। আমি তো শুধু রাগ ঝাড়তে চেয়েছিলাম।” লুপা তাচ্ছিল্য হেসে নীলের হাত ছাড়িয়ে হাঁটা ধরে। নীল হেঁচকা টানে লুপাকে নিজের দিকে ঘুরায়। লুপা কাঁদছে। নীল বলল,”তুই নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস। এমনটা করে কি পাচ্ছিস বল? আমার পরিবারের ভুলের জন্য আমি তোর দুটি পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো। তবুও আর রাগ করে থাকিস না প্লিজ। ক্ষমা করে দে আমায়।
_ছাড় আমায় প্লিজ।” লুপা নীলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে হাঁটা ধরলো৷ নীল দৌড়ে গিয়ে খপ করে লুপার হাত ধরে বলল,”দেখ ভালোই ভালোই বলছি কথা শুন। নয়তো খুব খারাপ হবে।
_হুমকি দিচ্ছো? ভেবেছো তোমার হুমকিতে আমি ভয় পাবো? কখনোই না।” লুপা ঝাড়া দিয়ে নীলের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে আবার হাঁটা ধরে। নীল দৌড়ে গিয়ে লুপার সামনে দাঁড়ালো। চারদিকে তাকিয়ে লুপা কিছু বুঝে উঠার আগেই চট করে লুপার ওষ্ঠযুগল দখল করে নিলো। লুপার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। লুপা ছটফট করে নিজেকে ছাড়াতে। নীল এসব কি করছে? আসে পাশে মানুষজন দেখলে কি ভাব্বে? নীল ছাড়েনা। এক সময় লুপার ছটফটানি থেমে যায়। ঘোর লেগে যায় নীলের জন্য পাগল হয়ে থাকা মনে। অবাধ্য হয়ে যায় তাঁর মনের অনুভূতি গুলো। সেও যোগ দেয় নীলের সাথে প্রেম প্রেম খেলায়। তারও হুস হারিয়ে যায় আশপাশের লোকজন দেখলে কি ভাব্বে ভাবেনা সে। বেশ কিছুটা সময় পরে রাস্তা দিয়ে যাওয়া গাড়ির হর্ণে কেঁপে ওঠে দুজন। চট করে দুজন দুজনকে ছেড়ে দেয়। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো অনেক গুলা তীক্ষ্ণ, ঘৃণিত দৃষ্টি এসে তাঁদের উপর পরছে। নীল লুপার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। লুপা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। না চাইতেও নীলের সাথে ডুব দিয়ে ফেলেছে এখন লজ্জা লাগছে। সেই প্রথম ডুব দেওয়ার পরে যে লজ্জা লাগছিলো সেই লজ্জাটা লাগছে। অনুভূতিটা নতুন হয়ে এসে মনের ঘরে ঝড় তুলছে। হঠাৎ লুপার লজ্জা ফুটা চেহারায় আঁধার নেমে আসলো৷ অভিমানের পাথর আবারও মনের ঘরটা চেপে ধরলো। অনুভূতি গুলা উড়ে গেলো সব। নীল বলল, “রিকশা ডাকি?” লুপা কিছু না বলে হাঁটা ধরলো নীল ধরতে গেলে লুপা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “ছুঁবে না আমায়। আমি হেঁটে যেতে পারবো।” বলেই লুপা হাঁটা ধরলো। নীল আর জোর করলো না লুপার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। লুপা আজ তাকে সারা দিয়েছে মানে লুপা আজও তাকে চায়। আজও অনুভূতি গুলা আগের মতোই আছে। শুধু অভিমানী হয়ে গেছে তাঁর অবুঝপাখিটা। পিছু লাগতে লাগতে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিবে সে।

__________________________

অরিনের মনটা আজ অনেক খারাপ। সারাদিন থেকে দিহান অরিনকে ফোন দিচ্ছেনা। মেসেজ সিন করছে কিন্তু রিপ্লাই দিচ্ছেনা। কাল রাত থেকে দিহান এমন করছে। রাতে যখন কথা হলো দিহান পাঁচ মিনিট কথা বলেই ফোন কেটে দিলো। এই পাঁচ মিনিট তাদের মধ্যে তেমন কথা হয়নি শুধু দিহান। আসবে না এটাই বলল। আগামীকাল জিহান আসবে ভেবেছিলো সাথে তাঁর স্বামীও আসবে। কিন্তু সে নাকি আসবে না। অরিন অনেক করে বলল দিহান বলছে তাঁর পক্ষে আসা নাকি সম্ভব নয়। সুমনা চৌধুরীও অনেকবার রিকুয়েষ্ট করেছেন কিন্তু দিহান আসবে না। অরিনের কাঁদতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করে কি এমন হলো দিহানের কি এমন করে ফেলল সে যে এমন করছে? দিহান তো তাঁর সাথে কথা না বলে থাকতে পারেনা তাহলে আজ থাকছে কেমনে?আজ সকালে সে রুম ঝাড়ু দিচ্ছিলো তখন তাঁর শ্বশুর এসে বলে গেলেন সে যেন কোনো কাজে হাত না দেয়। তারপর আরেকবার এসে অরিন মা বলে ডাকলেন। আজ প্রথম উনি অরিনের সাথে কথা বললেন তাও অরিন মা বলে ডাকলেন। এর থেকে খুশি আর কি হতে পারে? তবুও এই খুশি তাকে হাসাচ্ছে না। শুধু কাঁদিয়ে যাচ্ছে তাঁর স্বামীর এক চিমটি অবহেলায়।

চলবে,,,,

দাদুমনির সামনে থেকে সরতে পারিনা সরে গেলেই কান্নাকাটি শুরু করে দেন। উনার সামনে থাকলে লেখতে পারিনা। উনাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে হয়। উনি যখন ঘুমান তখন লিখি। মাঝে মাঝে তখন আমার কাজও থাকে। একটু একটু করে লেখে দুদিনে এক পর্ব হয়। তাই মাঝে একদিন গ্যাপ যায়। আশা করি আপনারা আমার সমস্যাটা বুঝবেন। গঠন মূলক মন্তব্য আশা করছি❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here