ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু❤ পর্ব_৩

0
1660

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু❤
পর্ব_৩
#সুলতানা_সিমা

কোয়াশার চাদরে মোড়ানো শীতের সকাল। চারদিকে শীতল বাতাস বইছে। কাঁচা রাস্তায় খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সাদা শাড়ি পরিহিতা অরিন। গায়ে কোনো শাল বা সোয়েটার নেই। শাড়ির আঁচলটা গায়ে পেচিয়ে হাত কাচুমাচু করে রাখছে। শীতল বাতাসের ছুঁয়ায় কাঁপছে সে। আর মনে মনে বকে যাচ্ছে তাদের পাশের ঘরের বৃদ্ধা মহিলাকে। অসুস্থ হলেই খাটে শুয়ে শুয়ে “অরিন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আয় বইন,অরিন অষুধ নিয়ে আয় বইন, বলে ঘ্যানঘ্যান করেন। যা শুনে অরিন হাত পা গুটিয়ে থাকতে পারেনা। মহিলাটার নাম আমিরুন নেছা। আপন বলতে কেউ নেই উনার। এক ছেলে ছিলো ডাক্তার বাড়িতে কাজ করতো। কিছুদিন আগে মারা গেছেন। মারা গেছেন নাকি মারা হয়েছে সেটা অবশ্য কেউ জানেনা। দুদিন নিখোঁজ থাকার পরে একদিন সকালে উনার বাড়ির পাশে উনার মৃত দেহ পাওয়া গেছিলো। পুলিশ এসেছিলো, তদন্ত করে কোনো তথ্য না পেয়ে বিষয়টা ছেড়ে দেয়। ছেড়ে নাকি কেউ টাকা দিয়ে চাপা দিয়েছে কে জানে।

আজ আমিরুন নেছা খুব অসুস্থ। রাতে হঠাৎ করে উনার শরীর খারাপ হয়ে গেছে। গা ঝাকিয়ে জ্বর এসেছে। উনার জন্যই সকাল বেলা ডাক্তার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে সে। প্রতিবারই উনার জন্য অরিনকে এভাবে ছুটতে হয়। অরিনের সৎ মা জহুরা বেগম এ নিয়ে তাঁকে অনেকবার বকাঝকা করেছেন। কিন্তু অরিন এসবে কান দেয়না। উনার অভ্যাসই এমন। অরিনকে আদর করেন ঠিকি, কিন্তু অরিনকে কারো সাথে মিশতে দেননা। কেন দেননা সেটা জানা নেই তাঁর। অরিনের মাঝে মাঝে খুব গর্ব হয় তাঁর সৎ মাকে নিয়ে। আবার মাঝে মাঝে উনার উপরে তাঁর প্রচন্ড রাগ হয়। উনি হচ্ছেন অরিনের বাবার ফুফুতো বোন তাঁর মা মারা যাওয়ার পরে, উনাকে বিয়ে করেছিলেন। ছোট বেলা থেকেই অরিনকে ভালোবাসেন তিনি। কিন্তু অরিনের মামাদের খালাদের কাউকেই উনি দেখতে পারেন না। উনারা এখানে আসলে তিনি উনাদের কদর করেন না। কেন করেন না সেটা জানা নেই অরিনের। তবে তাঁর মনটা খুব জানতে চায় এসব। অরিনের বাবা মারা গেছেন এক বছর হলো। তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পরে তাঁরা জানতে পারে তাঁর বাবার নামে কোনো সম্পত্তি নেই। সব নাকি অরিনের চাচার নামে আছে। সেই থেকে আজ এক বছর হলো তাঁর চাচি অরিনদের কাজের লোকদের চোখে দেখেন। মাঝে মাঝে অরিনকে মারতেও চান। কিন্তু অরিনের সৎ মায়ের জন্য পারেন না। অরিনের উপর তাঁর চাচির এতো রাগেরও একটা কারণ আছে। কথাগুলা ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটায় মন দিলো অরিন।

ডাক্তার বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে অরিন। এই বাড়িকে ডাক্তার বাড়ি বলা হয় কারণ, যখন মানুষের লেখাপড়ার হার খুব কম ছিলো। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। চিকিৎসার জন্য দূর দূরান্তে যেতে হতো। তখন এই বাড়ির মালিক ছিলেন ডাক্তার। বিনামূল্যে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করতেন। শহরে লেখাপড়া করে উনার ছেলেও ডাক্তার হয়। এখন উনার নাতি মেডিকেল কলেজে পড়ছে। গ্রামের মানুষদের টুকটাক চিকিৎসা সে করে। তবে কারও থেকে টাকা নেয়না। এসব থেকেই তাদের বাড়িটা উপাধি পেয়েছে ডাক্তার বাড়ি।

বাড়ির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অরিনের পা পিছলে যায়। গাছের একটা ডাল ধরে আটকায় নিজেকে। ঘাসের উপর পা ঘষে পায়ে লেগে যাওয়া কাঁদা ছাড়াতে ছাড়াতে গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বারকে বকতে লাগে। এই টুকু রাস্তা কাঁচা, এটা পাকা করে রাখলে কি এমন হয়? এই গ্রামটার নাম তমালপুর। অরিন এই গ্রামেরই মেয়ে। নিজের গ্রাম নিয়ে খুব একটা গর্ব হয়না তাঁর।

হাঁটতে হাঁটতে ডাক্তার বাড়ি এসে গেলো অরিন। দোতলার একটা বাড়ি। বাড়ির চারদিকে ফুল ফল কত রকমের গাছ। উঠুনটাও অনেক বড়। গেট খুলে ভিতরে ঢুকে দেখল বাড়ির বড় বউ উঠুনে চেয়ারে বসে বসে বই পড়ছেন। ছোট একটা টেবিল চারটে চেয়ার। টেবিলের উপর চায়ের কাপ রাখা। এই বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকলে অরিনের মনে হয় সে শহরে আছে। কোনো বড়সড় প্রাসাদের ভিতর আছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মহিলাটার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। শায়লা বেগম বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন। অরিনকে দেখে আবার বইয়ের দিকে তাকিয়ে পৃষ্টা উল্টাতে উল্টাতে বললেন,”কোনো দরকারে এসেছো?” অরিন মনে মনে হাসলো। মানুষ একটু বড়লোক হলেই গরিবদের মানুষ বলে মনে করেনা। সালামের উত্তরটাও তিনি দেননি। আর গরিবরা তো ধনীদের কাছে দরকার ছাড়া আসবে না। ধনীদের বাড়িতে ঘুরতে আসার কপাল নাই তাদের।

শায়লা বেগম আবার বললেন,”কী ব্যাপার কিছু বলছো না যে?”
_চাচি শাওন ভাইয়া বাড়িতে আছেন?
_কেন?
_দাদী অসুস্থ। মানে আলাউদ্দিন চাচার মা।
_তুমি দাঁড়াও আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।” বলেই হাতে বই আর চায়ের কাপটা নিয়ে চলে গেলেন তিনি। অরিন দাঁড়িয়ে থাকল। বরই গাছে ছোট ছোট বরই ধরেছে। যতটা পাতা ততটাই বরই। চারদিকে শুধু ফল আর ফলের গাছ। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাছ দেখে যাচ্ছিলো অরিন। তখন শাওন বেরিয়ে আসলো সদর দরজা থেকে। সাথে একটা ছেলে। লম্বা ফর্সা নিয়ে বেশ সুন্দর দেখতে। গলায় ঝুলানো একটা ক্যামেরা। তবে দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা এই গ্রামের না। অরিনের কাছে খুব চেনা চেনা লাগছে ছেলেটাকে। কোথায় যেন দেখেছে।

শাওন অরিনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,” কী ব্যাপার অরিন কেমন আছো?”
_ জ্বী ভাইয়া। আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
_কোনো সমস্যা?
_জ্বি। দাদী আবার অসুস্থ হয়ে গেছেন,আপনি যদি আসতেন।
_কী হইছে?
_খুব জ্বর।
_আচ্ছা তুমি দাঁড়াও আমি সবকিছু নিয়ে আসছি।

শাওন চলে গেলো ভিতরে। শাওনের পাশে থাকা ছেলেটা একবারও অরিনের দিকে তাকায়নি। সে তাঁর ক্যামেরা নিয়েই ব্যস্ত। গাছে দুইটা কাক বসেছে। এগুলার ছবি তুলার জন্য ছেলেটা হাঁটু গেড়ে বসলো। অরিনের হাসি পাচ্ছে ছেলেটার এমন কান্ডে। কাকের মতো বিরক্তিকর একটা পাখির ছবি তুলতে এতো কষ্ট করছে।

অরিন ছেলেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিতে লাগলো। নীল রংয়ের একটা জ্যাকেট পরেছে। সাথে কালো রংয়ের জিন্স। হাতে কালো একটা ঘড়ি। জ্যাকেটের হাত একটু তুলে রাখছে বলে ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে। ফর্সা হাতে ঘড়িটা আগলে আছে। সামনের দু’তিন গুচ্ছ চুল ব্রাউন কালার। সরু নাক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। অরিন চোখ ফিরিয়ে নিলো। এই ছেলেটাকে কোথায় দেখেছে সে মনে করতে পারছে না। কোনোকিছু মনে করতে চেষ্টা করে মনে করতে না পারলে মাথা ভনভন করে। অরিনেরও তাই হচ্ছে। অরিন ছেলেটার দিকে আবার তাকালো। ছেলেটা এবার অরিনের দিকে ঘুরে আছে। যার কারণে খুব ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে তাকে। একটু তাকিয়ে থাকতেই অরিনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। এটা তো সেই ছেলে যার সাথে একমাস আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিলো। অরিনের মাথা ঘুরে উঠল। এই ছেলে এখানে কী করছে? তাও ডাক্তার বাড়িতে। অরিন শুকনো একটা ঢোক গিলল। ততক্ষণে শাওন চলে আসলো।

শাওন এসে বললো,”সরি একটু দেরি হয়ে গেছে। চলো।” শাওনের কথায় চমকে ওঠে অরিন। একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। শাওন দিহানকে ডাক দিয়ে বলল,”কিরে দিহান যাবি আমার সাথে?” দিহান ক্যামেরার দিকেই তাকিয়ে জবাব দিলো,
_তুই কই যাবি?
_এইতো ওর সাথে ওদের বাড়িতে।” দিহান এবার চোখ তুলে অরিনের দিকে তাকালো। এক পলক দেখে চোখ নামিয়ে সাথে সাথে আবার তাকাল। মুখের ভঙ্গিটা এমন যেন সে বড়সড় শকড খেয়েছে। এভাবে তাকানোতে অরিনের একটু অস্বস্তি লাগছে। শাওন দিহানকে কিঞ্চিৎ ধমকের গলায় বলল,”ওই দিহান।” দিহান চোখ নামিয়ে নেয়। তাকে বিচলিত লাগছে। শাওন বলল,”যাবিনা নাকি?
_তুই যা আমার ইচ্ছে করছে না। আমি পরে তোকে নিয়ে গ্রাম ঘুরবো।
_তাহলে চলে আয়। আসার সময় ঘুরে আসবো।
_ঠিক আছে চল।

শাওন দিহান অরিনের সাথে চলল। অরিন আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে। দিহান অরিনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছে। তাঁর মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে। এই মেয়েটার সাথে তো তাঁর বিয়ে হয়েছিলো। এই জায়গায় এই মেয়ে কী করে? এটা কী তাঁর স্বামীর বাড়ি নাকি বাপের বাড়ি? আর সাদা শাড়ি কেন? দিহানের আবার নিজের উপর রাগ হলো। বার বার এই সাদা কাপড় নিয়ে প্রশ্ন কেন আসে তাঁর মাথায়। মনটা খারাপ হয়ে এলো তাঁর। নিজেকে স্বাভাবিক করতে ছবি তোলায় মন দিলো। চারদিক দেখছে আর ছবি তুলে যাচ্ছে। রাস্তার ছবি তুলতে গিয়ে দিহানের ক্যামেরায় অরিনের পা উঠে। শিশিরে ভিজে যাওয়া পা টা অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এই ঠান্ডার মাঝে জুতা পায়ে নেই দেখে দিহান বলে উঠে,

“হেই হোয়াইট শাড়ি আপনার পায়ে জুতো নাই কেন?” অরিন থেমে গেলো। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে দিহানের দিকে তাকিয়ে আবার হাঁটা ধরলো। কিছুই বলল না। শাওন দিহানকে ইশারায় ধমক দিলো। দিহান বলে উঠে, “ধমক দিচ্ছিস কেন? আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করলাম জুতা নাই কেন।”
_আসার সময় ছিঁড়ে গেছে।” কথাটা বলে অরিন হাঁটার গতি বাড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। দিহান কিছু বলল না। কয়েকটা পাঁতি হাঁস প্যাক প্যাক করে হেঁটে যাচ্ছে। দিহান ছবি তুলতে লাগলো। ছবি তুলার কারণে একটু পিছনে পরে যায়। শাওন আর অরিন আগে এসে উঠে অরিনদের বাড়িতে। ওরা বাড়িতে ঢুকে গেছে দেখে দিহানও দৌঁড়ে এসে ঢুকে।

টিনের বেড়া দেওয়া চারপাশটা। টিনের একটা গেট। ভেতরে এসে দেখলো মাত্র ছয়সাতটা টিন সেটের ঘর। দুএক হাত পর পর একটা ঘর। এরকম বাড়ি দিহান এই প্রথমবার দেখছে। আর কখনো দেখেনি। ছোট বেলায় দেখলেও মনে নেই। শাওন একটা ঘরে ঢুকলো। দিহান গিয়ে ঢুকলো না। এভাবে হুট করে মানুষের বাড়িতে এসে কারো ঘরে ঢুকে যাওয়া নিতান্তই অভদ্র কাজ। একটা মেয়ে একটা ঘর থেকে বের হয়েছিলো, দিহানকে দেখে আবার ভিতরে ঢুকে যায়। দিহানের মনে হলো এভাবে গেটের ভিতরে আসা তাঁর উচিত হয়নি। সে চলে যেতে পা বাড়িয়ে আবার থেমে যায়। তাঁর চোখ সাদা শাড়ি পরিহিতা মেয়েকে খুঁজছে। আজ থেকে একমাস আগের সেই কালো রাতে যে মেয়েটার জীবনে ঝড় তুলে ছিলো সে। যন্ত্রণার ঝড়। দিহান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসলো। তাঁর অস্বস্তি লাগছে এভাবে অসভ্যদের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু বার বার ইচ্ছে করছে এই মেয়েটার বিষয়ে জানতে। আচ্ছা মেয়েটা কি খুব গরিব? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই দিহানের মনে অস্থিরতা কাজ করলো।

বৃদ্ধ মহিলাটাকে দেখে অষুধপত্র দিয়ে বেরিয়ে আসে শাওন। অরিন শাওনের পিছু পিছু বেরিয়ে আসে। শাওন অরিনকে বলল,”

,”রাস্তার বিষয়টা নিয়ে কিছু মনে করো না অরিন। ও এমনই, কখন কাকে কী বলতে হয় বুঝেনা। বুঝই তো শহরের ছেলে তাও দেশের বাইরে ছিলো এতোদিন। মাঝে মাঝে দেশে আসলেও শহরেই থেকে গেছে কখনো গ্রামে আসেনি। আমার মেজো মামার ছেলে। তোমার মনে আছে দিশা ইশি লুপার কথা? ওই যে তুমি একবার গিয়েছিলে আমাদের বাড়ি তোমার মা অসুস্থ ছিলো। তখন উঠুনে অনেক গুলা ছেলে মেয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছিলো,আর একজন পরে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছিলো। দিশা। ওটা তো ওরই বোন। আর জিহান ভাই মিহানকে তো চিনই। ওরা আগে খুব আসতো। দিহানও ছোট বেলায় আসতো এখানে। বড় হয়ে আর আসেনি। তাই হয়তো চিননা।”

অরিন শুধু ছোট করে অহ বলল। শাওন অরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। অরিন একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। শাওনের এভাবে তাকানো মাঝে মাঝে তাকে খুব ভাবায়। নিজেকে সামলে শাওনকে বলল,”
_মিহান ভাইয়া কী এখন আসেন না?
_চারমাস হবে স্ট্যাডির জন্য দেশের বাইরে চলে গেছে।
_অহ।
_আচ্ছা তাহলে আজ যাই। দাদীর খেয়াল রেখো।
_জ্বি।

শাওন চলে গেলো। গেটের কাছে গিয়ে আবার পিছন ফিরে থাকালো। প্রতিবার যাওয়ার সময় গেটের কাছে গিয়ে তাকাবে। এটা তাঁর অভ্যাস নাকি অন্যকিছু বুঝেনা অরিন। শাওন তাকিয়ে আছে কিনা দেখতে অরিন তাকালো। সত্যি সত্যি সে তাকিয়ে আছে। অরিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে চলে গেলো।
অরিনের চাচি সেলিনা বেগম এতোক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করছিলেন। শাওন চলে যেতেই বড় বড় পা ফেলে এসে অরিনের চুলের মুঠি ধরলেন। আকস্মিক ঘটনায় অরিনের কলিজা দ্রুত লাফাতে লাগে। আর্তনাদে আহহহ বলে উঠে সে। সেলিনা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে অরিনকে বলেন,”নষ্টা মেয়ে, আমার বাড়িতে কোনো ছেলে নিয়ে আসতে নিষেধ করেছি না? দুদিন পর পর এই ছেলেকে নিয়ে এসে আমার বাড়িতে ঢুকিস কেন? তোকে থাকতে দিয়েছি বলে তোর নাগরদের নিয়ে এসে আমার বাড়ি ঢুকবি?” অরিন নিজেকে ছাড়াতে ছটফট করছে। পাশের ঘর থেকে জহুরা বেগম দৌঁড়ে এসে সেলিনার থেকে অরিনকে ছাড়ান। সেলিনা আবার এসে অরিনের চুলে মুঠি ধরতে যাবেন, তখন জহুরা আটকিয়ে বলেন,

“আপা মাইরেন না আপা। দয়া কইরা মাইয়াটারে মাইরেন না।
_সর এখান থেকে দরদ দেখাতে আসবি না।
_আমি দরদ দেখাইতাছি না আপা। আপনে ঘরে যান। ও আর অমন করব না। আমি বুঝাইয়া কইমুনে।” সেলিনা বেগম রাগে বিরবির করে অরিনকে বকতে বকতে চলে গেলেন নিজের ঘরে। অরিন চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজের ঘরে পা বাড়ালো। জহুরা বেগমও গেলেন অরিনের পিছু পিছু। অরিন খাটে বসে কান্না করছে জহুরা বললেন,”এর লাইগাই কই। কারও উপকার করনের দরকার নাই। এই বুড়ি তো আমাগো কেউ না তাইলে এই বুড়ির লাইগা মরবি কেন? আমরা তাগো বাড়িতে থাকবার পারতেছি এইডাই অনেক।” কথাটা বলতে বলতে জহুরা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে যান। উনার রাগ হচ্ছে অরিনের উপর। নিজে এতো অসহায় তাহলে অন্যের জন্য ছুটে ছুটে কেন মরবে। নিজের ঘরে গিয়ে সেলাই মেসিনে সেলাই করতে বসলেন তিনি। হাতে টাকা নাই। ঘরে চাল ডাল নাই। কয়েকদিন ধরে অরিনের প্রাইভেটেরও ছাত্র ছাত্রী নাই। শীত নেমে এসেছে অরিনের একটা সোয়েটার নাই। ভালো একটা সোয়েটার ছিলো গত বছর একটা ভিক্ষুককে দিয়ে দিছে। নিজের নাই তাঁর মধ্যে আবার দান করতে যায়। শীত পরেছে থেকে গায়ে ওড়না পেচিয়ে থাকে। একটা মাত্র শাল যেটা জহুরা বেগমের গা থেকে খুলতেই দেয়না। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে অরিনের জুতাটাও ছিঁড়ে গেছে। একটা সোয়েটার আর একটা জুতা কিনতেও কিছু টাকার দরকার। কেউ যদি দেয় তাহলে সেটাও অরিন নিবেনা। বুক ছিঁড়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে মন দিলেন তিনি।

দিহান শাওন একটা পুকুরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পুকুরে মাছ চাষ করা হয়েছে। একটু পর পর মাছ লাফ দিয়ে উঠে দৃশ্যটা মনমুগ্ধকর। কিন্তু দিহানের ভালো লাগছে না। তার কেন জানি অরিনের বিষয়ে জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। বার বার অরিনকে নিয়ে প্রশ্নগুলো তার মাথায় জেঁকে বসছে। শাওনকে কীভাবে জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছে না। যদি শাওন অন্যকিছু ভাবে তাহলে? নিজের সব দ্বিধাবোধ পিছনে ছুঁড়ে শাওনকে প্রশ্ন ছুঁড়লো দিহান,

_আচ্ছা শাওন ওই মেয়েটার নাম কী?
_কোন মেয়েটা?
_ওই যে রাস্তায় একটা মেয়েকে ওটা বললাম বলে বকলি।
_ওর নাম অরিন।
_আচ্ছা মেয়েটা বিবাহিতা?” শাওন কপাল কুঁচকে তাকাল দিহানের দিকে। তারপর দিহানের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,”
_কী ব্যাপার বলতো?
_ইয়ার এতো নেগেটিভলি নিচ্ছিস কেন? আমি তো শাড়ি পড়া দেখে জানতে চাইলাম। আর কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটার মনে অনেক কষ্ট আছে।”শাওন একটা লম্বা দম ছেড়ে বলল,”
_জানিস দিহান? মানুষের জীবন কতটা কষ্টের হতে পারে সেটা ওর জীবন না দেখে বলতে পারতাম না। ছোট বেলায় ওর মা মারা যান। তারপর ওর বাবা বিয়ে করেন উনার ফুফুতো বোনকে। ওর সৎ মায়ের কোনো সন্তান হয়নি আর। অরিনকেও অনেক ভালোবাসেন তিনি। ওর এসএসসি দেওয়ার পরে আমাদের গ্রামে একটা মেলা হয়। সেই মেলাতে আমাদের পাশের গ্রামের একটা ছেলে অরিনকে দেখে পছন্দ করে। ছেলেটা বিদেশ থেকে এসেছিলো। পরিবারও ভালো। চাচাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান। বিয়ের যত টাকা খরচ লাগে সবকিছু ছেলে করে। চাচাদের টাকা খরচ করতে হয়নি। বিয়ের পরে ওর লেখাপড়া করাবে বলেও কথা দেয় ছেলে। ছেলেটা খুব ধুমধাম করে বিয়েটাও করে। বিয়ের দিন রাত আটটা থেকে ছেলেটার কোনো খুঁজ পাওয়া যায়না। ঘরের লোকজন বলে, কে নাকি কল করে ডেকেছিল। সে আসছি বলে চলে যায়। খুঁজতে খুঁজতে রাত তিনটায় আমাদের গ্রামে লাশ পাওয়া যায়। কেউ তাকে খুব নির্মম ভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছিলো। নাক ফুল খুলে নিতে হয় বাসর ঘরে বধু বেশে স্বামীর অপেক্ষায় বসে থাকা অরিনের। তারপর অরিনকে নিয়ে আসেন চাচা। অরিনের জন্য চিন্তা করতে করতে এক সময় চাচাও মারা যান। অরিন আরো অসহায় হয়ে পরে। ওর চাচি ওদের ঠকিয়ে সব সম্পত্তি নিয়ে নেন। এক বছর চলে যায় অরিন লেখাপড়া করেনি। হয়তো নিজেকে সামলাতে তাঁর এক বছর লেগেছিলো। তারপর হঠাৎ আবার লেখাপড়া স্টার্ট করে। আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান অরিনের লেখাপড়ার দ্বায়িত্ব নিতে চান। এমনকি আমি নিজেও বলেছি একবার। কিন্তু অরিন কারো কাছ থেকে সাহায্য নিতে অনিচ্ছুক। চাচি টেইলারি করে,অরিন গ্রামের বাচ্চাদের পড়ায়। এসবে কিছু টাকা পায় সেই টাকা দিয়েই ওর লেখাপড়া আর সংসার চলে।

চলবে,,,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here