ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব_১০

0
2217

ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_১০
#সুলতানা_সিমা

দিহানের ইচ্ছে করছে নীলকে গলা টিপে খুন করতে। এই ছেলেটা নাম্বার ওয়ান ফাজিল। এভাবে লাগামহীনের মত তাকে অরিনের সামনে লজ্জা দিল? দিহান চুপচাপ বসে থাকল। কিছুক্ষণ পরে লুপা বিদায় নিয়ে চলে গেল। লুপা যাওয়ার একটু পরেই নীল শাওন চলে গেল। দিহানকে যেতে বলছে সবাই কিন্তু দিহান “তোরা যা আমি আসছি” বলে বসে থাকল। বসে থাকা ছাড়া উপায় ছিলনা। অরিন তার পা অরিনের পা দিয়ে চেপে রাখছে। সবাই চলে যাওয়ার পরে দিহানের ভয় টা আরও বেড়ে গেল। আজ যে অরিন তার কি অবস্থা করে ছাড়বে সেটা একমাত্র আল্লাহই জানে। দিহান অরিনের দিকে তাকিয়ে দু’কয়েক শুকনো ঢোক গিলে গলা ভিজাতে চায়। কিন্তু তার গলা ভিজেনা গলা শুকিয়ে চৌকির হয়ে আছে। দিহান অরিনকে বলল ”

_বি বি বিশ্বাস করেন আ আ আমি আপনাকে অ অ অসভ্য বলিনাই আ আ আমি আমাকে অসভ্য বলছি।

অরিন কিছু বলল না। ব্যাগে হাত দিতে যাবে তার আগেই দিহান খপ করে অরিনের হাত ধরে ফেলল। অনুরোধের স্বরে বলল”
_আর জীবনে বেয়াদবি করব না প্লিজ মাফ করে দেন। আপনি যা শাস্তি দিবেন মেনে নিব প্লিজ এমনটা করবেন না প্লিজ।
অরিন ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা টেনে বলল”
_হাত ছাড়ুন। একটা দরকারি জিনিস বের করছি ফোন নয়।” দিহান হাত ছেড়ে দিল। কিন্তু তার ভয় এখনো কাটেনি মনে হচ্ছে এই বুঝি অরিন ফোন বের করে তার ছবিটা নেটে ছেড়ে দিবে। অরিন ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে দিহানকে বলল”
_ভালোই হল আপনার সাথে দেখা হয়ে। এই কাগজটায় একটা সাইন করুন।
_এ এ এটা কিকি কিসের কাগজ?
_আগে সাইন করুন তারপর বলছি।
দিহান চুপচাপ সাইন করে নিল। এক কথায় অরিনকে ভয় পেয়ে সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করেনি। দিহান একটু সাহস জুগিয়ে বললো”
_সাইন টা কেন নিলেন?
_জেনে যাবেন কোনো একদিন। বাই” বলেই অরিন উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেলো। দিহানের কাছে অরিন ধাঁধার মত কঠিন। বার বার সে বুঝতে চায় কিন্তু যত বুঝতে যায় ততই কঠিন হয়ে যায়। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসল সে।

বাসায় আসার পরে দেখল তার পরিবারের সবাই সোফাতে বসে টিভি দেখছে। দিহান উপরের দিকে পা বাড়ায় তখন তার কানে ইশি ও দিশার চাপা হাসির স্বর আসে। দিহান পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তার দিকে তাকিয়ে সবাই হাসছে। দিহান স্বাভাবিক স্বরে বলল”
_কিরে হাসছিস কেন তোরা?” দিহানের প্রশ্নে ইশি হাসি থামিয়ে বলে।
_না না হাসছি না তুই টয়লেট সেড়ে নিচে আয়। তর অপেক্ষায় আমরা বসে আছি। জরুরি একটা আলাপ আছে।” ইশির কথায় সবাই হেসে উঠে। দিহান রাগি লুকে লুপার দিকে তাকাল। লুপা তার চশমা ঠিক করে কাচুমাচু হয়ে তার বড় মায়ের হাত আঁকড়ে ধরল।
_ভাইয়া ওর দিকে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? ওর কি দুষ তুই যদি ওর বন্ধুদের সামনে ওকে লজ্জায় ফেলিস তাহলে ও কি করবে?[দিশা]
_ওই চুপ কর তোরা। এই কুপার বাচ্চা লুপা আমি তরে বলছিলাম যে আমি টয়লেট যাব? বাসায় এসে একদম ঢুল বাজিয়ে দিলি।
_আহা দিহান ওরা ফাজলামো করছে তুই সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন?[দিহানের মা]
_তুমি জাননা আম্মু তোমাদের এই একেকটা মেয়ে হচ্ছে বদের হাড্ডি। সবগুলাকে একদিনে বিয়ে দেওয়া উচিত।
_হ্যা হ্যা আমাদের বিদায় করে তুই শান্তি ভিল্লায় বসে শান্তি মতো হাগু কর।[ইশি]
ইশির কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠল। দিহান রাগে গিজগিজ করতে করতে উপরে চলে গেল। রুমে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে খাটে বসে পরল। তার মাথায় কিছুই আসছে না। কি করবে সে। এভাবে কি চুপ করে থাকাটা তার ঠিক হচ্ছে? এটা ছোট খাটো কোনো বিষয় নয়। কয়েকদিন পরে যখন তন্দ্রাকে বিয়ে করতে যাবে তখন যদি বিয়ের দিন এসে মেয়েটা কাবিননামা দেখিয়ে ঝামেলা করে? তখন পুরো মিডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পরবে পুলিশ অফিসার হানিফ চৌধুরীর ছেলের কর্মকান্ড দেখুন গোপনে বিয়ে করে তাকে রেখে এখন প্রেমিকাকে বিয়ে। এরকম হাজারও নিউজ বেরুবে। তাদের পরিবারের মান সম্মান ডুবানোর জন্য এর থেকে বেশি আর কি লাগে। তাদের শত্রু পক্ষের জন্য এটা যথেষ্ট খুশির খবর হবে। হঠাৎ করে একটা মেয়ে এভাবে বিয়ে করল অবশ্যই কোনো কারণ ছাড়া করেনি। এভাবে চুপ থেকে থেকে পরে যদি বিষয়টা বড়সড় বিপদ হয়ে দাঁড়ায় তখন? ভাবতেই বুকটা ভয়ে কেঁপে ওঠে দিহানের। শাওন আর নীলকে সব কিছু জানাতে হবে। অবশ্য শাওনকে একবার বলেছে। এখন আবার বলতে হবে। ওরা যদি কোনো সলিউশন দিতে পারে। দিহান নীলকে আর শাওন কে ফোন দিয়ে বাসায় ডাকল। এভাবে আর চলা যাবেনা এর একটা বিহিত করা দরকার।

_________________

সৎ মা শব্দটা ছোট হলেও তার অবহেলা,অত্যাচার গুলা ছোট নয়। গর্ভধারীনি মায়ের মত কি আর সবাই হতে পারে? কখনোই পারেনা। প্রতিদিন কলেজ শেষে টিউশনিতে যায়। সন্ধ্যা হলে ক্লান্ত শরির নিয়ে বাসায় ফিরে। তবুও তার বিশ্রাম নেই। এসে রাতের জন্য রান্না করে একটু সময় পড়তে বসে। সামনে তার এইচএসসি এক্সাম। লেখাপড়ার প্রচুর চাপ। এদিকে টিউশনি না করলে তার হাতে টাকা আসবে না। টাকা না আসলে সে পরিক্ষার ফি দিবে কেমনে? কাল তিন হাজার টাকা পেয়ে দিহানকে দু’হাজার দিয়ে দিল। বাকি এক হাজার উকিলকে দিয়ে কাগজ লেখাল। এখন হাতে একটা টাকাও নাই। আরেক মাস না হলে টাকা হাতে আসবে না। রুমে ঢুকে ক্লান্ত শরিরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। দিন দিন শরির দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থতা ঝেকে বসেছে। ডাক্তার দেখানো উচিত। কিন্তু টাকা? ডাক্তার না হয় অন্য সময় দেখাবে। আপাতত কিছু টাকা টাকা দরকার পরিক্ষার ফি দিতে হবে। আজ টেউশনিতে যায়নি তার এক’শ টাকা কেটে যাবে বেতন থেকে। কলেজ থেকে বেরিয়ে লুপার সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। ওখানে দিহানের সাথে দেখা হল। দিহান নামক মানুষটার জন্য খুব খারাপ লাগছে তার। বার বার মনে হচ্ছে উনার সাথে এমন করা ঠিক হচ্ছে না। তাই আর মন চায়নি টিউশনিতে যেতে।

অরিন শুয়া থেকে উঠে বুক ছিড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জহুরা বেগমের রুমে যায়। আজ কয়েকদিন ধরে উনি তার সাথে ভালো ভাবে কথা বলছেন না। সেদিন লুপাদের বাসা থেকে ফিরতে রাত ১টা বেজে গেছিল। রাত করে আসায় অনেক কথা শুনিয়েছেন তাকে। তার গায়ে নতুন ড্রেস দেখে আরও বেশি কথা শুনান। এক সময় অরিন রেগে যায় আর উনার সাথে তর্ক ধরে। ব্যস হয়ে গেল উনার মারামারি শুরু।

একজন মহিলার সাথে কথা বলছিলেন জহুরা বেগম অরিনের উপস্থিতি তে দুজনই কেঁপে ওঠেন। অরিনের বুঝতে দেরি হয়নি তাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল।
রুমে ঢুকে মাথা নিচু করে জহুরা সামনে দাঁড়িয়ে বলে।
_মা কিছু কথা ছিল।
_কি কথা?(কপাল কুঁচকে) “অরিন জহুরার পাশে বসে থাকা মহিলার দিকে তাকাল। তারপর বলল ” একটু বাইরে আস।” জহুরা গম্ভীর গলায় বললেন “যা বলার এখানে বল। আমি কোথাও যেতে পারব না।” অরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল ”
_আমার কিছু টাকা লাগবে মা।
_কেন টাকা দিয়ে তুই কি করবি টিউশনি যে করছ একটা টাকা সংসারে লাগাছ? (পাশের মহিলার দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা আপনি বলেন আপা। আমার তিনটা বাচ্চা আছে। জামাই নাই। এগুলারে আমি কেমনে চালাব? এই সংসার সব কিছু আমি কেমনে চালাব? আমার যে বড় মেয়েটা আছে থাকে ত আমি একটা টাকাও দেইনা সে তার টাকায় চলে। তাহলে একে দিতে হবে কেন সে নিজে চলতে পারেনা? এই যে খাচ্ছে দাচ্ছে এসব কেমনে কি আনা হচ্ছে এই হিসাবটা কি মেয়েটা রাখে? এই তিন বছর ধরে যে টাকা কামাই করে একটা টাকা আমার হাতে দিয়ে বলছে যে এই নাও এটা সংসারে লাগাও? বুঝলেন আপা সবই আমার কপাল।”

অরিনের আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হলনা। চলে আসল ওখান থেকে। রুমে এসে দরজা বেজিয়ে দরজায় পিঠ ঠেকে কাঁদতে লাগল। একটা কথার বদলে এতগুলা কথা শুনিয়ে দিলেন? নিজের মায়ের কাছে আবদার করলে কি তিনি এমন করতেন? চোখের পানিটা মুছে নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়াল অরিন। আলমারি থেকে এক জুড়া স্বর্নের দুল বের করল। সেদিন বিক্রি করতে গেছিল। ২০হাজার দাম বলেছে। দামে তার হয়নি তাই আর বিক্রি করেনি। আজ মনে হচ্ছে এটা বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। শেষমেষ তার মায়ের শেষ স্মৃতিটাও ধরে রাখতে পারবে না। দুল জোড়া বুকে জড়িয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে অরিন। এটাতে তার মায়ের গন্ধ লেগে আছে কিন্তু এটা ধরে রাখার শক্তি তার নেই। ফোনের রিংটোন শুনে চোখের পানিটা মুছে দুল জোড়া জায়গা মতো রেখে এসে ফোন তুলল ”

_আসসালামু আলাইকুম আপু। কেমন আছিস?[ভেজা গলায়]
_ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই?
_আমি? আমিও খুব ভালো আছি আপু।(কিঞ্চিৎ কাপা গলায়)
_তোর গলা এমন শুনাচ্ছে কেন রে অরি? তুই সত্যি ভালো আছিস তো?
_হ্যা রে আপু আমি খুউউউউব আছি। অনেক বেশি ভালো। (কেঁদে কেঁদে)
_অরি কাঁদছিস কেন? ওই মহিলা তোকে আবার মারছে?
_আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই কেন রে আপু? কেন আমি এত নিঃস্ব? এই বিশাল পৃথিবীতে আমার একটা আশ্রয়স্থল নাই কেন বলবি?” বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে অরিন।
_কাঁদবিনা একদম কাঁদবি না। কে বলেছে তর কেউ নাই? আমি আছি তো।
_তুই তো আমার থেকেও অসহায় রে আপু।
_না রে ভালই আছি আমি। এবার বল কি খবর ওইটার? (কান্নাজড়িত কণ্ঠে)
_আপু একটা ভুল করে ফেলছি রে।
_কি করছিস?
_ওই লোকটা লুপার কাজিন।
_কিইইইইই? লু লুপার কাজিন মানে? আমাকে আগে বলিসনি কেন?
_হ্যা রে আপু আমি আগে জানতাম না। লুপার বার্থডে তে গিয়ে জানছি। তোকে ফোন দিতে চাইছিলাম আমার ব্যালেন্স ছিলনা। তুইও ফোন দিসনি এই কয়দিন তাই আর বলা হয়নি তোকে।
_একটা বিপদ থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেকটা বিপদ ডেকে আনলাম?
_জানিস আপু উনি আমার সাথে খুব খারাপ বিহেভ করেন। আমার খুব খারাপ লাগে। কিন্তু কিছু বলতে পারিনা।
_কেন বলবি না ও তোর সাথে খারাপ বিহেভ করবে কেন? তুই চুপ থাকবি কেন তুই প্রতিবাদ করবি।
_দুষ তো আমার আপু আমিই তো উনার জীবনে গেছি। আমার তো বুঝতে হবে উনার সাথে যা হয়েছে সেটা উনি মেনে নিতে পারছেন না তাই উনি এমন করছেন। উনার সব রাগ ঝাড়ছেন। কিন্তু মন কে বুঝাতে পারিনা আপু কষ্ট হয়। তবে জানিস আপু আমি মুখে কিছু বলিনা ঠিক আছে কিন্তু আমি শাস্তি দিয়ে বদলা নেই।
_ওমা কিভাবে?
অরিন চোখের পানিটা মুছে একে একে সব কিছু বলল। সব শুনে ফোনের ওপাশের জন বলল”
_তোর এসব ঠিক হচ্ছেনা অরি। আর ওর টাকা এভাবে খরচ করানো এটা মোটেও ঠিক হয়নি অরি।
_একদম উচিত হয়েছে। আরও হবে। আমাকে এত এত কথা বলার শাস্তি আমি এভাবেই দিব।
_আমি তোকে পাচঁ হাজার টাকা দিয়ে দিব তুই তার টাকা টা ফিরিয়ে দিবি।
_মোটেও না। আমি শুধু দু’হাজার টাকা ধার নিছিলাম সেটা ফিরিয়ে দিছি। আর তুই কেন আমাকে টাকা দিবি? নিজেই চলছিস টানাহেঁচড়া করে আবার আমায় দিবি। আমার কাছে যেটা পায় সেটা দিয়ে দিছি। আর ওই পাঁচ হাজার দিয়ে তো উনি দান করছে। আমারে তো দেয়নাই। উনি তো খুব বড়লোক মানুষ। অনেক বড় বড় কথা বলে। তাই উনাকে বুঝিয়ে দিলাম। কাউকে কিছু দিলে নিজের সামর্থ বুঝে দিতে হয়।
_ভালো করছিস।
_হুম। আপু আমার খারাপ লাগছে উনার জন্য।
_মাঝে মাঝে নিজের কথাটাও ভাবা উচিত অরি। ভুলে যাবিনা সেদিনের কথা।
_হুম।
_ভাল থাকিস পরে কথা হবে।
_হুম।

চলবে…..।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here